কাদের হাতে বন্দি আজ গণতন্ত্র! by এ কে এম শাহনাওয়াজ
গত তিন যুগে আমাদের দেশের রাজনীতি শুধু এর গৌরবময় ঐতিহ্যই হারায়নি, মেধাবী সংস্কৃতিবান নেতৃত্বও হারিয়েছে। রাজনৈতিক সাধুতা, গণতন্ত্র চর্চা, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর প্রতি সম্ভ্রমবোধ, রুচিশীল শব্দচয়ন- এসব হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাজনীতি থেকে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিবোধহীন একটি ঝগড়াটে নিম্নমানের রাজনীতি আমাদের গ্রাস করছে। বড় দুই প্রতিপক্ষ বিএনপি আর আওয়ামী লীগের বড় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জনগণের দৃষ্টিসীমা থেকে অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন প্রতিযোগিতা চলছে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে কত বেশি কষে গালাগাল দেওয়া যায় সেদিকে। যেন নেতা-নেত্রীদের ধারণা, উলঙ্গ গালাগাল বাড়াতে পারলে জনগণের সামনে তাঁদের মর্যাদা ও শক্তির প্রকাশ স্পষ্ট হবে।
আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ আর বিএনপিরই প্রায় পর্যায়ক্রমিক আবর্তন হয়। তাই দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মহান দায়িত্ব এ দুই দলের ওপর সবচেয়ে বেশি বর্তায়। রাজনীতিকে অস্বীকার করে রাষ্ট্র এগোতে পারে না। তাই আমরা প্রতিদিন কামনা করি, কোনো এক অলৌকিক মন্ত্রবলে আমাদের নেতা-নেত্রীদের মননে, মেধায়, কণ্ঠে, ঠোঁটে পরিমার্জনা আসুক। নেতা-নেত্রীরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালে যাতে আমাদের আর বিধাতার নাম জপ করতে না হয়।
'চোর' শব্দটি এখন রাজনৈতিক বক্তৃতায় খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি- এ দুই দলের নেতা-নেত্রীরা যখন ভাষণ দেন, তখন মনে হয় না দুই দল পরস্পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। মনে হয়, উভয়ই পরস্পরের জানের দুশমন। কোনো বিতার্কিকের মেধায় বা শব্দচয়নে নয়, নিম্নমানের ঝগড়াটে শব্দে চারপাশ উজালা হয়। কার আমলে কত অন্যায় আর দুর্নীতি হয়েছে আর নিজেরা কতটা উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন- এ ভাঙা রেকর্ড ক্লান্তিহীনভাবে বাজতেই থাকে। এক দল-সমর্থক কর্মীকে একবার বলেছিলাম, একই কথা এতবার বলায় সাধারণ মানুষের মনে এগুলো আর রেখাপাত করে না, সবাই বিরক্ত হয়। নেতা-নেত্রীরা কি তা বোঝেন না? তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, নেতা-নেত্রীরা অসংকোচে এসব বলেন সাধারণ জনগণের জন্য নয়, দলের কর্মীদের চাঙ্গা করতে। শুনে আমার মনে হলো- আহা, আজ যদি কোনো দলের কর্মী হতে পারতাম তাহলে বলতে পারতাম, কর্মীরা এতটা যান্ত্রিক হয়ে যায় কি না। তবে সবাই না হলেও অনেকেই হয় বলে আমার ধারণা। আমরা কলাম লেখকরা কিছুটা টের পাই। যত যৌক্তিকই হোক, কোনো লেখায় বিএনপির সমালোচনা বেশি হলে ই-মেইলে বিএনপি সমর্থকদের দু-চারজনের বকাঝকা শুনতে হয়। আবার আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচিত হলে লীগ সমর্থিত দু-একজন পাঠক সিদ্ধান্তে আসেন, আমি বিএনপি সমর্থক। সে অনুযায়ী আমার যা প্রাপ্য তাঁরা তা দিতে কসুর করেন না। আমার ধারণা, নেতা-নেত্রীরা এসব জানেন বলেই চোখ-কান বন্ধ করে এদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে।
আমার যদি ভুল না হয় তাহলে বলব, 'চোর' শব্দটি রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করে আওয়ামী লীগ। মাগুরা এবং বিএনপি আমলের অনেক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সেই থেকে বিএনপিকে বলা হতে থাকে 'ভোট চোর'। আমি ভাবতাম, বিএনপির পাপকে কিছুটা ক্ষমাসুন্দর চোখে বোধ হয় দেখা হচ্ছে। 'ভোট ডাকাতি' না বলে 'ভোট চোর' বলা হচ্ছে। ডাকাত তো সদর্পে এসে সিনা টান করে সিন্দুক ভেঙে সব কিছু নিয়ে যায়। চোর আসে লুকিয়ে-চুরিয়ে। তাই ছিনতাইয়ের আভিজাত্যে কিছুটা দুর্বল। এ কারণে মনে হয়েছে, চোর বলে গালাগাল দেওয়ার ভেতর বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগের মৃদু প্রশ্রয় রয়েছে। কিন্তু উভয় দলের মধ্যে প্রতিদিনের ঝগড়া দেখে মনে হয়েছে, ডাকাত বলে প্রতিপক্ষের আভিজাত্য বাড়াতে চাননি নেতা-নেত্রীরা। চোর বলার মধ্যে একটি তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। আর তা প্রকাশ করতে গিয়ে সম্ভবত বিএনপির দিকে ছুড়ে দিতে 'ভোট চোর' শব্দটি বেছে নিয়েছেন তাঁরা। একসময় মনে হতো, এ শব্দযুগল আওয়ামী লীগের একান্তই মনোপলি। কয়েক বছর প্রায় এককভাবে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। একপর্যায়ে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে 'চোরের মায়ের বড় গলা' প্রবাদও বর্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে একাধিকবার। এভাবে এ দেশের এক বড় রাজনৈতিক দল অন্য বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের 'চোর' বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। সম্প্র্রতি 'চোর' শব্দটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বিএনপি নেতা-নেত্রীরা। খালেদা জিয়া কয়েকটি অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রীদের 'চোর' ও 'মহাচোর' বলে আখ্যায়িত করেছেন। সর্বশেষ বিএনপির আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সরকারের সবাইকে খালেদা জিয়া দুর্নীতিবাজ ও চোর বলেছেন। তাহলে ফলাফল যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা বড় দুই দলই পরস্পরকে চোর বলে চিহ্নিত করেছে। আর আমরা অসহায় মানুষরা নত মস্তকে মানতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতারা সবাই চৌর্যবৃত্তের সঙ্গে জড়িত। দুর্ভাগ্য এই- বস্তুগত চুরির সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রও চুরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দুই সহকর্মীকে বলেছিলাম, রাজনৈতিক ঝগড়ারও তো একটি সংস্কৃতি রয়েছে। অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে তির্যক শব্দে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এর বদলে এত স্থূল-অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করা কেন? আপনাদের নেত্রীদের এ ভুলগুলো কি কেউ ধরিয়ে দিতে পারেন না? এসব অসংস্কৃত শব্দচয়ন সাধারণ মানুষ যে ভালোভাবে নিচ্ছে না, অন্তত এ কথাটিও তো বলা যায়! উত্তরে উভয়ই প্রায় অভিন্নভাবে জানালেন, যাঁরা নেত্রীদের খুব কাছে যাওয়া-আসা করেন তাঁদের কারোরই এতটা সাহস থাকে না। পাছে নেত্রী বিরক্ত হন এই ভয়েই কম্পমান থাকেন। তাই নেত্রীদের বরং উৎসাহিত করা হয়।
এসব দেখে গণতন্ত্রহীন রাজনীতিতে নেতা-নেত্রীদের স্থূল শব্দচয়ন আমাদের লজ্জিত করে। আমরা এ থেকে মুক্তি পেতে চাই। আমরা দেখতে চাই, আমাদের নেতা-নেত্রীরা রাজনৈতিক মেধায় যেমন চৌকস, তেমনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণও করতে পারেন বিতার্কিকের মার্জিত শব্দচয়নে। তাই অসহায় আমরা- যাদের হারানোর কিছু নেই, যারা গণতান্ত্রিক ও মার্জিত পরিবেশ পাওয়ার জন্য সব সময় ছটফট করি তারা নেতা-নেত্রীরা ক্ষুব্ধ হবেন জেনেও সমালোচনা করাটা দায়িত্ব মনে করি।
আমাদের দুঃখ হয়, যখন প্রধানমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী খালেদা জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করেন। 'খালেদা ভারত গিয়েছিলেন তেল মারতে' ধরনের শব্দ চয়ন করেন। বোঝা উচিত, যা চায়ের টেবিলের ঘরোয়া আড্ডায় বলা যায়, তা জনসভায় দাঁড়িয়ে বলা যায় না। আমাদের ধারণা, জননেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে এক ধরনের সরলতা রয়েছে। তাই মনের কথা বেফাঁস হলেও বলে ফেলেন। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেন না। তবুও মানতে হবে, তিনি সরকারপ্রধান। একটি বড় দলের প্রধান পরিচালক। একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাণ্ডারি। জনসম্মুুখে, মিডিয়ার সামনে তিনি যা বলবেন তা অনেক বেশি হিসেবি হওয়া প্রয়োজন। সরলতা সব ক্ষেত্রে নন্দিত নয়, নিন্দিতও হয়। তুলনায় আগে অনেক বেশি বাকসংযম ছিল খালেদা জিয়ার মধ্যে। এদিক থেকে জনগণের রেটিংয়ে তিনি কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। এখন দুই দলের নেতা-নেত্রীদের পরস্পরের প্রতিটি বিষয়ে 'দাঁতভাঙা' জবাব দেওয়ার প্রবণতা খালেদা জিয়াকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনিও বেফাঁস শব্দচয়নের দিকে এগোচ্ছেন। আমাদের মনে হয়, সব পক্ষের রাশ এখনই টানা প্রয়োজন।
১৯৯৬-এর শাসনকালেও অনেক বেফাঁস কথা বলে শেখ হাসিনা সমালোচিত হয়েছিলেন। শেষদিকে মনে হয়েছিল নিজেকে অনেকটা শুধরে নিয়েছিলেন তিনি। এবারের সরকারে প্রথম তিন বছর অনেকটা নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। আমরাও অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। চার বছরের গোড়া থেকে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে আচ্ছা করে বকে দেওয়ার ইচ্ছা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই আবারও বেফাঁস শব্দের ছড়াছড়ি বাড়তে থাকে। একই রোগের সংক্রমণ বিএনপি নেতাদের মধ্যেও স্পষ্ট হয়।
কিন্তু সৌরজগতের মহাজাগতিক সংঘর্ষের এ বাংলাদেশি সংস্করণে আমরা শঙ্কিত হই। শঙ্কা এ জন্য যে এই এপিসোড তো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারব না। কলঙ্কতিলক বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্মকে। এসব ঝগড়ার সঙ্গে গণতান্ত্রিক বোধহীনতা কাজ করে। কারণ গণতন্ত্র পরস্পরের মতের প্রতি সম্মান জানানো এবং সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। নেতা-নেত্রীদের আচরণে মনে হয়, তাঁরা গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। মানুষের সাধারণ প্রবণতা বোধ হয় মন্দ জিনিস থেকে দ্রুত প্রভাবিত হওয়া। প্রায় চার দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমি যুক্ত। দেখেছি ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আগে যতটা পারস্পরিক সহনশীলতা কাজ করত, এখন তা অনেকটা ভেঙে পড়ছে। বলনে-বচনে-আচরণে এরা যার যার নেতা-নেত্রীদের অনুসরণ করতে পছন্দ করছে। অপরাধবিজ্ঞানীরা বলবেন, দলীয় সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে এর ভূমিকা কতটুকু।
এসব বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ববান নেতা-নেত্রীদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে কি পারি না, আপনারা অন্তত ঘরোয়া আড্ডা ছাড়া এ দেশের সাধারণ মানুষকে লজ্জিত করে বা কষ্ট দেয় এমন শব্দচয়ন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে ভারমুক্ত করুন। কারণ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেকেই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আপনাদের অনুসরণ করে। এরা আলোকিত হোক- এটা নিশ্চয়ই আপনারাও চাইবেন। আর গণতন্ত্র প্রত্যাশী মানুষও নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পাক, এ তো সচেতন সবারই চাওয়া।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ আর বিএনপিরই প্রায় পর্যায়ক্রমিক আবর্তন হয়। তাই দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মহান দায়িত্ব এ দুই দলের ওপর সবচেয়ে বেশি বর্তায়। রাজনীতিকে অস্বীকার করে রাষ্ট্র এগোতে পারে না। তাই আমরা প্রতিদিন কামনা করি, কোনো এক অলৌকিক মন্ত্রবলে আমাদের নেতা-নেত্রীদের মননে, মেধায়, কণ্ঠে, ঠোঁটে পরিমার্জনা আসুক। নেতা-নেত্রীরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালে যাতে আমাদের আর বিধাতার নাম জপ করতে না হয়।
'চোর' শব্দটি এখন রাজনৈতিক বক্তৃতায় খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি- এ দুই দলের নেতা-নেত্রীরা যখন ভাষণ দেন, তখন মনে হয় না দুই দল পরস্পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। মনে হয়, উভয়ই পরস্পরের জানের দুশমন। কোনো বিতার্কিকের মেধায় বা শব্দচয়নে নয়, নিম্নমানের ঝগড়াটে শব্দে চারপাশ উজালা হয়। কার আমলে কত অন্যায় আর দুর্নীতি হয়েছে আর নিজেরা কতটা উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন- এ ভাঙা রেকর্ড ক্লান্তিহীনভাবে বাজতেই থাকে। এক দল-সমর্থক কর্মীকে একবার বলেছিলাম, একই কথা এতবার বলায় সাধারণ মানুষের মনে এগুলো আর রেখাপাত করে না, সবাই বিরক্ত হয়। নেতা-নেত্রীরা কি তা বোঝেন না? তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, নেতা-নেত্রীরা অসংকোচে এসব বলেন সাধারণ জনগণের জন্য নয়, দলের কর্মীদের চাঙ্গা করতে। শুনে আমার মনে হলো- আহা, আজ যদি কোনো দলের কর্মী হতে পারতাম তাহলে বলতে পারতাম, কর্মীরা এতটা যান্ত্রিক হয়ে যায় কি না। তবে সবাই না হলেও অনেকেই হয় বলে আমার ধারণা। আমরা কলাম লেখকরা কিছুটা টের পাই। যত যৌক্তিকই হোক, কোনো লেখায় বিএনপির সমালোচনা বেশি হলে ই-মেইলে বিএনপি সমর্থকদের দু-চারজনের বকাঝকা শুনতে হয়। আবার আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচিত হলে লীগ সমর্থিত দু-একজন পাঠক সিদ্ধান্তে আসেন, আমি বিএনপি সমর্থক। সে অনুযায়ী আমার যা প্রাপ্য তাঁরা তা দিতে কসুর করেন না। আমার ধারণা, নেতা-নেত্রীরা এসব জানেন বলেই চোখ-কান বন্ধ করে এদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে।
আমার যদি ভুল না হয় তাহলে বলব, 'চোর' শব্দটি রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু করে আওয়ামী লীগ। মাগুরা এবং বিএনপি আমলের অনেক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সেই থেকে বিএনপিকে বলা হতে থাকে 'ভোট চোর'। আমি ভাবতাম, বিএনপির পাপকে কিছুটা ক্ষমাসুন্দর চোখে বোধ হয় দেখা হচ্ছে। 'ভোট ডাকাতি' না বলে 'ভোট চোর' বলা হচ্ছে। ডাকাত তো সদর্পে এসে সিনা টান করে সিন্দুক ভেঙে সব কিছু নিয়ে যায়। চোর আসে লুকিয়ে-চুরিয়ে। তাই ছিনতাইয়ের আভিজাত্যে কিছুটা দুর্বল। এ কারণে মনে হয়েছে, চোর বলে গালাগাল দেওয়ার ভেতর বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগের মৃদু প্রশ্রয় রয়েছে। কিন্তু উভয় দলের মধ্যে প্রতিদিনের ঝগড়া দেখে মনে হয়েছে, ডাকাত বলে প্রতিপক্ষের আভিজাত্য বাড়াতে চাননি নেতা-নেত্রীরা। চোর বলার মধ্যে একটি তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। আর তা প্রকাশ করতে গিয়ে সম্ভবত বিএনপির দিকে ছুড়ে দিতে 'ভোট চোর' শব্দটি বেছে নিয়েছেন তাঁরা। একসময় মনে হতো, এ শব্দযুগল আওয়ামী লীগের একান্তই মনোপলি। কয়েক বছর প্রায় এককভাবে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। একপর্যায়ে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে 'চোরের মায়ের বড় গলা' প্রবাদও বর্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে একাধিকবার। এভাবে এ দেশের এক বড় রাজনৈতিক দল অন্য বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের 'চোর' বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। সম্প্র্রতি 'চোর' শব্দটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বিএনপি নেতা-নেত্রীরা। খালেদা জিয়া কয়েকটি অনুষ্ঠানে সরকারের মন্ত্রীদের 'চোর' ও 'মহাচোর' বলে আখ্যায়িত করেছেন। সর্বশেষ বিএনপির আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সরকারের সবাইকে খালেদা জিয়া দুর্নীতিবাজ ও চোর বলেছেন। তাহলে ফলাফল যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা বড় দুই দলই পরস্পরকে চোর বলে চিহ্নিত করেছে। আর আমরা অসহায় মানুষরা নত মস্তকে মানতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতারা সবাই চৌর্যবৃত্তের সঙ্গে জড়িত। দুর্ভাগ্য এই- বস্তুগত চুরির সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রও চুরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দুই সহকর্মীকে বলেছিলাম, রাজনৈতিক ঝগড়ারও তো একটি সংস্কৃতি রয়েছে। অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে তির্যক শব্দে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এর বদলে এত স্থূল-অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করা কেন? আপনাদের নেত্রীদের এ ভুলগুলো কি কেউ ধরিয়ে দিতে পারেন না? এসব অসংস্কৃত শব্দচয়ন সাধারণ মানুষ যে ভালোভাবে নিচ্ছে না, অন্তত এ কথাটিও তো বলা যায়! উত্তরে উভয়ই প্রায় অভিন্নভাবে জানালেন, যাঁরা নেত্রীদের খুব কাছে যাওয়া-আসা করেন তাঁদের কারোরই এতটা সাহস থাকে না। পাছে নেত্রী বিরক্ত হন এই ভয়েই কম্পমান থাকেন। তাই নেত্রীদের বরং উৎসাহিত করা হয়।
এসব দেখে গণতন্ত্রহীন রাজনীতিতে নেতা-নেত্রীদের স্থূল শব্দচয়ন আমাদের লজ্জিত করে। আমরা এ থেকে মুক্তি পেতে চাই। আমরা দেখতে চাই, আমাদের নেতা-নেত্রীরা রাজনৈতিক মেধায় যেমন চৌকস, তেমনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণও করতে পারেন বিতার্কিকের মার্জিত শব্দচয়নে। তাই অসহায় আমরা- যাদের হারানোর কিছু নেই, যারা গণতান্ত্রিক ও মার্জিত পরিবেশ পাওয়ার জন্য সব সময় ছটফট করি তারা নেতা-নেত্রীরা ক্ষুব্ধ হবেন জেনেও সমালোচনা করাটা দায়িত্ব মনে করি।
আমাদের দুঃখ হয়, যখন প্রধানমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী খালেদা জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করেন। 'খালেদা ভারত গিয়েছিলেন তেল মারতে' ধরনের শব্দ চয়ন করেন। বোঝা উচিত, যা চায়ের টেবিলের ঘরোয়া আড্ডায় বলা যায়, তা জনসভায় দাঁড়িয়ে বলা যায় না। আমাদের ধারণা, জননেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে এক ধরনের সরলতা রয়েছে। তাই মনের কথা বেফাঁস হলেও বলে ফেলেন। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেন না। তবুও মানতে হবে, তিনি সরকারপ্রধান। একটি বড় দলের প্রধান পরিচালক। একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাণ্ডারি। জনসম্মুুখে, মিডিয়ার সামনে তিনি যা বলবেন তা অনেক বেশি হিসেবি হওয়া প্রয়োজন। সরলতা সব ক্ষেত্রে নন্দিত নয়, নিন্দিতও হয়। তুলনায় আগে অনেক বেশি বাকসংযম ছিল খালেদা জিয়ার মধ্যে। এদিক থেকে জনগণের রেটিংয়ে তিনি কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। এখন দুই দলের নেতা-নেত্রীদের পরস্পরের প্রতিটি বিষয়ে 'দাঁতভাঙা' জবাব দেওয়ার প্রবণতা খালেদা জিয়াকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনিও বেফাঁস শব্দচয়নের দিকে এগোচ্ছেন। আমাদের মনে হয়, সব পক্ষের রাশ এখনই টানা প্রয়োজন।
১৯৯৬-এর শাসনকালেও অনেক বেফাঁস কথা বলে শেখ হাসিনা সমালোচিত হয়েছিলেন। শেষদিকে মনে হয়েছিল নিজেকে অনেকটা শুধরে নিয়েছিলেন তিনি। এবারের সরকারে প্রথম তিন বছর অনেকটা নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। আমরাও অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। চার বছরের গোড়া থেকে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে আচ্ছা করে বকে দেওয়ার ইচ্ছা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই আবারও বেফাঁস শব্দের ছড়াছড়ি বাড়তে থাকে। একই রোগের সংক্রমণ বিএনপি নেতাদের মধ্যেও স্পষ্ট হয়।
কিন্তু সৌরজগতের মহাজাগতিক সংঘর্ষের এ বাংলাদেশি সংস্করণে আমরা শঙ্কিত হই। শঙ্কা এ জন্য যে এই এপিসোড তো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারব না। কলঙ্কতিলক বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্মকে। এসব ঝগড়ার সঙ্গে গণতান্ত্রিক বোধহীনতা কাজ করে। কারণ গণতন্ত্র পরস্পরের মতের প্রতি সম্মান জানানো এবং সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। নেতা-নেত্রীদের আচরণে মনে হয়, তাঁরা গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। মানুষের সাধারণ প্রবণতা বোধ হয় মন্দ জিনিস থেকে দ্রুত প্রভাবিত হওয়া। প্রায় চার দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমি যুক্ত। দেখেছি ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আগে যতটা পারস্পরিক সহনশীলতা কাজ করত, এখন তা অনেকটা ভেঙে পড়ছে। বলনে-বচনে-আচরণে এরা যার যার নেতা-নেত্রীদের অনুসরণ করতে পছন্দ করছে। অপরাধবিজ্ঞানীরা বলবেন, দলীয় সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে এর ভূমিকা কতটুকু।
এসব বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ববান নেতা-নেত্রীদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে কি পারি না, আপনারা অন্তত ঘরোয়া আড্ডা ছাড়া এ দেশের সাধারণ মানুষকে লজ্জিত করে বা কষ্ট দেয় এমন শব্দচয়ন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে ভারমুক্ত করুন। কারণ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেকেই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আপনাদের অনুসরণ করে। এরা আলোকিত হোক- এটা নিশ্চয়ই আপনারাও চাইবেন। আর গণতন্ত্র প্রত্যাশী মানুষও নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পাক, এ তো সচেতন সবারই চাওয়া।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments