সংসদীয় রাজনীতি-সমঝোতা ও সহযোগিতাতেই সমাধান
বহুদিন পর, মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের একই অধিবেশনে ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা। গণতন্ত্রমনস্ক, শুভ ও কল্যাণের পক্ষের প্রতিটি মানুষকে এ ঘটনা উদ্বেলিত ও আশান্বিত করে তুলেছে। কেউ বলবেন, নেতৃবৃন্দের ভাষণ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সজ্জিত হওয়ার বদলে পরস্পরের প্রতি দোষারোপমূলক বক্তব্যেই আকীর্ণ ছিল।
অতীতের দোষত্রুটি উল্লেখ করে পরস্পরকে ঘায়েল করার কৌশলও ছিল। বক্তব্যে এমন অনেক উপাদান ছিল, যা সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের বিস্তর দূরত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। তারপরও রাজনীতির সাম্প্রতিক পরিপ্রেক্ষিতে দুই নেতার বক্তব্যকে আশাপ্রদ ঘটনা হিসেবে দেখার বিস্তর কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিরোধী দল জাতীয় সংসদে ফিরে এসেছে। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম, আয়াসসাধ্য মিছিল-সমাবেশের বদলে সংসদীয় বৈঠকে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করছে। শত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে সমাবেশ করে বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে অতিসম্প্রতি যে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে তারা, তা থেকে ভিন্ন চিত্রই দেখা গেল। কাউকে বাধাদান দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্বেচ্ছায় আনন্দিত চিত্তে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য প্রচার করেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে বক্তব্য সংসদে বসে শুনেছেন। এটাই সংসদীয় রাজনীতির সৌন্দর্য। বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। বিরোধী নেতার বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। আরেকটি ইতিবাচক দৃশ্যের অবতারণা ঘটত, যদি বিরোধীদলীয় নেতাও সংসদে উপস্থিত থেকে সে বক্তব্য শুনতেন। সরকারের অনেক সমালোচনা করলেও বিরোধীদলীয় নেতার বেশ কিছু বক্তব্য ইতিবাচক হিসেবেই গৃহীত হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলা জয়ের ঘটনায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটি অবশ্যই বিরল ও আশাব্যঞ্জক ঘটনা। সরকারের ভালো কাজে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন; খারাপ কাজে সমালোচনার কথা বলেছেন। কিছু বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিরোধী দলের কাজ অবশ্যই সঠিক সময়ে সরকারের সমালোচনা করা। তবে এ কাজটির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত প্লাটফর্ম জাতীয় সংসদ। সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের অংশগ্রহণে সংসদ মুখর হবে, ঘটনাক্রমে উত্তাপ-উত্তেজনাও সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সংসদ ত্যাগ করা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের যেমন সচেতন ভূমিকা দরকার, তেমনি সরকারেরও উচিত দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা। সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে, সহযোগিতার প্রস্তাব বলে বিবেচনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সমঝোতার মনোভাব নিয়ে উভয়কেই এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই আলোচনার পথ খোলা রয়েছে_ এমন সংকেত দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলও আলোচনায় আগ্রহী। বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রে প্রতিভাত হয়েছে যে, সংসদে এসে বিরোধী দল প্রস্তাব দিলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থায় বিবাদের সুরাহা হতে পারে। আমরা মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ইতিমধ্যেই রাজপথ যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও, সংঘাত-সংঘর্ষও কম হয়নি। এখন বিরোধী দল সংসদে ফিরে আসার প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা শুরু হওয়া দরকার। কেউ-ই চায় না, আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হোক। তার চেয়ে বড় কথা, সংসদীয় রীতিনীতি এড়িয়ে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামও বাঞ্ছনীয় নয়। ফলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সংসদে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে। আলাপ-আলোচনার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে একটি ভালো ফল মিলবে বলে আমরা আশা করি। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন তো বটেই, অন্য সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদীয় সংলাপের পথ খুলে যাক_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments