সরল গরল-শাস্তি দিচ্ছেন না কেন মাননীয় স্পিকার? by মিজানুর রহমান খান
বাংলাদেশের সংসদকক্ষে বাকস্বাধীনতার চরম অপব্যবহার চলছে। অনেকে ধরেই নিয়েছেন, সংসদের ফ্লোর যেন যা মুখে আসে তা-ই বলার এক স্বর্গরাজ্য। নারী সাংসদেরাও নারীত্বের অবমাননায় বেপরোয়া। শুধু দুই বড় দলের বিরোধের ক্ষেত্রেই নয়, ‘হাউস অব দ্য নেশন’-এর ফ্লোরে দাঁড়িয়ে ব্যক্তি বিদ্বেষ ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্ধ আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ
আমরা দেখেছি। ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে মানহানি ও চরিত্রহননের অপচেষ্টাও বিরল নয়। একটি খারাপ দৃষ্টান্তকে অতীতের আরেকটি খারাপ দৃষ্টান্তকে টেনে এনে জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়।
গত রোববার সংসদে দেওয়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই নারী সাংসদের অশালীন এবং অসংসদীয় বক্তব্য দণ্ডনীয়। সংবিধান বলছে সংসদের কার্যবিবরণীর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এটা নিঃশর্ত লাইসেন্স নয়। সংবিধান নৈতিকতা ও শালীনতাসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে হাউস অব কমন্স একই সঙ্গে আদালত ও সংসদের ভূমিকা পালন করত। ক্রমান্বয়ে সংসদ ও বিচার বিভাগ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এই মর্মে যে, সংসদে যা কিছুই বলা হোক, আদালত তার বিচার করতে পারবেন না। আদালতের হাত সংবিধান তাই খাটো করে দিয়েছে। কিন্তু আইনের সীমা লঙ্ঘনকারী সংসদ সদস্যদের শাস্তিদানে স্পিকারের হাত যথেষ্ট লম্বা রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে পার্লামেন্ট কোনো অবস্থাতেই বাকস্বাধীনতা খর্ব করে আইন তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু সেখানকার সংসদেও বাকস্বাধীনতায় লাগাম পরানো আছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ইতিহাসে এ পর্যন্ত পাঁচজন কংগ্রেসম্যানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের সংসদে অসংসদীয় ভাষা স্পিকার কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ বা বাদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সংসদ অশালীন, অবাঞ্ছিত এমনকি অশ্লীল বক্তব্য প্রদানের উন্মুক্ত মঞ্চে পরিণত হতে পারে। সে কারণেই আজ সময় এসেছে স্পিকারকে সংবিধান ও আইন নির্দেশিত ক্ষমতা প্রয়োগ করার।
সংসদকক্ষে কোনো সাংসদ গুরুতর বিশৃঙ্খল আচরণ করলে স্পিকার তাঁকে তাৎক্ষণিক বের করে দিতে পারেন। কিসে গুরুতর বিশৃঙ্খলা ঘটে তা নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা স্পিকারের। এ জন্য কোন সাংসদ কতক্ষণ ধরে সংসদে নিষিদ্ধ থাকবেন সে সময়টাও স্পিকার ঠিক করবেন। এখানে একটি চমকপ্রদ সংসদীয় রীতি রয়েছে। কারও অসদাচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে স্পিকার যদি তাঁর নাম উচ্চারণ করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। বিশ্বের অনেক আইনসভায় কারও নাম স্পিকার মুখে নেওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যকে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনা হয়। এবং সে প্রস্তাবটি কোনো আলোচনা ছাড়াই স্পিকার তাৎক্ষণিকভাবে ভোটে দিতে পারেন।
ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে অনুসৃত এই রীতিটি সম্পর্কে ব্রিটিশ সংসদ বিশেষজ্ঞ পল সিল্ক ও রোদ্রি ওয়াল্টার্স বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক আইনসভায় উত্তেজনা কখনো ফেটে পড়তে পারে। এ রকম অবস্থায় স্পিকারের ক্ষমতা রয়েছে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। হয় তিনি তাঁকে ওই দিনের জন্য বের করে দেবেন, আর অপরাধ গুরুতর হলে তিনি তাঁর নাম নেবেন। তিনি নাম নিলেই কোনো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ত্বরিত তাঁর বিরুদ্ধে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনবেন এবং তা নিশ্চিতভাবেই পাস হবে। কোনো উচ্ছৃঙ্খল সংসদ সদস্যের প্রথম অসদাচরণের ঘটনায় পাঁচ কার্যদিবস, দ্বিতীয় ঘটনায় ২০ কার্যদিবস এবং তৃতীয়বারের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কারাদেশ চলবে।’
বাংলাদেশে ফাঁক ও ফাঁকিটা এখানেই। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের যেসব দেশ সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসরণ করে থাকে, সেসব দেশে যেভাবে নির্বাচন করে, সেভাবে আগামী নির্বাচন হবে। কিন্তু বিশ্বের অপরাপর সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোর লিখিত সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সংবিধানটি একটি উদ্ভট, অদ্ভুত ও জবুথবু দলিল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। অন্যান্য সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে এর মিল নেই। অনেকেই বলবেন, সাত মণ তেল জুটবে না, রাধাও নাচবে না। কোনো বাংলাদেশি স্পিকার ক্ষমতাসীন দলের কারও নাম পারতপক্ষে নেবেন না। এবং তেমন অবস্থায় যাতে পড়তে না হয় সেজন্য তিনি আইন থেকে পালাবেন। তিনি ভালোমানুষ হতে চাইবেন। তিনি তাই বিরোধী দলেরও কারও নাম নেবেন না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাময়িক বহিষ্কারে স্পিকারের ক্ষমতার প্রয়োগ দাবি করেছেন। তিনি বিরোধীদলীয় সাংসদ রানুর শাস্তি চাইতে পারেন কিন্তু স্পিকার নিরপেক্ষ হতে পারলে উভয় দল থেকেই দোষী খুঁজে পাবেন।
এমন কিছু সময় আসে, যখন দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হয়। আর এ ধরনের একটি পদক্ষেপ পুরো সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক ধারার সূচনা ঘটাতে পারে।
স্পিকার যেসব অশালীন ও অসংসদীয় শব্দ কর্তন করেছেন তা লাইভ সংসদীয় টিভির কল্যাণে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব শুনেছে। সংসদীয় রীতি হচ্ছে স্পিকারের বাদ দেওয়া শব্দ গণমাধ্যমে সম্প্রচার হবে না। পত্রিকায় ছাপা হবে না। সংসদের কার্যবিবরণীতে মুদ্রিত হবে না। কিন্তু সে যুগ বাসী হয়ে গেছে। সংসদে টানা দুদিন যেভাবে ‘নিষিদ্ধ পল্লি’ কথাটি উচ্চারিত হলো, তাতে আশঙ্কা করা যায় এটাই শেষ ভীমরতি নয়।
বাংলাদেশের কার্যপ্রণালি বিধিতেও অসদাচরণের দায়ে সংসদ সদস্যের বহিষ্কারের বিধান আছে। সাংসদদের আচরণবিধি নেই। কিন্তু না থাকলেও স্পিকারই সর্বেসর্বা। স্পিকারের দ্বারা উল্লিখিত নাম নেওয়ার রীতি আমাদেরও আছে। কখনো প্রয়োগ হয়নি। বলা আছে, স্পিকার কোনো সদস্যের নাম নিলে তাঁকে সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘অধিবেশনের অনধিক অবশিষ্ট সময়ের জন্য’ বহিষ্কার করা যাবে। এ রকমভাবে বহিষ্কৃত কোনো সদস্যকে অবিলম্বে সংসদের সীমা ত্যাগ করতে হয়। তবে পরে এ রকম বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তাব আনা যায় এবং তা প্রত্যাহারও হতে পারে। অবশ্য কারও সংসদ সদস্য পদ স্থায়ীভাবে খারিজ করার বিধান নেই। এখানেও আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদীয় রাজনীতিকে বিকলাঙ্গ করে রাখার বিধানটি মনে রাখব।
উন্নত গণতন্ত্রেও অসদাচরণের দায়ে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের বিধান আছে। সংসদ এটা পারে কি না ভারতের দুটি হাইকোর্ট দুই রকম রায় দিয়েছেন। আমরা মনে করি পারে। বিংশ শতাব্দীতে হাউস অব কমন্সের তিনজন সদস্যকে স্পিকার বহিষ্কার করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সংসদীয় কমিটিতে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়ার জন্য লেবারদলীয় গ্যারি হ্যালিঘানকে বহিষ্কৃত হন। ভারত সেই ১৯৫১ সালেই সাংসদ বহিষ্কারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিচার বিভাগকে বাধাগ্রস্ত ও মিথ্যা মামলা দায়েরের কারণে ১৯৭৭ সালে লোকসভা ইন্দিরা গান্ধীকে বহিষ্কার করেছিল। ২০০৫ সালে টাকা খেয়ে প্রশ্ন করার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ১১ সাংসদকে রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পাকিস্তানে সম্পদের বিবরণী দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীসহ দুই শতাধিক সাংসদের পদ স্থগিত করা হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে সাংসদেরা এক অপরিসীম দায়মুক্তির বৃত্ত গড়ে তুলেছেন। এঁদের কিছুতেই কিচ্ছুটি হয় না। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সংসদের চুপ থাকা রহস্যজনক। সন্দেহ হয়, দায়মুক্তির সংস্কৃতি রক্ষার একটা আঁতাত আছে দুই দলের মধ্যে। এখন আইনকে চলতে দিলে, পরে আইন প্রয়োগকারীর বিরুদ্ধেও চলতে পারে। বাংলাদেশ তো সব অসম্ভবের দেশ। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের হম্বিতম্বি সীমিত থেকে যায়।
স্পিকার আবদুল হামিদ ১৯ মার্চ হাতুড়ি পিটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কিন্তু তিনি বিএনপির আসিফা আশরাফির বক্তব্যের পর বলেছেন, ‘নিষিদ্ধ পল্লির ব্যাপারে যেসব কথা হয়েছে তা শোভন নয়। আমি তো বলতে পারি না কার নিষিদ্ধ পল্লির অভিজ্ঞতা আছে। তবে তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত আপনাদেরই করতে হবে।’
আমরা তাঁর এ মন্তব্যে অস্বস্তির মধ্যে আছি। স্পিকার আরও বলেছেন, ‘আমি বিরোধীদলীয় চিফ হুইফকে বলেছিলাম আলোচনার জন্য কিছু সিনিয়র নেতাদের নাম দিতে।’ এটা হাসির উদ্রেক ঘটাতে পারে। কারণ, সিনিয়র নেতারা কি সব সময় সংসদীয় ও শালীন ভাষায় কথা বলেন? অনেক সময় তাঁরাই তো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেন।
অসংসদীয় শব্দভান্ডার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন রাখার মূল দায়িত্ব স্পিকারের। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বহু সংসদের অসংসদীয় ভাষার ওপর গাইডলাইন রয়েছে। ২০০৪ সালে অসংসদীয় শব্দ চিহ্নিত করে ভারতীয় লোকসভার স্পিকার ৯০০ পৃষ্ঠার একটি বই বের করেছেন। এ রকম একটা উদ্যোগ আমরাও আশা করি। বিরোধী দল রাষ্ট্রপতিকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলেছে। স্পিকার শব্দটিকে অসংসদীয় বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর উদ্যোগ নিরপেক্ষ, কার্যকর ও অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে যখন মানুষ দেখবে, অনুপস্থিত বিরোধী দলের উদ্দেশে সরকারি দলের যা খুশি শব্দ উচ্চারণে লাগাম পরাতে তিনি সমগুরুত্বে স্পর্শকাতর। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ২০ মার্চের দীর্ঘতম বক্তৃতায় ‘সংসদকে মাছের বাজার ও গালাগালির আখড়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, ‘বিএনপি না থাকলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা গালাগালি করেন।’ স্পিকার এই অভিযোগ খণ্ডন করেননি। তবে মাঝেমধ্যে তাঁকে আমরা সরকারি দলের বল্গাহীন বক্তব্যের রাশ টানতে দেখি। ১৮ মার্চে রানুর অশালীন মন্তব্য শুনে বিরোধী দলের নেতা টেবিল চাপড়িয়েছিলেন। দুদিন পরে তিনি যেন কৈফিয়ত দিলেন। বললেন, সংসদে মন্ত্রীদের গালাগালি শুনে নতুনরা শিখছে। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বেগম জিয়ার উদ্দেশে ‘কোলে চড়া’ সংক্রান্ত অনৈতিক মন্তব্য করেন। এর আইনি প্রতিকার বিএনপিকে খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু বেআইনিভাবে তারা সংসদের অপব্যবহার করতে পারে না।
মাননীয় স্পিকারকে কাজটা শুরু করতে হবে। কিছু বিতর্ক হয়তো হবে। আমরা সমাজে অনেক সময়ই দেখি, অনেক অনাচারের প্রতিকারের আইনানুগ উদ্যোগ নেওয়া হয় না, অভিযুক্তের প্রতি অনুকম্পাজনিত কারণে নয়। বরং তা এই আশঙ্কায়ও যে, তাহলে দ্রুত কথা উঠবে। বলা হবে নিকট অতীতে যিনি শুরু করেছিলেন তখন স্পিকার কেন ভূমিকা পালন করেননি। আমরা স্পিকারের তরফে এই ধরনের নির্লিপ্ততা আশা করি না।
ভারতীয় সংসদ বিশেষজ্ঞ কাউল ও শাকধার ১৯৫৮ সালে দেওয়া উড়িষ্যা হাইকোর্টের বরাতে লিখেছেন, বাকস্বাধীনতার সীমা সংসদকক্ষে লঙ্ঘিত হলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হবে সেটা নির্ধারণে স্পিকারের ক্ষমতা রয়েছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অপর এক রায়ে বলা আছে, স্পিকার যদি সংসদের শৃঙ্খলা রক্ষায় কোনো প্রক্রিয়াগত ভুল পদক্ষেপও নেন, তাহলেও আদালত বা অন্য কারও হাত নেই তা খতিয়ে দেখার। পাশ্চাত্যে ‘দুর্বৃত্ত’ এমপিদের সংসদে নিষিদ্ধ করা হয়। আমাদের স্পিকারও যাতে সেটা পারেন সেই সামর্থ্য তাঁকে অর্জন করতে হবে। বেগম জিয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে স্পিকার তাঁর বারোটা বাজার শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন সংসদের পরিবেশের বারোটা বাজানোয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
গত রোববার সংসদে দেওয়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই নারী সাংসদের অশালীন এবং অসংসদীয় বক্তব্য দণ্ডনীয়। সংবিধান বলছে সংসদের কার্যবিবরণীর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এটা নিঃশর্ত লাইসেন্স নয়। সংবিধান নৈতিকতা ও শালীনতাসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে হাউস অব কমন্স একই সঙ্গে আদালত ও সংসদের ভূমিকা পালন করত। ক্রমান্বয়ে সংসদ ও বিচার বিভাগ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এই মর্মে যে, সংসদে যা কিছুই বলা হোক, আদালত তার বিচার করতে পারবেন না। আদালতের হাত সংবিধান তাই খাটো করে দিয়েছে। কিন্তু আইনের সীমা লঙ্ঘনকারী সংসদ সদস্যদের শাস্তিদানে স্পিকারের হাত যথেষ্ট লম্বা রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে পার্লামেন্ট কোনো অবস্থাতেই বাকস্বাধীনতা খর্ব করে আইন তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু সেখানকার সংসদেও বাকস্বাধীনতায় লাগাম পরানো আছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ইতিহাসে এ পর্যন্ত পাঁচজন কংগ্রেসম্যানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের সংসদে অসংসদীয় ভাষা স্পিকার কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ বা বাদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সংসদ অশালীন, অবাঞ্ছিত এমনকি অশ্লীল বক্তব্য প্রদানের উন্মুক্ত মঞ্চে পরিণত হতে পারে। সে কারণেই আজ সময় এসেছে স্পিকারকে সংবিধান ও আইন নির্দেশিত ক্ষমতা প্রয়োগ করার।
সংসদকক্ষে কোনো সাংসদ গুরুতর বিশৃঙ্খল আচরণ করলে স্পিকার তাঁকে তাৎক্ষণিক বের করে দিতে পারেন। কিসে গুরুতর বিশৃঙ্খলা ঘটে তা নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা স্পিকারের। এ জন্য কোন সাংসদ কতক্ষণ ধরে সংসদে নিষিদ্ধ থাকবেন সে সময়টাও স্পিকার ঠিক করবেন। এখানে একটি চমকপ্রদ সংসদীয় রীতি রয়েছে। কারও অসদাচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে স্পিকার যদি তাঁর নাম উচ্চারণ করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। বিশ্বের অনেক আইনসভায় কারও নাম স্পিকার মুখে নেওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যকে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনা হয়। এবং সে প্রস্তাবটি কোনো আলোচনা ছাড়াই স্পিকার তাৎক্ষণিকভাবে ভোটে দিতে পারেন।
ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে অনুসৃত এই রীতিটি সম্পর্কে ব্রিটিশ সংসদ বিশেষজ্ঞ পল সিল্ক ও রোদ্রি ওয়াল্টার্স বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক আইনসভায় উত্তেজনা কখনো ফেটে পড়তে পারে। এ রকম অবস্থায় স্পিকারের ক্ষমতা রয়েছে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। হয় তিনি তাঁকে ওই দিনের জন্য বের করে দেবেন, আর অপরাধ গুরুতর হলে তিনি তাঁর নাম নেবেন। তিনি নাম নিলেই কোনো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ত্বরিত তাঁর বিরুদ্ধে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনবেন এবং তা নিশ্চিতভাবেই পাস হবে। কোনো উচ্ছৃঙ্খল সংসদ সদস্যের প্রথম অসদাচরণের ঘটনায় পাঁচ কার্যদিবস, দ্বিতীয় ঘটনায় ২০ কার্যদিবস এবং তৃতীয়বারের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কারাদেশ চলবে।’
বাংলাদেশে ফাঁক ও ফাঁকিটা এখানেই। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের যেসব দেশ সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসরণ করে থাকে, সেসব দেশে যেভাবে নির্বাচন করে, সেভাবে আগামী নির্বাচন হবে। কিন্তু বিশ্বের অপরাপর সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোর লিখিত সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সংবিধানটি একটি উদ্ভট, অদ্ভুত ও জবুথবু দলিল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। অন্যান্য সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে এর মিল নেই। অনেকেই বলবেন, সাত মণ তেল জুটবে না, রাধাও নাচবে না। কোনো বাংলাদেশি স্পিকার ক্ষমতাসীন দলের কারও নাম পারতপক্ষে নেবেন না। এবং তেমন অবস্থায় যাতে পড়তে না হয় সেজন্য তিনি আইন থেকে পালাবেন। তিনি ভালোমানুষ হতে চাইবেন। তিনি তাই বিরোধী দলেরও কারও নাম নেবেন না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাময়িক বহিষ্কারে স্পিকারের ক্ষমতার প্রয়োগ দাবি করেছেন। তিনি বিরোধীদলীয় সাংসদ রানুর শাস্তি চাইতে পারেন কিন্তু স্পিকার নিরপেক্ষ হতে পারলে উভয় দল থেকেই দোষী খুঁজে পাবেন।
এমন কিছু সময় আসে, যখন দায়িত্বশীল ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হয়। আর এ ধরনের একটি পদক্ষেপ পুরো সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক ধারার সূচনা ঘটাতে পারে।
স্পিকার যেসব অশালীন ও অসংসদীয় শব্দ কর্তন করেছেন তা লাইভ সংসদীয় টিভির কল্যাণে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব শুনেছে। সংসদীয় রীতি হচ্ছে স্পিকারের বাদ দেওয়া শব্দ গণমাধ্যমে সম্প্রচার হবে না। পত্রিকায় ছাপা হবে না। সংসদের কার্যবিবরণীতে মুদ্রিত হবে না। কিন্তু সে যুগ বাসী হয়ে গেছে। সংসদে টানা দুদিন যেভাবে ‘নিষিদ্ধ পল্লি’ কথাটি উচ্চারিত হলো, তাতে আশঙ্কা করা যায় এটাই শেষ ভীমরতি নয়।
বাংলাদেশের কার্যপ্রণালি বিধিতেও অসদাচরণের দায়ে সংসদ সদস্যের বহিষ্কারের বিধান আছে। সাংসদদের আচরণবিধি নেই। কিন্তু না থাকলেও স্পিকারই সর্বেসর্বা। স্পিকারের দ্বারা উল্লিখিত নাম নেওয়ার রীতি আমাদেরও আছে। কখনো প্রয়োগ হয়নি। বলা আছে, স্পিকার কোনো সদস্যের নাম নিলে তাঁকে সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘অধিবেশনের অনধিক অবশিষ্ট সময়ের জন্য’ বহিষ্কার করা যাবে। এ রকমভাবে বহিষ্কৃত কোনো সদস্যকে অবিলম্বে সংসদের সীমা ত্যাগ করতে হয়। তবে পরে এ রকম বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তাব আনা যায় এবং তা প্রত্যাহারও হতে পারে। অবশ্য কারও সংসদ সদস্য পদ স্থায়ীভাবে খারিজ করার বিধান নেই। এখানেও আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদীয় রাজনীতিকে বিকলাঙ্গ করে রাখার বিধানটি মনে রাখব।
উন্নত গণতন্ত্রেও অসদাচরণের দায়ে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের বিধান আছে। সংসদ এটা পারে কি না ভারতের দুটি হাইকোর্ট দুই রকম রায় দিয়েছেন। আমরা মনে করি পারে। বিংশ শতাব্দীতে হাউস অব কমন্সের তিনজন সদস্যকে স্পিকার বহিষ্কার করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সংসদীয় কমিটিতে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়ার জন্য লেবারদলীয় গ্যারি হ্যালিঘানকে বহিষ্কৃত হন। ভারত সেই ১৯৫১ সালেই সাংসদ বহিষ্কারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিচার বিভাগকে বাধাগ্রস্ত ও মিথ্যা মামলা দায়েরের কারণে ১৯৭৭ সালে লোকসভা ইন্দিরা গান্ধীকে বহিষ্কার করেছিল। ২০০৫ সালে টাকা খেয়ে প্রশ্ন করার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ১১ সাংসদকে রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পাকিস্তানে সম্পদের বিবরণী দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীসহ দুই শতাধিক সাংসদের পদ স্থগিত করা হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে সাংসদেরা এক অপরিসীম দায়মুক্তির বৃত্ত গড়ে তুলেছেন। এঁদের কিছুতেই কিচ্ছুটি হয় না। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সংসদের চুপ থাকা রহস্যজনক। সন্দেহ হয়, দায়মুক্তির সংস্কৃতি রক্ষার একটা আঁতাত আছে দুই দলের মধ্যে। এখন আইনকে চলতে দিলে, পরে আইন প্রয়োগকারীর বিরুদ্ধেও চলতে পারে। বাংলাদেশ তো সব অসম্ভবের দেশ। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের হম্বিতম্বি সীমিত থেকে যায়।
স্পিকার আবদুল হামিদ ১৯ মার্চ হাতুড়ি পিটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। কিন্তু তিনি বিএনপির আসিফা আশরাফির বক্তব্যের পর বলেছেন, ‘নিষিদ্ধ পল্লির ব্যাপারে যেসব কথা হয়েছে তা শোভন নয়। আমি তো বলতে পারি না কার নিষিদ্ধ পল্লির অভিজ্ঞতা আছে। তবে তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত আপনাদেরই করতে হবে।’
আমরা তাঁর এ মন্তব্যে অস্বস্তির মধ্যে আছি। স্পিকার আরও বলেছেন, ‘আমি বিরোধীদলীয় চিফ হুইফকে বলেছিলাম আলোচনার জন্য কিছু সিনিয়র নেতাদের নাম দিতে।’ এটা হাসির উদ্রেক ঘটাতে পারে। কারণ, সিনিয়র নেতারা কি সব সময় সংসদীয় ও শালীন ভাষায় কথা বলেন? অনেক সময় তাঁরাই তো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেন।
অসংসদীয় শব্দভান্ডার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন রাখার মূল দায়িত্ব স্পিকারের। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বহু সংসদের অসংসদীয় ভাষার ওপর গাইডলাইন রয়েছে। ২০০৪ সালে অসংসদীয় শব্দ চিহ্নিত করে ভারতীয় লোকসভার স্পিকার ৯০০ পৃষ্ঠার একটি বই বের করেছেন। এ রকম একটা উদ্যোগ আমরাও আশা করি। বিরোধী দল রাষ্ট্রপতিকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ বলেছে। স্পিকার শব্দটিকে অসংসদীয় বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর উদ্যোগ নিরপেক্ষ, কার্যকর ও অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে যখন মানুষ দেখবে, অনুপস্থিত বিরোধী দলের উদ্দেশে সরকারি দলের যা খুশি শব্দ উচ্চারণে লাগাম পরাতে তিনি সমগুরুত্বে স্পর্শকাতর। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ২০ মার্চের দীর্ঘতম বক্তৃতায় ‘সংসদকে মাছের বাজার ও গালাগালির আখড়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, ‘বিএনপি না থাকলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা গালাগালি করেন।’ স্পিকার এই অভিযোগ খণ্ডন করেননি। তবে মাঝেমধ্যে তাঁকে আমরা সরকারি দলের বল্গাহীন বক্তব্যের রাশ টানতে দেখি। ১৮ মার্চে রানুর অশালীন মন্তব্য শুনে বিরোধী দলের নেতা টেবিল চাপড়িয়েছিলেন। দুদিন পরে তিনি যেন কৈফিয়ত দিলেন। বললেন, সংসদে মন্ত্রীদের গালাগালি শুনে নতুনরা শিখছে। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বেগম জিয়ার উদ্দেশে ‘কোলে চড়া’ সংক্রান্ত অনৈতিক মন্তব্য করেন। এর আইনি প্রতিকার বিএনপিকে খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু বেআইনিভাবে তারা সংসদের অপব্যবহার করতে পারে না।
মাননীয় স্পিকারকে কাজটা শুরু করতে হবে। কিছু বিতর্ক হয়তো হবে। আমরা সমাজে অনেক সময়ই দেখি, অনেক অনাচারের প্রতিকারের আইনানুগ উদ্যোগ নেওয়া হয় না, অভিযুক্তের প্রতি অনুকম্পাজনিত কারণে নয়। বরং তা এই আশঙ্কায়ও যে, তাহলে দ্রুত কথা উঠবে। বলা হবে নিকট অতীতে যিনি শুরু করেছিলেন তখন স্পিকার কেন ভূমিকা পালন করেননি। আমরা স্পিকারের তরফে এই ধরনের নির্লিপ্ততা আশা করি না।
ভারতীয় সংসদ বিশেষজ্ঞ কাউল ও শাকধার ১৯৫৮ সালে দেওয়া উড়িষ্যা হাইকোর্টের বরাতে লিখেছেন, বাকস্বাধীনতার সীমা সংসদকক্ষে লঙ্ঘিত হলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হবে সেটা নির্ধারণে স্পিকারের ক্ষমতা রয়েছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অপর এক রায়ে বলা আছে, স্পিকার যদি সংসদের শৃঙ্খলা রক্ষায় কোনো প্রক্রিয়াগত ভুল পদক্ষেপও নেন, তাহলেও আদালত বা অন্য কারও হাত নেই তা খতিয়ে দেখার। পাশ্চাত্যে ‘দুর্বৃত্ত’ এমপিদের সংসদে নিষিদ্ধ করা হয়। আমাদের স্পিকারও যাতে সেটা পারেন সেই সামর্থ্য তাঁকে অর্জন করতে হবে। বেগম জিয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে স্পিকার তাঁর বারোটা বাজার শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন সংসদের পরিবেশের বারোটা বাজানোয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments