অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ন ভাবনা by এম এ রশীদ

কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ : যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় রাখা কর্তব্য। নামকরণের প্রস্তাব এলে এটা জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে তাতে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। শেখ মুজিবের কথাই ধরুন। ওই মহানায়কের উপাধিই তো বঙ্গবন্ধু।


তিনিই তো খালি হাতে রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।' আর কার আছে এত সাহস? বের করুন তো তাঁর সমকক্ষ। কোনো হুইসেলধারীর আশ্বাস পেয়ে তিনি তো এই হুংকার ছাড়েননি। তাই তাঁর নামের উপাধির সঙ্গেই বাংলাদেশ জড়িয়ে আছে। তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ায় মাননীয় হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিলেন- 'তাঁকে এ পুরস্কার দেয় কে? তিনি তো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা- সব কিছুর উর্ধ্বে।' এই পুরস্কার দিয়ে তাঁকে অবনমিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণের আগে এই প্রেক্ষাপট অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। জাতিসংঘে যেদিন তিনি বাংলায় ভাষণ দেন, সেদিন Legendary Mujib will speak- এই শিরোনামে সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে লিফলেট ছাড়া হয়। তাই বলি, যত্রতত্র যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে তাঁর নামের ছোঁয়া দিয়ে বড় করার প্রয়োজন নেই। তবে মিরপুর স্টেডিয়ামটি তো এখনো তাজউদ্দীনের নামে করা যায়।
যে প্রতিষ্ঠানের নাম কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে আগেই নামকরণ হয়ে গেছে, সেই নাম পরিহার করে নিজ দলীয় কারো নামে নামকরণ করা লোকে খুব পছন্দ করে না।
ঢাকা শহরকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি বৃহৎ ও ব্যয়বহুল প্রকল্প গৃহীত হয়েছে- যেমন জয়দেবপুর-নারায়ণগঞ্জ উড়াল সেতু, মিরপুর-গুলিস্তান মনো রেল, গুলিস্তান-যাত্রাবাহী ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতু ও প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পদ্মা সেতু।
বৃহৎ প্রকল্পের প্রতি এত আগ্রহাতিশয্যের রহস্য কী? প্রকল্প প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা কি এটা অবগত নন যে প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, আনুপাতিক হারে পণ্য সরবরাহ বা সেবা উৎপাদন বৃদ্ধি না পেলে ওই শ্রেণীর প্রকল্পে অর্থ ঢালা দেশে মূল্যস্ফীতি উসকে দেওয়ার শামিল। উল্লিখিত সব ব্যয়বহুল প্রকল্প যোগাযোগ খাতে অন্তর্ভুক্ত করায়ও সাধারণ মানুষ এর মধ্যে উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করবে। জনগণ বরং আশা করে, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক এত ব্যয়বহুল প্রকল্পের আধিক্যের পরিবর্তে যতটা সম্ভব দেশের সব অঞ্চলে বিভিন্ন আকারের মাঝারি প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়া, যাদের বাস্তবায়নকাল হবে হ্রস্ব এবং ব্যয়সীমা হবে সাধ্যের মধ্যে। তাহলেই প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্য উপকারিতা সারা দেশে বিস্তৃত হবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে- যার ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনে প্রায় সব অঞ্চল সমহারে না হলেও সম্ভাব্য ন্যায্য হারে উপকৃত হবে।
যেকোনো ইস্যু উত্থাপিত হলেই সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক জবাবদিহিতা প্রয়োজন। পাকিস্তান আমল থেকে দেখে এসেছি, প্রায়ই তথ্যমন্ত্রী সরকারের পক্ষে Spokesman-এর কাজ করেন। তবে ওই মন্ত্রীকে হতে হয় কাজে দক্ষ এবং জ্ঞানগরিমায় ও বাচনভঙ্গিতে অন্যদের চেয়ে বাড়া। বর্তমান সরকারের পক্ষে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য নির্ধারিত কোনো মন্ত্রী আছেন বলে দেখা যায় না। বিরোধীদের বক্তব্য ও দাবির জবাবই দেওয়ার কোনো প্রয়োজন কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। এমন একটা ভাব যেন কোনো অভিযোগ বা প্রস্তাব অথবা মতামত বিরোধী দল তুলে ধরলে তার জবাব বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর ওপর কোনো অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। ওদিকে কোনো প্রশ্ন উঠলেই প্রধানমন্ত্রীর জবাব দেওয়ার মতো গুরুগম্ভীর ইস্যু না হলেও তিনি হালকাভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
সরকার সম্প্রতি ছয়টি নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাকথিত বিশেষজ্ঞ ও বিশেষ মতবাদের সাংবাদিক- যাঁরা সর্বদা সরকারবিরোধী কিছু বলার বা লেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন, তাঁরা অহরহ বলে বেড়াচ্ছেন যে নতুন ব্যাংক স্থাপনের কোনো সংগত যুক্তি নেই এবং বিদ্যমান ব্যাংকগুলোই অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরের বর্তমানের ব্যাংকিং প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। এই প্রস্তাবিত ব্যাংক ছয়টি ব্যাংকিং খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে। সরকার কেবল দলীয় স্বার্থে এই ছয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বা গভর্নর কোনো তথ্যভিত্তিক জবাব দেননি। প্রায়শই দেখা যায়, এ ধরনের সমালোচনার কোনো তথ্য বিশ্লেষণমূলক সরকারি জবাব না পাওয়ায় জনমনে অভিযোগগুলো শিকড় গেড়ে বসে। অবশ্য দেখা গেল, বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন যে আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় ব্যাংক শাখার সংখ্যা অপ্রতুল, জিডিপির আকারের তুলনায় ব্যাংকসেবা অপ্রতুল, খাদ্য উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে ওই সেক্টরে ব্যাংকসেবা সম্প্রসারিত হয়নি। তা ছাড়া বিদেশি রেমিট্যান্স-প্রবাহ বৃদ্ধি ও গার্মেন্ট রপ্তানি বৃদ্ধির হারের তুলনায় ব্যাংকসেবা খুবই অপর্যাপ্ত। ড. হাছান মাহমুদের এই তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের পর জনমনে সৃষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনেকটাই কেটে গেছে।
উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা দেশ পরিচালনায় ব্যস্ত। কিন্তু উপদেষ্টারা না নির্বাচিত, না আছে তাঁদের জবাবদিহিতা। দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ সেক্টরই সর্বাধিক বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অতি ভয়াবহ- এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে লোডশেডিং আরো অসহনীয় হবে, কৃষি ও শিল্প-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন নিম্নগামী হবে, বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব উৎপাদিত পণ্যের মূল্য আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা তাঁর দায়িত্ব সামাল দিতে সক্ষম বলে গণ্য করা যায় না।
পঁচাত্তর সালে বার্ষিক বাজেটের পরিমাণ ছিল এক হাজার বা এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর বর্তমান পরিমাণ আনুমানিক এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির পরিমাণ ১৯০ গুণ। স্পষ্টত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মের পরিমাণ, পরিধি ও ব্যাপ্তি বিশাল ও বিপুল আকার ধারণ করেছে। অতীতে প্রায়শই এ মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করে মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করা হতো। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর মেধা, দক্ষতা ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু তাঁর মতো বয়স্ক এক ব্যক্তির একার পক্ষে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সামাল দেওয়া নিঃসন্দেহে দুরূহ। একজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আছেন বটে। তবে তিনি তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা। মন্ত্রণালয়ের বিশাল কর্মপরিধির কোনো কাজ সরাসরি তাঁর দেখার কথা নয়। প্রতিমন্ত্রী থাকলে হয়তো শেয়ার মার্কেটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে যথাযথ দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারতেন।

লেখক : কলামিস্ট, সাবেক যুগ্ম সচিব

No comments

Powered by Blogger.