কালের পুরাণ-‘তিরস্কৃত’ ও ‘বহিষ্কৃত’ লীগের ভবিষ্যৎ কী? by সোহরাব হাসান
শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আদর্শ হিসেবে প্রচার করা হলেও সংগঠনটির কাজকর্ম এর পুরোপুরি বিপরীত। এখনকার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষাও চান না, শান্তিও চান না। আর এ দুটির অনুপস্থিতিতে প্রগতি যে সুদূরপরাহত, তা খোলাসা করে না বললেও চলে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ। লক্ষ্য ছিল শান্তি ও প্রগতির চাকা এগিয়ে নেওয়ার। ৬৩ বছর পর দেখা গেল ভূতের মতো তারা কেবল পেছনের দিকেই হাঁটছে।
আগের বছরের অগ্রগতি ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে পরের বছরের নানা অপকর্ম। আগের মেয়াদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায় পরের মেয়াদের প্রবল মাস্তানিতে। এখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-মাস্তানি নিয়ে যাঁরা আফসোস করছেন, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আগামী বছর তাঁদের সেই আক্ষেপ আর থাকবে না। কেননা, তখন সংগঠনটির সন্ত্রাস-লুটপাট বর্তমানকে অনেক গুণ ছাড়িয়ে যাবে। পাঠক তখন মনে মনে বলবেন, আহ! আগের বছরটি কত ভালো ছিল। আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি মাপার বাটখারা হলো, আগের বছরের চেয়ে আমরা কত বেশি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যেমন ছাত্রদলের ‘প্রবীণ’ নেতারা আগের আমলের ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও মাস্তানির উদাহরণ দিতেন, এখন ছাত্রলীগের ‘প্রৌঢ়’ নেতারা ছাত্রদলের মাস্তানি-সন্ত্রাসের উদাহরণ দিচ্ছেন। কে কার চেয়ে ভালো, সেই বিচার নয়; কে কার চেয়ে কম খারাপ, তা নিয়ে জোর বাদানুবাদ চলছে।
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা-কর্মীরা যখন ঢাকায় বর্ণাঢ্য মিছিল করেছেন, তখন সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অন্য রকম মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে একজন নৃত্যশিল্পীর শ্লীলতাহানি করেছেন ও ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তা-ও সেই নৃত্যশিল্পীর স্বামীকে আরেকটি ঘরে আটকে রেখে, তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে। পরে ওই শিল্পীর স্বামী কৌশলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ দ্রুত এসে নৃত্যশিল্পীকে উদ্ধার করে।
পুলিশ অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্তব্যে অবহেলা করলেও এখানে যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। তারা একজন শিল্পীকে ছাত্রলীগনামধারী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে এবং ওই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। তারা জানে না এসব মামুলি বহিষ্কার ও তিরস্কার ছাত্রলীগের পোশাকধারী মাস্তানদের কাবু করতে পারে না। আবার কোনো সম্মেলন সামনে রেখে তাঁরা বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেবেন ও নেতৃত্বের আসন দখল করবেন। আইন তাঁদের স্পর্শ করতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদার একটি ছাত্রসংগঠনের অধঃপতন যে কী পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার প্রমাণ সাতক্ষীরার ঘটনা। এ রকম বহু সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে দোতলা থেকে ফেলে হত্যা করেছিল তারই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে মারা যান ছাত্রলীগ নেতা পলাশ জমাদ্দার। ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের চারজন কর্মীকে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগনামধারী ক্যাডাররা, যাঁদের একজন মারা যান। যেখানে ছাত্রলীগ আছে, সেখানেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাত-সংঘর্ষে আহত অথবা মৃত্যুর খবর প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হয়। ছাত্রলীগ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা, মন্ত্রীরা বড়াই করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝান্ডা উড়িয়ে চলেছেন বলে সনদ দেন। কিন্তু তাঁরা কি জানেন, এ সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যত নেতা-কর্মী মারা গেছেন, প্রতিপক্ষ সংগঠন কিংবা স্বৈরশাসকের হাতেও তত নেতা-কর্মী মারা যাননি।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি লক্ষণীয় দিক হলো, বিএনপির আমলে অধিকাংশ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ উধাও। এখন আওয়ামী লীগ আমল চলছে। স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদল ও শিবির উধাও। এর নাম দেওয়া যায় দখল আর উধাওয়ের রাজনীতি। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। থাকলেও ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের দ্বিমুখী আক্রমণে টিকতে পারছে না। অতএব ছাত্রলীগকে ঠেকায় কে? অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রশাসন ও ছাত্রলীগ একাকার হয়ে যায়। কে প্রশাসন চালাচ্ছে, বলা কঠিন।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে একবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সাংগঠনিক প্রধান বা অভিভাবকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ছাত্রলীগের সুমতি আসবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ধমক ও তিরস্কার তাদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। তারা একটির পর একটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। যার সর্বশেষ শিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের শেষ পরীক্ষা দিয়ে তিনি যখন ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের ১২-১৩ জন কর্মী তাঁকে ধরে নির্মাণাধীন ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের পেছনে নিয়ে রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটায়। সন্ধ্যায় তাঁকে পাশের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসে। ভোর ছয়টায় তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান।
এ দুর্ধর্ষ অভিযানে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, বাতিল হওয়া ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক গ্রুপের তিন কর্মী। তাঁরা হলেন: প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও দর্শন বিভাগের একই ব্যাচের মো. রাশেদুল ইসলাম। সাভার থানার পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করেছে। জুবায়ের ছিলেন সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মী।
জুবায়ের অঘটন বা সংঘর্ষে নিহত হননি। তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যার হোতা ছাত্রদল ও শিবিরের কেউ নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবিদার ছাত্রলীগের কর্মীরাই। সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে দিনদুপুরে হত্যা করা হবে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। গতকাল প্রথম আলোয় জুবায়েরের মায়ের আহাজারির খবর পড়ে যেকোনো মানুষের চোখ ছলছল করবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘তোমরা কার বুক খালি করেছ?’। এভাবে আর কত মায়ের বুক খালি হবে? বাবা সন্তানের লাশ বহন করবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কী করে খুনি হয়? কোন রাজনীতি তাঁদের খুনি বানায়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে। তাঁরা হয়তো বলবেন, তাঁদের কমিটি আগেই বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বাতিল কমিটি কী করে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক তৎপরতা চালায়? প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসছাড়া করে? উত্তর দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথা উপাচার্যকেও। জুবায়েরের ঘাতকেরা তাঁর নামেই স্লোগান দিয়েছে। একজন উপাচার্য কেন একটি ছাত্রসংগঠনের উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়বেন? তিনি যে ক্যাডারদের রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন, তা অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে নমনীয় আচরণেই প্রমাণিত। প্রথম দিন তিনি অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করলেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে আইনশৃঙ্খলা কমিটি তাঁদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ বার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মারামারিতে জড়িয়েছেন। ২০১০ সালের ৫ জুলাই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। ছাত্রলীগের নেতা নামধারী জসিমউদ্দিন মানিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেমন তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, এখনকার প্রশাসনও কি জুবায়ের আহমেদের খুনিদের বাঁচাতে চাইছে? সাধারণ ছাত্রদের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও একটি গ্রুপ উপাচার্যের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সক্রিয়। অন্য গ্রুপের কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের মাস্তানি বন্ধ না করে এক পক্ষকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। যাঁরা নিজ যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যে উপাচার্যের পদ বাগিয়ে নেন, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতাদের তোয়াজ করেই গদি রক্ষা করতে চান।
আওয়ামী লীগ সরকারই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কে এম শাহনেওয়াজকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছিল। ছাত্রলীগ এক বছরের মধ্যে তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যও কাজ করতে পারেননি ছাত্রলীগের অসহযোগিতার কারণে। চুয়েট বন্ধ হয়েছে ছাত্রলীগের আন্দোলনের কারণে। কুয়েটের ঘটনায়ও ছাত্রলীগ জড়িত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছয় মাসে তারা ১৯ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। অন্যদের ওপর চড়াও হয়েছে অন্তত ১০ বার।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলির শিকার হয়ে জীবন হারান মেধাবী ছাত্র ও খেতমজুর বাবার সন্তান আবু বকর। এর শেষ কোথায়?
ছাত্রলীগের কোথাও অঘটন ঘটলে, কেউ মারা গেলে আওয়ামী লীগের নেতারা ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে মৃদু তিরস্কার করেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন বা দায়ী ব্যক্তিদের বহিষ্কার করেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, এ রকম মোলায়েম ওষুধে তা কাজ হবে না। এ জন্য চাই কড়া ডোজের আইনি ওষুধ।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা-কর্মীরা যখন ঢাকায় বর্ণাঢ্য মিছিল করেছেন, তখন সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অন্য রকম মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে একজন নৃত্যশিল্পীর শ্লীলতাহানি করেছেন ও ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তা-ও সেই নৃত্যশিল্পীর স্বামীকে আরেকটি ঘরে আটকে রেখে, তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে। পরে ওই শিল্পীর স্বামী কৌশলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ দ্রুত এসে নৃত্যশিল্পীকে উদ্ধার করে।
পুলিশ অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্তব্যে অবহেলা করলেও এখানে যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। তারা একজন শিল্পীকে ছাত্রলীগনামধারী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে এবং ওই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। তারা জানে না এসব মামুলি বহিষ্কার ও তিরস্কার ছাত্রলীগের পোশাকধারী মাস্তানদের কাবু করতে পারে না। আবার কোনো সম্মেলন সামনে রেখে তাঁরা বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেবেন ও নেতৃত্বের আসন দখল করবেন। আইন তাঁদের স্পর্শ করতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদার একটি ছাত্রসংগঠনের অধঃপতন যে কী পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার প্রমাণ সাতক্ষীরার ঘটনা। এ রকম বহু সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে দোতলা থেকে ফেলে হত্যা করেছিল তারই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে মারা যান ছাত্রলীগ নেতা পলাশ জমাদ্দার। ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের চারজন কর্মীকে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগনামধারী ক্যাডাররা, যাঁদের একজন মারা যান। যেখানে ছাত্রলীগ আছে, সেখানেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাত-সংঘর্ষে আহত অথবা মৃত্যুর খবর প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হয়। ছাত্রলীগ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা, মন্ত্রীরা বড়াই করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝান্ডা উড়িয়ে চলেছেন বলে সনদ দেন। কিন্তু তাঁরা কি জানেন, এ সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যত নেতা-কর্মী মারা গেছেন, প্রতিপক্ষ সংগঠন কিংবা স্বৈরশাসকের হাতেও তত নেতা-কর্মী মারা যাননি।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি লক্ষণীয় দিক হলো, বিএনপির আমলে অধিকাংশ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ উধাও। এখন আওয়ামী লীগ আমল চলছে। স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদল ও শিবির উধাও। এর নাম দেওয়া যায় দখল আর উধাওয়ের রাজনীতি। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। থাকলেও ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের দ্বিমুখী আক্রমণে টিকতে পারছে না। অতএব ছাত্রলীগকে ঠেকায় কে? অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রশাসন ও ছাত্রলীগ একাকার হয়ে যায়। কে প্রশাসন চালাচ্ছে, বলা কঠিন।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে একবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সাংগঠনিক প্রধান বা অভিভাবকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ছাত্রলীগের সুমতি আসবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ধমক ও তিরস্কার তাদের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি। তারা একটির পর একটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। যার সর্বশেষ শিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের শেষ পরীক্ষা দিয়ে তিনি যখন ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের ১২-১৩ জন কর্মী তাঁকে ধরে নির্মাণাধীন ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের পেছনে নিয়ে রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটায়। সন্ধ্যায় তাঁকে পাশের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসে। ভোর ছয়টায় তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান।
এ দুর্ধর্ষ অভিযানে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, বাতিল হওয়া ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক গ্রুপের তিন কর্মী। তাঁরা হলেন: প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের খন্দকার আশিকুল ইসলাম, খান মো. রইস ও দর্শন বিভাগের একই ব্যাচের মো. রাশেদুল ইসলাম। সাভার থানার পুলিশ আশিককে গ্রেপ্তার করেছে। জুবায়ের ছিলেন সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মী।
জুবায়ের অঘটন বা সংঘর্ষে নিহত হননি। তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যার হোতা ছাত্রদল ও শিবিরের কেউ নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবিদার ছাত্রলীগের কর্মীরাই। সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে দিনদুপুরে হত্যা করা হবে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। গতকাল প্রথম আলোয় জুবায়েরের মায়ের আহাজারির খবর পড়ে যেকোনো মানুষের চোখ ছলছল করবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘তোমরা কার বুক খালি করেছ?’। এভাবে আর কত মায়ের বুক খালি হবে? বাবা সন্তানের লাশ বহন করবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কী করে খুনি হয়? কোন রাজনীতি তাঁদের খুনি বানায়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে। তাঁরা হয়তো বলবেন, তাঁদের কমিটি আগেই বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বাতিল কমিটি কী করে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক তৎপরতা চালায়? প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসছাড়া করে? উত্তর দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথা উপাচার্যকেও। জুবায়েরের ঘাতকেরা তাঁর নামেই স্লোগান দিয়েছে। একজন উপাচার্য কেন একটি ছাত্রসংগঠনের উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়বেন? তিনি যে ক্যাডারদের রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন, তা অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে নমনীয় আচরণেই প্রমাণিত। প্রথম দিন তিনি অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করলেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে আইনশৃঙ্খলা কমিটি তাঁদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ বার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মারামারিতে জড়িয়েছেন। ২০১০ সালের ৫ জুলাই সংঘর্ষের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। ছাত্রলীগের নেতা নামধারী জসিমউদ্দিন মানিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেমন তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, এখনকার প্রশাসনও কি জুবায়ের আহমেদের খুনিদের বাঁচাতে চাইছে? সাধারণ ছাত্রদের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও একটি গ্রুপ উপাচার্যের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সক্রিয়। অন্য গ্রুপের কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের মাস্তানি বন্ধ না করে এক পক্ষকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। যাঁরা নিজ যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যে উপাচার্যের পদ বাগিয়ে নেন, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতাদের তোয়াজ করেই গদি রক্ষা করতে চান।
আওয়ামী লীগ সরকারই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কে এম শাহনেওয়াজকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছিল। ছাত্রলীগ এক বছরের মধ্যে তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যও কাজ করতে পারেননি ছাত্রলীগের অসহযোগিতার কারণে। চুয়েট বন্ধ হয়েছে ছাত্রলীগের আন্দোলনের কারণে। কুয়েটের ঘটনায়ও ছাত্রলীগ জড়িত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছয় মাসে তারা ১৯ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। অন্যদের ওপর চড়াও হয়েছে অন্তত ১০ বার।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলির শিকার হয়ে জীবন হারান মেধাবী ছাত্র ও খেতমজুর বাবার সন্তান আবু বকর। এর শেষ কোথায়?
ছাত্রলীগের কোথাও অঘটন ঘটলে, কেউ মারা গেলে আওয়ামী লীগের নেতারা ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে মৃদু তিরস্কার করেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি শাখার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন বা দায়ী ব্যক্তিদের বহিষ্কার করেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, এ রকম মোলায়েম ওষুধে তা কাজ হবে না। এ জন্য চাই কড়া ডোজের আইনি ওষুধ।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments