ছাত্রলীগের হামলা, কুয়েট বন্ধ by কাজী আবদুল্লাহ ও সুমন্ত চক্রবর্ত্তী

বেলা দেড়টা। চাপাতি-রামদা-রড-লাঠি-শিকল নিয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অমর একুশে হলের ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তিনতলা হলের প্রতিটি তলায় সামনে যাকেই পেয়েছেন, বেধড়ক পিটিয়েছেন, কুপিয়েছেন। গতকাল সোমবার ঘটা এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত ছাত্ররা উপাচার্য মুহাম্মদ আলমগীরের বাসভবন ও প্রশাসনিক ভবনের কাচ ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে


পুলিশ সাধারণ ছাত্রদের লাঠিপেটা করলে উত্তেজনা আরও বাড়ে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। আহত ছাত্ররা বলেছেন, অমর একুশে হলের বার্ষিক ভোজে নিম্নমানের খাবার দেওয়ায় প্রতিবাদ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে ক্ষিপ্ত হন আয়োজক কমিটির সদস্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের নেতৃত্বেই গতকালের এই হামলা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত শিক্ষার্থীরা বলেন, ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসী গতকাল বেলা দেড়টার দিকে অমর একুশে হলে হামলা চালায়। তারা অন্তত ১০টি কক্ষ ভাঙচুর করে। গুরুতর আহত হন ২০ শিক্ষার্থী।
আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাসেল নামের দুই ছাত্র, লেনিন, শুভ, শুভজিৎ, সেতু, সুজাত, সঞ্জু, আলাউদ্দিন, কমল ও শাহাদাতকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লিংকন, সাকিব, অর্ণবকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কারও পুরো নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসাধীন এক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, অমর একুশে হলে গত ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি বার্ষিক ভোজের আয়োজন করা হয়। গত রোববার ছিল মূল আয়োজন। এ উপলক্ষে হলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮৮৫ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু টাকার তুলনায় খাবারের মান নিম্ন হওয়ায় প্রতিবাদ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় আয়োজক কমিটির সদস্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দাবি করেন, হল কর্তৃপক্ষ তাঁদের হাতে জনপ্রতি ৭০০ টাকা দিয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, সাধারণ ছাত্ররা চাঁদার টাকার বিষয়ে তদন্ত দাবি করেন। তাঁরা ভোজন কমিটির সদস্যদের হল থেকে বহিষ্কারেরও দাবি জানান। রোববার রাতে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে প্রাধ্যক্ষ সজল অধিকারীর সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় সেখানে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিবেন্দ্র শেখর শিকদার, প্রাধ্যক্ষ গ্রাইটন সরকার ও তরিকুল ইসলাম। খবর পেয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে হাজির হলে সাধারণ ছাত্ররা তাঁদের ধাওয়া দিয়ে হল থেকে বের করে দেন এবং হলের প্রতিটি ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা ওই চার শিক্ষককেও অবরুদ্ধ করে রাখেন।
আহত ছাত্ররা জানান, রাত তিনটার দিকে উপাচার্য আলমগীর ওই হলে যান এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হলের ভোজন কমিটির দায়িত্বে থাকা ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ছাত্রদের সামনে একটি কাগজে স্বাক্ষর করেন। একই সঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো সাধারণ ছাত্র মার খেলে তাঁর দায়িত্ব উপাচার্যের বলে জানান।
উপাচার্যের আশ্বাস পেয়ে ছাত্ররা চার শিক্ষককে বাইরে যেতে দেন এবং আবার ফটকগুলোতে তালা লাগিয়ে দেন।
ছাত্রলীগের হামলায় আহত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্র বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলে সংস্কারের কাজ চলায় ওই হলের অনেক ছাত্র সাময়িকভাবে একুশে হলে ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদেরও বেধড়ক পিটিয়েছেন।
হামলার প্রতিক্রিয়া: হলে ছাত্রলীগের হামলার পর ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ছাত্ররা উপাচার্যের বাসভবন ও প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে দরজা-জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা উপাচার্যের স্ত্রীকে বাসভবন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ছাত্রদের ধাওয়া দেয়। ওই সময় উপাচার্যের মেয়ে (১৩) আহত হয়।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে পুলিশের সঙ্গে উত্তেজিত ছাত্রদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় ইটের আঘাতে খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোস্তফা কামালের কপাল ফেটে যায়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ব্যাপক লাঠিপেটা করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র বলেন, ‘উপাচার্য আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার পরও ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে আমাদের মার খেতে হলো।’
খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি দেবদুলাল বাড়ৈ বলেন, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আয়োজক কমিটির সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। তবে আয়োজক কমিটির মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা থাকতে পারেন।
অধ্যাপক শিবেন্দ্র শেখর শিকদার বলেন, ‘বার্ষিক খাওয়া-দাওয়া নিয়ে গত রোববার রাতে আয়োজক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরোধ হয়। একসময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা আমাদের আটকে রাখে। শেষে উপাচার্যের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।’
অধ্যাপক শিবেন্দ্র বলেন, ‘আজ (গতকাল) সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পাল্টা হামলা করা হয়। আমি পুলিশ নিয়ে দুপুরে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। শেষে উপাচার্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন।’
যোগাযোগ করলে উপাচার্য মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমার বাংলোর ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। ছাত্ররা দুটি গাড়ি, প্রশাসনিক ও প্রকৌশল ভবনেও ভাঙচুর চালিয়েছে। আমার স্ত্রী ও মেয়েকে আহত করা হয়েছে।’
খান জাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বেলা দুইটার দিকে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘর্ষ বাধে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ঘটনার পর অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.