নির্বাচন-আগাম ভোট :যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা by আমীন আল রশীদ

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পি টু কনসালট্যান্টের কর্মকর্তা ব্রায়ান প্যাট্রিকের সঙ্গে আলাপ শিকাগো সিটি মেয়রের অফিসের নিচতলায়। লম্বা লাইনের একদম শেষ ব্যক্তিটি তিনি। কেন এই লাইন? ব্রায়ান জানালেন, ভোট দিতে এসেছেন।
কিসের ভোট? বললেন, প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের ভোট। বললাম, ভোট তো নভেম্বরের ৬ তারিখ। আরও বেশ কয়েকদিন পরে। আজ কীভাবে ভোট দেবেন? বললেন, এটি আগাম ভোট। নাগরিকরা চাইলে ভোটের জন্য নির্ধারিত দিনের আগেই এ রকম আগাম ভোট দিতে পারেন।
প্রশ্ন হলো, এর সুবিধাটা কী? ব্রায়ান জানালেন, এর সুবিধা অনেক। প্রথমত, ভোটের দিন যদি কারও বিশেষ কাজ থাকে, সে ক্ষেত্রে তিনি এই আগাম ভোটের সুযোগ নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ভোটের দিন তুলনামূলকভাবে বেশি লাইন থাকে। সে ক্ষেত্রে আগাম ভোট দিয়ে গেলে কাজটা শেষ হয়। তৃতীয়ত, আমেরিকানদের একটা বড় অংশ ভোট দেওয়ার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। যে কারণে আগাম ভোট ওইসব অনাগ্রহী ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহ জোগায়। চতুর্থত, আগাম ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে নির্বাচনের হাওয়াটা বোঝা যায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তার নিজের শহর এই শিকাগোতে এসে আগাম ভোট দিয়ে গেছেন। সৌভাগ্যক্রমে ওইদিন আমিও শিকাগোতে। যদিও তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। যেমন সুযোগ হয়েছিল ভোটের রাতে শিকাগোর ম্যাককরমিক প্যালেসে তার ইলেকশন নাইটে উপস্থিত থাকার। এটি একটি বিরল অভিজ্ঞতা বলা চলে। ৬ নভেম্বর রাতে বারাক ওবামা তার বিজয় ভাষণ দিয়েছিলেন এই স্থানে বিশাল এক জনসমাগমে। সেখানে বারাক ওবামার মঞ্চের খুব কাছেই বসেছিলাম। মধ্যরাত অবধি জমকালো ওই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি।
ফেরা যাক আগাম ভোট প্রসঙ্গে। শতকরা একশ' ভাগ ভোটার ভোট দেবেন এটা পৃথিবীর কোনো দেশেই আশা করা সমীচীন নয়। আমেরিকায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়লেই তারা খুশি। সে তুলনায় আমাদের দেশে ভোটের শতকরা হার অনেক বেশি। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কেন্দ্রে ৮৫, এমনকি ৯০ ভাগ ভোটও পড়েছে। এই তথ্য আমেরিকার নির্বাচন সংশিল্গষ্ট যার কাছেই বলেছি, আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলেন। শিকাগো ফেডারেশন অব লেবারের প্রেসিডেন্ট জর্জ রেমিরেজ এই তথ্য শুনে তার সহকর্মী হানাকে বললেন, 'শোনো শোনো ওদের দেশে নাকি ৮৫ ভাগ ভোট পড়ে। আর আমরা ৫০-৬০ শতাংশ ভোটের জন্য কত ঘাম ঝরাই!'
আমেরিকার তুলনায় আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচনে কেন বেশি ভোট পড়ে, তার অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তবে সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় এই যে, আমেরিকার সরকার কাঠামোতে কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্ব খুবই কম। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেকটিই স্বাবলম্বী। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট তাদের দরকার তো হয়ই না, উল্টো তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে পয়সা দেয়। প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের রয়েছে আলাদা সংবিধান, আলাদা আইন। যেমন একই কাজ এক অঙ্গরাজ্যে জায়েজ, অথচ অন্য কোনো অঙ্গরাজ্যে সেটাই হয়তো নাজায়েজ। সেখানের স্থানীয় সরকার যথেষ্ট শক্তিশালী। তাছাড়া সরকারে যে দলই থাকুক না কেন, নাগরিকদের যে নিত্যদিনের সুযোগগুলো পাওয়ার কথা, যেমন ধরা যাক গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ এসবে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। এসব নাগরিক সুবিধা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো ক্ষোভও নেই। হয়তো এ কারণেই তাদের ভোটের প্রতি আগ্রহ কম। তাছাড়া আমাদের যেমন নির্বাচনের দিন সংশিল্গষ্ট নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকে, আমেরিকায় তার বালাই নেই। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে আবার দৌড় দেয় অফিসে। আমি শিকাগো শহরের ওয়েস্ট শেরউইনে যে আমেরিকান পরিবারের সঙ্গে ছিলাম, তার গৃহকর্ত্রী ম্যারেন নেলসন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ৬ নভেম্বর ভোর ৬টায় তিনি ঘুম থেকে উঠে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন। বললেন, রেডি হও। তোমাকে ভোট দেখাতে নিয়ে যাব। তারপর অফিসে যাব। তার অফিস ভোটকেন্দ্র থেকে ঢের দূরে। যেতে হয় ট্রেনে। আধঘণ্টার জার্নি। তারপর মিনিট পাঁচেকের হঁাঁটাপথ। সব মিলিয়ে ৯টার মধ্যে অফিসে পেঁৗছতে হয়। কিন্তু ভোটের দিন বলে বাড়তি খাতির নেই।
তবে আমেরিকার রাজনীতিকরা ভোটারদের যথেষ্ট খাতির করেন। তাদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নানাভাবে উৎসাহ দেন। তারই অংশ আগাম ভোট, তারা যেটাকে বলে আর্লি ভোটিং। আমাদের দেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অন্য কোনো জরুরি কাজের কারণে ভোট দিতে পারেন না তাদের বাইরেও অন্তত পাঁচ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারেন না কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে।
আমাদের দেশে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন সারাদেশে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়, সে কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশিল্গষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি গণমাধ্যমের হাজার হাজার কর্মী যারা বিভিন্ন স্থান থেকে ভোটের খবর দেন এবং অসংখ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক ভোট দিতে পারেন না। এসব দায়িত্বের সঙ্গে সংশিল্গষ্ট হাতেগোনা কিছু লোক হয়তো একটু সময়-সুযোগ হলে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের হিসাবেই অন্তত পাঁচ লাখ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হন। ফলে যারা এ রকম সঙ্গত কারণে ভোট দিতে পারেন না, তাদের জন্য আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা পদ্ধতি আছে, যার নাম পোস্টাল ব্যালট। অর্থাৎ কোনো ভোটার যদি সংশিল্গষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন জানান যে, তিনি পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে চান, তাহলে তার জন্য ওই ব্যালট সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ নিজেই স্বীকার করেছেন, এই পোস্টাল ব্যালটের ব্যাপারে ভোটারদের কোনো আগ্রহ নেই। কেননা পোস্টাল ব্যালটের পদ্ধতি জটিল। তার চেয়ে বরং আমেরিকার এই আর্লি ভোটিং বা আগাম ভোট অনেক সহজ।
এ ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনী আইনে ছোট্ট একটু সংশোধনী এনে পোস্টাল ব্যালটের পরিবর্তে আগাম ভোটিংয়ের পদ্ধতি চালু করা যায়। অর্থাৎ ভোটের কয়েকদিন আগে বিশেষ বিশেষ কিছু জায়গায় আগাম ভোট নেওয়া যেতে পারে। নির্ধারিত এলাকার ভোটারদের মধ্যে যারা আগ্রহী তারা আগাম ভোট দিলেও সেগুলো গণনা করা হবে চূড়ান্ত ভোটের ফল গণনার সঙ্গেই। ততদিন ওই ব্যালট বাক্স কড়া নিরাপত্তায় থাকবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেহেতু পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট প্রকট। তাই এ ক্ষেত্রে সংশয় থেকেই যাবে যে, ওই বাক্সে বাড়তি ব্যালট ঢোকানো হলো কি-না। সেটা অবশ্য অন্য তর্ক। তবে এটা পরীক্ষামূলকভাবে বড় বড় কয়েকটি শহরে, অন্তত প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে চালু করে দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের সঙ্গে সংশিল্গষ্ট যে পাঁচ লাখ ভোটারের কথা বলা হলো, দেখা যাবে তাদের প্রায় শতভাগই এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে উৎসাহী হবেন। এ বিষয়ে আইন সংশোধনের পাশাপাশি নির্বাচনী বিধিমালাও পরিবর্তন আনতে হবে। এটা সম্ভব হলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা আরেকটু আধুনিক হবে বলে আশা করা যায়। তবে প্রশ্নটা আবারও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের। এই সংকট কবে কাটবে তা বলা মুশকিল।

আমীন আল রশীদ :সাংবাদিক
aminalrasheed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.