ক্রসফায়ার, গুম বন্ধ করুন-মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ
সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাংলাদেশ ডেলিগেশনের প্রধান উইলিয়াম হানা এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুপ্তহত্যা, গুম ইত্যাদি মানবাধিকারপরিপন্থী অপরাধের নিন্দা করেছেন। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক নিন্দা করেছেন বলে নয়, বাংলাদেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন যাপন নিশ্চিত করার স্বার্থে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছে এবং ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ বলে বর্ণিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১০০ জন মানুষ। তাদের মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) হাতে ৩৫ জন, পুলিশের হাতে ১৯ জন আর র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে নিহত হয়েছে চারজন। বাকিরা মারা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকা অবস্থায়, যেটাকে বলা হয় ‘নিরাপত্তা হেফাজত’।
২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত কথিত ক্রসফায়ারে নিহত মানুষের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক নিন্দা-সমালোচনার পরও ক্রসফায়ার নামের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। নতুন উদ্বেগের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে আরও এক গুরুতর পদ্ধতি—গুম বা গুপ্তহত্যা। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে তুলে নিয়ে গেছেন। তার পর থেকে তিনি নিখোঁজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ কিছু জানে না, নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতেও পারে না। তারপর এক দিন পাওয়া গেল নিখোঁজ ব্যক্তিটির লাশ। এ রকম ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ৫১ জন মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। তাদের মধ্যে লাশ পাওয়া গেছে মাত্র ১৫ জনের, বাকিরা নিরুদ্দেশ। তাঁরা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন—এসব উদ্ঘাটন করা, উদ্ধারের প্রয়োজন হলে উদ্ধার করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তথা রাষ্ট্রের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিখোঁজ (গুম বা অপহরণের শিকার) ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে চায় না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, ২০১১ সালে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমরা সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকারকে পৃথকভাবে দেখতে চাই। সমাজে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ হ্রাস পেলে অবশ্যই জনজীবনে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে এবং সে কারণে এটা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতেই যদি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনা অব্যাহত থাকে, তাহলে সমাজে গভীর নিরাপত্তাহীনতা থেকেই যায় এবং সার্বিক বিচারে তাহলে বলা যায় না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আসলে উন্নতি হয়েছে। উন্নয়ন-সহযোগী বা দাতাদের নিন্দা-সমালোচনার কারণে নয়, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থেই সরকারের উচিত ক্রসফায়ার ও গুমের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা হেফাজতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাগুলো বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
No comments