কালান্তরের কড়চা : মহাজোট সরকারের ৩ বছর-২০১২ : হাসিনা সরকারের জন্য বিপজ্জনকভাবে বাঁচার বছর by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
দেখতে দেখতে তিনটি বছর চলে গেল। আজ থেকে আর তিন দিন পর ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার তিন বছর পূর্ণ হবে। সামনে আর মাত্র দুই বছর। এই দুই বছরের কার্যকলাপের ওপরই নির্ভর করছে এই সরকারের ভবিষ্যৎ। দেশের মানুষ আরো পাঁচ বছরের জন্য এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখবে, না এই এক টার্মের পরই বিদায় সালাম জানাবে, তা সরকারের বাকি দুই বছরের পারফরম্যান্সের ওপরই বেশি নির্ভর করছে। তাতে এই তিন বছরের সাফল্য
ও ব্যর্থতাগুলোও যে বিবেচিত হবে না, তা নয়। কিন্তু ক্রুসিয়াল ইয়ার্স হচ্ছে এই দুই বছর। বিশেষ করে ২০১২ সাল।
১ জানুয়ারির 'সানডে টাইমস' তার প্রধান সম্পাদকীয়র শিরোনাম দিয়েছে_'২০১২ : '2012 : Cameron's year of living dangerously.' (২০১২ : ক্যামেরনের বিপজ্জনকভাবে বাঁচার বছর)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সম্পর্কে লন্ডনের রবিবাসরীয় পত্রিকাটির এটা হচ্ছে সতর্কবাণী। আমার মতে, এই সতর্কবাণী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বলতে গেলে ২০১২ ও ২০১৩ এই দুটো বছরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং বছর।
ক্ষমতায় থাকার অর্ধেকের বেশি সময় চলে যাওয়ার পর আর এ কথা বলা যাবে না যে এ সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলো খতিয়ান করার সময় এখনো আসেনি। কিংবা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা অন্য ছোট-বড় দলগুলোর গত তিন বছরের এগোনো-পেছানো বিশ্লেষণ করা যাবে না। কালের মুকুরে সব কিছুই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে তা আরো বেশি স্পষ্ট। লুকানো-ছাপানোর কিছু নেই।
গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের বড় অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে হাঁকডাক শোনা গেছে, সেই হাঁকডাক এখন স্তিমিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন থেকে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সব ব্যাপারে দেশবাসীর সামনে ভবিষ্যতের যে মনোহর চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছিল, সেই চিত্রটি এখন অস্পষ্ট। এ জন্য গোড়াতেই আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিল। প্রতিশ্রুতির বন্যায় দেশবাসীকে ভাসিয়ে না দিয়ে বাস্তবতার আলোকে সচেতন ও সতর্ক রাখা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হতো।
শৈশবে ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের কবিতায় পড়েছিলাম_
'মনোহর মূর্তি হেরে
ওহে জীব অন্ধকারে
ভবিষ্যতে কোরো না নির্ভর,
সহায় সম্পদ বলো
সকলি ঘুচায় কাল
আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর।'
এই কাব্যকথা শুধু একজন মানুষের বেলায় নয়, একটি সরকারের বেলায়ও সঠিক। আজ তিন বছর দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার শুরুতেই ভবিষ্যতের মনোহর চিত্র আঁকার পরিণতি বুঝতে পারছে এবং মনে মনে নিশ্চয়ই আওড়াচ্ছে, 'আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর'।
এই সরকার তিনটি বছর হেলায় কাটিয়েছে, তা বলব না। খুব বড় বড় সাফল্য তাদের আছে। এক দিন আগে ১ জানুয়ারি তারা সারা দেশের স্কুলগুলোতে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেঁৗছে দেওয়ার স্কিম অনুযায়ী তিন কোটি ২৩ লাখ বই ছেলেমেয়েদের হাতে পেঁৗছে দিয়েছে। এটা একটা উন্নয়নশীল দেশে যুগান্তকারী ঘটনা। আমাকে এই খবর জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এক শুভাকাঙ্ক্ষী দুঃখ করে বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের এত বড় সাফল্য, কিন্তু এর কোনো কানেকটিভিটি নেই। দেশের মানুষকে এই সাফল্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য কোনো উদ্যোগ-আয়োজন নেই।'
এই শুভাকাঙ্ক্ষী আরো বললেন, 'সরকারের সাফল্যগুলো দেশবাসীর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য যুবলীগ, ছাত্রলীগের মধ্যেও কোনো উদ্যোগ ও তৎপরতা নেই। সরকারের একটি তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু একমাত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফিতা কাটা ছাড়া বিভাগীয় মন্ত্রীর আর কোনো যোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। অথচ সরকারের সব কাজে খুঁত ধরা, ব্যর্থতা আবিষ্কারের জন্য প্রচারমাধ্যমের অভাব নেই, তাদের প্রচারশক্তিও জোরালো। তার মোকাবিলায় সরকারের কণ্ঠশক্তি খুবই ক্ষীণ।'
শুধু একজন নয়, আওয়ামী লীগের অনুগ্রহভোগী নন, এমন বহু শুভাকাঙ্ক্ষীই এই অভিযোগ করে থাকেন, আমি যার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আমি বিস্মিত হয়ে দেখেছি, আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকও সরকারের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু সাফল্যগুলোর কথা জানেন না। আমার ধারণা, গত তিন বছরে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা এবং তাদের মন্তব্য ও খবর সঠিক না হলে সময়মতো তার রেসপন্ড করার ব্যাপারে ঢিলেমি। এই সরকার দাবি করে, তারা জবাবদিহিতার সরকার। কিন্তু তাদের সম্পর্কে প্রচার ও অপপ্রচার কোনো ব্যাপারেই তারা জবাব দানে দ্রুত ও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কোনো অভিযোগ উঠলেই বলে, এটা বিএনপির প্রচার অথবা বিএনপি সরকারই সমস্যাটি সৃষ্টি করে গেছে।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, কৃষিক্ষেত্রেও সরকারের সাফল্য অসাধারণ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু শিল্পোদ্যোগ দ্রুত হারে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। তা ছাড়া কৃষিব্যবস্থায়ও বিদ্যুতায়নের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি সহসা মোচন করা যাচ্ছে না। এই সরকার আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে আশা করা যায়। গ্যাস ও পানি সংকট বর্তমান সরকার আগের সরকারগুলো থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। এক মেয়াদে কোনো সরকার এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, বর্তমান সরকারও পারেনি। তবে সমস্যা সমাধানে তারা এগোচ্ছে। হাসিনা সরকার আরো এক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান করতে অবশ্যই পারবে।
বর্তমান সরকারের একটি ক্ষেত্রের সাফল্য আরেকটি ক্ষেত্রের ব্যর্থতার দরুন ঢাকা পড়ছে। কৃষিপণ্য_বিশেষ করে ধান, চাল, আলু ইত্যাদির উৎপাদন চমৎকার। কিন্তু উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এত ঊর্ধ্বমুখী যে কৃষক তার পণ্য বিক্রি করে তা সামাল দিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রীর বাণিজ্যনীতি সঠিক না হলে, বিএনপির আমল থেকে লাগামছাড়া অসাধু ট্রেড সিন্ডিকেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাফল্য ঢাকা পড়ে যাবে।
সরকারের আরো একটি বড় ব্যর্থতা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে। সরকার জঙ্গি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে যতটা সফল হয়েছে, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনে ততটা সফল হয়নি। ফলে জঙ্গি দমনে তার সাফল্য সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার জন্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক হত্যা অব্যাহত থাকার তো একটা বড় ঘটনা মেয়র লোকমান হত্যা। অন্যদিকে কিডন্যাপিং, গুপ্তহত্যা, চাঁদাবাজি সংক্রান্ত খুন, অপহরণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের আন্তরিকতা আছে, দক্ষতা আছে বলে মনে হয় না। তবে কেবল মন্ত্রী বদল দ্বারা এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যত দিন ক্ষমতাসীন দল থেকে সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের উচ্ছেদ করা না যাবে তত দিন অন্যান্য দলের এমনকি দলবিহীন পেশাদার সন্ত্রাসীদেরও দমন করা যাবে না। পুলিশের দুর্র্নীতি সন্ত্রাস দমনে একটি বড় বাধা এ কথা সত্য, কিন্তু পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণীর কর্তাব্যক্তি কর্তৃত্বমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিলে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ অনেটকাই সম্ভব।
দুর্নীতির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'তাঁর মন্ত্রীদের কেউ দুর্নীতিপরায়ণ নন, কারো বিরদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।' অন্য কোনো কোনো মন্ত্রীর কথা বাদ দিই, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে কি দুর্নীতির অভিযোগ স্বয়ং বিশ্বব্যাংক তোলেনি? বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করলেই তা সঠিক হবে, এমন কথা বলি না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সম্পর্কে কোনো ধরনের তদন্তের ফল জানার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠালেন কেন? এই ব্যাপারটাকে দেশের মানুষ দুই ভাবে দেখবে। আবুল হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করে নিলেন, অথবা বিশ্বব্যাংকের অন্যায় চাপের কাছে মাথা নত করলেন। এখন প্রশ্ন, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশ্নে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানে একটি সুপার পাওয়ারের চাপ অগ্রাহ্য করেছেন, সেখানে বিশ্বব্যাংকের চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন কেন? যেখানে তাঁর মন্ত্রীরাই বলছেন, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সংগ্রহে বাধা হবে না।
আইন করে দুর্নীতি দমন করা যায় না। আইন করে দুর্নীতি দমন করা গেলে নয়াচীনে কমিউনিস্ট শাসনেও প্রতিবছর কয়েক শ লোককে দুর্নীতির জন্য প্রাণদণ্ড দিতে হতো না। মহাত্মা গান্ধী ও মাও সে তুং দুজনেই রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিপরীতমুখী হলেও দুর্নীতি দমনে শুদ্ধি অভিযানে বিশ্বাস করতেন। এ জন্য তাঁরা দলের আদর্শবাদী যুবশক্তিকে কাজে লাগাতেন। আওয়ামী লীগও দুর্নীতি দমন করতে চাইলে দুদককে শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে দলের যুবশক্তিকে সক্রিয় করা প্রয়োজন। এ জন্য মাঠে সক্রিয় হওয়া দরকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগের। কিন্তু যেখানে শর্ষের ভেতরেই ভূত ঢুকেছে, সেখানে ভূত তাড়াবে কে?
বেহাল সড়ক, সড়ক দুর্ঘটনা দ্রুত বৃদ্ধি এবং রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ভয়াবহ যানজট_এসব সমস্যা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও সরকারের অক্ষমতা জনমনে রীতিমতো ক্ষোভের সৃষ্টি করে রেখেছে। যানজট এখন উন্নত দেশগুলোর বড় শহরগুলোতেও বড় সমস্যা। এর স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। কিন্তু দেশের বড় বড় রাস্তাঘাটের অবর্ণনীয় অবস্থা এবং তাতে প্রায় প্রত্যহই সাধারণ ও অসাধারণ ব্যক্তিদের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশবাসীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ড. কামাল হোসেন এবং নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও অল্পের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন।
এই সড়ক উন্নয়নের ব্যাপারেও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন অভিযোগ করেছেন, অর্থ মন্ত্রক পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী এই অভিযোগে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যেই সমস্যাটি ঝুলে আছে। বেঘোরে মরছে মানুষ। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী যদি ত্বরিত এ ব্যাপারে কিছু করতে পারেন, তাহলে সেটা হবে বর্তমান সরকারের জন্য অনেক মাইনাস চিহ্নের মধ্যে একটি প্লাস পয়েন্ট।
দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়ার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু কোথায় যেন সরকারের অধিকাংশ কাজে একটা অযোগ্যতার ছাপ দেখা যায়। এটার শুরু মন্ত্রিসভা গঠনের সূচনা পর্বে। যোগ্যতার বদলে কেবল আনুগত্যকে গুরুত্ব দিয়ে এক শ্রেণীর মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বাছাই করার ফলে আজ সরকারের এ অবস্থা। আন্তরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও সরকার যেসব বড় সাফল্য অর্জন করেছে, সেগুলো নিজেদের অক্ষমতার জন্যই দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারছে না এবং এই সাফল্যগুলো কতখানি ধরে রাখতে পারবে, তাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুকূল অবস্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, সেই অনুকূল অবস্থা আজ তিন বছর পর আর নেই। বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। আমেরিকায় ওবামার জনপ্রিয়তা দোদুল্যমান। ভারতে সোনিয়া-মনমোহন সরকারের দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে লেজেগোবরে অবস্থা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে মার্কিননীতি ব্যর্থতার সম্মুখীন। ইরাকে যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে ওবামা দাবি জানালেও বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। এ রকম যুদ্ধ অবসানের ঘোষণা বুশ সাহেবও দিয়েছিলেন।
তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়ায় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জিতেছে। এর প্রভাব পাকিস্তানে এবং ভায়া পাকিস্তান বাংলাদেশেও পড়বে। আওয়ামী লীগকে তার সেক্যুলারপন্থী রাজনীতি নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, সেক্যুলারিস্ট আওয়ামী লীগে কিছু ট্রয়ের ঘোড়ার তৎপরতা গত তিন বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রয়োজনে এদের নাম ধরে হয়তো আমাকে এক দিন আলোচনা করতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যদি আওয়ামী লীগ সরকার ঢিলেমি দেখায়, যার আলামত দেখা যাচ্ছে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও আইনজীবী নির্বাচনে, তাহলে ২০১২ কোন ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশকে টেনে নেবে, তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত বা ব্যর্থ করার ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত চক্রান্ত নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরের আত্মসন্তোষ ও অযোগ্যতাই বড় হয়ে উঠতে পারে। এই বিচার এবং বাংলাদেশের ভাগ্য দুই-ই নির্ধারিত হবে ২০১২ সালে।
লন্ডন, ২ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১২
১ জানুয়ারির 'সানডে টাইমস' তার প্রধান সম্পাদকীয়র শিরোনাম দিয়েছে_'২০১২ : '2012 : Cameron's year of living dangerously.' (২০১২ : ক্যামেরনের বিপজ্জনকভাবে বাঁচার বছর)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সম্পর্কে লন্ডনের রবিবাসরীয় পত্রিকাটির এটা হচ্ছে সতর্কবাণী। আমার মতে, এই সতর্কবাণী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বলতে গেলে ২০১২ ও ২০১৩ এই দুটো বছরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং বছর।
ক্ষমতায় থাকার অর্ধেকের বেশি সময় চলে যাওয়ার পর আর এ কথা বলা যাবে না যে এ সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলো খতিয়ান করার সময় এখনো আসেনি। কিংবা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা অন্য ছোট-বড় দলগুলোর গত তিন বছরের এগোনো-পেছানো বিশ্লেষণ করা যাবে না। কালের মুকুরে সব কিছুই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে তা আরো বেশি স্পষ্ট। লুকানো-ছাপানোর কিছু নেই।
গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের বড় অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে হাঁকডাক শোনা গেছে, সেই হাঁকডাক এখন স্তিমিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন থেকে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সব ব্যাপারে দেশবাসীর সামনে ভবিষ্যতের যে মনোহর চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছিল, সেই চিত্রটি এখন অস্পষ্ট। এ জন্য গোড়াতেই আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিল। প্রতিশ্রুতির বন্যায় দেশবাসীকে ভাসিয়ে না দিয়ে বাস্তবতার আলোকে সচেতন ও সতর্ক রাখা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হতো।
শৈশবে ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের কবিতায় পড়েছিলাম_
'মনোহর মূর্তি হেরে
ওহে জীব অন্ধকারে
ভবিষ্যতে কোরো না নির্ভর,
সহায় সম্পদ বলো
সকলি ঘুচায় কাল
আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর।'
এই কাব্যকথা শুধু একজন মানুষের বেলায় নয়, একটি সরকারের বেলায়ও সঠিক। আজ তিন বছর দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার শুরুতেই ভবিষ্যতের মনোহর চিত্র আঁকার পরিণতি বুঝতে পারছে এবং মনে মনে নিশ্চয়ই আওড়াচ্ছে, 'আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর'।
এই সরকার তিনটি বছর হেলায় কাটিয়েছে, তা বলব না। খুব বড় বড় সাফল্য তাদের আছে। এক দিন আগে ১ জানুয়ারি তারা সারা দেশের স্কুলগুলোতে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেঁৗছে দেওয়ার স্কিম অনুযায়ী তিন কোটি ২৩ লাখ বই ছেলেমেয়েদের হাতে পেঁৗছে দিয়েছে। এটা একটা উন্নয়নশীল দেশে যুগান্তকারী ঘটনা। আমাকে এই খবর জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এক শুভাকাঙ্ক্ষী দুঃখ করে বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের এত বড় সাফল্য, কিন্তু এর কোনো কানেকটিভিটি নেই। দেশের মানুষকে এই সাফল্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য কোনো উদ্যোগ-আয়োজন নেই।'
এই শুভাকাঙ্ক্ষী আরো বললেন, 'সরকারের সাফল্যগুলো দেশবাসীর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য যুবলীগ, ছাত্রলীগের মধ্যেও কোনো উদ্যোগ ও তৎপরতা নেই। সরকারের একটি তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু একমাত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফিতা কাটা ছাড়া বিভাগীয় মন্ত্রীর আর কোনো যোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। অথচ সরকারের সব কাজে খুঁত ধরা, ব্যর্থতা আবিষ্কারের জন্য প্রচারমাধ্যমের অভাব নেই, তাদের প্রচারশক্তিও জোরালো। তার মোকাবিলায় সরকারের কণ্ঠশক্তি খুবই ক্ষীণ।'
শুধু একজন নয়, আওয়ামী লীগের অনুগ্রহভোগী নন, এমন বহু শুভাকাঙ্ক্ষীই এই অভিযোগ করে থাকেন, আমি যার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আমি বিস্মিত হয়ে দেখেছি, আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকও সরকারের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু সাফল্যগুলোর কথা জানেন না। আমার ধারণা, গত তিন বছরে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, মিডিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা এবং তাদের মন্তব্য ও খবর সঠিক না হলে সময়মতো তার রেসপন্ড করার ব্যাপারে ঢিলেমি। এই সরকার দাবি করে, তারা জবাবদিহিতার সরকার। কিন্তু তাদের সম্পর্কে প্রচার ও অপপ্রচার কোনো ব্যাপারেই তারা জবাব দানে দ্রুত ও বস্তুনিষ্ঠ নয়। কোনো অভিযোগ উঠলেই বলে, এটা বিএনপির প্রচার অথবা বিএনপি সরকারই সমস্যাটি সৃষ্টি করে গেছে।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, কৃষিক্ষেত্রেও সরকারের সাফল্য অসাধারণ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু শিল্পোদ্যোগ দ্রুত হারে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। তা ছাড়া কৃষিব্যবস্থায়ও বিদ্যুতায়নের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি সহসা মোচন করা যাচ্ছে না। এই সরকার আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে আশা করা যায়। গ্যাস ও পানি সংকট বর্তমান সরকার আগের সরকারগুলো থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। এক মেয়াদে কোনো সরকার এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, বর্তমান সরকারও পারেনি। তবে সমস্যা সমাধানে তারা এগোচ্ছে। হাসিনা সরকার আরো এক টার্ম ক্ষমতায় থাকতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান করতে অবশ্যই পারবে।
বর্তমান সরকারের একটি ক্ষেত্রের সাফল্য আরেকটি ক্ষেত্রের ব্যর্থতার দরুন ঢাকা পড়ছে। কৃষিপণ্য_বিশেষ করে ধান, চাল, আলু ইত্যাদির উৎপাদন চমৎকার। কিন্তু উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম এত ঊর্ধ্বমুখী যে কৃষক তার পণ্য বিক্রি করে তা সামাল দিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রীর বাণিজ্যনীতি সঠিক না হলে, বিএনপির আমল থেকে লাগামছাড়া অসাধু ট্রেড সিন্ডিকেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাফল্য ঢাকা পড়ে যাবে।
সরকারের আরো একটি বড় ব্যর্থতা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে। সরকার জঙ্গি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে যতটা সফল হয়েছে, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনে ততটা সফল হয়নি। ফলে জঙ্গি দমনে তার সাফল্য সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার জন্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক হত্যা অব্যাহত থাকার তো একটা বড় ঘটনা মেয়র লোকমান হত্যা। অন্যদিকে কিডন্যাপিং, গুপ্তহত্যা, চাঁদাবাজি সংক্রান্ত খুন, অপহরণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের আন্তরিকতা আছে, দক্ষতা আছে বলে মনে হয় না। তবে কেবল মন্ত্রী বদল দ্বারা এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যত দিন ক্ষমতাসীন দল থেকে সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের উচ্ছেদ করা না যাবে তত দিন অন্যান্য দলের এমনকি দলবিহীন পেশাদার সন্ত্রাসীদেরও দমন করা যাবে না। পুলিশের দুর্র্নীতি সন্ত্রাস দমনে একটি বড় বাধা এ কথা সত্য, কিন্তু পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণীর কর্তাব্যক্তি কর্তৃত্বমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিলে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ অনেটকাই সম্ভব।
দুর্নীতির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'তাঁর মন্ত্রীদের কেউ দুর্নীতিপরায়ণ নন, কারো বিরদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।' অন্য কোনো কোনো মন্ত্রীর কথা বাদ দিই, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে কি দুর্নীতির অভিযোগ স্বয়ং বিশ্বব্যাংক তোলেনি? বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করলেই তা সঠিক হবে, এমন কথা বলি না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সম্পর্কে কোনো ধরনের তদন্তের ফল জানার আগেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠালেন কেন? এই ব্যাপারটাকে দেশের মানুষ দুই ভাবে দেখবে। আবুল হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করে নিলেন, অথবা বিশ্বব্যাংকের অন্যায় চাপের কাছে মাথা নত করলেন। এখন প্রশ্ন, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশ্নে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানে একটি সুপার পাওয়ারের চাপ অগ্রাহ্য করেছেন, সেখানে বিশ্বব্যাংকের চাপের কাছে নতিস্বীকার করলেন কেন? যেখানে তাঁর মন্ত্রীরাই বলছেন, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সংগ্রহে বাধা হবে না।
আইন করে দুর্নীতি দমন করা যায় না। আইন করে দুর্নীতি দমন করা গেলে নয়াচীনে কমিউনিস্ট শাসনেও প্রতিবছর কয়েক শ লোককে দুর্নীতির জন্য প্রাণদণ্ড দিতে হতো না। মহাত্মা গান্ধী ও মাও সে তুং দুজনেই রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিপরীতমুখী হলেও দুর্নীতি দমনে শুদ্ধি অভিযানে বিশ্বাস করতেন। এ জন্য তাঁরা দলের আদর্শবাদী যুবশক্তিকে কাজে লাগাতেন। আওয়ামী লীগও দুর্নীতি দমন করতে চাইলে দুদককে শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে দলের যুবশক্তিকে সক্রিয় করা প্রয়োজন। এ জন্য মাঠে সক্রিয় হওয়া দরকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগের। কিন্তু যেখানে শর্ষের ভেতরেই ভূত ঢুকেছে, সেখানে ভূত তাড়াবে কে?
বেহাল সড়ক, সড়ক দুর্ঘটনা দ্রুত বৃদ্ধি এবং রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ভয়াবহ যানজট_এসব সমস্যা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও সরকারের অক্ষমতা জনমনে রীতিমতো ক্ষোভের সৃষ্টি করে রেখেছে। যানজট এখন উন্নত দেশগুলোর বড় শহরগুলোতেও বড় সমস্যা। এর স্বল্পমেয়াদি কোনো সমাধান নেই। কিন্তু দেশের বড় বড় রাস্তাঘাটের অবর্ণনীয় অবস্থা এবং তাতে প্রায় প্রত্যহই সাধারণ ও অসাধারণ ব্যক্তিদের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশবাসীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ড. কামাল হোসেন এবং নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও অল্পের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন।
এই সড়ক উন্নয়নের ব্যাপারেও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন অভিযোগ করেছেন, অর্থ মন্ত্রক পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী এই অভিযোগে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যেই সমস্যাটি ঝুলে আছে। বেঘোরে মরছে মানুষ। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী যদি ত্বরিত এ ব্যাপারে কিছু করতে পারেন, তাহলে সেটা হবে বর্তমান সরকারের জন্য অনেক মাইনাস চিহ্নের মধ্যে একটি প্লাস পয়েন্ট।
দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়ার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু কোথায় যেন সরকারের অধিকাংশ কাজে একটা অযোগ্যতার ছাপ দেখা যায়। এটার শুরু মন্ত্রিসভা গঠনের সূচনা পর্বে। যোগ্যতার বদলে কেবল আনুগত্যকে গুরুত্ব দিয়ে এক শ্রেণীর মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বাছাই করার ফলে আজ সরকারের এ অবস্থা। আন্তরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও সরকার যেসব বড় সাফল্য অর্জন করেছে, সেগুলো নিজেদের অক্ষমতার জন্যই দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারছে না এবং এই সাফল্যগুলো কতখানি ধরে রাখতে পারবে, তাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুকূল অবস্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, সেই অনুকূল অবস্থা আজ তিন বছর পর আর নেই। বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। আমেরিকায় ওবামার জনপ্রিয়তা দোদুল্যমান। ভারতে সোনিয়া-মনমোহন সরকারের দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে লেজেগোবরে অবস্থা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে মার্কিননীতি ব্যর্থতার সম্মুখীন। ইরাকে যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে ওবামা দাবি জানালেও বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। এ রকম যুদ্ধ অবসানের ঘোষণা বুশ সাহেবও দিয়েছিলেন।
তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়ায় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জিতেছে। এর প্রভাব পাকিস্তানে এবং ভায়া পাকিস্তান বাংলাদেশেও পড়বে। আওয়ামী লীগকে তার সেক্যুলারপন্থী রাজনীতি নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, সেক্যুলারিস্ট আওয়ামী লীগে কিছু ট্রয়ের ঘোড়ার তৎপরতা গত তিন বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রয়োজনে এদের নাম ধরে হয়তো আমাকে এক দিন আলোচনা করতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যদি আওয়ামী লীগ সরকার ঢিলেমি দেখায়, যার আলামত দেখা যাচ্ছে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও আইনজীবী নির্বাচনে, তাহলে ২০১২ কোন ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশকে টেনে নেবে, তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত বা ব্যর্থ করার ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত চক্রান্ত নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরের আত্মসন্তোষ ও অযোগ্যতাই বড় হয়ে উঠতে পারে। এই বিচার এবং বাংলাদেশের ভাগ্য দুই-ই নির্ধারিত হবে ২০১২ সালে।
লন্ডন, ২ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১২
No comments