অংশীদারি সংলাপের যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর আজ-শান্তি নিরাপত্তা ও উন্নয়নে কাজ করবে ঢাকা-ওয়াশিংটন by মেহেদী হাসান

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে একযোগে নিবিড়ভাবে কাজ করার সদিচ্ছাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় অংশীদারির সংলাপ স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আজ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের 'যৌথ অংশীদারির ঘোষণা' স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে।


পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যৌথ অংশীদারির ঘোষণায় পররাষ্ট্রসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি পর্যায়ে এবং দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানের উল্লেখ থাকবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অত্যাবশ্যকীয় যে ধাপগুলো পার হতে হবে, তা গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি। আজ শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপের ঘোষণা স্বাক্ষরের জন্য সময় নির্ধারিত রয়েছে।
যা থাকছে অংশীদারি সংলাপের ঘোষণায় : কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, অংশীদারি সংলাপে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠকের কথা উল্লেখ থাকার পাশাপাশি সুস্পষ্ট কিছু বিষয়ে ঐকমত্যের কথা থাকতে পারে, যা ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক ও আলোচনার রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জোরালো মৈত্রী ও মূল্যবোধকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করার ঘোষণা থাকতে পারে যৌথ ঘোষণার প্রথম দিকেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়াদিতে দুই দেশের অংশীদারত্ব জোরদারের আগ্রহ বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও বৈশ্বিক স্বার্থে পারস্পরিক শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে একযোগে কাজ করার এবং জোরালো অংশীদারির ব্যাপারে দুই দেশের বিশ্বাস রাখার কথাও থাকবে যৌথ ঘোষণায়। এ ছাড়া একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ দুই দেশের পারস্পরিক মূল্যবোধ একে অন্যের প্রতি সম্পৃক্ততার পথ দেখাবে বলেও যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ থাকতে পারে।
সূত্র আরো জানায়, সহনশীলতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, শক্তিশালী সুশীল সমাজসহ বাংলাদেশি সমাজের অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা যৌথ ঘোষণায় গুরুত্ব পাবে। খাদ্যনিরাপত্তা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, জলবায়ু পরিবর্তন, গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ, নারী ও যুবসমাজের ক্ষমতায়নসহ যৌথ উন্নয়ন অগ্রাধিকার অর্জনের জন্য বৃহৎ পরিসরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার ও অংশীদারির বিষয়টিও স্থান পাবে ঘোষণায়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যৌথ ঘোষণায় জাতিসংঘের মাধ্যমে উভয় দেশের আস্থা এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ও শান্তিরক্ষা উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। এ ছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবদানের প্রসঙ্গ থাকবে।
সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, দস্যুতা, মানব ও অস্ত্রপাচারের মতো আন্তদেশীয় অপরাধ দমনসহ নিরাপত্তা সহযোগিতায় সংলাপ জোরদারে উভয় দেশের দৃঢ় আগ্রহের কথা স্থান পাবে যৌথ ঘোষণায়। এ ছাড়া সমৃদ্ধ দুই সমাজের মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, নতুন নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির আগ্রহ স্থান পেতে পারে যৌথ ঘোষণায়। তথ্য, দক্ষতা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে উভয় দেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টিতে জোর দেওয়া হতে পারে ঘোষণায়।
এ বিষয়গুলো এবং অভিন্ন লক্ষ্য পূরণে দুই দেশের অগ্রসর হওয়া, যৌথভাবে চলমান ও ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত দিকে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র 'অংশীদারি সংলাপ'-এর আওতায় প্রতিবছর বৈঠক করবে বলে ঘোষণা থাকবে। উভয় পক্ষের জন্য সুবিধাজনক সময়ে পররাষ্ট্রসচিব/আন্ডার সেক্রেটারির নেতৃত্বে ওই সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা থাকবে। এ ছাড়া দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়েও নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের আগ্রহ যৌথ ঘোষণায় স্থান পাবে বলে জানা গেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে 'কৌশলগত অংশীদারি সংলাপ'-এর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ 'কৌশলগত' শব্দটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানায়। কৌশলগত শব্দটির মাধ্যমে মূলত নিরাপত্তা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব পায় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
বিনিময় হয়নি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের এজেন্ডা : আজ শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে বৈঠকের আগে দুই দেশের মধ্যে কোনো আলোচ্যসূচি বিনিময় হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে জানান, এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই সম্ভাব্য আলোচ্যসূচি বিনিময় করেনি।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যুতে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তকরণ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অধিকতর সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা করবে ঢাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য আলোচ্যসূচি সম্পর্কে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশটি টিকফা স্বাক্ষর ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার, গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কথা বলতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা চাইতে পারে বলেও তাঁরা মনে করেন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, অন্য কোনো রাষ্ট্রের কাছে সরকার জবাবদিহি করবে না। তিনি আরো বলেন, সরকারের জবাবদিহিতা থাকবে জনগণ ও সংসদের কাছে।

No comments

Powered by Blogger.