যে কাউকে সচিব করবে সরকার! by আশরাফুল হক রাজীব
বেসরকারি পর্যায় থেকে সচিবসহ যেকোনো পর্যায়ে লোক নিয়োগের বিধান রেখে 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২'-এর খসড়া করা হয়েছে। এই নিয়োগ দেওয়াকে বলা হচ্ছে আউটসোর্সিং পদ্ধতি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে প্রশাসনে আরো বেশি দলীয়করণ হবে।
খসড়া আইনে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধানও রাখা হয়নি। এমনকি কাজের ধরন অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ভাগ করার বিষয়টিও উপেক্ষিত রয়েছে। নতুন আইন করতে গিয়ে সরকার সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট থেকে সরে এসেছে। নাটকীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য গতকাল রবিবার একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও এ ধরনের আইন হয়নি। আমরা আইনটি করতে চাচ্ছি। সিভিল সার্ভিস আইনে সব কিছুই থাকবে।' জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এক মাসের মধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইনটির খসড়া করা হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে দ্রুত খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। একই সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও বৈঠক চলবে।'
সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজনমতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে ও করেছে। এতে করে প্রশাসনে দলীয়করণ ব্যাপকতর হয়, বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পায়। এ অবস্থায় ২০০৩ সাল থেকেই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সময় আইনটির খসড়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এ ধরনের আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটাও বাস্তব রূপ পায়নি। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে দুই বছর ধরে সভা-সেমিনার করে এবং সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। খসড়া চূড়ান্ত করার আগে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫৭১টি মতামত ও ২৪৩টি লিখিত সুপারিশ পাওয়া যায়। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এ আইন প্রণয়নের নামে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সিভিল সার্ভিস আইনটি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আইনটি অনুমোদন হয়ে আসার পরিবর্তে নতুন একটি আইন এসেছে।
নতুন খসড়া আইনে ২০টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে ৫ নম্বর ধারায় কর্মচারীদের আউটসোর্সিং করার প্রস্তাব রয়েছে। খসড়া আইনের ৫-এর খ ধারায় বলা হয়েছে, 'সরকার প্রয়োজন মনে করিলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রেণী, প্রকৃতি বা কর্মের সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিক লইতে পারিবেন এবং কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী বা শ্রেণীর কর্ম পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করিতে পারিবেন।' খসড়া আইনের এ ধারা শেষ পর্যন্ত বলবৎ থাকলে সরকার যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে সচিব বা যেকোনো পদে নিয়োগ করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, 'বেসরকারি করপোরেট হাউসগুলো দিব্যি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তাদের সেবা যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে মন্দ কী?'
এ ব্যাপারে সন্দিহান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করপোরেট হাউসগুলো তাদের মতো করে কাজ করে। সরকারি অফিসে নিয়মকানুন মানতে হয়। দলীয়করণ করার ফলে প্রশাসনের মান কমেছে। এই দলীয়করণ বন্ধ হলে কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবেন, কারণ দলীয়করণ বন্ধ হলে পদোন্নতির মানদণ্ড হবে দক্ষতা। কর্মকর্তাদের সুনামের সঙ্গে কাজের কোনো বিকল্প থাকবে না। যেকোনো বেসরকারি লোককে সচিব পদে নিয়োগ করা হলে প্রশাসন আরো ভেঙে পড়বে।
আউটসোর্সিং বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইনের খসড়া আমি দেখিনি। উন্নত দেশে সাধারণত আউটসোর্সিং করা হয়। আউটসোর্সিংয়ে তৃতীয় একটি কম্পানি বা সংস্থাকে বলা হয় প্রয়োজনীয় লোকবল বা সেবা দেওয়ার জন্য। এটা মূলত শ্রমিক পর্যায়ে হয়ে থাকে। এখন সরকার কী ভাবছে, আমি জানি না।'
সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'পদাধিকারবলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীগণের মধ্যে প্রধান হইবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি জনপ্রশাসনের কর্মে দক্ষ ও সরকারের নিয়মিত সচিবগণের মধ্য হইতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করিবেন।' বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় সবচেয়ে সিনিয়র সচিবকে। নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী নিয়মিত সচিবদের মধ্যে থেকে যেকোনো সচিবকে সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করতে পারবে। এর ফলে কর্মকর্তাদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি বেড়ে যাবে বলে একজন সচিব জানিয়েছেন।
খসড়া আইনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবেরও একটি বিশিষ্ট স্থানের কথা বলা হয়েছে। এ বিশিষ্ট স্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আইনে এর ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করছেন। কর্মচারী আইনে মেধা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ, পেশাগত দক্ষতাকে পদোন্নতির মূল ভিত্তি ধরা হয়েছে। তবে পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষায় বসার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অথচ সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টে লিখিত পরীক্ষা দিয়েই পদোন্নতি পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। দলীয় সমর্থক জুনিয়র কর্মকর্তাদের বাধার মুখে এ আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। নতুন কর্মচারী আইনে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা না রাখায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, সিভিল সার্ভিস আইন করা হচ্ছিল বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রুল ১৯৮০ সালের আওতায় গঠিত বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের একটি আইনের আওতায় পরিচালনার উদ্দেশ্যে। এ আইনের খসড়া প্রণয়নকালে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের আপত্তি জানান। সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের খসড়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জন্য কোনো আইন ছিল না। 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২' প্রণয়নের মাধ্যমে প্রথম গ্রেড থেকে শুরু করে ২০তম গ্রেডের সব কর্মচারীকে একটি আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া এ আইনের ১৮ ধারার ২ উপধারার বিধি প্রণয়নের ক্ষমতায় বলা হয়েছে, 'বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা সংক্রান্ত বিশেষ বিধানাবলি প্রণয়ন করা হবে।' এ থেকে বোঝা যায়, সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের আর কোনো উপযোগিতা থাকে না।
পরামর্শ সভায় প্রকৃচির সমালোচনা
গতকাল রবিবার 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২' নিয়ে তিনটি কারিগরি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একটি পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর একটি হোটেলে প্রকৌশলী, কৃষি ও চিকিৎসক (প্রকৃচি) নেতাদের সঙ্গে এ পরামর্শ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন এইচ টি ইমাম, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় প্রকৃচির নেতারা আইন নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, বর্তমান প্রশাসন সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন। সরকারকে চাপে ফেলে পদোন্নতি নিয়েছেন কর্মকর্তারা। এই অসম পদোন্নতির ফলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যা পদ রয়েছে তার চেয়ে বাড়তি পদোন্নতি পেয়েছেন এক হাজার ১৯৬ জন। এটা বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। সভায় বিএমএ নেতা শাহ আলম বলেন, 'সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টেও আমাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তার প্রতিফলন ছিল না। অর্থাৎ আমাদের মতামত নেওয়া হলেও তা চূড়ান্ত খসড়ায় স্থান পায় না।' কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, পদোন্নতিতে সমতা থাকতে হবে। বর্তমানে ক্যাডার বৈষম্য বেশি। শামসুল হক কমিশনের প্রতিবেদনে গুচ্ছ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ ছিল যা আজকের কর্মচারী আইনে স্থান পায়নি। পিডাব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা সচিব হয়ে গেছেন। আর পূর্ত ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখনো মাঠপর্যায়েই রয়ে গেছেন। সভায় রাজউকের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা বলেন, সব ক্যাডারের গ্রেড এক এর পদ থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও এ ধরনের আইন হয়নি। আমরা আইনটি করতে চাচ্ছি। সিভিল সার্ভিস আইনে সব কিছুই থাকবে।' জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এক মাসের মধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইনটির খসড়া করা হয়েছে। সবার মতামত নিয়ে দ্রুত খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। একই সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও বৈঠক চলবে।'
সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজনমতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে ও করেছে। এতে করে প্রশাসনে দলীয়করণ ব্যাপকতর হয়, বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পায়। এ অবস্থায় ২০০৩ সাল থেকেই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সময় আইনটির খসড়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এ ধরনের আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটাও বাস্তব রূপ পায়নি। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে দুই বছর ধরে সভা-সেমিনার করে এবং সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। খসড়া চূড়ান্ত করার আগে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫৭১টি মতামত ও ২৪৩টি লিখিত সুপারিশ পাওয়া যায়। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এ আইন প্রণয়নের নামে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সিভিল সার্ভিস আইনটি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আইনটি অনুমোদন হয়ে আসার পরিবর্তে নতুন একটি আইন এসেছে।
নতুন খসড়া আইনে ২০টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে ৫ নম্বর ধারায় কর্মচারীদের আউটসোর্সিং করার প্রস্তাব রয়েছে। খসড়া আইনের ৫-এর খ ধারায় বলা হয়েছে, 'সরকার প্রয়োজন মনে করিলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রেণী, প্রকৃতি বা কর্মের সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিক লইতে পারিবেন এবং কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী বা শ্রেণীর কর্ম পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করিতে পারিবেন।' খসড়া আইনের এ ধারা শেষ পর্যন্ত বলবৎ থাকলে সরকার যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে সচিব বা যেকোনো পদে নিয়োগ করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, 'বেসরকারি করপোরেট হাউসগুলো দিব্যি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তাদের সেবা যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে মন্দ কী?'
এ ব্যাপারে সন্দিহান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করপোরেট হাউসগুলো তাদের মতো করে কাজ করে। সরকারি অফিসে নিয়মকানুন মানতে হয়। দলীয়করণ করার ফলে প্রশাসনের মান কমেছে। এই দলীয়করণ বন্ধ হলে কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবেন, কারণ দলীয়করণ বন্ধ হলে পদোন্নতির মানদণ্ড হবে দক্ষতা। কর্মকর্তাদের সুনামের সঙ্গে কাজের কোনো বিকল্প থাকবে না। যেকোনো বেসরকারি লোককে সচিব পদে নিয়োগ করা হলে প্রশাসন আরো ভেঙে পড়বে।
আউটসোর্সিং বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আইনের খসড়া আমি দেখিনি। উন্নত দেশে সাধারণত আউটসোর্সিং করা হয়। আউটসোর্সিংয়ে তৃতীয় একটি কম্পানি বা সংস্থাকে বলা হয় প্রয়োজনীয় লোকবল বা সেবা দেওয়ার জন্য। এটা মূলত শ্রমিক পর্যায়ে হয়ে থাকে। এখন সরকার কী ভাবছে, আমি জানি না।'
সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'পদাধিকারবলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীগণের মধ্যে প্রধান হইবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি জনপ্রশাসনের কর্মে দক্ষ ও সরকারের নিয়মিত সচিবগণের মধ্য হইতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করিবেন।' বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় সবচেয়ে সিনিয়র সচিবকে। নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী নিয়মিত সচিবদের মধ্যে থেকে যেকোনো সচিবকে সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করতে পারবে। এর ফলে কর্মকর্তাদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি বেড়ে যাবে বলে একজন সচিব জানিয়েছেন।
খসড়া আইনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবেরও একটি বিশিষ্ট স্থানের কথা বলা হয়েছে। এ বিশিষ্ট স্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আইনে এর ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করছেন। কর্মচারী আইনে মেধা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ, পেশাগত দক্ষতাকে পদোন্নতির মূল ভিত্তি ধরা হয়েছে। তবে পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষায় বসার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অথচ সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টে লিখিত পরীক্ষা দিয়েই পদোন্নতি পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। দলীয় সমর্থক জুনিয়র কর্মকর্তাদের বাধার মুখে এ আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। নতুন কর্মচারী আইনে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা না রাখায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, সিভিল সার্ভিস আইন করা হচ্ছিল বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রুল ১৯৮০ সালের আওতায় গঠিত বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের একটি আইনের আওতায় পরিচালনার উদ্দেশ্যে। এ আইনের খসড়া প্রণয়নকালে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের আপত্তি জানান। সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের খসড়ায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জন্য কোনো আইন ছিল না। 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২' প্রণয়নের মাধ্যমে প্রথম গ্রেড থেকে শুরু করে ২০তম গ্রেডের সব কর্মচারীকে একটি আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া এ আইনের ১৮ ধারার ২ উপধারার বিধি প্রণয়নের ক্ষমতায় বলা হয়েছে, 'বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা সংক্রান্ত বিশেষ বিধানাবলি প্রণয়ন করা হবে।' এ থেকে বোঝা যায়, সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের আর কোনো উপযোগিতা থাকে না।
পরামর্শ সভায় প্রকৃচির সমালোচনা
গতকাল রবিবার 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২' নিয়ে তিনটি কারিগরি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একটি পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর একটি হোটেলে প্রকৌশলী, কৃষি ও চিকিৎসক (প্রকৃচি) নেতাদের সঙ্গে এ পরামর্শ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন এইচ টি ইমাম, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় প্রকৃচির নেতারা আইন নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, বর্তমান প্রশাসন সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন। সরকারকে চাপে ফেলে পদোন্নতি নিয়েছেন কর্মকর্তারা। এই অসম পদোন্নতির ফলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যা পদ রয়েছে তার চেয়ে বাড়তি পদোন্নতি পেয়েছেন এক হাজার ১৯৬ জন। এটা বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। সভায় বিএমএ নেতা শাহ আলম বলেন, 'সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টেও আমাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তার প্রতিফলন ছিল না। অর্থাৎ আমাদের মতামত নেওয়া হলেও তা চূড়ান্ত খসড়ায় স্থান পায় না।' কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, পদোন্নতিতে সমতা থাকতে হবে। বর্তমানে ক্যাডার বৈষম্য বেশি। শামসুল হক কমিশনের প্রতিবেদনে গুচ্ছ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ ছিল যা আজকের কর্মচারী আইনে স্থান পায়নি। পিডাব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা সচিব হয়ে গেছেন। আর পূর্ত ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখনো মাঠপর্যায়েই রয়ে গেছেন। সভায় রাজউকের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা বলেন, সব ক্যাডারের গ্রেড এক এর পদ থাকতে হবে।
No comments