একজন এএসপির বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ by কাজী আনিছ
বরিশাল রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবুল কালাম আজাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এক নারী ও তাঁর আগের স্বামীর পরিবার। পুলিশের উচ্চপর্যায়ে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি ওই নারী। শেষমেশ আদালতে মামলা করতে হয়েছে তাঁকে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্রে স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করা, প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন করা, নির্যাতন, অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এবং এরপর মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ওই নারীর আগের স্বামী জাকির হোসাইনের অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা দিয়ে বাসায় বারবার পুলিশ পাঠানোর কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এতে বাসায় তালাবদ্ধ অবস্থায় অমানবিক দিন কাটাচ্ছে তাঁর দুই শিশুপুত্র।
সম্প্রতি প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক নারী ফোন করে তালাবদ্ধ বাসায় দুই শিশুর বসবাসের কথা জানান। সে সূত্রে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় এসব তথ্য। পরে পৃথক দুই দিনে জাকির হোসাইন ও তাঁর সাবেক স্ত্রী আনোয়ার-ই তাসলিমা প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন। তাঁরা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তোলেন।
ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন তাসলিমা। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট জাকিরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাসলিমা জানান, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিরপুরের সেনপাড়ায় থাকতেন। সেখানেই জন্ম হয় দুই সন্তান ইবনে ইফতেখায়রুল হোসাইন (৭) ও তানভীর হোসাইনের (৩)। স্বামী-স্ত্রীর চাকরির টাকায় তাঁর (তাসলিমা) নামে মিরপুর ও উত্তরায় জায়গা কিনে দুটি বাড়ি করেন জাকির। পরে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন তাসলিমা।
তাসলিমা জানান, একপর্যায়ে স্বামী জাকির তাঁকে শেয়ার ব্যবসা করার জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা দেন। এরই মধ্যে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে ফেসবুকে এএসপি আজাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সে সূত্রে আজাদ তাঁর সব জেনে নেন। তাসলিমার অভিযোগ, কিছুদিন যেতে না-যেতেই জাকিরকে তালাক দিয়ে তাঁকে (এএসপি) বিয়ে করার জন্য চাপ দেন আজাদ। অন্যথায় আত্মহত্যা করে ফাঁসিয়ে দেওয়া, জাকিরকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, বাচ্চাদের অপহরণ করাসহ বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকেন। তাঁকে তালাক দিতে তাঁর স্বামীকেও চাপ দেন এএসপি আজাদ।
২০১০ সালের নভেম্বরে জাকিরকে তালাক দিতে বাধ্য হন বলে দাবি করেন তাসলিমা। তারপর দুই সন্তান নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠেন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা কাজি অফিসে নিয়ে আজাদ তাঁকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আজাদের চাপে দুই সন্তানকে তিনি জাকিরের কাছে পাঠিয়ে দেন।
তাসলিমার অভিযোগ, বিয়ের পর চাপ দিয়ে আট লাখ টাকা নিয়ে নেন আজাদ। এরপর তাঁর নামে থাকা দুটি বাড়ির একটি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। শুরু হয় নির্যাতন। আজাদের সঙ্গে যুক্ত হন তাঁর ভাই মঞ্জুরুল আলম, বাবলুসহ কয়েকজন। তাসলিমা দাবি করেন, গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বাবলু, স্থানীয় সন্ত্রাসী সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজন তাঁকে সেনপাড়ার কেয়ারি মুনের গলির একটি মাদ্রাসায় আটকে তাঁর জামাকাপড় ছিঁড়ে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করে। তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে। রাজি না হলে তারা তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় নিয়ে নির্যাতন করে।
তাসলিমা বলেন, ওই দিন মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে যান তাঁর ভাই। ডিসি আগে তাঁকে (তাসলিমা) চিকিৎসা করাতে পরামর্শ দেন এবং বলেন, পরে মামলা নেওয়া যাবে। চিকিৎসার পর তাসলিমা কাফরুল থানায় গেলে পুলিশ আর মামলা নেয়নি। বিষয়টি জানাতে ডিসির মুঠোফোনে কল করেন, কয়েকটি খুদে বার্তাও পাঠান। ডিসি সাড়া দেননি।
ডিসি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আসলে অপহরণের বিষয়ে যেভাবে বলা হচ্ছে, তা ঠিক ওইভাবে নয়। শুনেছি, স্বামী তালাক দিতে চাচ্ছিল আর স্ত্রী এতে রাজি না হওয়ার ফলে ঘটনা ঘটেছে। তার পরও দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’
তাসলিমা জানান, গত জানুয়ারি মাসে তিনি আদালতে এএসপি আজাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেন। নারী নির্যাতন মামলায় ১ ফেব্রুয়ারি এএসপি আজাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। অপহরণ মামলাটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। অপর মামলায় সমন জারি করা হয়।
তাসলিমার আগের স্বামী জাকির হোসাইন বলেন, ‘এএসপি আজাদের হুমকির কারণেই তাসলিমা আমাকে ছেড়ে যায়। গত বছরের জুলাই মাসে তাঁরা আমার দুই সন্তানকে ফেরত পাঠান। ১৪ ডিসেম্বর তাসলিমাকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কয়েকজন সাংবাদিকসহ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। এরপর আজাদ ও তাঁর লোকজন আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে। ২৮ ডিসেম্বর পিরোজপুরে আজাদের ভাই মঞ্জুরুল আলম তাসলিমা, তার বাবা, ভাই ও আমার বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা করে। এরপর কাফরুল থানার পুলিশ বারবার বাসায় হানা দিতে থাকে। এখন আমি দুই সন্তানকে ঘরে তালাবন্দী করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এক মহিলাকে বাসার চাবি দিয়ে সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি এখন সুযোগমতো বাসায় ঢুকে বাচ্চাদের খাবার-দাবার দিচ্ছেন।’
জাকির বলেন, ‘আমার বড় ছেলে ইফতেখায়রুল মিরপুরের একটি স্কুলে পড়ত। ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার পর তাকে আর স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি। কারণ, সন্তানদেরও অপহরণের হুমকি দিচ্ছেন আজাদ।’
তাসলিমা বলেন, ‘বিচার চেয়ে আমি প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু আজাদ পুলিশ হওয়ায় প্রশাসন কিছুই করেনি।’ তাসলিমার অভিযোগ, তাঁর করা অপহরণের মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউর রহমান। তিনি মামলার সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে আতাউর রহমান বলেন, ‘তদন্ত চলছে।’ তাসলিমার মামলাটি কি ভুয়া—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কিছুটা সত্যতা আছে।’
জাকির বলেন, তাঁর ঘর ভাঙার আগে আজাদের বিরুদ্ধে তিনি কাফরুল থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন। থানা তা নেয়নি।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তাসলিমা বলেন, ‘আজাদের নির্যাতনের বিষয়ে আমি বরিশালের ডিআইজির কাছে আবেদন করেছিলাম। পরে তাঁর অনুরোধে তা প্রত্যাহার করি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’
তাসলিমা বলেন, ‘আমি এখন ভয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে পারি না। গত ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে হুমকি দেয় এএসপি আজাদের ভাই মঞ্জুরুল আলমসহ কয়েকজন। কোতোয়ালি থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি আবদুর রহিম বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে তাসলিমা আমার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সেটি প্রত্যাহার করে নেন। আমি কোনো অনুরোধ করিনি।’
আগের বিয়ে গোপন, কাজির জিডি: ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাটিকাটা এলাকার কাজি মো. হানিফ বলেন, ‘গত বছরের ১ জুলাই আবুল কালাম আজাদ ও তাসলিমা বিয়ে করতে এসেছিলেন। আজাদকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বিবাহিত কি না। তিনি “না” বলেন। তাসলিমা নিজেকে তালাকপ্রাপ্ত বলেন। এর কিছুদিন পর আজাদের লোকজন এসে “দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতি”র একটি কাগজ দেয়। তা গ্রহণ করা সম্ভব নয় বললে আমাকে হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে আমি তা নেই।’ কাজি বলেন, ‘তবে প্রথম বিয়ে গোপন করার বিষয়টি আমি নিকাহনামায় উল্লেখ করেছি। এরপর তারা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।’ এ বিষয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি জিডি করা হয়েছে।
আজাদ যা বলেন: এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এএসপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ফেইসবুকে পরিচয় হইছিল। পরে তাকে বিয়ে করছি। গত ২ ডিসেম্বর তালাক দিছি।’ প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে কিছু খাইয়ে বশ করছিল। পরে আবার ছেড়ে দিছি।’ জাকিরকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘জাকিরকে আমি চিনি না। তার বাচ্চারা কোথায় কীভাবে থাকে, তা-ও আমার দেখার বিষয় না।’
জাকিরকে না চেনার পরও মামলায় কেন আসামি করা হলো জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘ওটা আমার ভাইয়ের ব্যাপার।’ জাকিরকে সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দিচ্ছেন—এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এএসপি বলেন, ‘জাকির নিজেই তো একজন সন্ত্রাসী।’ একটু আগে বললেন তাঁকে চেনেন না, তাহলে কীভাবে জানলেন সন্ত্রাসী? আজাদের উত্তর, ‘বিয়ের পর চিনছি। তাসলিমা তখন অবিবাহিত বলছিল।’ নিকাহনামায় তো তাসলিমা নিজেকে তালাকপ্রাপ্ত উল্লেখ করেছিলেন। আজাদের উত্তর, ‘জানি না।’
তালাকের বিষয়ে জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, ‘আমি কোনো তালাক নোটিশ পাইনি।’
সম্প্রতি প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক নারী ফোন করে তালাবদ্ধ বাসায় দুই শিশুর বসবাসের কথা জানান। সে সূত্রে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় এসব তথ্য। পরে পৃথক দুই দিনে জাকির হোসাইন ও তাঁর সাবেক স্ত্রী আনোয়ার-ই তাসলিমা প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন। তাঁরা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ তোলেন।
ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন তাসলিমা। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট জাকিরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাসলিমা জানান, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিরপুরের সেনপাড়ায় থাকতেন। সেখানেই জন্ম হয় দুই সন্তান ইবনে ইফতেখায়রুল হোসাইন (৭) ও তানভীর হোসাইনের (৩)। স্বামী-স্ত্রীর চাকরির টাকায় তাঁর (তাসলিমা) নামে মিরপুর ও উত্তরায় জায়গা কিনে দুটি বাড়ি করেন জাকির। পরে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন তাসলিমা।
তাসলিমা জানান, একপর্যায়ে স্বামী জাকির তাঁকে শেয়ার ব্যবসা করার জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা দেন। এরই মধ্যে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে ফেসবুকে এএসপি আজাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সে সূত্রে আজাদ তাঁর সব জেনে নেন। তাসলিমার অভিযোগ, কিছুদিন যেতে না-যেতেই জাকিরকে তালাক দিয়ে তাঁকে (এএসপি) বিয়ে করার জন্য চাপ দেন আজাদ। অন্যথায় আত্মহত্যা করে ফাঁসিয়ে দেওয়া, জাকিরকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, বাচ্চাদের অপহরণ করাসহ বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকেন। তাঁকে তালাক দিতে তাঁর স্বামীকেও চাপ দেন এএসপি আজাদ।
২০১০ সালের নভেম্বরে জাকিরকে তালাক দিতে বাধ্য হন বলে দাবি করেন তাসলিমা। তারপর দুই সন্তান নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠেন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা কাজি অফিসে নিয়ে আজাদ তাঁকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আজাদের চাপে দুই সন্তানকে তিনি জাকিরের কাছে পাঠিয়ে দেন।
তাসলিমার অভিযোগ, বিয়ের পর চাপ দিয়ে আট লাখ টাকা নিয়ে নেন আজাদ। এরপর তাঁর নামে থাকা দুটি বাড়ির একটি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। শুরু হয় নির্যাতন। আজাদের সঙ্গে যুক্ত হন তাঁর ভাই মঞ্জুরুল আলম, বাবলুসহ কয়েকজন। তাসলিমা দাবি করেন, গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বাবলু, স্থানীয় সন্ত্রাসী সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজন তাঁকে সেনপাড়ার কেয়ারি মুনের গলির একটি মাদ্রাসায় আটকে তাঁর জামাকাপড় ছিঁড়ে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করে। তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে। রাজি না হলে তারা তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় নিয়ে নির্যাতন করে।
তাসলিমা বলেন, ওই দিন মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে যান তাঁর ভাই। ডিসি আগে তাঁকে (তাসলিমা) চিকিৎসা করাতে পরামর্শ দেন এবং বলেন, পরে মামলা নেওয়া যাবে। চিকিৎসার পর তাসলিমা কাফরুল থানায় গেলে পুলিশ আর মামলা নেয়নি। বিষয়টি জানাতে ডিসির মুঠোফোনে কল করেন, কয়েকটি খুদে বার্তাও পাঠান। ডিসি সাড়া দেননি।
ডিসি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আসলে অপহরণের বিষয়ে যেভাবে বলা হচ্ছে, তা ঠিক ওইভাবে নয়। শুনেছি, স্বামী তালাক দিতে চাচ্ছিল আর স্ত্রী এতে রাজি না হওয়ার ফলে ঘটনা ঘটেছে। তার পরও দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’
তাসলিমা জানান, গত জানুয়ারি মাসে তিনি আদালতে এএসপি আজাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেন। নারী নির্যাতন মামলায় ১ ফেব্রুয়ারি এএসপি আজাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। অপহরণ মামলাটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। অপর মামলায় সমন জারি করা হয়।
তাসলিমার আগের স্বামী জাকির হোসাইন বলেন, ‘এএসপি আজাদের হুমকির কারণেই তাসলিমা আমাকে ছেড়ে যায়। গত বছরের জুলাই মাসে তাঁরা আমার দুই সন্তানকে ফেরত পাঠান। ১৪ ডিসেম্বর তাসলিমাকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কয়েকজন সাংবাদিকসহ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। এরপর আজাদ ও তাঁর লোকজন আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে। ২৮ ডিসেম্বর পিরোজপুরে আজাদের ভাই মঞ্জুরুল আলম তাসলিমা, তার বাবা, ভাই ও আমার বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা করে। এরপর কাফরুল থানার পুলিশ বারবার বাসায় হানা দিতে থাকে। এখন আমি দুই সন্তানকে ঘরে তালাবন্দী করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এক মহিলাকে বাসার চাবি দিয়ে সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি এখন সুযোগমতো বাসায় ঢুকে বাচ্চাদের খাবার-দাবার দিচ্ছেন।’
জাকির বলেন, ‘আমার বড় ছেলে ইফতেখায়রুল মিরপুরের একটি স্কুলে পড়ত। ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার পর তাকে আর স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি। কারণ, সন্তানদেরও অপহরণের হুমকি দিচ্ছেন আজাদ।’
তাসলিমা বলেন, ‘বিচার চেয়ে আমি প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু আজাদ পুলিশ হওয়ায় প্রশাসন কিছুই করেনি।’ তাসলিমার অভিযোগ, তাঁর করা অপহরণের মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউর রহমান। তিনি মামলার সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে আতাউর রহমান বলেন, ‘তদন্ত চলছে।’ তাসলিমার মামলাটি কি ভুয়া—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কিছুটা সত্যতা আছে।’
জাকির বলেন, তাঁর ঘর ভাঙার আগে আজাদের বিরুদ্ধে তিনি কাফরুল থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন। থানা তা নেয়নি।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তাসলিমা বলেন, ‘আজাদের নির্যাতনের বিষয়ে আমি বরিশালের ডিআইজির কাছে আবেদন করেছিলাম। পরে তাঁর অনুরোধে তা প্রত্যাহার করি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’
তাসলিমা বলেন, ‘আমি এখন ভয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে পারি না। গত ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে হুমকি দেয় এএসপি আজাদের ভাই মঞ্জুরুল আলমসহ কয়েকজন। কোতোয়ালি থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি আবদুর রহিম বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে তাসলিমা আমার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সেটি প্রত্যাহার করে নেন। আমি কোনো অনুরোধ করিনি।’
আগের বিয়ে গোপন, কাজির জিডি: ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাটিকাটা এলাকার কাজি মো. হানিফ বলেন, ‘গত বছরের ১ জুলাই আবুল কালাম আজাদ ও তাসলিমা বিয়ে করতে এসেছিলেন। আজাদকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বিবাহিত কি না। তিনি “না” বলেন। তাসলিমা নিজেকে তালাকপ্রাপ্ত বলেন। এর কিছুদিন পর আজাদের লোকজন এসে “দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতি”র একটি কাগজ দেয়। তা গ্রহণ করা সম্ভব নয় বললে আমাকে হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে আমি তা নেই।’ কাজি বলেন, ‘তবে প্রথম বিয়ে গোপন করার বিষয়টি আমি নিকাহনামায় উল্লেখ করেছি। এরপর তারা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।’ এ বিষয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি জিডি করা হয়েছে।
আজাদ যা বলেন: এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এএসপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ফেইসবুকে পরিচয় হইছিল। পরে তাকে বিয়ে করছি। গত ২ ডিসেম্বর তালাক দিছি।’ প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে কিছু খাইয়ে বশ করছিল। পরে আবার ছেড়ে দিছি।’ জাকিরকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘জাকিরকে আমি চিনি না। তার বাচ্চারা কোথায় কীভাবে থাকে, তা-ও আমার দেখার বিষয় না।’
জাকিরকে না চেনার পরও মামলায় কেন আসামি করা হলো জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘ওটা আমার ভাইয়ের ব্যাপার।’ জাকিরকে সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দিচ্ছেন—এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এএসপি বলেন, ‘জাকির নিজেই তো একজন সন্ত্রাসী।’ একটু আগে বললেন তাঁকে চেনেন না, তাহলে কীভাবে জানলেন সন্ত্রাসী? আজাদের উত্তর, ‘বিয়ের পর চিনছি। তাসলিমা তখন অবিবাহিত বলছিল।’ নিকাহনামায় তো তাসলিমা নিজেকে তালাকপ্রাপ্ত উল্লেখ করেছিলেন। আজাদের উত্তর, ‘জানি না।’
তালাকের বিষয়ে জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, ‘আমি কোনো তালাক নোটিশ পাইনি।’
No comments