গল্পের তারামাছ আর স্বপ্ন দেখা by তানজিনা হক

আসছে ২০১৩ সাল, চারদিকে নতুন বছরের আগমনী বারতা আকাশে-বাতাসে। এই দিনগুলো এলেই খুব মনে পড়ে যায় স্কুলে পড়াকালীন কথা। নতুন ক্লাসে নতুন বই বারবার নাকের কাছে নিয়ে সুগন্ধ অনুভব করতাম। ভাবতাম, আগামী বছরে নতুন নতুন কী করা যায়।
বেলায় বেলায় অনেক দূর সময় গড়িয়ে গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার বয়সও বেড়েছে, তবু এমনটি কি হওয়ার কথা ছিল! আজ আশপাশে শুধুই হাহাকার, বন্ধু-স্বজনের চোখে ভেসে ওঠে স্বপ্নহীন দিনের অপেক্ষা, দু'চোখের গহ্বরে দেখি শুধুই শূন্যতা । ভাবতে একটু ভালো লাগে না। আজ এই প্রসঙ্গে ঔধপশ ঈধহভরবষফ ধহফ গধৎশ ঠ. ঐধহংবহ লেখা ছোট একটা ইংরেজি গল্প মনে পড়ে গেল।
সন্ধ্যা প্রায় প্রায়, এক ভদ্রলোক মেক্সিকান সমুদ্রসৈকত ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, দূরে স্থানীয় এক ভদ্রলোক নিচু হয়ে কিছু তুলছেন আবার সঙ্গে সঙ্গেই তা সমুদ্রে ছুড়ে ফেলছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, ওই স্থানীয় ভদ্রলোকটি সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে আসা তারামাছগুলোকে আবার সমুদ্রের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে প্রথম ভদ্রলোকটি বিরক্তই বোধ করলেন। তিনি স্থানীয় ভদ্রলোকটির কাছে গেলেন এবং বললেন, 'শুভ সন্ধ্যা বন্ধু, আমি অবাক হচ্ছি আপনি এসব কী করছেন?' জবাবে স্থানীয় ভদ্রলোকটি বললেন, 'আমি তারামাছগুলোকে আবার সমুদ্রে ফিরিয়ে দিচ্ছি। লক্ষ্য করুন এখন ভাটার সময়, তারামাছগুলো সৈকতে ভেসে আসছে; কিন্তু ফিরে যেতে পারছে না। যদি আমি তাদের সমুদ্রের জলে না ফিরিয়ে দেই তাহলে তারা অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে।' প্রথম ভদ্রলোকটি বললেন, 'বুঝলাম, এখানে এই সমুদ্রসৈকতে এখন হাজার হাজার তারামাছ ভেসে আসছে। আপনার পক্ষে সম্ভব না সবাইকে সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া এবং আপনি কি অনুভব করতে পারছেন, শত শত সৈকতে এই ঘটনা ঘটছে! আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনার এই কাজ এই ঘটনার কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না?' স্থানীয় ভদ্রলোকটি স্মিত হাসলেন, নিচু হলেন, ভেসে আসা একটা তারামাছ তুললেন আবার তা সমুদ্রের জলে ফিরিয়ে দিলেন আর জবাবে বললেন, 'সব হয়তো পারব না, আমি না হয় এই একটা তারামাছের জীবনেই পরিবর্তন এনে দিতে চেষ্টা করছি!'
এই গল্পটিতে কি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাগুলো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে না? 'আমরা অহঙ্কার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিয়া থাকি।'
তবু আমি পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আশার স্বপ্ন আমাকে জাগ্রত রাখে। প্রতিদিন প্রস্তুতি নিই নতুন সূর্য দেখব বলে। আমার খুব মনে হয়, আমাদের সবাই হয়তো খুব শিগগির একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারব, যেখানে সবাই তার অবস্থানে থেকেই যতটুকু সম্ভব ততটুকু শুভ পরিবর্তনের চেষ্টা করব। আর তাহলেই আমাদের ছোট প্রচেষ্টাগুলো এক সময় গল্পের সবগুলো তারামাছের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে। সমাজ থেকে দূর হবে আশাহীনতার জঞ্জাল। আমার স্বপ্ন দেখার সার্থকতা হবে সেদিনই। তাই আমি 'স্বপ্ন দেখব বলে দু'চোখ পেতেছি।'

No comments

Powered by Blogger.