সহজ-সরল-ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক চলে রেলের গাড়ি by কনকচাঁপা

ছোট্টবেলায় বাংলাদেশ বেতারে যখন আমার আস্ত আস্ত গান রেকর্ড করে নিত রেডিও প্রশাসন, তখন অনেক অনেক গানের প্রয়োজন পড়ত। সেখানে শ্রদ্ধেয় আবদুল আহাদ, মীর কাশিম আলী খাঁ, অজিত রায়, আবদুল লতিফ, আবদুল হাকিম, লাকী আখন্দ, এইচ এম রফিক, আজাদ রহমান_তাঁদের সুন্দর সুন্দর গান আমি গাইতে থাকলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা করে গান। পারিশ্রমিক ১০ টাকা। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে এত গান_তাই নতুন গান, আমার জন্য কে সুর করবে?


তাবড় তাবড় গীতিকারের সঙ্গে আমি কবি শামসুর রাহমানের লেখা গানও করেছি। আহা কি সৌভাগ্য আমার! নিজেকেই যেন এখন হিংসে হচ্ছে। এত কিছুর পরও যখন গান 'টান' পড়ত তখন ওস্তাদজি বশীর আহমেদ, আব্বা আজিজুল হক মোর্শেদ আমার জন্য গান লিখে সুর করে দিতেন। ওস্তাদজির গান লিখতেন বিশিষ্ট গীতিকার ফজল-এ-খোদা চাচা। আর আব্বার লেখা গানে সুর করতেন আব্বাই। কী সহজ-সরল অথচ বার্তাময় অর্থবহ গান ছিল সেগুলো। অথচ এ সবই ছিল ছড়া গান! সে রকম একটি গান ছিল 'ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক চলে রেলের গাড়ি_ওই গাড়িতে চড়ে আমি দেব এদেশ পাড়ি।' গানের এক স্থানে ছিল_'বড় হয়ে রেলগাড়িতে যাব শ্বশুরবাড়ি।' এ স্থানে এসে অহেতুক লজ্জায় লাল হতাম। ভাবতাম, বড় হলে শ্বশুরবাড়িতে যাবই_ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা! এই রেলগাড়ির সঙ্গে আমার জীবন ওতপ্রোতভাবে বাঁধা ছিল। বছরে দুবার স্কুলের ছুটিতে ওই রেলগাড়িতে করে গ্রামে যেতাম। জানতাম, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাপদ যান ওই ট্রেন। কী কাব্যময় তার চলা। কমলাপুর স্টেশনের নান্দনিক স্থাপত্য আমাকে মোহিত করে দিত। খোপ খোপ উড়ন্ত পালের মতো ভাঁজগুলোর ভেতরের দিককার বাকবাকুম পায়রাকে কিনা হিংসে হতো। আর সেই স্মার্ট ব্যক্তিত্বময় যানটি আজ কিনা অবহেলিত। ধুঁকে ধুঁকে লজ্জায় অবনত হয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, থেমে থেমে যাচ্ছে। এ যেন আমাদের এ জাতিরই প্রতিরূপ। অনেক আগের কথা জানি না_আমাদের এ সরকারও কথা দিয়েছিল রেলওয়ে খাতকে আরো উন্নত করা হবে। সেটা টিকিট-টাইম, পরিচ্ছন্নতা, স্বচ্ছতা_সব ব্যাপারেই। কিন্তু কিছুই হয়নি। এই রেলওয়ের স্থবির হয়ে যাওয়াতে অনাদর-অবহেলা যত না রয়েছে, তার চেয়ে রয়েছে বোধ হয় ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার আগে থেকেই রেলবগি আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তৈরি হতো। কিন্তু হঠাৎই সেটা বন্ধ হয়ে পাকিস্তান থেকে তা আমদানি করা শুরু হয়। সেগুলোর মান আমাদের দেশে তৈরি হওয়া বগির চেয়ে খারাপ। বগিগুলোর এমন অবস্থা, কোন দিন যে সের দরে কেনার জন্য কটকটিওয়ালা দাম হাঁকবে আল্লাহই জানেন। আমার মনে হয়, এগুলো সবই ছককাটা ষড়যন্ত্র। সড়কপথ বাড়লে গাড়ি বিক্রি বাড়বে_রেলপথ থেকে সে রকমটা আশা করা যায় না। যাঁরা সরকারকে বড় বড় উপদেশ দেওয়ার জায়গায় বসে আছেন, তাঁরাই কি প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার রেলপথ বন্ধ করার বুদ্ধি বাতলে দিলেন? পাকিস্তান আমলে যদি আমরা বগি বানাতে পারি, তবে এখন কেন পারব না? বগি আমদানিতে খরচ হচ্ছে প্রায় তিন-চার কোটি টাকা। অথচ আমাদের সৈয়দপুরের বগি ৮০ লাখ টাকায় কেনা যায়। আমাদের বেশির ভাগ ইঞ্জিনের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছর হয়ে গেছে। প্রথমদিকে যা কর্মচারী ছিল, তার চেয়ে ২০০০ সালের দিকে বেড়েছিল ভালোই। এখন আবার তা অনেক কমে গেছে। অনেক স্টেশন, জংশন প্রায় অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। আর তাতে মানুষ যাতায়াতের সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে_যাঁরা কর্মচারী আছেন, তাঁরা বেশির ভাগই দিনের আলোতেই দুর্নীতিগ্রস্ত। রাতের আলোয় তো আমাদের বগিগুলো যেখানে-সেখানে থেমে মাদক দ্রব্যাদি প্রসব করে। হা কপাল! ট্রেনে 'স্ট্যান্ডিং' টিকিট পাওয়া যায়। তাও আবার প্রথম শ্রেণীর কুপওয়ালা বগিগুলোতে। কুপ_অর্থাৎ বিছানা সংবলিত বগিগুলোতে বিছানা-বালিশগুলো নিয়ে কি লীলাখেলা চলে আল্লাহই মালুম। সরকারি পর্যায়ে অন্য পরিবহন খাতে যে বাজেট থাকে, তার অর্ধেকও সম্ভবত রেলওয়ে পায় না। রেললাইনের মাটিগুলো কেউ কেটে নেয়, না বর্ষাকালে গলে ধুয়ে যায়_যার ফলে রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে অতি মাত্রায়। ট্রেনের ধীরগতিতে যাত্রীদের চলাচলে আগ্রহ হারানো, রেলের খাসজমি সরকারের আত্মীয়-স্বজনকে লিজ দেওয়া, দখলদারিত্ব দেওয়া, বগির অভ্যন্তর অসম্ভব নোংরা হয়ে যাওয়া, এগুলো দেখে দেখে কেউ আর সানন্দে ট্রেনে চড়তে চায় না। চেয়ারের ঢাকনাগুলো কাপড়ের বিধায় অজস্র তেলাপোকার আবাস_সেই পোকা মারতে অ্যারোসল না মেরে সোজা বিষ স্প্রে করা হয়। আমার মনে হয়, ওই বিষ তেলাপোকার গায়ে না মেরে সরকার হুকুম দিক আমাদের শ্বাসনালি বরাবর মারতে। তাহলেই এই বাড়তি জনগণের চাপে সরকারের কষ্ট পেতে হবে না। আমার কথা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব, রোমান্টিক, নিরাপদ এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাটাকে কি আরো নিয়মের মধ্যে ফেলা খুবই কঠিন? আগে ট্রেন দ্রুতলয়ে বলত ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক ঝিকঝিক চলে রেলের গাড়ি। অনাদরে সেই রেলই ঢিমেলয়ে খেয়াল অঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করে_'এদিক যাই তো ওদিক যাই, যেদিক পানে আমি চাই_দুর্নীতি ছাড়া কিছু নাই_কিন্তু আমি বাঁচতে চাই।' এগুলো সে বলে বটে, কিন্তু তা আর সুরে লাগে না। বৃদ্ধ জরাজীর্ণ কণ্ঠশিল্পীর মতো শরীরের সঙ্গে লয়তাল জানও কণ্ঠস্বরও ঢ্যাড়ঢেড়ে হয়ে গেছে। কু-উ-উ-ঝিকঝিক ঝকঝকে রেলগাড়ি কবে আবার দেখতে পাব বলতে পারেন কেউ?
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.