কল্পকথার গল্প-নতুন বর্ষে থাকিব হর্ষে by আলী হাবিব
টুপ করে ডুব দিল সূর্য। কোথায়? পশ্চিম আকাশে। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। তখনই শুরু হলো? না, গেল একটা বছর ধরেই তো প্রস্তুতি চলছে। আর এই ডিসেম্বরের শুরু থেকে তো 'কবে আসছে, কবে আসছে' করতে করতে সময় ফুরোতেই চায় না। 'আসি আসি করে তুমি আর এলে না'। না, এমন নয়। আসি আসি করে এসেই গেল নতুন বছর। উফ, অপেক্ষার প্রহর কত যে দীর্ঘ হতে পারে, প্রেমে যাদের মন মজেছে, সেটা তাদের বিলক্ষণ জানা আছে। সেই প্রহর এল একেবারে একটা
বছর পর। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে। একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে রাত ১২টা ১ মিনিটে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কে বলে বিলেতি কালচারে লগ্ন মানা হয় না? এই একটা উৎসব দেখলেই তো বুঝে নেওয়া যায়, বাঙালিই শুধু লগ্ন মেনে চলে না। লগ্ন মেনে অন্যদেরও উৎসব করতে হয়। উদাহরণ তো হাতের কাছে একেবারেই টাটকা। এই যে থার্টিফার্স্ট চলে গেল। পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হলো মহাসমারোহে, সাড়ম্বরে। বোশেখের প্রথম দিনের মতো 'এসো এসো' কিংবা 'তাপিত নিঃশ্বাস বায়ে' গেয়ে নয়, একেবারে পশ্চিমা কায়দায়, নাচে-গানে ভরপুর। রাতভর সে উদ্বাহু নৃত্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, থার্টিফার্স্টের জন্য কেন থার্স্টি থাকাটা সার্থক।
বাঙালির এই এক গুণ_গ্রহণ করতে জানে। 'পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার'_সেই দরজা দিয়ে যা কিছু আসছে, বাঙালি বেশ বেছে বেছে তা গ্রহণ করছে। উৎসবপ্রিয় জাতি বলে কথা! একটা উৎসব পেয়ে ধন্য। পেল থার্টিফার্স্ট। একটু নাক সিঁটকানো অভ্যেস যাঁদের, তাঁরা বলবেন, ও উৎসব তো আমাদের নয়। কিন্তু এখন তো মেনে নিতেই হবে, আমরা নিয়েছি। থার্টিফার্স্টে থার্স্টি হতে আমাদের এখন আর বাধে না। আমরা এখন বাঁধভাঙা স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি আমাদের আনন্দের নৌকা। থার্টিফার্স্টে তাই কেবলই ভেসে চলা। কী আয়োজন! ঢাকার অভিজাত হোটেলগুলোতে মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাড়ায় পাড়ায় বাজি ফুটছে। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘর পেরোতেই 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' ধ্বনিতে মুখরিত রাজধানী, সারা দেশও। নেচে-গেয়ে, পান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
কেন এই আয়োজন? তেমন কিছুই না, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেই যে এই আয়োজন, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আয়োজনটা হয়ে থাকে রাতে। স্বাভাবিকভাবেই আয়োজনটা বর্ণাঢ্য হয়। কী হয় সেখানে? যাঁরা কোনো দিনই ও পথ মাড়াননি, তাঁরাও তো চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। থার্টিফার্স্ট আসা মানেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া। থার্টিফার্স্ট আসা মানেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে তল্লাশি। থার্টিফার্স্ট আসা মানেই হুল্লোড়। প্রার্থনা কি হয়? নেচে-গেয়ে পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আবাহন। এটাও তো কম প্রার্থনা নয়। থার্টিফার্স্টে কি ফেলে আসা বছরের হিসাব হয়? কী হবে হিসেব করে? আজকের দিনটাই তো বেহিসেবি হওয়ার দিন। না, দিন নয়, রাত। তার পরও হিসাব একটা করতে হবে। কারণ ২০১১ যখন এল, তখনো আমরা এভাবেই নেচে-গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। আমাদের নাচে-গানে-পানে নতুন যে দিন আনে, সেটাই তো ছিল ২০১১ সালের প্রথম দিন। তারপর সারাটা বছর কেমন গেল আমাদের দিন? কিছু হিসাব আছে, যেগুলো করতে খুব বেশি কুশলী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কেমন? সঠিক অঙ্কটা বলতে না পারলেও যে কেউ বলে দিতে পারবেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশ ঋণগ্রস্ত হয়েছে। 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা'_নানা খাতে নানা ঋণ। আবার এটাও বলা যায়, দিন যত যাবে ঋণ তত বাড়বে। এই ঋণের টাকায় আমাদের উন্নয়ন হবে। একালের গৌরী সেন কাবুলিওয়ালাদেরও হার মানাবে আজকের দিনে। ঋণ নিতে আজকাল বাধ্য করা হয়। বাধ্য হয়ে আমাদেরও ঋণ নিতে হয়। কারণ আমাদের টাকা নেই। মহান দাতারা এসে আমাদের ঋণ দেন। আমরা ধন্য হয়ে যাই। 'ঋণং কৃত্ত্বা' আমরা উন্নয়নের কাজ করি। তার পরও আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় না। আমাদের রাস্তার অবস্থা ভালো না। আমাদের রেলগাড়ি সময়মতো চলে না। আমাদের টাকার মান দিন দিন কমে যায়। কিন্তু তার পরও আমরা খুশি। আমাদের আহ্লাদের সীমা নেই।
থাকবে কেন? কী নেই আমাদের? আমাদেরও ডিজে আছে, ভিজে আছে, আরজে আছে। এত কিছু আর কার যে আছে, কিংবা নেই_সেটা আমরা হিসাব করতে যাই না। আরেকটা জিনিস আছে। আছেই তো। আর কিছু না থাক, আমাদের মনের ভেতর আনন্দ আছে। গ্রহণ করার মতো মন আছে আমাদের। আমরা গ্রহণ করি। আমরা থার্টিফার্স্ট নিয়েছি। ভ্যালেন্টাইন নিয়েছি। আর কী কী নেওয়া যায়? নেওয়ার মতো কিছু থাকলে অবশ্যই নেব।
বছরে কয়েকটা দিন আনন্দ না করলে আর চলছে না। নিদেনপক্ষে মোবাইল ফোনের খুদেবার্তায় 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' বলে ইয়ার-বান্ধবদের জন্য শুভ কামনা তো করা যায়! করলাম। এ বছরের মতো গেল বছরও আমরা এই শুভ কামনা করেছিলাম। ফলটা কী দাঁড়াল? শুভ-অশুভের হিসাব মিলিয়ে কেমন গেল আমাদের ২০১১? তা বেশ গেল বলতে হবে। আমাদের জীবনের একটা ছন্দ আছে। অনেকটা হোঁচট খেয়ে চলি আমরা। অন্য বছরগুলোর মতো ২০১১ সালেও ঈশ্বরের কৃপায় তার ব্যতিক্রম হয়নি। বছরজুড়ে আমরা বাজারে গিয়ে ব্যাজার মুখে ফিরেছি বাড়িতে। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে যখন-তখন গাড়ি উল্টে যায়। প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হয় আমাদের। অভ্যাসটা ফেলে আসা বছরেও বজায় ছিল। গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স অর্জন করা যায়_এমন তত্ত্বে ও তথ্যে আমরা বিহ্বল। কোটি টাকায় মেরামত করা রাস্তার ছাল-বাকল উঠে যায়। রাস্তা না খাল, বর্ষাকালে সেটা বুঝতেও কষ্ট হয়। কিন্তু তার পরও সেই রাস্তায় আমরা চলাচল করি। এ দেশে কনটেইনার খুললে কাপড়ের বদলে দামি গাড়ি পাওয়া যায়। এবার অবশ্য রাস্তাঘাটে গাড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। কয়েক বছর আগে দেখা গিয়েছিল। বিদ্যুৎ কতক্ষণ থাকবে, নতুন সংযোগ দেওয়া যাবে কি না সেটা নিশ্চিত না করেও দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আগামী তিন বছর বিদ্যুতের বাড়বাড়ন্ত না হোক, দাম যে বাড়তে থাকবে_সেটাও সম্প্রতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বছরে চারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও, আটবার যে বাড়েনি এই ভেবে আমরা আপ্লুত হই। আমাদের রাজধানী এই মহানগরী একটা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। সেটা ভেঙে আমরা দুটো বানিয়েছি। স্বার্থটা কী? উন্নয়ন হবে। কেমন সে উন্নয়ন? তাহলে তো সমস্যার দিকে একটু দৃষ্টি দিতে হয়। কী সমস্যা রাজধানীতে? একের ভেতর কত, সেটা হিসাব করার দরকার নেই। যে কয়টা মনে আসে বলে যাওয়া যাক। এ মহানগরীতে বিদ্যুৎ থাকে না। পানির সংকট, গ্যাস সংকট। রাস্তাঘাট ঠিকমতো মেরামত হয় না। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। বাড়িভাড়া দিন দিন বাড়ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়। এবার নিশ্চয়ই তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে যাবে। সিটি করপোরেশন দুটো হয়ে গেছে। উন্নয়ন একেবারে আপনার বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে। কেমন করে? কোনো এক সকালে দেখলেন বউয়ের মুখটা প্রসন্ন। কেন? চুলোয় গ্যাস আছে। পানির কলে পানি আছে। নতুন বছর তো শুরু হলো, বাড়িওয়ালা হয়তো বলে গেছেন_এ বছর আর ভাড়া বাড়বে না। বাজারে গিয়ে দেখলেন, যে অদৃশ্য সিন্ডিকেট এত দিন বাজারের ঘাড়ে চেপে বসে ছিল, সেটা উধাও। আপনি বেশ জমিয়ে বাজার করে বাড়িতে ফিরলেন। অফিসে গেলেন, রাস্তায় কোথাও জ্যামে পড়তে হলো না। 'আহা কী আনন্দ বাতাসে'_মনে একরাশ খুশি নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। এসে শুনলেন সারা দিনে একবারও বিদ্যুৎ যায়নি। এমনটা হলেই না বলা যাবে, ঢাকা-ভঙ্গে কোনো সমস্যা হয়নি। বরং যা হয়েছে, তাকেই বলে উন্নয়ন।
কিন্তু এ সবই তো স্বপ্ন। দিবাস্বপ্ন বলে একটা ব্যাপার আছে না? এটা ঠিক সেই বস্তু। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কিন্তু তার পরও তো কিছু একটা আশা করতে হবে। রাতভর নেচে-গেয়ে একটি বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন যে বছরটিকে আবাহন করলাম, সেই বছরটিকে ঘিরে কোনো প্রত্যাশা কি থাকবে না আমাদের? নিশ্চয়ই থাকবে।
সেই প্রত্যাশার কথা লিখেছেন একালের এক কবি। কী লিখেছেন তিনি? কয়েকটা পঙ্ক্তিতে চোখ বোলানো যাক_
নতুন বর্ষে থাকিব হর্ষে
দেখিব না চোখে সর্ষে ফুল
বজায় থাকিবে মান-সম্মান
হারাইব না তো অকুলে কুল।
শেষে যদি দেখি সবটা ভুল
তাহলে ছিঁড়িব মাথার চুল।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments