প্রচ্ছদ রচনা : ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি-স্ব-সংস্কৃতি ধ্বংসের আত্মঘাতী পাঁয়তারা!
দীর্ঘ প্রায় ৪৭ বছর পর আবারও ভারতীয় ছবি আমদানির পাঁয়তারা চলছে। উর্দু ভাষার আগ্রাসন রুখে দিতে গিয়ে জন্ম নিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন; আপন ভাষা-সংস্কৃতি-মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। যে জাতি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লাখো শহীদের রক্ত দিতে পারে, বিশ্বে বিস্ময়কর ইতিহাসের জন্ম দিতে পারে, সে জাতি আজ কালের স্রোতে আপন স্বকীয়তা ভুলে নিজেই নিজের গলা টিপে ধরছে।
নানা সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনীর ফাঁদে নিজের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ব্যক্তি ও বিশেষ মহলের স্বার্থে বিলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য কম দিনের নয়। আবার তার ব্যর্থতাও অনেক! সাফল্য-ব্যর্থতা যা-ই থাকুক না কেন, তার অধিকারী আমরাই। কানা ছেলে বলে তাকে ত্যাগ করব_এ হওয়ার নয়। কিন্তু আজ মুক্তবাজারের যুগে সবই সম্ভব। সরাসরি তাকে ত্যাগ করতে না বললেও এমন বিধি-ব্যবস্থা করা হয়, যাতে কানা ছেলে নিজেই ঘর ছেড়ে ভাগে। ভারতীয় ছবি আমদানির ঘটনাটি ঠিক তেমনি। আমরা পৃথিবীর সব দেশের সিনেমা দেখতে চাই; এমনকি ভারতীয়ও। ভারতেও বাজারি সিনেমা ছাড়া আরো অনেক ভালো ছবি নির্মিত হয়। আমরা সেগুলোও উপভোগ করতে চাই। যখন কেবল বাজারি ছবিই আমাদের দেওয়া হচ্ছে তখনই আমাদের প্রতিবাদ। আমাদের বাংলা সিনেমায় যা হচ্ছে, তার পক্ষ নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আকাশ-সংস্কৃতির প্রবল আগ্রাসনে নিজের অস্তিত্ব আজও জানান দিয়ে যাচ্ছে কোনোমতে। আমাদের নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি শানিত করতে, আরো বিশ্বময় করে তুলতে বিশ্ব সংস্কৃতি দর্শন করব, তাই বলে আপন সংস্কৃতিকে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিয়ে নয়। তাই সবার আগে দেশীয় চলচ্চিত্রের সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাব বিশ্ব সংস্কৃতির হাত ধরে। ভারতীয় ছবি আমদানির রাজনীতির আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে লিখেছেন_মাহবুব রশিদ
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় সিনেমা চলত। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আইয়ুব সরকার এক ডিক্রি জারি করে ভারতীয় ছবি এ দেশে নিষিদ্ধ করে। দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা বহাল রইল এবং উর্দু ছবিও নিষিদ্ধ করা হলো। শুরু হলো এফডিসির স্বর্ণযুগ, বিনোদনভিত্তিক ছবি তারা বানাতে থাকল, একে একে দ্রুত বাজার বিস্তার হলো এবং প্রায় দেড় হাজারের মতো তৈরি হলো, যেখানে ১৯৭২ সালে হলো শতাধিক। এমনকি লাভের মুখ দেখেন হল মালিকরা। প্রযোজক হয়ে গেলেন অনেকে। অনেকেই একাধিক হল দিয়ে ব্যবসা জাঁকিয়ে বসলেন। আশির দশকে চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে অভিহিত হওয়ার গৌরব অর্জন করল। এরপর প্রথম আঘাত এল স্যাটেলাইট টিভির মাধ্যমে নব্বই দশকে অবিবেচকের মতো আকাশ মুক্ত করে দেওয়ায়। ফলে হুমকির মুখোমুখি হলো দেশি চলচ্চিত্র শিল্প। সেই সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী হংকং থেকে পর্নোগ্রাফি আমদানি করে হলে প্রদর্শন করতে থাকল। এতে মধ্যবিত্ত ও পারিবারিক দর্শক হলবিমুখ হলো, প্রতিভাবান নির্মাতা ও কলাকুশলীরা সরে গেলেন। আর নতুন যাঁরা এলেন তাঁরা দেশি ছবিতেই অশ্লীলতার জোয়ার বইয়ে দিলেন। যেনতেনভাবে কিছু ছবি শুট করে তার সঙ্গে রিল ভরে পর্নোগ্রাফি ঢুকিয়ে দেওয়া হতো সে সময়। অনেক সময় তাঁরা নিজেরাই রগরগে দৃশ্যের কাটপিস রাখতেন। এসব করার জন্য কোনো সৃষ্টিশীল নির্মাতা বা কলাকুশলীর দরকার হতো না। কম পয়সায় এসব ছবি দিয়ে নব্বই দশক পর্যন্ত হল মালিকরা চুটিয়ে ব্যবসা করলেন। কিন্তু পরবর্তী সময় সরকারি কঠোর হস্তক্ষেপে যখন এসব বন্ধ হলো, তখন হল মালিকসহ সব চলচ্চিত্র শিল্প কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। দেশি চলচ্চিত্রের দর্শকদের মানসিক পরিবর্তন হলো, দেশি চলচ্চিত্র থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এই ১০ বছরে সুস্থ চলচ্চিত্র চর্চা না হওয়ায় এর মান এগোয়নি; কিন্তু দর্শকের কাছে টিভি-ভিসিডির মাধ্যমে অনেক বিকল্প চলে এসেছে, তার অভ্যস্ততা পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষ আর হলমুখী নয়। বিনোদনের জন্য তাকে আর প্রেক্ষাগৃহে যেতে হয় না। আর যদিওবা যায়, গ্লামারাস হিন্দি বা হলিউডি সিনেমার তুলনায় বাংলা ছবি তার কাছে পানসে মনে হয়। এ বাস্তবতায় ব্যাপকভাবে একে একে হল ধ্বংস হতে লাগল। হল বাঁচানোর জন্য সরকার ২০১০ সালে জানুয়ারিতে ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতীয় ছবি প্রবেশের বিষয়ে আমদানি নীতিমালায় বিধি-নিষেধ নিজেই তুলে নেয়। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আমদানিনীতির প্রায় সবটিতেই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে, 'উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত কোনো ছায়াছবি (সাব টাইটেলসহ বা সাব টাইটেল ব্যতীত) আমদানি করা যাবে না। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সাব টাইটেল ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা বা ইংরেজি সাবটাইটেলসহ আমদানি করা যাবে। এ উপধারাটিতেও বন্ধনীর মধ্যে বলা আছে 'উপমহাদেশের ভাষা প্রস্তুতকৃত ছবি ব্যতীত'। সরকার আমদানি নীতি আদেশ ২০০৯-২০১২-এ উপরোক্ত ধারাটি বিলোপ করে। ফলে উপমহাদেশে কোনো ছবি সাব টাইটেলসহ বা সাব টাইটেল ছাড়া আমদানির আর বাধা থাকে না। কিন্তু দেশি চলচ্চিত্র পরিচালক শিল্পী কলাকুশলীদের প্রবল আপত্তির মুখে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে সরকার আবার বিধি-নিষেধ আরোপ করেন।
সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার বিচারে আমদানিকারক ও প্রদর্শকদের উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালতের নির্দেশে উল্লেখিত সময়ে যেসব ছবি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা হয়, সেসব ছবিকে তথ্য মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দেয়। এই অনাপত্তিপত্রের মাধ্যমই প্রথম দফায় তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করা হয়। পরে ছবি তিনটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়ার পর গত ২৩ ডিসেম্বর সেগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ছয়টি হলে প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি আগেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে এমন অজুহাত দেখিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আরো ৯টি ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানির।
গত ২০ বছর যথেচ্ছ স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রাদুর্ভাবে ও বাংলা ছবির ব্যর্থতায় পরিবর্তিত রুচির দর্শক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের হলে ফিরিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তারা যদি ভারতীয় বাজারি ছবি এনে হল ভরতে পারে তবে এসব ভোক্তা সাংস্কৃতিক উপকরণ আমদানি করার চেষ্টা বৈধতা পাবে। এতে দেশি চলচ্চিত্র শিল্পের কী ক্ষতি হবে, তা বিবেচ্য নয়। মুনাফাই আসল কথা। ২০ বছর ধরে আকাশ খুলে দিয়ে ও পর্নোগ্রাফি চর্চা করে যে ভুল করা হয়েছিল তারই প্রলম্বিত ও পরিণত রূপ হলে হিন্দি ছবি প্রদর্শন। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কফিনের শেষ পেরেক। ইতিমধ্যে দেশে তরুণ কিছু নির্মাতার উদ্ভব হয়েছে। ২০ বছরের ঘন অন্ধকার সরিয়ে টানেলের প্রান্তে যখন কিছু আলোর মুখ দেখা যাচ্ছে, সমাজের গতিশীল মানুষের সিনেমা যখন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, তখন তাদের এমন প্রয়াস কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারা বাংলা চলচ্চিত্রের স্বকীয় বিকাশ, বাংলাদেশের মানুষের কথা, লোকসাহিত্যের সরলতা চায় না। তারা কেবল মুনাফা করতে চায়।
ঘরে বসে সিনেমা দেখতে বাধা না থাকলে
হলে দেখতে বাধা কোথায়?
মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী_রস সৃষ্টিতেও সে যেমন সৃষ্টিশীল, তেমনি রস আস্বাদনেও তার সৃষ্টিশীলতা না থাকলে যেকোনো মহৎ সৃষ্টি ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে সব ধরনের অনুভূতি গ্রহণ করে এবং তা থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিশীলভাবে ব্যক্ত করে। যথাক্রমে চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-তক। তার অনুভূতি যন্ত্রগুলোকে অনুরণিত করার জন্য তাই রয়েছে টেঙ্ট, ছবি, শব্দ, ঘ্রাণ-স্বাদ-প্রভৃতি। যা শিল্পরূপ লাভ করে সাহিত্য-চিত্রকলা বা সংগীত-সুরভি বা খাদ্যে। সাহিত্য সব অনুভূতি শব্দ বা বাক্যের মাধ্যমে বিমূর্তভাবে সবার অনুভূতিতে আসে। সিনেমা আধুনিকতম শিল্প মাধ্যম। সেখানে চক্ষু-কর্ণ একই সঙ্গে তথ্য গ্রহণ করে। তাই এর প্রভাব অনেক বেশি।
ভালো ছবি যেমন কোনো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রতিফলন ঘটাতে পারে, তেমনি দর্শকের দেশ কাল ইতিহাসের পরিচয় মুছে দিয়ে তাকে স্রেফ ভোক্তায় পরিণত করতে পারে চলচ্চিত্র। তখন নির্মাতা ও দর্শকের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক থাকে না। তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয় বিকিকিনির, দোকানদার আর খদ্দেরের। লক্ষ্য তখন লাভ-ক্ষতির। নির্মাতা, প্রযোজক তখন দর্শককে দেখেন ভোক্তা হিসেবে, তুলে আনতে চান সর্বোচ্চ মুনাফা। ভোক্তার চাহিদা পূরণের জন্য দরকার পড়ে আইটেম গান- অ্যাকশন, যৌনতায় ভরপুর সব উপকরণ। ফিটফাট এসব পণ্য তখন মুগ্ধ করে খদ্দেররূপী দর্শককে।
তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কালচারাল অ্যাম্বাসাডর হলো বলিউডি সিনেমা। তিন মহাদেশ দাপিয়ে বেড়ায় যে ভারতীয় সিনেমা, এ শুধু সিনেমা নয়, একই সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞাপন, তার আঞ্চলিক দাপটের প্রকাশ এবং তার সাংস্কৃতিক শক্তির আগ্রাসনী চিহ্ন। তার পুঁজির ক্ষমতা প্রকাশও বটে। অস্কার-কানের লাল গালিচায় পদচারণ করে তারা বলতে চায় আমরাও আছি, শক্তভাবেই আছি এবং আরো বড় হয়ে আসছি। ইংল্যান্ড-আমেরিকার বঙ্ অফিসের প্রথম দশে দু-একটি বলিউডি সিনেমা মাঝেমধ্যেই থাকে। সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি হিসেবে তারা যে দখলদারিত্ব কায়েম করতে চায়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এসব সিনেমায়। মিডিয়া একটি রাজনৈতিক সামরিক হাতিয়ার, সে তো গোয়েবলসই দেখিয়ে দিয়েছিলেন গত শতকের প্রথমার্ধে। এই দখলদারিত্ব কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ হলো তাদের ছোট পর্দা দখল। সেখানে কেবল বলিউডি সংস্কৃতির (ভুল বুঝবেন না, ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। ভারতবর্ষ বহু সাংস্কৃতিক সত্তার সমাবেশ) দখলদারিত্বই কেবল বিস্তার হয় না, ভারতীয় পণ্যের প্রচার-প্রসার ও বিজ্ঞাপনও হয়। একটু একটু করে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পণ্য সংস্কৃতি। সেখানে পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন সিনেমার নায়ক-নায়িকারা। আবার একটু পরই তাঁদের দেখা যায় বাজারি সিনেমায়, অ্যাকশন বা যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া দৃশ্যে। টিভি চ্যানেলগুলো আসলে বিজ্ঞাপন বা অনুষ্ঠান দর্শকদের কাছে বিক্রি করে না, বরং দর্শকদের বিক্রি করে ভারতীয় পুঁজিপতি ব্যবসায়ী নির্মাতা-প্রযোজকদের কাছে। তাই আমাদের মগজ-মননের চরদখল যেমন টিভি চ্যানেলে হয়, তেমনি তার প্রসার হয় সিনামা হলে। এ কারণে টিভি যেমন জায়েজ হয় না, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে হলে ভারতীয় বাজারি সিনেমা আনাও নৈতিক বৈধতা পায় না।
প্রতিযোগিতা হচ্ছে না বলে কি ভালো সিনেমা হচ্ছে না!
দেশি চলচ্চিত্রের মানহীনতা আর সিনেমা শিল্পের মন্দার দোহাই দিয়ে একদল লোক বলছে প্রতিযোগিতা নেই বলে ভালো সিনেমা হচ্ছে না! উত্তম বচন। আমাদের দেশের ক্রিকেট দলের মান তুলনামূলক খারাপ। ভারতের 'এ' দল আমাদের জাতীয় দলের চেয়ে ভালো বলেই বোধ হয়। তবে আমরা একই যুক্তিতে আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিজ গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে ভারতীয় 'এ' দলের খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে নিয়োগ করি না কেন? আমার যা আছে, তা ভালো হোক মন্দ হোক আমারই। আর যতক্ষণ তা আছে, তার বিকাশের পথও উন্মুক্ত আছে। আমাদের চলচ্চিত্র আপাত মানহীন, তাই বলে আমরা তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি না। আসলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কিছু চলচ্চিত্রকার খুব সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন বলেই বাজার দখল করার জন্য স্থায়ী পুঁজির এ রকম তড়িঘড়ি।
আর প্রতিযোগিতা সৃষ্টির কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের কথা আরো হাস্যকর। তিন মহাদেশ দাপিয়ে বেড়ানো বলিউডি ছবির প্রবল পুুঁজির সঙ্গে টিকে থাকবে দুর্বল বাংলা ছবির ফটকাপুঁজি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলে? হলিউডি-বলিউডি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি টিকে আছে ব্রাজিল মেক্সিকো, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়ার ছবি? উত্তর সোজা। টিকে থাকতে না পেরে এসব দেশের ছবির বাজার এখন মার্কিন ও ভারতীয় পুঁজির দখলে। এর পরও ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে ভারতীয় ছবির ড্রিম ফ্যাক্টরি কী করে ভরসাস্থল হয়?
তাঁরা বলছেন প্রটেকশন আর প্রতিযোগিতাহীনতাই মূল সমস্যা। এ কথা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ দুই দশক ধরে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে স্যাটেলাইট চ্যানেলের মোকাবিলা করতে হয়েছে। টেলিভিশনের দাপটে দেশি সিনেমা হলগুলো হারিয়েছে মধ্যবিত্ত দর্শক। আর এখন ভারতীয় বাজারি ছবি দেশি চলচ্চিত্রকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উৎখাতের মুখে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলা সিনেমার মান একটি বিশেষ দিকে মোড় নেয় ৯০ দশকে। দুর্বল অবকাঠামো আর পুঁজিতে তাকে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারেনি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সম্পর্কিত কোর্স নেই, গবেষণা নেই, স্থায়ী পুঁজি নেই। এ অবস্থাকে কিভাবে প্রটেকশনরূপে চিহ্নিত করা যায় তা বিবেচ্য।
আরেকটি কথা বলেন অনেকে; ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান ১৯৬৫ সালে ঢাকায় বছরে কয়টি চলচ্চিত্র নির্মিত হতো? তিন-চারটির বেশি নয়। বাংলা ভাষায় দেশি কলাকুশলী ও শিল্পীদের ছবি বলেই দর্শক বিপুল সমারোহে সেগুলো দেখতে যেত। ঢাকার তখনো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলতে কিছু তৈরি হয়নি। ১৯৬৫ সালের পর ভারতীয় চলচ্চিত্র বন্ধ করে দেওয়ার পরই ঢাকায় বাস্তবিক অর্থে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সৃষ্টি হয়েছে। জহির রায়হান, খান আতা, কাজী জহির, এহতেশাম মুস্তাফিজ, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কামাল আহমেদের মতো পরিচালক কলাকুশলী শিল্পীরা সামনে উঠে আসতে পেরেছেন প্রটেকশন দেওয়ার পরই। তাঁরা তাঁদের স্বাধীন পথ চিনে নিতে পেরেছেন।
অধুনা চলচ্চিত্রকার টিভি ব্যক্তিত্ব গদ্যলেখক হুমায়ূন আহমেদ সংবাদপত্রের মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন 'বহুত দিন হোয়ে' নামে। তিনি মন্তব্য করেন, বাংলা চলচ্চিত্র এমন কোনো 'রসগোল্লা' নয় এবং তিনি সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্ব বিস্তার করেন। তাঁর কাছে হাস্যকর মনে হয়, 'এ দেশের আইন হলো আনফিটকে সারভাইভ করার সুযোগ করে দেওয়া।'
বটে! তাঁর যুক্তি মতে, দেশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খুলে সব প্রতিবন্ধী হত্যা করা উচিত। চমৎকার ফ্যাসিস্ট তিনি। তিনি রম্যলেখক, রম্য চলচ্চিত্রকার। বাণিজ্যিক ছবির মতো ৪০-৫০টি প্রিন্ট তিনি করেন না। অল্প বিনিয়োগে কয়েকটি প্রিন্ট করিয়ে ধাপে ধাপে কয়েকটি হলে ছবি চালিয়ে তিনি টাকা তুলে নেন। ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা তাঁর প্রখর। ধারণা করা যায়, প্রয়োজন হলে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র বানানো ছেড়ে হিন্দি চলচ্চিত্রের আমদানিকারক, পরিবেশক হয়ে যাবেন। নতুবা সরকারি অনুদান নিয়ে দেশেই হিন্দি চলচ্চিত্র বানানো শুরু করবেন। আমরা তাঁর নতুন সৃষ্টিশীলতা দেখতে পাব সে ক্ষেত্রে। আশা করি, তিনি উত্তম প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারবেন।
সিনেমা বাঁচাব না হল বাঁচাব!
যখন এ প্রশ্নটি করা হয়, তখন এর অন্তর্গত ত্রুটিটি চোখ এড়িয়ে যায়। দুটি ভিন্ন মূল্যমানের বিষয়কে আমরা একই নিক্তিতে বিবেচনা করি। এরা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য নয়। একটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্প না বাঁচলে তার হল বাঁচানোর প্রশ্ন কিভাবে আসতে পারে তা বোধগোম্য নয়। যেন পাকা ধানে মই দিয়ে এসে ধানের গোলা রক্ষা করার জন্য ছুটে আসা। চলচ্চিত্র তার আপন কালের, আপন সমাজের বাস্তবতার জীবনবোধের প্রতিনিধি। আর হল হলো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সিনেমা না বাঁচলে হল বাঁচবে না। এ সহজ সত্যটি মুনাফালোভী হল মালিকরা অনুধাবন করতে চান না। ষাটের দশকে এ দেশে প্রায় ১৫০টি সিনেমা হল ছিল। স্বাধীনতার-উত্তর যুগে তা বাড়তে বাড়তে এসে ঠেকেছে এক হাজার ৪৩৫টিতে। সিনেমার রমরমা যুগে একেকজন হল মালিক তিন-চারটা পর্যন্ত হল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পীদের পরিশ্রম-প্রয়াসে লাভের গুড়টুকু তাঁরা ঠিকই খেয়েছেন। তারপর যখন খারাপ দিন এল, হলের পরিমাণ কমতে কমতে আজ মাত্র ৬০৮টি অবশিষ্ট আছে। প্রেক্ষাগৃহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এর মালিকরা সব সময় মুনাফা করতে চান। সে লক্ষ্যেই নব্বইয়ের দশকে তাঁরা হংকং থেকে পর্নোগ্রাফি আমদানি করে এক টিকিটে দুই ছবি দেখিয়ে মুনাফা করেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের পতনে তাঁদের দায়িত্বও কম নয়। এসব সুবিধাভোগী হল মালিক তাঁদের মুনাফার মোহেই আজ ঢালাওভাবে ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির চক্রান্ত করছেন। নব্বইয়ের দশকে তাঁদের পর্নোগ্রাফি আমদানি এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে পিছিয়ে দিয়েছে ২০ বছর। আরো শতবর্ষ পিছিয়ে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করতে দেশি চলচ্চিত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য এখন ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানি করার সুর তুলেছেন। মুনাফার জন্য তাঁরা সব করতে পারেন।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শক মাসে এক দিন সিনেমা হলে যেতে পারতেন। কিন্তু জীবন নির্বাহের ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে যেতে থাকলে কেবল বিনোদনের জন্য মধ্যবিত্তরা বছরেও এক দিন সিনেমা হলে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে হলগুলো বাধ্য হয়ে পর্নোগ্রাফি দেখানো শুরু করে।
তাদের এ কর্মকাণ্ডই মধ্যবিত্তদের হলবিমুখ করল। নারীরা হলে যাওয়া বন্ধ করে দিল, সপরিবারে হলে যাওয়ার উপায় থাকল না। হলগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল_ছারপোকার দৌরাত্ম্য বাড়ল। হলগুলোর ধ্বংসের জন্য হল মালিকদের মুনাফা লোভই অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু এ দায় চাপানো হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর।
সিনেমা হলগুলোর আসন ব্যবস্থা ভালো নয়। হলে ইয়ারকুলার ঠিকমতো কাজ করে না। মানুষ হলে যায় বিনোদনের জন্য। কিন্তু বিনোদনের উপযুক্ত ব্যবস্থা সিনেমা হলে নেই। উপরন্তু মন্দার এ যুগে মালিকরা হল সংস্কারে আরো বিনিয়োগে আগ্রহী নন। তাঁদের পর্নোগ্রাফির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এবং টিভি চ্যানেলের দৌরা@ে@@@্য টিকে থাকতে গিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালকরাও বাংলা চলচ্চিত্রে যুক্ত করেছেন কাটপিস। কিন্তু ঘটনা ঘটনার নিয়মে চলে। তাঁরা মুনাফার লোভে যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বুমেরাং হয়ে তাঁদের ঘাড়ে পড়েছে। একে একে হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে আর মধ্যবর্তী যে শূন্যতা চলচ্চিত্রাঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে, তার স্থান দখল করে নিয়েছে ভারতীয় বাজারি ছবি। এখন তাঁরা আরো আত্মঘাতী হয়ে সেসব ছবিই দেখাতে চাইছেন হলে। এতে যদি দেশি সিনেমা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে শিগগিরই দেশে একটা সিনেমা হলও থাকবে না।
টিভি চ্যানেলের নৈরাজ্য!
ডরেমন কার্টুনের নাম শুনেছেন? না শুনলে তিন বছরের অধিক বয়সী যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুর কাছে গিয়ে শব্দটি উচ্চারণ করুন। যদি তার চোখে বা চেহারায় চাঞ্চল্য দেখতে না পান, তবে বর্তমান লেখককে অভিশাপ দিন, কোনো আপত্তি থাকবে না। কার্টুনটি জাপানি; ভাষান্তর করা হয়েছে হিন্দিতে। বিপুল জনপ্রিয় এ কার্টুনটি দিনে ১০ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় দেখানো হয়। এতে শিশুদের উপযোগী কিছুই নেই। শুধু তা-ই নয়, এর ভাষা অশিষ্ট হিন্দিবহুল শব্দ ও কাহিনী প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী। এসব কার্টুনের মাধ্যমে যেসব শিশুর সামাজিকীকরণ হচ্ছে, তা আমাদের বাংলাদেশের বাস্তব সমাজজাত নয়। এর মাধ্যমে শিশুরা শিখছে হিন্দি ভাষা, অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারে না, আর কিছু কিছু আবেগ তারা হিন্দি ছাড়া প্রকাশই করতে পারে না। কোনো বিষয়ে অস্বীকৃতি জানায় আমাদের শিশুরা এভাবে, 'কভি নেহি হো সক্তা'। আপনার-আমার সন্তানরা এখন স্বপ্ন দেখে, ভাবে হিন্দিতে। একটি প্রজন্ম এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে, যারা ভাবনায়, মননে বিদেশি চেতনা ধারণ করে। বাংলার কাদা-মাটি, জল-হাওয়া তাদের স্বপ্নে নেই। স্বভূমে পরবাসীর মতো তারা রাজস্থানের মরুভূমিতে, দিলি্লর গলিপথে, মুম্বাইয়ের ফুটপাতে পাঞ্জাবের হাবেলিতে জীবনযাপন করে। তারা যখন আমাদের দেশের হাল ধরবে, তখন কী হবে বলে আপনার ধারণা?
এভাবে কিশোর-কিশোরীরা বা তরুণরা আসক্ত নানা ধরনের ভালগার গান ও রিয়ালিটি শোতে, হিন্দি সিনেমায়_তার উপজাত জীবনযাপন পদ্ধতিতেও সুলভ। ঈদ এলে দেখা যায়, বিপণী বিতান তার আক্রা দরের পোশাকের নাম দিচ্ছে সিনেমার বা সিরিয়ালের নায়িকার নামে। ভোক্তা সাংস্কৃতিক বিকাশ হচ্ছে এভাবেই। শাহরুখ-সালমানরা আমাদের মাঠ দাবিয়ে যাচ্ছেন এসে। বাসায় মা-বোন-খালারা সিরিয়ালের মোহে রিমোর্ট হাতছাড়া করছেন না। উচ্চবিত্তদের বাসায় ভিন্ন ভিন্ন সিরিয়াল রুচি চরিতার্থ করার জন্য একাধিক টিভিও দেখা যাচ্ছে। বাজার প্রসারিত হচ্ছে এভাবেই। দু-চার লাইন বলিউডি হিন্দি বলতে না পারলে এখন 'আনকালচারড' প্রতিভাত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। এ দায় তারা কেন নিতে যাবে? অতএব গড্ডালিকায় গা ভাসানোই সমীচীন। সব দেশেই টিভি চ্যানেলের ওপর সেন্সরশিপ আছে। আকাশ কখনোই মুক্ত নয়।
আমাদের দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেল আসা শুরু হয়েছিল নব্বই দশকের শুরুতে এবং এ দশকেই এই সংস্কৃতি চরম বিকাশ লাভ করে। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো ধরনের বিবেচনা না করেই আমাদের আকাশ সবার জন্য মুক্ত করে দিই। এর প্রভাব হয় সুদূর বিস্তারি। মধ্যবিত্তরা হলবিমুখ হয়ে পড়ে। আমাদের সংস্কৃতিক স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা থাকলেও তারা নিজেরা সাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষার জন্য সে দেশে আমাদের চ্যানেল দেখায় না। কেবল ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশই বিদেশি সংস্কৃতির চ্যানেল বিষয়ে রক্ষণশীল। কেবল আমরাই গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিই; আবার মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে, তথ্য অধিকারের কথা বলে একে বৈধ করি। আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিষয়টি কেবল সরলরৈখিক ভারতবিরোধিতার প্রশ্ন নয়!
আগেই বলেছি, তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কালচারাল অ্যাম্বাসাডর হলো বলিউডি বাজারি সিনেমা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে একটা পলকা সুতোর ওপর টিকে আছে। ভারত বহুজাতির দেশ। তাই একক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই একে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কথাটা কয়েকবার প্রচার করতে হয়। এভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে একক কিছু নেই, তাই বলিউডে তাদের বিকল্প সর্বভারতীয় সংস্কৃতি তৈরি করার একটি ফ্যাক্টরি আছে। সেই সর্বভারতীয় ভারতের সংস্কৃতি আসলে সর্বভারতীয়ও নয়। কেবল উত্তর ভারতের মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও দিলি্লর প্রতিনিধিত্ব করে তারা। এমনকি ভাষার ঐক্যও নেই ভারতে। ভারতের ৪০ শতাংশ লোক হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারে আর মাতৃভাষা হিন্দি আরো অনেক কমসংখ্যক লোকের। সেই হিন্দি ভাষার মারফতে ভারত নিজেদের বেঁধে রাখার আয়োজন করেছে বলিউডে, তিনটি প্রধান সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছে। এই তিনটি সংস্কৃতি আবার চরিত্রে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি বা বুর্জোয়া বা ব্যবসায়ী। তারা তাদের পুঁজির জোরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ভারতীয় সংস্কৃতির মুখপাত্র হিসেবে। তাই বলছি, বলিউডি ছবি ভারতীয় ছবির মুখপাত্র নয়। এমনকি এর আগ্রাসনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না ভারতের অন্যান্য সংস্কৃতির ছবি ইত্যাদি। অনেক স্বকীয়তা, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি বাজার থাকা সত্ত্ব্বেও দক্ষিণী ছবি মূল ধারায় আসতে পারছে না বলিউডি ছবির দৌরা@ে@@@্য। তেলেগু-মালয়লাম ছবি তো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আছে। কলকাতার বাংলা ছবি স্বকীয়তা হারিয়ে বলিউডি ছবির অনুকরণসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইন্ডাস্ট্রিতে একই প্রভাব। সব জায়গায় বৃহৎ পুঁজির হিন্দি সিনেমার চমক ও চটক। হাল ফ্যাশনের গাড়ি, আধুনিক বাড়ি, সুইচ টেপা প্রেম, যৌনতার প্রতীক শান্ত নারী ও পুরুষালি দাপটওয়ালা সহিংস নায়ক আর জীবনবিরোধী মূল্যবোধে সংস্কৃতি হয়ে পড়ছে হিন্দি সিনেমার মতো। তাই বলিউডি হিন্দি সিনেমা কেবল আমাদের দেশের ইন্ডাস্ট্রির জন্য হুমকি নয়। হুমকি তার নিজের দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির জন্যও। নিজের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সত্তাকে সে এরই মধ্যে ধ্বংস করেছে। এখন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের দিকে। বিষয়টি সরলরৈখিক ভারতবিরোধিতার নয়। বরং বিষয়টির ভরকেন্দ্র হলো ভোক্তা সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তারের বিরোধিতায়। ভারতীয় ভোক্তা সংস্কৃতির প্রচার করে ফ্যাসিস্ট নন্দনতত্ত্ব, যা গ্রাস করে নেয় সবার স্বকীয়তা, নিজস্বতা। সবাইকে পরিণত করে পণ্যে। নিজ দেশে সে যেমন বাজার বাড়াতে সর্বগ্রাসী হয়েছে, তেমনি হাত বাড়িয়েছে বিশ্ব বাজারের দিকে। আর তুলনামূলক দুর্বল শক্তির কারণে আমাদের প্রেক্ষাপটে তাদের প্রভাব নিরঙ্কুশ হবে, তা বুঝতে বেশি আয়াস লাগে না।
সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার হালচাল
বাঙালির মানসে এক দুর্নিবার ঔপনিবেশিকতা আস্তানা গাড়ে প্রধানত কম্পানি আমলে, বেঙ্গল রেনেসাঁর পর। তারা হয়ে পড়ে শক্তিশালীর দুর্বল অনুকারী। ব্রিটিশ শাসকচক্রের সযত্ন তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা 'দেখতে নেটিভ, কিন্তু মনে-মননে ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ স্বার্থসিদ্ধ করে' তারা এই দুর্বল অনুকরণের পরম্পরা আজও জারি রেখেছে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, কল্লোল গোষ্ঠীসহ আমরা আজ পর্যন্ত সাহিত্যে পশ্চিমে প্রাপ্ত নির্দেশিকার অনুকরণ করে গেছি। শেখ মুজিব পশ্চিমাধারার জাতীয়তাবাদ চর্চা করে নেতা হয়েছেন আর দেশি ধারার চর্চা করে ভাসানী ১৯৬৯ সালের পর হালে পানি কমই পেয়েছেন। আমাদের বাংলা ছবিও অধুনা ও সর্বদাই ভারতীয় ছবির উপনিবেশ। ১৯৬০-৭০ এর দশকে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অনুকরণ করা হতো দিলীপ কুমার ও উত্তম কুমারকে। আজ করা হয় বলিউডি সিনেমাকে। কিন্তু বলিউডি স্থায়ী পুঁজি, কারিগরি দক্ষতা না থাকায় তা দুর্বল অনুকরণেই পর্যবসিত হচ্ছে। ভারতীয় বাজারি ছবির মতো আজগুবি কাহিনী নর্তন-কুর্দন আর জবরজং মারপিটের ব্যবহার পাওয়া যাবে বাংলা ছবিতেও। ফলে ঢাকাই ছবির নির্বিচার পক্ষ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও তার ক্ষমতা তুলনীয় নয় বলিউডি ছবির সঙ্গে। তবু এতেও থাকে ভোক্তা-সংস্কৃতির নানা উপকরণ। গুণগতভাবে হলিউড, বলিউড, ঢালিউডের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হলিউডি-বলিউডি বাজারি সিনেমা খুব সুস্থধারার সিনেমা হাজির করে এমন নয়। এদের কোনো মূলগত অনৈক্য নেই। উন্নত কারিগরি দক্ষতা, অকর্ষণীয় সংলাপের সুবাদে হলিউড-বলিউড যৌনতা, ভালগার আর ভায়োলেন্স খুব সুন্দর মোড়কে হাজির করে। অন্যদিকে ফাটকা পুঁজির কম বাজেটের বাংলা ছবির সে সামর্থ্য নেই, কারিগরি দক্ষতা নেই, তাই এসব জিনিস তারা সরাসরি দর্শককে দেখায়। ছলটুকু করতে তারা জানে না, পারে না।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
২০১০ সালে সরকার ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সচেতন মহলে এই প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংবাদপত্র ও ব্লগে বিস্তর লেখালেখি শুরু হয় এ নিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা প্রবল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, চলচ্চিত্রশিল্পী রাজ্জাক, আলমগীর, রামেন্দু মজুমদার, নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, ডা. এম এ করিম প্রমুখ। আবার মুদ্রার অপর পিঠও আছে। গদ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান কে এম আর মঞ্জুর, বিভিন্ন সিনেমা হল মালিকসহ অনেকে এর পক্ষে কথা বলতে থাকেন। ২০১০ সালের এপ্রিলে চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ গঠিত হয় এবং তারা ঘোষণা করে, 'দেশে কোনোমতেই ভারতীয় চলচ্চিত্র আসতে দেওয়া হবে না। যদি দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় চলচ্চিত্র আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আন্দোলনের পথ বেছে নেব। শিল্পী, কলাকুশলীরা তখন ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবে।' এই ঐক্য পরিষদে সংশ্লিষ্ট ছিলেন মিজু আহমেদ, শওকত জামিল, আবদুল লতিফ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শাহ আলম কিরণ, খসরু প্রমুখ। এ ছাড়া ২০১১ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ জানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি 'স্ট্যামফোর্ড সিনে ফোরাম'। তারা মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সংস্কৃতি মঞ্চ ও নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে। তারপর ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ সালে যখন আইনের ফাঁকফোকর গলে এসব ছবি দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশনার অজুহাতে তখন অনেকেই চুপ থাকেন, পাছে আদালত অবমাননার ঘেরাটোপে পড়ে যেতে হয়_ এই ভেবে। এফডিসিকেন্দ্রিক আন্দোলনকারীরা মৌন থাকেন। কিন্তু কিছু তরুণ 'ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র আগ্রাসন প্রতিরোধ আন্দোলন' নাম দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাঁরা ২১ ডিসেম্বর প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেন এবং তথ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশে যান। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা সম্পন্ন করা যায় না। তবে ২৩ ডিসেম্বর যেসব হলে ভারতীয় পর্ন সিনেমা দেখানো হবে, তার সামনে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেন। প্রবল পুলিশি বাধা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নানা বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিভিন্ন সমমনা ফিল্ম সোসাইটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংবাদপত্র কর্মী, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। তাঁরা নিজেদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন।
উত্তরণের উপায়
আমরা পৃথিবীর সব দেশের সিনেমা দেখার পক্ষে। এমনকি সব ধরনের সিনেমা দেখারও পক্ষে। কোনোভাবেই বিদেশি ছবি আমদানিকে সরলরৈখিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ানো উচিত নয়। বরং সারা দুনিয়ার ভালো ভালো ছবি যাতে আমাদের দেশের সবাই দেখতে পারে, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণই আমাদের লক্ষ্য। যেখানে বাজারি সিনেমা আমদানি করে বাজারের দখল নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং মানুষকে নিছক ভোক্তায় পরিণত করা হচ্ছে, তা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে বেশি আয়াস লাগে না, ভারতীয় ছবি আমদানি করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রদর্শন করলেই প্রতিযোগিতা করে আমাদের চলচ্চিত্রের মান ভালো হয়ে উঠবে না, তেমন সমন্বিত চেষ্টা ছাড়া সোনার ডিম পাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়ে যাবে। এ শিল্প নানা ঘটনা পরম্পরায় প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে গেছে। তবু আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ প্রজন্ম পরিচালক ও নির্মাতা উদ্যোগী আছেন। তাঁরা আমাদের ছবি বানানোর জন্য তাঁদের সংগ্রাম জারি রেখেছেন। তাঁদের সংগ্রামের পথ আরেকটু সহজ করার জন্য আমাদের প্রয়াসী হতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শনসংক্রান্ত বিষয়টি এই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে আজ পর্যন্ত একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট নেই। একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরিতে সরকারি পদক্ষেপ খুবই জরুরি। হলগুলোর অবস্থা খুবই বেগতিক। সেখানে পর্দা ময়লা, প্রজেক্টর নষ্ট। হল মালিকদের দিক থেকে যেমন এসব বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হলগুলোয় ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করতে হবে, সিনেমাস্কোপ লেন্স লাগাতে হবে। বন্ধ সিনেমা হলগুলো আবার চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। টিকিটের ওপর আরোপিত কর মুক্ত করে দিতে হবে। এতে হলে জনসমাগম বাড়বে। চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া ঠুনকো সেন্সর নীতিমালা পরিবর্তন ও কার্যকর সেন্সর বোর্ড গঠন করতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি কাঁচামাল ও অনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর আমদানি কর সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে। মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের চাহিদা পূরণে প্রতিবছর সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কেবল মুখ দেখানো অনুদান নয়, প্রদত্ত অনুদান যেন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অনুদান কাকে, কেন দেওয়া হচ্ছে_অনুদান প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অনুষ্ঠান প্রচার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক। এমন নানা দিক থেকে সুপরিকল্পিত কাজ করার মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, সিদ্ধান্তগুলো যেন আগের মতোই আত্মঘাতী না হয়।
কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর নানা নতুন নতুন ফিকিরে একটু একটু করে নষ্ট হয়েছে ঢাকাই সিনেমা। অবাধ আকাশ দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে, মগজের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করেছে বাজারি ছবি, সেই সঙ্গে জনগণের পকেটও কাটা হয়েছে, পর্নোগ্রাফি চর্চা করা হয়েছে, ইন্দ্রিয়বৃত্তি উসকে দিয়ে মস্তিষ্ক নিশ্চল করার কাজে সিনেমা ব্যবহার হয়েছে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন 'আইনগত দিক থেকে এভাবে সরকার ভারতীয় ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে রাখতে পারে না।' আমরা বলি, আইন না থাকলে আইন প্রণয়ন করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আগ্রাসনবিরোধী আইন নেই দেখিয়ে আগ্রাসন জায়েজ করা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য প্রকাশ। শুধু অধ্যাপকরাই নন, একই ধরনের চিন্তার মন্ত্রী, আমলা ও নীতিনির্ধারকদের কারণে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আজ হুমকির মুখে। চলচ্চিত্র ডোবে ডুবুক, আমরা আমাদের টাকা উঠাতে চাই লাভ করে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে চাই_এরূপ মানসিকতার কারণে বিলুপ্তির আশঙ্কা আরো বেড়েছে। চলচ্চিত্র কখনো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে অতি বুদ্ধিবৃত্তিক আঁতেল উদ্ধারকর্তাদের মাধ্যমেও। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশ কুসুমাস্তীর্ণ করব, নাকি কণ্টকাকীর্ণ করব।
শেষ কথা
শেষ কথা সহজভাবে বলতে গেলে লড়াইটা পুঁজির, লড়াইটা রাজনীতির, দখলদারিত্ব বিস্তারের, আধিপত্যবাদ কায়েমের। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজেদের দৈন্য। ভারতীয় বাজারি ছবি আমাদের দেশে আসার এক হাজার একটা যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু একই যুক্তি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু হবে না। এই হলো উদার নীতির উদারতা, মুক্তবাজারের মুক্তি। উদারতা কেবল দেখায় কম শক্তির গরিবরা। মুক্ত থাকে কেবল গরিবের বাজার। আর শক্তিশালীদের বাজারে ঢুকতে গেলেই নানা নিয়ম-নীতির চোখ রাঙানিতে পালানো ছাড়া গতি থাকে না। ভারতের আকাশ সংস্কৃতি যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে আমাদের দেশে, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সেভাবে কেন যেতে পারছে না ভারতে? আমাদের কিছু তো ভালো ছবি আছে, ভারতের তিনটি ছবি আমাদের দেশের হলে এল, আমাদের তিনটি ছবি কেন একই সমারোহে ভারতের হলে দেখানো হচ্ছে না? রক্ষণশীলতা দেখাচ্ছে কেবল ভারতই। আমাদের যেন রক্ষা করার মতো কিছুই নেই। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, চলচ্চিত্রে ভিন্ন সফলতাও তো কম নয়। সেই সাফল্য খুঁজতেও খুব কষ্ট হয় না। জহির রায়হান থেকে শুরু করে আমাদের তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকি, নুরুল আলম আতিক কম কিছু অর্জন করেননি। কিন্তু তাঁদের পদে পদে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়েছে। তাঁদের অবাধ বিচরণের পথ বন্ধ করা হয়েছে। জহির রায়হানের সময় ছিল বিদেশি বুর্জোয়া শাসকরা। আজ এসেছে তাদেরই দেশি প্রতিনিধিরা। শোষণের পদ্ধতি, দাবিয়ে রাখার উপায় একই আছে। কিন্তু বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেই সত্য সবচেয়ে শানিতভাবে বেরিয়ে আসবে, সবচেয়ে শক্তি নিয়ে প্রকাশিত হবে_তা এসব বিদেশি আধিপত্যবাদী ও তার দেশি গোলামরা ভুলে গেছেন। ইতিহাস তাঁরা পড়েন না, পড়লে তা জানতেন।
আমরা ইমেজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আস্থা রাখি। যে ইমেজের ভিত্তি অসত্য, অন্যায় শোষণ; তার পরাজয় নিশ্চিত জেনেই আমাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে হবে। সিনেমায় আমরা আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রকাশ দেখতে চাই, সিনেমাকে পুঁজির দাসত্বমুক্ত ও জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হিসেবে চাই।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় সিনেমা চলত। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আইয়ুব সরকার এক ডিক্রি জারি করে ভারতীয় ছবি এ দেশে নিষিদ্ধ করে। দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা বহাল রইল এবং উর্দু ছবিও নিষিদ্ধ করা হলো। শুরু হলো এফডিসির স্বর্ণযুগ, বিনোদনভিত্তিক ছবি তারা বানাতে থাকল, একে একে দ্রুত বাজার বিস্তার হলো এবং প্রায় দেড় হাজারের মতো তৈরি হলো, যেখানে ১৯৭২ সালে হলো শতাধিক। এমনকি লাভের মুখ দেখেন হল মালিকরা। প্রযোজক হয়ে গেলেন অনেকে। অনেকেই একাধিক হল দিয়ে ব্যবসা জাঁকিয়ে বসলেন। আশির দশকে চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে অভিহিত হওয়ার গৌরব অর্জন করল। এরপর প্রথম আঘাত এল স্যাটেলাইট টিভির মাধ্যমে নব্বই দশকে অবিবেচকের মতো আকাশ মুক্ত করে দেওয়ায়। ফলে হুমকির মুখোমুখি হলো দেশি চলচ্চিত্র শিল্প। সেই সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী হংকং থেকে পর্নোগ্রাফি আমদানি করে হলে প্রদর্শন করতে থাকল। এতে মধ্যবিত্ত ও পারিবারিক দর্শক হলবিমুখ হলো, প্রতিভাবান নির্মাতা ও কলাকুশলীরা সরে গেলেন। আর নতুন যাঁরা এলেন তাঁরা দেশি ছবিতেই অশ্লীলতার জোয়ার বইয়ে দিলেন। যেনতেনভাবে কিছু ছবি শুট করে তার সঙ্গে রিল ভরে পর্নোগ্রাফি ঢুকিয়ে দেওয়া হতো সে সময়। অনেক সময় তাঁরা নিজেরাই রগরগে দৃশ্যের কাটপিস রাখতেন। এসব করার জন্য কোনো সৃষ্টিশীল নির্মাতা বা কলাকুশলীর দরকার হতো না। কম পয়সায় এসব ছবি দিয়ে নব্বই দশক পর্যন্ত হল মালিকরা চুটিয়ে ব্যবসা করলেন। কিন্তু পরবর্তী সময় সরকারি কঠোর হস্তক্ষেপে যখন এসব বন্ধ হলো, তখন হল মালিকসহ সব চলচ্চিত্র শিল্প কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। দেশি চলচ্চিত্রের দর্শকদের মানসিক পরিবর্তন হলো, দেশি চলচ্চিত্র থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এই ১০ বছরে সুস্থ চলচ্চিত্র চর্চা না হওয়ায় এর মান এগোয়নি; কিন্তু দর্শকের কাছে টিভি-ভিসিডির মাধ্যমে অনেক বিকল্প চলে এসেছে, তার অভ্যস্ততা পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষ আর হলমুখী নয়। বিনোদনের জন্য তাকে আর প্রেক্ষাগৃহে যেতে হয় না। আর যদিওবা যায়, গ্লামারাস হিন্দি বা হলিউডি সিনেমার তুলনায় বাংলা ছবি তার কাছে পানসে মনে হয়। এ বাস্তবতায় ব্যাপকভাবে একে একে হল ধ্বংস হতে লাগল। হল বাঁচানোর জন্য সরকার ২০১০ সালে জানুয়ারিতে ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতীয় ছবি প্রবেশের বিষয়ে আমদানি নীতিমালায় বিধি-নিষেধ নিজেই তুলে নেয়। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আমদানিনীতির প্রায় সবটিতেই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে, 'উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত কোনো ছায়াছবি (সাব টাইটেলসহ বা সাব টাইটেল ব্যতীত) আমদানি করা যাবে না। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সাব টাইটেল ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা বা ইংরেজি সাবটাইটেলসহ আমদানি করা যাবে। এ উপধারাটিতেও বন্ধনীর মধ্যে বলা আছে 'উপমহাদেশের ভাষা প্রস্তুতকৃত ছবি ব্যতীত'। সরকার আমদানি নীতি আদেশ ২০০৯-২০১২-এ উপরোক্ত ধারাটি বিলোপ করে। ফলে উপমহাদেশে কোনো ছবি সাব টাইটেলসহ বা সাব টাইটেল ছাড়া আমদানির আর বাধা থাকে না। কিন্তু দেশি চলচ্চিত্র পরিচালক শিল্পী কলাকুশলীদের প্রবল আপত্তির মুখে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে সরকার আবার বিধি-নিষেধ আরোপ করেন।
সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার বিচারে আমদানিকারক ও প্রদর্শকদের উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালতের নির্দেশে উল্লেখিত সময়ে যেসব ছবি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা হয়, সেসব ছবিকে তথ্য মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দেয়। এই অনাপত্তিপত্রের মাধ্যমই প্রথম দফায় তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করা হয়। পরে ছবি তিনটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়ার পর গত ২৩ ডিসেম্বর সেগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ছয়টি হলে প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি আগেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে এমন অজুহাত দেখিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আরো ৯টি ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানির।
গত ২০ বছর যথেচ্ছ স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রাদুর্ভাবে ও বাংলা ছবির ব্যর্থতায় পরিবর্তিত রুচির দর্শক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের হলে ফিরিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তারা যদি ভারতীয় বাজারি ছবি এনে হল ভরতে পারে তবে এসব ভোক্তা সাংস্কৃতিক উপকরণ আমদানি করার চেষ্টা বৈধতা পাবে। এতে দেশি চলচ্চিত্র শিল্পের কী ক্ষতি হবে, তা বিবেচ্য নয়। মুনাফাই আসল কথা। ২০ বছর ধরে আকাশ খুলে দিয়ে ও পর্নোগ্রাফি চর্চা করে যে ভুল করা হয়েছিল তারই প্রলম্বিত ও পরিণত রূপ হলে হিন্দি ছবি প্রদর্শন। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কফিনের শেষ পেরেক। ইতিমধ্যে দেশে তরুণ কিছু নির্মাতার উদ্ভব হয়েছে। ২০ বছরের ঘন অন্ধকার সরিয়ে টানেলের প্রান্তে যখন কিছু আলোর মুখ দেখা যাচ্ছে, সমাজের গতিশীল মানুষের সিনেমা যখন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, তখন তাদের এমন প্রয়াস কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারা বাংলা চলচ্চিত্রের স্বকীয় বিকাশ, বাংলাদেশের মানুষের কথা, লোকসাহিত্যের সরলতা চায় না। তারা কেবল মুনাফা করতে চায়।
ঘরে বসে সিনেমা দেখতে বাধা না থাকলে
হলে দেখতে বাধা কোথায়?
মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী_রস সৃষ্টিতেও সে যেমন সৃষ্টিশীল, তেমনি রস আস্বাদনেও তার সৃষ্টিশীলতা না থাকলে যেকোনো মহৎ সৃষ্টি ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে সব ধরনের অনুভূতি গ্রহণ করে এবং তা থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিশীলভাবে ব্যক্ত করে। যথাক্রমে চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-তক। তার অনুভূতি যন্ত্রগুলোকে অনুরণিত করার জন্য তাই রয়েছে টেঙ্ট, ছবি, শব্দ, ঘ্রাণ-স্বাদ-প্রভৃতি। যা শিল্পরূপ লাভ করে সাহিত্য-চিত্রকলা বা সংগীত-সুরভি বা খাদ্যে। সাহিত্য সব অনুভূতি শব্দ বা বাক্যের মাধ্যমে বিমূর্তভাবে সবার অনুভূতিতে আসে। সিনেমা আধুনিকতম শিল্প মাধ্যম। সেখানে চক্ষু-কর্ণ একই সঙ্গে তথ্য গ্রহণ করে। তাই এর প্রভাব অনেক বেশি।
ভালো ছবি যেমন কোনো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রতিফলন ঘটাতে পারে, তেমনি দর্শকের দেশ কাল ইতিহাসের পরিচয় মুছে দিয়ে তাকে স্রেফ ভোক্তায় পরিণত করতে পারে চলচ্চিত্র। তখন নির্মাতা ও দর্শকের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক থাকে না। তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয় বিকিকিনির, দোকানদার আর খদ্দেরের। লক্ষ্য তখন লাভ-ক্ষতির। নির্মাতা, প্রযোজক তখন দর্শককে দেখেন ভোক্তা হিসেবে, তুলে আনতে চান সর্বোচ্চ মুনাফা। ভোক্তার চাহিদা পূরণের জন্য দরকার পড়ে আইটেম গান- অ্যাকশন, যৌনতায় ভরপুর সব উপকরণ। ফিটফাট এসব পণ্য তখন মুগ্ধ করে খদ্দেররূপী দর্শককে।
তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কালচারাল অ্যাম্বাসাডর হলো বলিউডি সিনেমা। তিন মহাদেশ দাপিয়ে বেড়ায় যে ভারতীয় সিনেমা, এ শুধু সিনেমা নয়, একই সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞাপন, তার আঞ্চলিক দাপটের প্রকাশ এবং তার সাংস্কৃতিক শক্তির আগ্রাসনী চিহ্ন। তার পুঁজির ক্ষমতা প্রকাশও বটে। অস্কার-কানের লাল গালিচায় পদচারণ করে তারা বলতে চায় আমরাও আছি, শক্তভাবেই আছি এবং আরো বড় হয়ে আসছি। ইংল্যান্ড-আমেরিকার বঙ্ অফিসের প্রথম দশে দু-একটি বলিউডি সিনেমা মাঝেমধ্যেই থাকে। সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক-সামরিক শক্তি হিসেবে তারা যে দখলদারিত্ব কায়েম করতে চায়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এসব সিনেমায়। মিডিয়া একটি রাজনৈতিক সামরিক হাতিয়ার, সে তো গোয়েবলসই দেখিয়ে দিয়েছিলেন গত শতকের প্রথমার্ধে। এই দখলদারিত্ব কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ হলো তাদের ছোট পর্দা দখল। সেখানে কেবল বলিউডি সংস্কৃতির (ভুল বুঝবেন না, ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, ভারতীয় সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। ভারতবর্ষ বহু সাংস্কৃতিক সত্তার সমাবেশ) দখলদারিত্বই কেবল বিস্তার হয় না, ভারতীয় পণ্যের প্রচার-প্রসার ও বিজ্ঞাপনও হয়। একটু একটু করে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পণ্য সংস্কৃতি। সেখানে পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন সিনেমার নায়ক-নায়িকারা। আবার একটু পরই তাঁদের দেখা যায় বাজারি সিনেমায়, অ্যাকশন বা যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া দৃশ্যে। টিভি চ্যানেলগুলো আসলে বিজ্ঞাপন বা অনুষ্ঠান দর্শকদের কাছে বিক্রি করে না, বরং দর্শকদের বিক্রি করে ভারতীয় পুঁজিপতি ব্যবসায়ী নির্মাতা-প্রযোজকদের কাছে। তাই আমাদের মগজ-মননের চরদখল যেমন টিভি চ্যানেলে হয়, তেমনি তার প্রসার হয় সিনামা হলে। এ কারণে টিভি যেমন জায়েজ হয় না, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে হলে ভারতীয় বাজারি সিনেমা আনাও নৈতিক বৈধতা পায় না।
প্রতিযোগিতা হচ্ছে না বলে কি ভালো সিনেমা হচ্ছে না!
দেশি চলচ্চিত্রের মানহীনতা আর সিনেমা শিল্পের মন্দার দোহাই দিয়ে একদল লোক বলছে প্রতিযোগিতা নেই বলে ভালো সিনেমা হচ্ছে না! উত্তম বচন। আমাদের দেশের ক্রিকেট দলের মান তুলনামূলক খারাপ। ভারতের 'এ' দল আমাদের জাতীয় দলের চেয়ে ভালো বলেই বোধ হয়। তবে আমরা একই যুক্তিতে আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিজ গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে ভারতীয় 'এ' দলের খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে নিয়োগ করি না কেন? আমার যা আছে, তা ভালো হোক মন্দ হোক আমারই। আর যতক্ষণ তা আছে, তার বিকাশের পথও উন্মুক্ত আছে। আমাদের চলচ্চিত্র আপাত মানহীন, তাই বলে আমরা তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি না। আসলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কিছু চলচ্চিত্রকার খুব সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন বলেই বাজার দখল করার জন্য স্থায়ী পুঁজির এ রকম তড়িঘড়ি।
আর প্রতিযোগিতা সৃষ্টির কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের কথা আরো হাস্যকর। তিন মহাদেশ দাপিয়ে বেড়ানো বলিউডি ছবির প্রবল পুুঁজির সঙ্গে টিকে থাকবে দুর্বল বাংলা ছবির ফটকাপুঁজি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলে? হলিউডি-বলিউডি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি টিকে আছে ব্রাজিল মেক্সিকো, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়ার ছবি? উত্তর সোজা। টিকে থাকতে না পেরে এসব দেশের ছবির বাজার এখন মার্কিন ও ভারতীয় পুঁজির দখলে। এর পরও ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে ভারতীয় ছবির ড্রিম ফ্যাক্টরি কী করে ভরসাস্থল হয়?
তাঁরা বলছেন প্রটেকশন আর প্রতিযোগিতাহীনতাই মূল সমস্যা। এ কথা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ দুই দশক ধরে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে স্যাটেলাইট চ্যানেলের মোকাবিলা করতে হয়েছে। টেলিভিশনের দাপটে দেশি সিনেমা হলগুলো হারিয়েছে মধ্যবিত্ত দর্শক। আর এখন ভারতীয় বাজারি ছবি দেশি চলচ্চিত্রকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উৎখাতের মুখে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলা সিনেমার মান একটি বিশেষ দিকে মোড় নেয় ৯০ দশকে। দুর্বল অবকাঠামো আর পুঁজিতে তাকে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারেনি। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সম্পর্কিত কোর্স নেই, গবেষণা নেই, স্থায়ী পুঁজি নেই। এ অবস্থাকে কিভাবে প্রটেকশনরূপে চিহ্নিত করা যায় তা বিবেচ্য।
আরেকটি কথা বলেন অনেকে; ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান ১৯৬৫ সালে ঢাকায় বছরে কয়টি চলচ্চিত্র নির্মিত হতো? তিন-চারটির বেশি নয়। বাংলা ভাষায় দেশি কলাকুশলী ও শিল্পীদের ছবি বলেই দর্শক বিপুল সমারোহে সেগুলো দেখতে যেত। ঢাকার তখনো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলতে কিছু তৈরি হয়নি। ১৯৬৫ সালের পর ভারতীয় চলচ্চিত্র বন্ধ করে দেওয়ার পরই ঢাকায় বাস্তবিক অর্থে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সৃষ্টি হয়েছে। জহির রায়হান, খান আতা, কাজী জহির, এহতেশাম মুস্তাফিজ, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কামাল আহমেদের মতো পরিচালক কলাকুশলী শিল্পীরা সামনে উঠে আসতে পেরেছেন প্রটেকশন দেওয়ার পরই। তাঁরা তাঁদের স্বাধীন পথ চিনে নিতে পেরেছেন।
অধুনা চলচ্চিত্রকার টিভি ব্যক্তিত্ব গদ্যলেখক হুমায়ূন আহমেদ সংবাদপত্রের মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন 'বহুত দিন হোয়ে' নামে। তিনি মন্তব্য করেন, বাংলা চলচ্চিত্র এমন কোনো 'রসগোল্লা' নয় এবং তিনি সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্ব বিস্তার করেন। তাঁর কাছে হাস্যকর মনে হয়, 'এ দেশের আইন হলো আনফিটকে সারভাইভ করার সুযোগ করে দেওয়া।'
বটে! তাঁর যুক্তি মতে, দেশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খুলে সব প্রতিবন্ধী হত্যা করা উচিত। চমৎকার ফ্যাসিস্ট তিনি। তিনি রম্যলেখক, রম্য চলচ্চিত্রকার। বাণিজ্যিক ছবির মতো ৪০-৫০টি প্রিন্ট তিনি করেন না। অল্প বিনিয়োগে কয়েকটি প্রিন্ট করিয়ে ধাপে ধাপে কয়েকটি হলে ছবি চালিয়ে তিনি টাকা তুলে নেন। ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা তাঁর প্রখর। ধারণা করা যায়, প্রয়োজন হলে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র বানানো ছেড়ে হিন্দি চলচ্চিত্রের আমদানিকারক, পরিবেশক হয়ে যাবেন। নতুবা সরকারি অনুদান নিয়ে দেশেই হিন্দি চলচ্চিত্র বানানো শুরু করবেন। আমরা তাঁর নতুন সৃষ্টিশীলতা দেখতে পাব সে ক্ষেত্রে। আশা করি, তিনি উত্তম প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারবেন।
সিনেমা বাঁচাব না হল বাঁচাব!
যখন এ প্রশ্নটি করা হয়, তখন এর অন্তর্গত ত্রুটিটি চোখ এড়িয়ে যায়। দুটি ভিন্ন মূল্যমানের বিষয়কে আমরা একই নিক্তিতে বিবেচনা করি। এরা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য নয়। একটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্প না বাঁচলে তার হল বাঁচানোর প্রশ্ন কিভাবে আসতে পারে তা বোধগোম্য নয়। যেন পাকা ধানে মই দিয়ে এসে ধানের গোলা রক্ষা করার জন্য ছুটে আসা। চলচ্চিত্র তার আপন কালের, আপন সমাজের বাস্তবতার জীবনবোধের প্রতিনিধি। আর হল হলো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সিনেমা না বাঁচলে হল বাঁচবে না। এ সহজ সত্যটি মুনাফালোভী হল মালিকরা অনুধাবন করতে চান না। ষাটের দশকে এ দেশে প্রায় ১৫০টি সিনেমা হল ছিল। স্বাধীনতার-উত্তর যুগে তা বাড়তে বাড়তে এসে ঠেকেছে এক হাজার ৪৩৫টিতে। সিনেমার রমরমা যুগে একেকজন হল মালিক তিন-চারটা পর্যন্ত হল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পীদের পরিশ্রম-প্রয়াসে লাভের গুড়টুকু তাঁরা ঠিকই খেয়েছেন। তারপর যখন খারাপ দিন এল, হলের পরিমাণ কমতে কমতে আজ মাত্র ৬০৮টি অবশিষ্ট আছে। প্রেক্ষাগৃহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এর মালিকরা সব সময় মুনাফা করতে চান। সে লক্ষ্যেই নব্বইয়ের দশকে তাঁরা হংকং থেকে পর্নোগ্রাফি আমদানি করে এক টিকিটে দুই ছবি দেখিয়ে মুনাফা করেছেন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের পতনে তাঁদের দায়িত্বও কম নয়। এসব সুবিধাভোগী হল মালিক তাঁদের মুনাফার মোহেই আজ ঢালাওভাবে ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির চক্রান্ত করছেন। নব্বইয়ের দশকে তাঁদের পর্নোগ্রাফি আমদানি এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে পিছিয়ে দিয়েছে ২০ বছর। আরো শতবর্ষ পিছিয়ে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করতে দেশি চলচ্চিত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য এখন ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানি করার সুর তুলেছেন। মুনাফার জন্য তাঁরা সব করতে পারেন।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শক মাসে এক দিন সিনেমা হলে যেতে পারতেন। কিন্তু জীবন নির্বাহের ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে যেতে থাকলে কেবল বিনোদনের জন্য মধ্যবিত্তরা বছরেও এক দিন সিনেমা হলে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে হলগুলো বাধ্য হয়ে পর্নোগ্রাফি দেখানো শুরু করে।
তাদের এ কর্মকাণ্ডই মধ্যবিত্তদের হলবিমুখ করল। নারীরা হলে যাওয়া বন্ধ করে দিল, সপরিবারে হলে যাওয়ার উপায় থাকল না। হলগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল_ছারপোকার দৌরাত্ম্য বাড়ল। হলগুলোর ধ্বংসের জন্য হল মালিকদের মুনাফা লোভই অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু এ দায় চাপানো হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর।
সিনেমা হলগুলোর আসন ব্যবস্থা ভালো নয়। হলে ইয়ারকুলার ঠিকমতো কাজ করে না। মানুষ হলে যায় বিনোদনের জন্য। কিন্তু বিনোদনের উপযুক্ত ব্যবস্থা সিনেমা হলে নেই। উপরন্তু মন্দার এ যুগে মালিকরা হল সংস্কারে আরো বিনিয়োগে আগ্রহী নন। তাঁদের পর্নোগ্রাফির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এবং টিভি চ্যানেলের দৌরা@ে@@@্য টিকে থাকতে গিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালকরাও বাংলা চলচ্চিত্রে যুক্ত করেছেন কাটপিস। কিন্তু ঘটনা ঘটনার নিয়মে চলে। তাঁরা মুনাফার লোভে যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বুমেরাং হয়ে তাঁদের ঘাড়ে পড়েছে। একে একে হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে আর মধ্যবর্তী যে শূন্যতা চলচ্চিত্রাঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে, তার স্থান দখল করে নিয়েছে ভারতীয় বাজারি ছবি। এখন তাঁরা আরো আত্মঘাতী হয়ে সেসব ছবিই দেখাতে চাইছেন হলে। এতে যদি দেশি সিনেমা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে শিগগিরই দেশে একটা সিনেমা হলও থাকবে না।
টিভি চ্যানেলের নৈরাজ্য!
ডরেমন কার্টুনের নাম শুনেছেন? না শুনলে তিন বছরের অধিক বয়সী যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুর কাছে গিয়ে শব্দটি উচ্চারণ করুন। যদি তার চোখে বা চেহারায় চাঞ্চল্য দেখতে না পান, তবে বর্তমান লেখককে অভিশাপ দিন, কোনো আপত্তি থাকবে না। কার্টুনটি জাপানি; ভাষান্তর করা হয়েছে হিন্দিতে। বিপুল জনপ্রিয় এ কার্টুনটি দিনে ১০ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় দেখানো হয়। এতে শিশুদের উপযোগী কিছুই নেই। শুধু তা-ই নয়, এর ভাষা অশিষ্ট হিন্দিবহুল শব্দ ও কাহিনী প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী। এসব কার্টুনের মাধ্যমে যেসব শিশুর সামাজিকীকরণ হচ্ছে, তা আমাদের বাংলাদেশের বাস্তব সমাজজাত নয়। এর মাধ্যমে শিশুরা শিখছে হিন্দি ভাষা, অনেকেই ভালো বাংলা বলতে পারে না, আর কিছু কিছু আবেগ তারা হিন্দি ছাড়া প্রকাশই করতে পারে না। কোনো বিষয়ে অস্বীকৃতি জানায় আমাদের শিশুরা এভাবে, 'কভি নেহি হো সক্তা'। আপনার-আমার সন্তানরা এখন স্বপ্ন দেখে, ভাবে হিন্দিতে। একটি প্রজন্ম এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে, যারা ভাবনায়, মননে বিদেশি চেতনা ধারণ করে। বাংলার কাদা-মাটি, জল-হাওয়া তাদের স্বপ্নে নেই। স্বভূমে পরবাসীর মতো তারা রাজস্থানের মরুভূমিতে, দিলি্লর গলিপথে, মুম্বাইয়ের ফুটপাতে পাঞ্জাবের হাবেলিতে জীবনযাপন করে। তারা যখন আমাদের দেশের হাল ধরবে, তখন কী হবে বলে আপনার ধারণা?
এভাবে কিশোর-কিশোরীরা বা তরুণরা আসক্ত নানা ধরনের ভালগার গান ও রিয়ালিটি শোতে, হিন্দি সিনেমায়_তার উপজাত জীবনযাপন পদ্ধতিতেও সুলভ। ঈদ এলে দেখা যায়, বিপণী বিতান তার আক্রা দরের পোশাকের নাম দিচ্ছে সিনেমার বা সিরিয়ালের নায়িকার নামে। ভোক্তা সাংস্কৃতিক বিকাশ হচ্ছে এভাবেই। শাহরুখ-সালমানরা আমাদের মাঠ দাবিয়ে যাচ্ছেন এসে। বাসায় মা-বোন-খালারা সিরিয়ালের মোহে রিমোর্ট হাতছাড়া করছেন না। উচ্চবিত্তদের বাসায় ভিন্ন ভিন্ন সিরিয়াল রুচি চরিতার্থ করার জন্য একাধিক টিভিও দেখা যাচ্ছে। বাজার প্রসারিত হচ্ছে এভাবেই। দু-চার লাইন বলিউডি হিন্দি বলতে না পারলে এখন 'আনকালচারড' প্রতিভাত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। এ দায় তারা কেন নিতে যাবে? অতএব গড্ডালিকায় গা ভাসানোই সমীচীন। সব দেশেই টিভি চ্যানেলের ওপর সেন্সরশিপ আছে। আকাশ কখনোই মুক্ত নয়।
আমাদের দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেল আসা শুরু হয়েছিল নব্বই দশকের শুরুতে এবং এ দশকেই এই সংস্কৃতি চরম বিকাশ লাভ করে। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো ধরনের বিবেচনা না করেই আমাদের আকাশ সবার জন্য মুক্ত করে দিই। এর প্রভাব হয় সুদূর বিস্তারি। মধ্যবিত্তরা হলবিমুখ হয়ে পড়ে। আমাদের সংস্কৃতিক স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তা থাকলেও তারা নিজেরা সাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষার জন্য সে দেশে আমাদের চ্যানেল দেখায় না। কেবল ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশই বিদেশি সংস্কৃতির চ্যানেল বিষয়ে রক্ষণশীল। কেবল আমরাই গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিই; আবার মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে, তথ্য অধিকারের কথা বলে একে বৈধ করি। আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিষয়টি কেবল সরলরৈখিক ভারতবিরোধিতার প্রশ্ন নয়!
আগেই বলেছি, তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কালচারাল অ্যাম্বাসাডর হলো বলিউডি বাজারি সিনেমা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে একটা পলকা সুতোর ওপর টিকে আছে। ভারত বহুজাতির দেশ। তাই একক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই একে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কথাটা কয়েকবার প্রচার করতে হয়। এভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে একক কিছু নেই, তাই বলিউডে তাদের বিকল্প সর্বভারতীয় সংস্কৃতি তৈরি করার একটি ফ্যাক্টরি আছে। সেই সর্বভারতীয় ভারতের সংস্কৃতি আসলে সর্বভারতীয়ও নয়। কেবল উত্তর ভারতের মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও দিলি্লর প্রতিনিধিত্ব করে তারা। এমনকি ভাষার ঐক্যও নেই ভারতে। ভারতের ৪০ শতাংশ লোক হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারে আর মাতৃভাষা হিন্দি আরো অনেক কমসংখ্যক লোকের। সেই হিন্দি ভাষার মারফতে ভারত নিজেদের বেঁধে রাখার আয়োজন করেছে বলিউডে, তিনটি প্রধান সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছে। এই তিনটি সংস্কৃতি আবার চরিত্রে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধি বা বুর্জোয়া বা ব্যবসায়ী। তারা তাদের পুঁজির জোরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ভারতীয় সংস্কৃতির মুখপাত্র হিসেবে। তাই বলছি, বলিউডি ছবি ভারতীয় ছবির মুখপাত্র নয়। এমনকি এর আগ্রাসনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না ভারতের অন্যান্য সংস্কৃতির ছবি ইত্যাদি। অনেক স্বকীয়তা, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি বাজার থাকা সত্ত্ব্বেও দক্ষিণী ছবি মূল ধারায় আসতে পারছে না বলিউডি ছবির দৌরা@ে@@@্য। তেলেগু-মালয়লাম ছবি তো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আছে। কলকাতার বাংলা ছবি স্বকীয়তা হারিয়ে বলিউডি ছবির অনুকরণসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইন্ডাস্ট্রিতে একই প্রভাব। সব জায়গায় বৃহৎ পুঁজির হিন্দি সিনেমার চমক ও চটক। হাল ফ্যাশনের গাড়ি, আধুনিক বাড়ি, সুইচ টেপা প্রেম, যৌনতার প্রতীক শান্ত নারী ও পুরুষালি দাপটওয়ালা সহিংস নায়ক আর জীবনবিরোধী মূল্যবোধে সংস্কৃতি হয়ে পড়ছে হিন্দি সিনেমার মতো। তাই বলিউডি হিন্দি সিনেমা কেবল আমাদের দেশের ইন্ডাস্ট্রির জন্য হুমকি নয়। হুমকি তার নিজের দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির জন্যও। নিজের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সত্তাকে সে এরই মধ্যে ধ্বংস করেছে। এখন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের দিকে। বিষয়টি সরলরৈখিক ভারতবিরোধিতার নয়। বরং বিষয়টির ভরকেন্দ্র হলো ভোক্তা সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তারের বিরোধিতায়। ভারতীয় ভোক্তা সংস্কৃতির প্রচার করে ফ্যাসিস্ট নন্দনতত্ত্ব, যা গ্রাস করে নেয় সবার স্বকীয়তা, নিজস্বতা। সবাইকে পরিণত করে পণ্যে। নিজ দেশে সে যেমন বাজার বাড়াতে সর্বগ্রাসী হয়েছে, তেমনি হাত বাড়িয়েছে বিশ্ব বাজারের দিকে। আর তুলনামূলক দুর্বল শক্তির কারণে আমাদের প্রেক্ষাপটে তাদের প্রভাব নিরঙ্কুশ হবে, তা বুঝতে বেশি আয়াস লাগে না।
সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার হালচাল
বাঙালির মানসে এক দুর্নিবার ঔপনিবেশিকতা আস্তানা গাড়ে প্রধানত কম্পানি আমলে, বেঙ্গল রেনেসাঁর পর। তারা হয়ে পড়ে শক্তিশালীর দুর্বল অনুকারী। ব্রিটিশ শাসকচক্রের সযত্ন তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা 'দেখতে নেটিভ, কিন্তু মনে-মননে ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ স্বার্থসিদ্ধ করে' তারা এই দুর্বল অনুকরণের পরম্পরা আজও জারি রেখেছে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, কল্লোল গোষ্ঠীসহ আমরা আজ পর্যন্ত সাহিত্যে পশ্চিমে প্রাপ্ত নির্দেশিকার অনুকরণ করে গেছি। শেখ মুজিব পশ্চিমাধারার জাতীয়তাবাদ চর্চা করে নেতা হয়েছেন আর দেশি ধারার চর্চা করে ভাসানী ১৯৬৯ সালের পর হালে পানি কমই পেয়েছেন। আমাদের বাংলা ছবিও অধুনা ও সর্বদাই ভারতীয় ছবির উপনিবেশ। ১৯৬০-৭০ এর দশকে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে অনুকরণ করা হতো দিলীপ কুমার ও উত্তম কুমারকে। আজ করা হয় বলিউডি সিনেমাকে। কিন্তু বলিউডি স্থায়ী পুঁজি, কারিগরি দক্ষতা না থাকায় তা দুর্বল অনুকরণেই পর্যবসিত হচ্ছে। ভারতীয় বাজারি ছবির মতো আজগুবি কাহিনী নর্তন-কুর্দন আর জবরজং মারপিটের ব্যবহার পাওয়া যাবে বাংলা ছবিতেও। ফলে ঢাকাই ছবির নির্বিচার পক্ষ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও তার ক্ষমতা তুলনীয় নয় বলিউডি ছবির সঙ্গে। তবু এতেও থাকে ভোক্তা-সংস্কৃতির নানা উপকরণ। গুণগতভাবে হলিউড, বলিউড, ঢালিউডের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হলিউডি-বলিউডি বাজারি সিনেমা খুব সুস্থধারার সিনেমা হাজির করে এমন নয়। এদের কোনো মূলগত অনৈক্য নেই। উন্নত কারিগরি দক্ষতা, অকর্ষণীয় সংলাপের সুবাদে হলিউড-বলিউড যৌনতা, ভালগার আর ভায়োলেন্স খুব সুন্দর মোড়কে হাজির করে। অন্যদিকে ফাটকা পুঁজির কম বাজেটের বাংলা ছবির সে সামর্থ্য নেই, কারিগরি দক্ষতা নেই, তাই এসব জিনিস তারা সরাসরি দর্শককে দেখায়। ছলটুকু করতে তারা জানে না, পারে না।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
২০১০ সালে সরকার ভারতীয় বাজারি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সচেতন মহলে এই প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সংবাদপত্র ও ব্লগে বিস্তর লেখালেখি শুরু হয় এ নিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা প্রবল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, চলচ্চিত্রশিল্পী রাজ্জাক, আলমগীর, রামেন্দু মজুমদার, নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, ডা. এম এ করিম প্রমুখ। আবার মুদ্রার অপর পিঠও আছে। গদ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান কে এম আর মঞ্জুর, বিভিন্ন সিনেমা হল মালিকসহ অনেকে এর পক্ষে কথা বলতে থাকেন। ২০১০ সালের এপ্রিলে চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ গঠিত হয় এবং তারা ঘোষণা করে, 'দেশে কোনোমতেই ভারতীয় চলচ্চিত্র আসতে দেওয়া হবে না। যদি দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় চলচ্চিত্র আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আন্দোলনের পথ বেছে নেব। শিল্পী, কলাকুশলীরা তখন ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবে।' এই ঐক্য পরিষদে সংশ্লিষ্ট ছিলেন মিজু আহমেদ, শওকত জামিল, আবদুল লতিফ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শাহ আলম কিরণ, খসরু প্রমুখ। এ ছাড়া ২০১১ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ জানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম সোসাইটি 'স্ট্যামফোর্ড সিনে ফোরাম'। তারা মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সংস্কৃতি মঞ্চ ও নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে। তারপর ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ সালে যখন আইনের ফাঁকফোকর গলে এসব ছবি দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশনার অজুহাতে তখন অনেকেই চুপ থাকেন, পাছে আদালত অবমাননার ঘেরাটোপে পড়ে যেতে হয়_ এই ভেবে। এফডিসিকেন্দ্রিক আন্দোলনকারীরা মৌন থাকেন। কিন্তু কিছু তরুণ 'ভারতীয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র আগ্রাসন প্রতিরোধ আন্দোলন' নাম দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাঁরা ২১ ডিসেম্বর প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেন এবং তথ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশে যান। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা সম্পন্ন করা যায় না। তবে ২৩ ডিসেম্বর যেসব হলে ভারতীয় পর্ন সিনেমা দেখানো হবে, তার সামনে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেন। প্রবল পুলিশি বাধা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নানা বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিভিন্ন সমমনা ফিল্ম সোসাইটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংবাদপত্র কর্মী, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। তাঁরা নিজেদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন।
উত্তরণের উপায়
আমরা পৃথিবীর সব দেশের সিনেমা দেখার পক্ষে। এমনকি সব ধরনের সিনেমা দেখারও পক্ষে। কোনোভাবেই বিদেশি ছবি আমদানিকে সরলরৈখিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ানো উচিত নয়। বরং সারা দুনিয়ার ভালো ভালো ছবি যাতে আমাদের দেশের সবাই দেখতে পারে, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণই আমাদের লক্ষ্য। যেখানে বাজারি সিনেমা আমদানি করে বাজারের দখল নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং মানুষকে নিছক ভোক্তায় পরিণত করা হচ্ছে, তা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে বেশি আয়াস লাগে না, ভারতীয় ছবি আমদানি করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রদর্শন করলেই প্রতিযোগিতা করে আমাদের চলচ্চিত্রের মান ভালো হয়ে উঠবে না, তেমন সমন্বিত চেষ্টা ছাড়া সোনার ডিম পাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়ে যাবে। এ শিল্প নানা ঘটনা পরম্পরায় প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে গেছে। তবু আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ প্রজন্ম পরিচালক ও নির্মাতা উদ্যোগী আছেন। তাঁরা আমাদের ছবি বানানোর জন্য তাঁদের সংগ্রাম জারি রেখেছেন। তাঁদের সংগ্রামের পথ আরেকটু সহজ করার জন্য আমাদের প্রয়াসী হতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শনসংক্রান্ত বিষয়টি এই নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে আজ পর্যন্ত একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট নেই। একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরিতে সরকারি পদক্ষেপ খুবই জরুরি। হলগুলোর অবস্থা খুবই বেগতিক। সেখানে পর্দা ময়লা, প্রজেক্টর নষ্ট। হল মালিকদের দিক থেকে যেমন এসব বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। হলগুলোয় ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করতে হবে, সিনেমাস্কোপ লেন্স লাগাতে হবে। বন্ধ সিনেমা হলগুলো আবার চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। টিকিটের ওপর আরোপিত কর মুক্ত করে দিতে হবে। এতে হলে জনসমাগম বাড়বে। চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া ঠুনকো সেন্সর নীতিমালা পরিবর্তন ও কার্যকর সেন্সর বোর্ড গঠন করতে হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি কাঁচামাল ও অনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর আমদানি কর সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে। মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের চাহিদা পূরণে প্রতিবছর সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কেবল মুখ দেখানো অনুদান নয়, প্রদত্ত অনুদান যেন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অনুদান কাকে, কেন দেওয়া হচ্ছে_অনুদান প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অনুষ্ঠান প্রচার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক। এমন নানা দিক থেকে সুপরিকল্পিত কাজ করার মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, সিদ্ধান্তগুলো যেন আগের মতোই আত্মঘাতী না হয়।
কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর নানা নতুন নতুন ফিকিরে একটু একটু করে নষ্ট হয়েছে ঢাকাই সিনেমা। অবাধ আকাশ দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে, মগজের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করেছে বাজারি ছবি, সেই সঙ্গে জনগণের পকেটও কাটা হয়েছে, পর্নোগ্রাফি চর্চা করা হয়েছে, ইন্দ্রিয়বৃত্তি উসকে দিয়ে মস্তিষ্ক নিশ্চল করার কাজে সিনেমা ব্যবহার হয়েছে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন 'আইনগত দিক থেকে এভাবে সরকার ভারতীয় ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে রাখতে পারে না।' আমরা বলি, আইন না থাকলে আইন প্রণয়ন করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আগ্রাসনবিরোধী আইন নেই দেখিয়ে আগ্রাসন জায়েজ করা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য প্রকাশ। শুধু অধ্যাপকরাই নন, একই ধরনের চিন্তার মন্ত্রী, আমলা ও নীতিনির্ধারকদের কারণে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আজ হুমকির মুখে। চলচ্চিত্র ডোবে ডুবুক, আমরা আমাদের টাকা উঠাতে চাই লাভ করে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে চাই_এরূপ মানসিকতার কারণে বিলুপ্তির আশঙ্কা আরো বেড়েছে। চলচ্চিত্র কখনো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে অতি বুদ্ধিবৃত্তিক আঁতেল উদ্ধারকর্তাদের মাধ্যমেও। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশ কুসুমাস্তীর্ণ করব, নাকি কণ্টকাকীর্ণ করব।
শেষ কথা
শেষ কথা সহজভাবে বলতে গেলে লড়াইটা পুঁজির, লড়াইটা রাজনীতির, দখলদারিত্ব বিস্তারের, আধিপত্যবাদ কায়েমের। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজেদের দৈন্য। ভারতীয় বাজারি ছবি আমাদের দেশে আসার এক হাজার একটা যুক্তি থাকতে পারে কিন্তু একই যুক্তি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু হবে না। এই হলো উদার নীতির উদারতা, মুক্তবাজারের মুক্তি। উদারতা কেবল দেখায় কম শক্তির গরিবরা। মুক্ত থাকে কেবল গরিবের বাজার। আর শক্তিশালীদের বাজারে ঢুকতে গেলেই নানা নিয়ম-নীতির চোখ রাঙানিতে পালানো ছাড়া গতি থাকে না। ভারতের আকাশ সংস্কৃতি যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে আমাদের দেশে, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সেভাবে কেন যেতে পারছে না ভারতে? আমাদের কিছু তো ভালো ছবি আছে, ভারতের তিনটি ছবি আমাদের দেশের হলে এল, আমাদের তিনটি ছবি কেন একই সমারোহে ভারতের হলে দেখানো হচ্ছে না? রক্ষণশীলতা দেখাচ্ছে কেবল ভারতই। আমাদের যেন রক্ষা করার মতো কিছুই নেই। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, চলচ্চিত্রে ভিন্ন সফলতাও তো কম নয়। সেই সাফল্য খুঁজতেও খুব কষ্ট হয় না। জহির রায়হান থেকে শুরু করে আমাদের তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকি, নুরুল আলম আতিক কম কিছু অর্জন করেননি। কিন্তু তাঁদের পদে পদে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়েছে। তাঁদের অবাধ বিচরণের পথ বন্ধ করা হয়েছে। জহির রায়হানের সময় ছিল বিদেশি বুর্জোয়া শাসকরা। আজ এসেছে তাদেরই দেশি প্রতিনিধিরা। শোষণের পদ্ধতি, দাবিয়ে রাখার উপায় একই আছে। কিন্তু বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেই সত্য সবচেয়ে শানিতভাবে বেরিয়ে আসবে, সবচেয়ে শক্তি নিয়ে প্রকাশিত হবে_তা এসব বিদেশি আধিপত্যবাদী ও তার দেশি গোলামরা ভুলে গেছেন। ইতিহাস তাঁরা পড়েন না, পড়লে তা জানতেন।
আমরা ইমেজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আস্থা রাখি। যে ইমেজের ভিত্তি অসত্য, অন্যায় শোষণ; তার পরাজয় নিশ্চিত জেনেই আমাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে হবে। সিনেমায় আমরা আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রকাশ দেখতে চাই, সিনেমাকে পুঁজির দাসত্বমুক্ত ও জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি হিসেবে চাই।
No comments