সাদাকালো-সংঘাতের রাজনীতি নয়, সমঝোতার সংলাপই সঠিক পন্থা by আহমদ রফিক
দেশের রাজনীতি নিয়ে মানুষ মহাচিন্তায়। সংবাদপত্র মহল থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, আড্ডা ও বৈঠকখানা, আলোচনা এবং লেখালেখিতেও রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও সংঘাতের কথা উঠে আসছে। আসছে নিত্যদিন।
কত যে কালি খরচ, কত যে প্রিন্টার-পত্র বের করে আনা- সবই নিরর্থক। আমাদের রাজনীতি কিছুতেই মসৃণ পথে হাঁটবে না। যে যাই বলুক তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ থেকে দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী, রাজনীতিমনস্ক বিশিষ্টজন সবাই একনাগাড়ে বলে চলেছেন রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, যুক্তি ও সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য। এমনকি দলবিশেষের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ সমর্থকও বলছেন : না, এ অবস্থা চলতে পারে না। দেশের স্বার্থে দুই প্রধান দলের মধ্যে সৌহার্দ্য না হোক অন্তত সহিষ্ণু সৌজন্য গড়ে তোলা জরুরি। এতে দুই দলেরই দায়িত্ব রয়েছে।
'মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা' থেকে আইনজীবীদের বিশিষ্টজনও একই কথা বলছেন। তাঁদের মধ্যে দুই প্রধান দলের সমর্থকও রয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁদের এক সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও একই সুরে কথা বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য : যেকোনো মূল্যে 'সংঘাত এড়াতে দুই নেত্রীর সংলাপের বিকল্প নেই।' ব্যারিস্টার হক বলেছেন, 'প্রয়োজনে এমন জনমত বা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা বসতে বাধ্য হন।'
সাধু প্রস্তাব। এমন কথা বেশ কিছুদিন থেকে নানাজনের মুখে শুনে আসছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কিছু হয়নি, কোনো সুফল মেলেনি। স্বভাবতই প্রশ্ন : দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে বাধ্য করবে যে জনমত সে জনমত তৈরি করবেন কে বা কারা? এ ব্যাপারে জনাব হক কিছু বলেননি। শক্তিমান কোনো সংঘবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এ স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হবে না, হতে পারে না।
সুশীল সমাজ, নাগরিক ঐক্য বা এ ধরনের আধা-রাজনৈতিক অথবা সামাজিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ কাজে নেমে পড়ছে না কেন? প্রবাদ রয়েছে- 'শুকনো কথায় চিড়া ভেজে না।' কাজেই কথার বদলে কাজ অর্থাৎ সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা দরকার- আন্দোলন শব্দটা যদি বা না-ই ব্যবহার করি। কিন্তু সেদিকটায় তেমন কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না, তাহলে কিভাবে অর্জিত হবে অন্বিষ্ট।
ব্যারিস্টার হুদা বলেছেন, 'সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে দুই নেত্রী ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।' কিন্তু আবারও প্রশ্ন : দুই নেত্রীকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কারা কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করবেন। কে শুনবেন কার কথা? রফিক-উল হকও প্রায় একইভাবে বলেছেন, দুই দলের আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন দিলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে।
সুধীজনদের এসব সাধু প্রস্তাব আজকের নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পানি গড়াচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিরোধী দল কেন বুঝতে চাইছে না যে হরতাল ডেকে, রাজপথ অবরোধ করে ক্ষমতাসীন কাউকে আসনচ্যুত করা যায় না, যাবে না গণবিদ্রোহ না ঘটলে। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না। তাহলে কেন এ নৈরাজ্যে কিছু প্রাণনাশ ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা, নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি টেনে নিচে নামানো?
বিরোধী দল যদি রাজপথে সংঘাত সৃষ্টি করে তো ক্ষমতাসীন দল তার পাল্টা ব্যবস্থা নেবে; তেমন আলামত আমরা এর আগেও দেখেছি। তাতে লাভ হয়েছে কার? বরং দুর্দশা সাধারণ মানুষের, এমনকি মধ্যবিত্তের এবং দিনমজুরদের। সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি আর সম্পদ নষ্ট। এসব কাজে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই, থাকতে পারে না। এসব তাদের সব ধরনের স্বার্থের পরিপন্থী। তাহলে কেন সংঘাতের রাজনীতি অনুসরণ? এ সংঘাতের পেছনে দলীয় স্বার্থ ছাড়া দেশের স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ জড়িত নেই। এ সহজ কথাটা সবাই বোঝেন।
কথাগুলো কি একতরফা হয়ে যাচ্ছে? এগুলো আমার কথাই নয়, বেশ কিছুদিন থেকে অনেকের মুখে শোনা। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্টজনের এমনই মতামত, যাঁরা অন্ধ, কট্টর দলীয় সমর্থক নন। হ্যাঁ, বক্তব্য একতরফা নয় এ কারণে যে তাঁরা ক্ষমতাসীন দলকেও বলছেন যুক্তিবান হতে, গণতান্ত্রিক মূল বিধিবিধিন মেনে সংসদীয় রাজনীতির আদর্শ পথ ধরে চলতে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে, দুই পক্ষেই কিছু না কিছু ছাড় দিয়ে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে।
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখন যত সংকট- তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দলীয় সরকার। অথচ নির্দলীয় অন্য কোনো সরকার এ বিষয়ে কিছুতে মতৈক্য হচ্ছে না। মতৈক্য দূরে থাক, সেখানে পৌঁছতে যে প্রাথমিক বৈঠক বা আলোচনা দরকার সেই মূল জায়গাটিতেই তো পৌঁছা যাচ্ছে না- মতামতের ঐক্য-অনৈক্য দূরস্থ। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছতে পরামর্শ, প্রস্তাবও কম আসছে না। কিন্তু কোনো দিকেই বরফ গলছে না, গলতে শুরুই করছে না। সব কিছু অনড়, জমাট হিমশিলার মতো।
একটু আগে এ লেখাতেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে ঐকমত্য তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংলাপের বাতাবরণ কিভাবে, কাদের হাতে ধরে সম্ভব; তেমন কিছু তো দেখা যাচ্ছে না। সে কথার জের টেনে বলছি- এ কাজটা পারেন শুধুই দুই নেত্রী- তাঁদের রাজনৈতিক শুভেচ্ছা নিয়ে, দেশের দশের সমস্যার কথা ভেবে। পারেন তাঁদের দুজনের চারপাশের পরামর্শকদের মন্ত্রণা না শুনে, নিজদের বিচার বিচক্ষণতার টানে সমঝোতার জন্য সংলাপের সূচনা ঘটাতে।
পরামর্শকরা (দুই দলেরই) যে যাঁর বিশ্বাস বা স্বার্থমাফিক তাঁদের মূল নেত্রীকে তাঁদের পছন্দমতো পথে টেনে নিতে চেষ্টা করবেন। অতীতে এমন উদাহরণ বিরল নয়। এর ফল শুভ হয়নি। হয়নি দেশের জন্য, এমনকি দলের জন্যও। কাজেই দুই নেত্রীর ওই অশুভ পথ ধরে চলা সাধারণ মানুষ চায় না। কথা প্রসঙ্গে বলছি, একটি নিরপেক্ষ গণভোট নেওয়া হলে দেখা যাবে দুই দলের সাধারণ সমর্থকসহ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চাইছে সাদা মন নিয়ে দুই নেত্রী খোলামেলা আলোচনায় বসুন। তাহলেই তাঁরা একটা সমাধানে পৌঁছে যেতে পারবেন। জেদ ও আপসহীন মনোভাব নিয়ে কোনো দিন সমস্যার সমাধান মিলবে না।
পাঠক, আমাদের বড় সমস্যা হলো শুদ্ধাচারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব, সহিষ্ণুতার অভাব, যা নয় তাই বলে ফেলার স্বভাব। আর বেশি করে এটা করছেন নেতা, হাফ নেতারা। তাঁদের রাজনীতি হচ্ছে লাগামহীন কথা বলার চর্চা। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুলতেই চোখে পড়বে ওইসব নেতার অমিয়বাণী- আক্রমণাত্মক বাক্য ব্যবহার না করলে তাঁদের রাজনীতি সিদ্ধ হয় না। জানতে ইচ্ছা করে, দেশটা যদি এখন 'হীরক রাজার' হয়ে থাকে তাহলে এর আগে কোন রাজার ছিল। সে রাজার পরিচয়টাও তো মানুষ জানতে চাইবে। সে পরিচয় নেতার বক্তব্যে না এলেও অনেকে তা জানেন। সে সময়কার সংবাদপত্রের পাতায়, মানুষের অভিজ্ঞতায় তা ধরা রয়েছে। তাই যে নেতা যখন যা বলেন, দর্পণে মুখ দেখে অতীত ইতিকথার হিসাব মাথায় রেখে বলা উচিত।
কিন্তু তাঁরা তা বলেন না। কারণ তাঁদের ধারণা, বাঙালি বড় বিস্মৃতিপ্রবণ। তাঁরা প্রচারে ভোলেন। বাসি কথা বা পুরনো ঘটনা মনে রাখেন না। সে হিসাবে তাঁরা ভোটবাক্সের ওপর হাত রাখেন। রাজনীতিকদের জন্য তাতে মস্ত সুবিধা। ভোটাররা কখনো সংসদ সদস্যদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনতেও চেষ্টা করেন না। আর 'না' ভোটের ব্যবস্থাও নেই। কাজেই বেশ আছেন তাঁরা।
একটা বিষয়ে অর্থাৎ সমঝোতার প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে বিএনপির উচিত তাদের নীতি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করে তোলা। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। এ দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম নন। তাঁদের কারো কারো অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে, কারো মধ্যস্তরে, সাধারণ পর্যায়ে তো অনেকে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধী এবং হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপকর্মে ব্যাপকভাবে জড়িত জামায়াত নেতাদের বিচারের প্রশ্নে তাঁদের ভূমিকা স্পষ্ট ও ইতিবাচক নয় কেন। এ বিষয়ে নেত্রীকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ওইসব অপরাধীর বিচারের বিষয়ে সাধারণ মানুষ একাট্টা। তারা ওইসব ঘাতকের যথাযথ বিচার ও শাস্তি চায়।
তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিষয়ক সমঝোতায় জোট বাঁধার বিষয়টা সংশ্লিষ্ট না করাই বোধ হয় ভালো। কারণ তাতে অভিযোগ-পাল্টাঅভিযোগ উঠে আসবে, সে সুযোগও আছে। তাই দুই নেত্রীকে একসঙ্গে বসে, একাধিকবার বসে সমঝোতার ও ঐকমত্যের নীতিসূত্র ঠিক করে নিতে হবে। দুই নেত্রীরই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। তার ভিত্তিতে অন্যদের পরামর্শ ব্যতিরেকে তাঁরা দুজনই সমাধানের জায়গাটা আগে ঠিক করুন। আগেই বলেছি, আবারও বলছি- এতে দুই পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে, সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। এ কাজ শুরু করার প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের। দুই পক্ষকেই হুমকি বা একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ছেড়ে আলোচনায় বসতে হবে। 'অনলাইন' তরুণ পাঠকদের কথা ভুলে যাবেন না, তাঁরা সংখ্যায় কম নন। তাঁরা যেমন বলেন, 'টানা কর্মসূচি মানে দেশের বারোটা বাজানো' তেমনি বিরোধীদলীয় সরকার পতনের হুমকিরও তাঁরা বিরোধী। বিরোধী জামায়াত-সমর্থনের ভূমিকা নিয়ে। তাঁদের কথা, আমাদের কথা, সবার কথা- দেশটাকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না। সমঝোতা-সালিস সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়। তাই বলে কোনো পক্ষ যেন না বলে, 'সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার।'
কথাগুলো বলছি এ জন্য যে হরতাল, অবরোধ, গণসংযোগ নিয়ে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যখন ঘোষণা শোনে 'গণসংযোগে বাধা দিলে টানা হরতাল'। যখন অন্যদিকে অনুরূপ ঘোষণা : আমরাও রাজপথে আছি, মাঠে আছি। কোনো উপদ্রব-অশান্তি বরদাশত করব না। মধ্যিখানে মানুষ শাঁখের করাতের নিচে। অথচ মানুষের জন্যই নাকি রাজনীতি।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ থেকে দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী, রাজনীতিমনস্ক বিশিষ্টজন সবাই একনাগাড়ে বলে চলেছেন রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, যুক্তি ও সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য। এমনকি দলবিশেষের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ সমর্থকও বলছেন : না, এ অবস্থা চলতে পারে না। দেশের স্বার্থে দুই প্রধান দলের মধ্যে সৌহার্দ্য না হোক অন্তত সহিষ্ণু সৌজন্য গড়ে তোলা জরুরি। এতে দুই দলেরই দায়িত্ব রয়েছে।
'মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা' থেকে আইনজীবীদের বিশিষ্টজনও একই কথা বলছেন। তাঁদের মধ্যে দুই প্রধান দলের সমর্থকও রয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁদের এক সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও একই সুরে কথা বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য : যেকোনো মূল্যে 'সংঘাত এড়াতে দুই নেত্রীর সংলাপের বিকল্প নেই।' ব্যারিস্টার হক বলেছেন, 'প্রয়োজনে এমন জনমত বা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা বসতে বাধ্য হন।'
সাধু প্রস্তাব। এমন কথা বেশ কিছুদিন থেকে নানাজনের মুখে শুনে আসছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কিছু হয়নি, কোনো সুফল মেলেনি। স্বভাবতই প্রশ্ন : দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে বাধ্য করবে যে জনমত সে জনমত তৈরি করবেন কে বা কারা? এ ব্যাপারে জনাব হক কিছু বলেননি। শক্তিমান কোনো সংঘবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এ স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হবে না, হতে পারে না।
সুশীল সমাজ, নাগরিক ঐক্য বা এ ধরনের আধা-রাজনৈতিক অথবা সামাজিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ কাজে নেমে পড়ছে না কেন? প্রবাদ রয়েছে- 'শুকনো কথায় চিড়া ভেজে না।' কাজেই কথার বদলে কাজ অর্থাৎ সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা দরকার- আন্দোলন শব্দটা যদি বা না-ই ব্যবহার করি। কিন্তু সেদিকটায় তেমন কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না, তাহলে কিভাবে অর্জিত হবে অন্বিষ্ট।
ব্যারিস্টার হুদা বলেছেন, 'সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে দুই নেত্রী ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।' কিন্তু আবারও প্রশ্ন : দুই নেত্রীকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কারা কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করবেন। কে শুনবেন কার কথা? রফিক-উল হকও প্রায় একইভাবে বলেছেন, দুই দলের আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন দিলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে।
সুধীজনদের এসব সাধু প্রস্তাব আজকের নয়, বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পানি গড়াচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিরোধী দল কেন বুঝতে চাইছে না যে হরতাল ডেকে, রাজপথ অবরোধ করে ক্ষমতাসীন কাউকে আসনচ্যুত করা যায় না, যাবে না গণবিদ্রোহ না ঘটলে। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না। তাহলে কেন এ নৈরাজ্যে কিছু প্রাণনাশ ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা, নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি টেনে নিচে নামানো?
বিরোধী দল যদি রাজপথে সংঘাত সৃষ্টি করে তো ক্ষমতাসীন দল তার পাল্টা ব্যবস্থা নেবে; তেমন আলামত আমরা এর আগেও দেখেছি। তাতে লাভ হয়েছে কার? বরং দুর্দশা সাধারণ মানুষের, এমনকি মধ্যবিত্তের এবং দিনমজুরদের। সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি আর সম্পদ নষ্ট। এসব কাজে সাধারণ মানুষের সমর্থন নেই, থাকতে পারে না। এসব তাদের সব ধরনের স্বার্থের পরিপন্থী। তাহলে কেন সংঘাতের রাজনীতি অনুসরণ? এ সংঘাতের পেছনে দলীয় স্বার্থ ছাড়া দেশের স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ জড়িত নেই। এ সহজ কথাটা সবাই বোঝেন।
কথাগুলো কি একতরফা হয়ে যাচ্ছে? এগুলো আমার কথাই নয়, বেশ কিছুদিন থেকে অনেকের মুখে শোনা। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্টজনের এমনই মতামত, যাঁরা অন্ধ, কট্টর দলীয় সমর্থক নন। হ্যাঁ, বক্তব্য একতরফা নয় এ কারণে যে তাঁরা ক্ষমতাসীন দলকেও বলছেন যুক্তিবান হতে, গণতান্ত্রিক মূল বিধিবিধিন মেনে সংসদীয় রাজনীতির আদর্শ পথ ধরে চলতে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে, দুই পক্ষেই কিছু না কিছু ছাড় দিয়ে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে।
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখন যত সংকট- তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দলীয় সরকার। অথচ নির্দলীয় অন্য কোনো সরকার এ বিষয়ে কিছুতে মতৈক্য হচ্ছে না। মতৈক্য দূরে থাক, সেখানে পৌঁছতে যে প্রাথমিক বৈঠক বা আলোচনা দরকার সেই মূল জায়গাটিতেই তো পৌঁছা যাচ্ছে না- মতামতের ঐক্য-অনৈক্য দূরস্থ। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছতে পরামর্শ, প্রস্তাবও কম আসছে না। কিন্তু কোনো দিকেই বরফ গলছে না, গলতে শুরুই করছে না। সব কিছু অনড়, জমাট হিমশিলার মতো।
একটু আগে এ লেখাতেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে ঐকমত্য তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংলাপের বাতাবরণ কিভাবে, কাদের হাতে ধরে সম্ভব; তেমন কিছু তো দেখা যাচ্ছে না। সে কথার জের টেনে বলছি- এ কাজটা পারেন শুধুই দুই নেত্রী- তাঁদের রাজনৈতিক শুভেচ্ছা নিয়ে, দেশের দশের সমস্যার কথা ভেবে। পারেন তাঁদের দুজনের চারপাশের পরামর্শকদের মন্ত্রণা না শুনে, নিজদের বিচার বিচক্ষণতার টানে সমঝোতার জন্য সংলাপের সূচনা ঘটাতে।
পরামর্শকরা (দুই দলেরই) যে যাঁর বিশ্বাস বা স্বার্থমাফিক তাঁদের মূল নেত্রীকে তাঁদের পছন্দমতো পথে টেনে নিতে চেষ্টা করবেন। অতীতে এমন উদাহরণ বিরল নয়। এর ফল শুভ হয়নি। হয়নি দেশের জন্য, এমনকি দলের জন্যও। কাজেই দুই নেত্রীর ওই অশুভ পথ ধরে চলা সাধারণ মানুষ চায় না। কথা প্রসঙ্গে বলছি, একটি নিরপেক্ষ গণভোট নেওয়া হলে দেখা যাবে দুই দলের সাধারণ সমর্থকসহ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চাইছে সাদা মন নিয়ে দুই নেত্রী খোলামেলা আলোচনায় বসুন। তাহলেই তাঁরা একটা সমাধানে পৌঁছে যেতে পারবেন। জেদ ও আপসহীন মনোভাব নিয়ে কোনো দিন সমস্যার সমাধান মিলবে না।
পাঠক, আমাদের বড় সমস্যা হলো শুদ্ধাচারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব, সহিষ্ণুতার অভাব, যা নয় তাই বলে ফেলার স্বভাব। আর বেশি করে এটা করছেন নেতা, হাফ নেতারা। তাঁদের রাজনীতি হচ্ছে লাগামহীন কথা বলার চর্চা। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুলতেই চোখে পড়বে ওইসব নেতার অমিয়বাণী- আক্রমণাত্মক বাক্য ব্যবহার না করলে তাঁদের রাজনীতি সিদ্ধ হয় না। জানতে ইচ্ছা করে, দেশটা যদি এখন 'হীরক রাজার' হয়ে থাকে তাহলে এর আগে কোন রাজার ছিল। সে রাজার পরিচয়টাও তো মানুষ জানতে চাইবে। সে পরিচয় নেতার বক্তব্যে না এলেও অনেকে তা জানেন। সে সময়কার সংবাদপত্রের পাতায়, মানুষের অভিজ্ঞতায় তা ধরা রয়েছে। তাই যে নেতা যখন যা বলেন, দর্পণে মুখ দেখে অতীত ইতিকথার হিসাব মাথায় রেখে বলা উচিত।
কিন্তু তাঁরা তা বলেন না। কারণ তাঁদের ধারণা, বাঙালি বড় বিস্মৃতিপ্রবণ। তাঁরা প্রচারে ভোলেন। বাসি কথা বা পুরনো ঘটনা মনে রাখেন না। সে হিসাবে তাঁরা ভোটবাক্সের ওপর হাত রাখেন। রাজনীতিকদের জন্য তাতে মস্ত সুবিধা। ভোটাররা কখনো সংসদ সদস্যদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনতেও চেষ্টা করেন না। আর 'না' ভোটের ব্যবস্থাও নেই। কাজেই বেশ আছেন তাঁরা।
একটা বিষয়ে অর্থাৎ সমঝোতার প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে বিএনপির উচিত তাদের নীতি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করে তোলা। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। এ দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম নন। তাঁদের কারো কারো অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে, কারো মধ্যস্তরে, সাধারণ পর্যায়ে তো অনেকে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধী এবং হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপকর্মে ব্যাপকভাবে জড়িত জামায়াত নেতাদের বিচারের প্রশ্নে তাঁদের ভূমিকা স্পষ্ট ও ইতিবাচক নয় কেন। এ বিষয়ে নেত্রীকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ওইসব অপরাধীর বিচারের বিষয়ে সাধারণ মানুষ একাট্টা। তারা ওইসব ঘাতকের যথাযথ বিচার ও শাস্তি চায়।
তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিষয়ক সমঝোতায় জোট বাঁধার বিষয়টা সংশ্লিষ্ট না করাই বোধ হয় ভালো। কারণ তাতে অভিযোগ-পাল্টাঅভিযোগ উঠে আসবে, সে সুযোগও আছে। তাই দুই নেত্রীকে একসঙ্গে বসে, একাধিকবার বসে সমঝোতার ও ঐকমত্যের নীতিসূত্র ঠিক করে নিতে হবে। দুই নেত্রীরই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। তার ভিত্তিতে অন্যদের পরামর্শ ব্যতিরেকে তাঁরা দুজনই সমাধানের জায়গাটা আগে ঠিক করুন। আগেই বলেছি, আবারও বলছি- এতে দুই পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে, সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। এ কাজ শুরু করার প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের। দুই পক্ষকেই হুমকি বা একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ছেড়ে আলোচনায় বসতে হবে। 'অনলাইন' তরুণ পাঠকদের কথা ভুলে যাবেন না, তাঁরা সংখ্যায় কম নন। তাঁরা যেমন বলেন, 'টানা কর্মসূচি মানে দেশের বারোটা বাজানো' তেমনি বিরোধীদলীয় সরকার পতনের হুমকিরও তাঁরা বিরোধী। বিরোধী জামায়াত-সমর্থনের ভূমিকা নিয়ে। তাঁদের কথা, আমাদের কথা, সবার কথা- দেশটাকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না। সমঝোতা-সালিস সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়। তাই বলে কোনো পক্ষ যেন না বলে, 'সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার।'
কথাগুলো বলছি এ জন্য যে হরতাল, অবরোধ, গণসংযোগ নিয়ে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। যখন ঘোষণা শোনে 'গণসংযোগে বাধা দিলে টানা হরতাল'। যখন অন্যদিকে অনুরূপ ঘোষণা : আমরাও রাজপথে আছি, মাঠে আছি। কোনো উপদ্রব-অশান্তি বরদাশত করব না। মধ্যিখানে মানুষ শাঁখের করাতের নিচে। অথচ মানুষের জন্যই নাকি রাজনীতি।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
No comments