প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী-ঝরে গেল অর্ধেক by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

ঞ্চম শ্রেণীতে আসা পর্যন্ত অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। ২০০৭ সালে ৪৫ লাখ ছাত্রছাত্রী নিবন্ধন করেছিল। তাদের মধ্যে ২৫ লাখ শিক্ষার্থীই এবার পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, স্কুল, পাঠ্যপুস্তক, পাঠদান চিত্তাকর্ষক না হওয়া, বাবা-মায়ের অসেচতনতাসহ বিভিন্ন কারণকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
সরকারি হিসাবেই প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৫ শতাংশ। ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তার


সুফল মিলছে না। এ অবস্থায় করণীয় কী, সে ব্যাপারে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সুপারিশ করতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছর যারা পঞ্চম শ্রেণীর এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তারা ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ২৩ লাখ শিক্ষার্থী। এখানে প্রায় ২২ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল। এ ছাড়া ফলাফলের সময়ও ঝরে যাবে (ফেল) আরো অনেক শিক্ষার্থী। আর গত তিন দিনের পরীক্ষায় অনুপস্থিত দুই লাখ শিক্ষার্থী। সবমিলিয়ে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষায় পঞ্চম শ্রেণীতে এসে ঝরে পড়ছে ২৫ লাখ শিক্ষার্থী।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিদ্যালয়) জামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কেন শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে, তার কিছু কারণ মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করেছে। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি এবং পড়াশোনার প্রতি দরিদ্র বাবা-মায়ের অনাগ্রহকে দায়ী করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে না পেরে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অনেকেই স্কুল ছেড়ে দেয়। অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও ফেল করলে আর পড়তে চায় না। এ ছাড়া কিছু কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে বাবা-মা সন্তানের পড়াশোনার চেয়ে কাজকে গুরুত্ব দেন। ফলে ওই সন্তান পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে স্কুলে যায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রথম শ্রেণী থেকে শিক্ষার্থীরা যত ওপরে উঠছে তত ঝরে পড়ছে। এটা পুরো সিস্টেমের দুর্বলতা। এ জন্য পুরো সিস্টেমের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এটা রাতারাতি সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, দারিদ্র্য, বিদ্যালয় ও বই-পুস্তক শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় না হওয়া, অনগ্রসর এলাকায় মেয়েশিশুদের, বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর মেয়েদের নানা রকম নিরাপত্তার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে শিশুরা ঝরে পড়ছে। এটা রোধ করতে এলাকাভেদে নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর পরামর্শ দেন তিনি।
তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আবদুর রউফ চৌধুরী মনে করেন, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার বিষয়টি সরলভাবে হিসাব করাটা ঠিক হবে না। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, শিশুরা প্রাথমিকে ভর্তি হয় ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর তারা অন্য ধারার স্কুলে চলে যায়। আবার কেউ ফেল করে পরের বছর পরীক্ষাও দেয়। এ কারণে ঝরে পড়ার সঠিক হিসাব বের করাটা গবেষণার বিষয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমাতে উপবৃত্তির সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি স্কুলে বিস্কুট দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয় ৪৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ২২ লাখ ৫১ হাজার ৪৩৬ জন এবং ছাত্রী ২২ লাখ ৩২ হাজার ৬২৮ জন। ভর্তি হওয়া ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৩ লাখ ১৬ হাজার ২২৩ জন পরীক্ষার্থী এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। বাকিরা বিভিন্ন কারণে এই পাঁচ বছরে কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে গেছে। আবার এবার পরীক্ষার প্রথম তিন দিনেই অনুপস্থিত রয়েছে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। ওই সব শিশুর মধ্যে ৫৫ ভাগ শিশু মাঝারি থেকে গুরুতর অপুষ্টির শিকার। এ ছাড়া ৫৬ শতাংশ শিশু প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজনের। অপুষ্টির শিকার এসব শিশুর পক্ষে দীর্ঘ সময়ে ক্লাসে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। অপুষ্টির কারণে তাদের শেখার ও মনে রাখার ক্ষমতা দুটোই কমে যায়। একপর্যায়ে তারা স্কুল ছেড়ে যায়।
এ ছাড়া গত অক্টোবর মাসে ঢাকায় মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি সেমিনারের আয়োজন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ওই সেমিনারে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, শতভাগ ভর্তি হলেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা যাচ্ছে না। এজন্য দারিদ্র্য, অভিভাবকের আগ্রহ ও আকর্ষণীয় ক্লাসরুম না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরো বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ইউনিয়ন কোটায় বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ থাকায় শহরের পাশাপাশি গ্রামেও নিবন্ধন করেছে অনেক শিক্ষার্থী। এর ফলে পরীক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু পরীক্ষা দিতে হয় যেকোনো একটি স্কুলের শিক্ষার্থী হয়েই। এতে করে অনুপস্থিতির হার বাড়ে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সংস্থাপন) মো. ফসিহউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক অভিভাবকও বাসস্থান পরিবর্তন করে ফেলেন। ফলে তাঁর সন্তানও নতুন স্কুলে দ্বিতীয়বার নিবন্ধন করে। ওদিকে আগের নিবন্ধনও রয়ে যায়। দুই জায়গায় নিবন্ধন বন্ধের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ঝরেপড়া রোধ এবং প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা অফিস পরিদর্শন করে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ আদেশ জারি করে।

No comments

Powered by Blogger.