বহে কাল নিরবধি-অবক্ষয়কবলিত দুর্ভাগা এই দেশ! by এম আবদুল হাফিজ
এক সময়ে ভাবা হতো যেকোনো দেশ, জাতি বা সমাজের অবক্ষয় কোনো বিশেষ গোষ্ঠী, বিশেষ করে সমাজের অপরাধপ্রবণ অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্তত আমরা এই প্রপঞ্চের (Phenomenon) সর্বজনীনতা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না।
এখন তার সর্বজনীনতা সম্পর্কে আমরা শতভাগ নিশ্চিত এবং তা না হয়েও উপায় নেই। সংবাদপত্রে পড়েছি সহকারী জজের কারে ফেনসিডিল ও অস্ত্র পাওয়ার কথা। র্যাবের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পটিয়ার কোনো এক দরবার শরিফ থেকে অর্থ লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠেছিল। আর পুলিশ? তাদের বিরুদ্ধে শুধু ছিনতাইকারীকে সহযোগিতাই নয়, স্বয়ং ছিনতাই করার অভিযোগ আছে। কখন কোন পরিস্থিতিতে এমন অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো ঘটে, তা নিয়ে মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণ হতে পারে; কিন্তু মুহূর্তে এগুলোর কারণ হিসেবে উপলব্ধিতে যা ভেসে ওঠে, তা হলো কোথাও কোনো বিচ্যুতি, কোনো ব্যত্যয় অথবা সমাজে বা ব্যক্তিবিশেষে কোনো মারাত্মক স্খলন, যা ঘটলে তারা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে এবং নৈতিকতাবোধ বিলুপ্ত হয়।
একদিনে, বছরে বা যুগে এই অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয় না অথবা কোনো একটি মহলই এর জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি না। মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো_বিন্দু বিন্দু পানি দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রস্তরখণ্ডের ওপর পতিত হলে যেমন পাথরও ক্ষয়ে যায়, তেমনি সমসাময়িক সময়ের নিরন্তর কুপ্রভাবে বাধ্য হয়ে তাদের মহৎ প্রবৃত্তি বিকৃত হয়েছে। এক সময়ে ওই সুকুমার বৃত্তিগুলো তার ধারকের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে সুকুমার বৃত্তির ধারক মানুষটি আর ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না।
পাঠকরা নিশ্চয়ই দেখেছেন, আপনার চারদিকের মানুষজন আজকাল কী অবলীলায় গর্হিত কঠিন কাজটি সম্পন্ন করে। প্রতিবেশী, সহপাঠী বা হরিহর আত্মা বন্ধুর গলায় ছুরি চালাতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। তাদের বিকৃত মননের শিকার হতে দেখা যায় জায়া-ভগি্ন-মাতাকে। ধর্ষণ করার পর হত্যা এখন আকছার ঘটে থাকে। সেখানেও মূল্যবোধের অভাবে মানবিকতা বোধ জাগ্রত হয় না। অথচ কয়েক মুহূর্ত আগেই ধর্ষণের শিকার নারী অথবা কিশোরী বা তরুণীকে ধর্ষক-ঘাতক ব্যক্তিটি তার সব আবেগ-উচ্ছ্বাস দিয়ে আলিঙ্গন করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রেমিক রূপান্তরিত হয় ঘাতকে। অনেকে হয়তো একে নাশকতা বা নিষ্ঠুরতা বলবেন, কিন্তু এরও পেছনে তো এক প্রকার অবক্ষয়ই কাজ করে।
অবক্ষয় কি মনোবিকারের চূড়ান্ত পর্যায়! কিন্তু অবক্ষয়ের মতো একটি সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী-মহামারিকে কি কোনো মানসিক ব্যাধির ছকে ফেলে এর ভয়াবহতা হ্রাস করা যায়। কৈশোরে প্রাপ্তবয়স্কদের অভ্যাসপ্রসূত বিষয়গুলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ভেবেছি। স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই কেউ কিছু বলার আগেই ওই সব বিষয় যেমন_ধূমপান এমনকি কোনো কোনো প্রকার সিনেমায় আমাদের কিশোরদের প্রবেশাধিকার নেই বলে নিশ্চিত থেকেছি। সময়ের হাওয়ায় কোথায় কখন কিভাবে সেসব স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পর্দা উন্মোচিত হলো জানি না। এখন তো কিশোর বা ষাটোর্ধ্ব সবার হাতেই ইয়াবা।
সমাজ বদলের উথাল-পাথাল হাওয়ায় আমাদের সমাপনী পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন ছিন্ন না হলেও হয়েছে শিথিল, ভঙ্গুর। নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনকে গণ্য করা হয় এক প্রকারের প্রতিক্রিয়াশীলতা। প্রগতিশীলতার নামে পারস্পরিক সম্পর্কে এসেছে শিষ্টাচারহীনতা, যার প্রভাব আমরা রাজনৈতিক জীবনেও অনুভব করি।
অনেকে মনে করেন, দেশের বিবদমান রাজনীতি সমাজে অবক্ষয় এনেছে। আমি তো বরং মনে করি, দেশে বিদ্যমান অবক্ষয়ই রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। অবক্ষয়ের আরেক নাম সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে নিশ্চলতা (Stupor) যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সমাজ, রাষ্ট্র বা ব্যক্তিজীবনে নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা নতুন দর্পণের রক্ত সঞ্চালিত হয় না। আমরা এখন সেই নিশ্চলতায় আক্রান্ত, যা আমাদের রাজনীতিকেও সংক্রমিত করেছে। আমাদের বিরাজমান সাংঘর্ষিক রাজনীতি যে ক্রমেই আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোর অপমৃত্যু ঘটিয়ে আমাদের হ্যামিলনের বাঁশি বাজিয়ে এক মৃত্যুকূপের দিকে ধাবিত করছে সে হুঁশই আমাদের নেই। দেশের কলহপ্রিয় শীর্ষস্থানীয় নেতারা আত্মপ্রসাদে ভুগছেন যে তাঁদের কেউ রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন, আবার কেউ আপসহীন দেশনেত্রী।
এরই মধ্যে সমাজের সামর্থ্যবানরা নির্জলা ভোগবাদে গা ভাসিয়েছে। তারা কোনো অনুশাসনের নিগড়ে আবদ্ধ হতে চায় না। তাদের কোনো জীবনদর্শন নেই।
তারা কোনো আদর্শের তোয়াক্কা করে না। জীবনকে তারা শুধু উপভোগ্যই দেখতে চায়। আস্তে আস্তে এমন মানুষ যূথবদ্ধ জীবনে যে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার প্রয়োজন তা-ও হারিয়ে ফেলে এবং একটি অনুভূতিহীন যান্ত্রিক জীবনে উপনীত হয়। এরই প্রতিফলন আজকাল আমরা দেখি সমাজজীবনের স্থূলতা ও কৃত্রিমতার মধ্যে। এতে হয়তো উচ্ছলতা আছে, কিন্তু নান্দনিকতা নেই।
অবক্ষয়ের অন্ধকার জগৎ থেকে আমরা যে শিগগিরই বেরিয়ে আসতে পারব তার কোনো লক্ষণ নেই। নেই সে লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা। ফলে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা শুধু তলিয়েই যাচ্ছি অতল গহ্বরে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
একদিনে, বছরে বা যুগে এই অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয় না অথবা কোনো একটি মহলই এর জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি না। মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো_বিন্দু বিন্দু পানি দীর্ঘদিন ধরে কোনো প্রস্তরখণ্ডের ওপর পতিত হলে যেমন পাথরও ক্ষয়ে যায়, তেমনি সমসাময়িক সময়ের নিরন্তর কুপ্রভাবে বাধ্য হয়ে তাদের মহৎ প্রবৃত্তি বিকৃত হয়েছে। এক সময়ে ওই সুকুমার বৃত্তিগুলো তার ধারকের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে সুকুমার বৃত্তির ধারক মানুষটি আর ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না।
পাঠকরা নিশ্চয়ই দেখেছেন, আপনার চারদিকের মানুষজন আজকাল কী অবলীলায় গর্হিত কঠিন কাজটি সম্পন্ন করে। প্রতিবেশী, সহপাঠী বা হরিহর আত্মা বন্ধুর গলায় ছুরি চালাতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। তাদের বিকৃত মননের শিকার হতে দেখা যায় জায়া-ভগি্ন-মাতাকে। ধর্ষণ করার পর হত্যা এখন আকছার ঘটে থাকে। সেখানেও মূল্যবোধের অভাবে মানবিকতা বোধ জাগ্রত হয় না। অথচ কয়েক মুহূর্ত আগেই ধর্ষণের শিকার নারী অথবা কিশোরী বা তরুণীকে ধর্ষক-ঘাতক ব্যক্তিটি তার সব আবেগ-উচ্ছ্বাস দিয়ে আলিঙ্গন করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রেমিক রূপান্তরিত হয় ঘাতকে। অনেকে হয়তো একে নাশকতা বা নিষ্ঠুরতা বলবেন, কিন্তু এরও পেছনে তো এক প্রকার অবক্ষয়ই কাজ করে।
অবক্ষয় কি মনোবিকারের চূড়ান্ত পর্যায়! কিন্তু অবক্ষয়ের মতো একটি সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী-মহামারিকে কি কোনো মানসিক ব্যাধির ছকে ফেলে এর ভয়াবহতা হ্রাস করা যায়। কৈশোরে প্রাপ্তবয়স্কদের অভ্যাসপ্রসূত বিষয়গুলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ভেবেছি। স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই কেউ কিছু বলার আগেই ওই সব বিষয় যেমন_ধূমপান এমনকি কোনো কোনো প্রকার সিনেমায় আমাদের কিশোরদের প্রবেশাধিকার নেই বলে নিশ্চিত থেকেছি। সময়ের হাওয়ায় কোথায় কখন কিভাবে সেসব স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পর্দা উন্মোচিত হলো জানি না। এখন তো কিশোর বা ষাটোর্ধ্ব সবার হাতেই ইয়াবা।
সমাজ বদলের উথাল-পাথাল হাওয়ায় আমাদের সমাপনী পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন ছিন্ন না হলেও হয়েছে শিথিল, ভঙ্গুর। নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনকে গণ্য করা হয় এক প্রকারের প্রতিক্রিয়াশীলতা। প্রগতিশীলতার নামে পারস্পরিক সম্পর্কে এসেছে শিষ্টাচারহীনতা, যার প্রভাব আমরা রাজনৈতিক জীবনেও অনুভব করি।
অনেকে মনে করেন, দেশের বিবদমান রাজনীতি সমাজে অবক্ষয় এনেছে। আমি তো বরং মনে করি, দেশে বিদ্যমান অবক্ষয়ই রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। অবক্ষয়ের আরেক নাম সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে নিশ্চলতা (Stupor) যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সমাজ, রাষ্ট্র বা ব্যক্তিজীবনে নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা নতুন দর্পণের রক্ত সঞ্চালিত হয় না। আমরা এখন সেই নিশ্চলতায় আক্রান্ত, যা আমাদের রাজনীতিকেও সংক্রমিত করেছে। আমাদের বিরাজমান সাংঘর্ষিক রাজনীতি যে ক্রমেই আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোর অপমৃত্যু ঘটিয়ে আমাদের হ্যামিলনের বাঁশি বাজিয়ে এক মৃত্যুকূপের দিকে ধাবিত করছে সে হুঁশই আমাদের নেই। দেশের কলহপ্রিয় শীর্ষস্থানীয় নেতারা আত্মপ্রসাদে ভুগছেন যে তাঁদের কেউ রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন, আবার কেউ আপসহীন দেশনেত্রী।
এরই মধ্যে সমাজের সামর্থ্যবানরা নির্জলা ভোগবাদে গা ভাসিয়েছে। তারা কোনো অনুশাসনের নিগড়ে আবদ্ধ হতে চায় না। তাদের কোনো জীবনদর্শন নেই।
তারা কোনো আদর্শের তোয়াক্কা করে না। জীবনকে তারা শুধু উপভোগ্যই দেখতে চায়। আস্তে আস্তে এমন মানুষ যূথবদ্ধ জীবনে যে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার প্রয়োজন তা-ও হারিয়ে ফেলে এবং একটি অনুভূতিহীন যান্ত্রিক জীবনে উপনীত হয়। এরই প্রতিফলন আজকাল আমরা দেখি সমাজজীবনের স্থূলতা ও কৃত্রিমতার মধ্যে। এতে হয়তো উচ্ছলতা আছে, কিন্তু নান্দনিকতা নেই।
অবক্ষয়ের অন্ধকার জগৎ থেকে আমরা যে শিগগিরই বেরিয়ে আসতে পারব তার কোনো লক্ষণ নেই। নেই সে লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা। ফলে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা শুধু তলিয়েই যাচ্ছি অতল গহ্বরে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments