চার দশকের পরিবর্তিত মানসিকতা by ওয়াহিদ নবি
ফুটবল মাঠে আজকাল আর লোক হয় না। কোটি টাকা খরচ করেও আর দর্শক আনা যায় না। ফুটবলের সাবেক হিরোদের দিয়ে আবেদন করানোর পরও দেখা যায়, গ্যালারি ফাঁকা। অথচ আগে যেমন-তেমন ম্যাচ থাকলেও মাঠ ভর্তি হয়ে যেত। মফস্বল শহরের টুর্নামেন্টগুলোতেও উপচেপড়া ভিড় দেখা যেত।
কেন এমন অবস্থা হলো বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার। বলতে পারব না। কবি রেনার মারিয়া রিলকের দেওয়া উপদেশের কথা মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন একজন তরুণ কবিকে, 'যদি এমন কোনো প্রশ্ন আসে তোমার মনে যার উত্তর তুমি জানো না, তবে উত্তর জানার জন্য তাড়াহুড়া করো না। প্রশ্নটা সম্পর্কে ভাবতে থাকো উত্তরটা পেয়ে যাবে।' আমি তাঁর উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করছি। একজন বন্ধু আমাকে বলল, 'একটা জিনিস ভালো হয়েছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমায়। অন্তত একটা জায়গায় কালোবাজারি বন্ধ হয়েছে।'
কিছু কিছু জিনিস বেড়েছে। সবচেয়ে বেড়েছে 'বিউটি পার্লার'। চার দশক আগে এদের নাম শুনিনি। আর এখন এদের প্রসারের কথা বলতে গেলে ব্যাঙের ছাতার কথাটাই মনে পড়ে যায়। কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আজকাল মহিলারা অবশ্যই পার্লারে যাবেন। হাজারের কমে সেখান থেকে সার্ভিস নেওয়া যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা চলে আসে এই প্রসঙ্গে। বন্ধু আমাকে বলল, আজকাল ছোট ছোট শহরেও এমনকি পুরুষদের জন্যও বিউটি পার্লার হয়েছে।
এখন টেলিভিশন হয়েছে ঘরে ঘরে। বিউটি পার্লারের প্রসারে সাহায্য করেছে টিভি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শস্য ক্ষেতে গ্রামের মানুষগুলো তাদের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চাগুলো খালি গায়ে। তাদের মাঝখানে পার্লারফেরত বেনারসি পরিহিতা টিভিশিল্পীদের দেখে তাঁদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। রেডিওর আমলে গায়িকারা গায়িকা ছিলেন। এখন টিভি তঁাঁদের নায়িকা হতে বাধ্য করেছে। গান গাওয়ার সময় হাসলে ভালো লাগে এমনটা প্রযোজক হয়তো তাঁদের বলে দেন। 'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে' গাইতে গাইতে যখন প্রখ্যাত গায়িকা হাসেন তখন প্রচারমাধ্যমের বিশাল ক্ষমতা সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকে না।
বাংলা ভাষার দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন বাংলার সন্তানরা। সেখান থেকেই স্বাধীনতার চেতনা। কিন্তু ইংরেজি না জানলে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না। এ জন্যই বোধ হয় আজকাল কথা বলতে অনেকে অর্ধেকটা বাংলা আর অর্ধেকটা ইংরেজি বলেন। আর 'কিন্তু' কথাটা আমাদের জবান থেকে একেবারেই উঠে গেছে। অনেকের কথা শুনে মনে হয় তাঁরা 'বাংরেজি' বা 'ইংগালি' বলছেন। এর একটা কারণ হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আরেকটা কারণ হয়তো এই যে টিভির অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণ করার সময় বিদেশি বিদেশি ভাব দেখালে লোকে গুরুত্ব দেবে।
ভাষায় ভেজাল দেখে না হয় আমরা একটু হেসে নিই বা বিরক্ত হই কিন্তু খাবারে ভেজাল নিয়ে কী করব! ফরমালিন দেওয়া মাছের চেয়ে তো পচা মাছ খাওয়াই ভালো ছিল। সবটাতেই ভেজাল। সা'দত হোসেন মান্টোর গল্পের মতো বিষেও ভেজাল। কী সৃজনশীল শক্তি। লিচুগাছেই লিচুতে নাকি লাল রং স্প্রে করে ওরা- লিচুকে পাকা দেখানোর জন্য। এদের ধরবে কে? দেশটা একটা 'পানিশমেন্ট ফ্রি জোনে' পরিণত হয়েছে।
দেশটা আবার ধসের দেশেও পরিণত হয়েছে। শেয়ারবাজারে ধস, ব্যাংকে ধস। আসলে নৈতিকতায় ধস। এই পানিশমেন্ট ফ্রি জোনে যারা ধস ঘটায় তারা নিরাপদ। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, শক্তিশালী। তবে মনে হয়, হাওয়া একটু বদলাচ্ছে। দু-একজন গ্রেপ্তার হচ্ছে। দেখেশুনে মানুষ নেতিবাচক হয়ে গেছে। ওরা বলছে, এদের বিচার ও শাস্তি কি সত্যই হবে?
মানুষের পেশা আর কাজ সব বদলে গেছে। 'ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ' এ-জাতীয় একটি সংস্কৃত বাক্য শুনেছিলাম। এটা এখন আর বলা যাবে না। বলতে হবে 'ছাত্র নং টেন্ডারনং তপঃ'। ছাত্ররা যদি টেন্ডার দেয় তবে ব্যবসায়ীরা কী করছেন? দুষ্টলোকরা বলে তারা সংসদ চালাচ্ছে। শোনা কথা কাজেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে সত্য, তবে শোনা যায় যে ৮০ শতাংশ সংসদ সদস্য নাকি ব্যবসায়ী। চাঁদাবাজি কোথায় হচ্ছে না। টিভিতে দেখলাম পুলিশ গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে। বিবিসির বাংলা বিভাগের একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধে পড়লাম, আমাদের সেনাবাহিনী নাকি ব্যবসায়ে খুব ভালো করছে।
আমাদের দেশে প্রবীণদের পুনর্বাসনের খুব একটা ব্যবস্থা নেই। তাই অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ও সেনাকর্তারা রাজনীতিতে নিজেদের পুনর্বহাল করছেন। চাকরি জীবনে তাঁদের অবদান কেমন ছিল এটা কেউ জানতে আগ্রহী নন। শুনেছি এক কর্মকর্তা তাঁর ক্ষমতা তাঁর চৌহদ্দির বাইরে প্রয়োগ করার জন্য আদালত কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছিলেন। একজন আবার অতি উৎসাহে ১৪৪ ধারার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে আইনে বলা হয়েছে, চারজনের বেশি একসঙ্গে হওয়া যাবে না। সেখানে তিনি একজনের বেশি একসঙ্গে হওয়াকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। এঁরা এখন বড় রাজনৈতিক নেতা। কোনো কোনো অবসরপ্রাপ্ত কর্তা আবার টক শোতে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে উপদেশ বিতরণ করছেন। এই উপদেশদাতাদের সংখ্যা সীমিত। কাজেই একই ধরনের কথা শুনি তাঁদের কাছ থেকে। এঁদের একজনের নাকি একটি 'শপিং মল' আছে । সরকারি চাকরির সীমিত আয়ে কী করে তিনি এটা 'ম্যানেজ' করলেন কে জানে? অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই যে একমাত্র উপদেশদাতা তা নয়। একজন উপদেশদাতা সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিষোদগার করছিলেন ইদানীং। পরে শোনা গেল তিনি নাকি সরকারের কাছ থেকে কিছু বাগাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি এখনো উপদেশ দিয়েই চলেছেন কিন্তু কেউ শুনছে কি না জানি না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস একটা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখনই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তখনই কি আমরা জানতে পারি। তাহলে যখন আমরা জানতে পারিনি তখন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করে কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভালো চাকরি করছে। আমরা তাঁদের সেবা উপভোগ করছি। হে আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করো।
যুগটা হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতির। অ্যাডাম স্মিথ আর জন মেনার্ড কিনসের মতো মহামানবদের কাছে আমরা মুক্ত অর্থনীতির মাহাত্ম্যের কথা শুনেছি। এ কারণেই হয়তো আমাদের সরকার ধসজাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নাক গলায়নি। মুক্ত অর্থনীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই নিশ্চয়ই জাল টাকা তৈরির কাজে মন দিয়েছে কিছু মানুষ। কেউ কেউ নাকি ধরাও পড়েছে। ধরা পড়া মানুষগুলোর সঙ্গে ধরা না পড়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত কী রকম আমরা জানি কি? শুনি আমাদের জিডিপি নাকি সন্তোষজনক। জাল টাকা তৈরি কি গ্রহণ করা হয়েছে জিডিপি নির্ণয়ে? আর টাকা তৈরি যে এত সোজা তা আগে ভাবিনি। একটাই সান্ত্বনা পাই মনে তা হচ্ছে, আমাদের মুদ্রাস্ফীতি যখন নিয়ন্ত্রণ হারায়নি তখন জাল টাকা প্রস্তুতকারকরা হয়তো খুব উপযুক্ত নয়।
অর্থনীতি অন্যান্য নীতিকে প্রভাবিত করবে- এটাই স্বাভাবিক। কাজেই অনেক (সংখ্যা বলা যাবে না) প্রাইভেট শিক্ষায়াতন গড়ে উঠছে। এদের ভর্তি হওয়ার ফি-এর অঙ্ক শুনলে ভিরমি খেতে হয়। আমাদের জন্য গর্বের বিষয় এই যে এত টাকা দেওয়ার যথেষ্ট মানুষ আছে আমাদের দেশে। আমরা অর্থনীতির সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে বিশ্বাস করতে চাই।
সবাই অভিযোগ করেন, দুটি রাজনৈতিক দলের হাতে সব ক্ষমতা। তাঁরা তৃতীয় শক্তির উত্থান দেখতে চান। কিছুদিন আগে বিলেতের একটি বাংলা টিভির একটি টক শোতে প্যানেলের সদস্য করা হয়েছিল আমাকে। তৃতীয় শক্তির কথা আমাকে জিজ্ঞেস করা হলে আমি প্রশ্ন জিজ্ঞাসাকারীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, 'পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কোনোটাতে তৃতীয় শক্তি আপনি দেখতে পান কি?' প্যানেলের অপর সদস্য অত্যন্ত চমৎকার প্রশ্ন করলেন, 'এই তৃতীয় শক্তি চাচ্ছে কারা?' এ প্রশ্নটি উঠানোর কারণ হচ্ছে, এই যে দেশে ফলপ্রসূ দল দুটির বেশি না থাকলেও দলাদলির অভাব নেই। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি। আইনজীবীদের মধ্যে দলাদলি। সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলি। অবশ্য সাগর-রুনির খুনি ধরার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকরা। অন্যান্য নিহত সাংবাদিকদের খুনি ধরার দাবি উঠলে (যা উঠা উচিত) কী হবে কে জানে? এসব দলাদলিতে দলাদলিটাই সব। একদল যদি বলে সূর্য পূর্ব দিকে উঠেছে তবে অন্য দলটি বলবে, 'না পশ্চিম দিকে উঠেছে'। আইনজীবীরা দল ধরে এসে উচ্চকণ্ঠে টিভির ক্যামেরার সামনে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, বিচারপতিদের কাছে যুক্তি তুলে ধরে লাভ নেই; কারণ তাঁরাও একটি দলে। অবশ্য হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। দশ বছর আইন ব্যবসায়ে থাকলেই হলো। জজ হওয়ার জন্য বাকিটা 'লবিংই'। পার্লামেন্টকে এই দলাদলির হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিরোধী দল সেখানে যাচ্ছে না। শুধু দলাদলি নয়, উপদলীয় ব্যাপারও রয়েছে। ডাক্তারদের একটি দলের উপদল অপর উপদলের নেতাদের হত্যা করার জন্য পেশাদার খুনি নিয়োগ করেছে এই সংবাদ সংবাদমাধ্যমে দেখলাম যদিও ব্যাপারটি একেবারে চাপা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দুটি দল কোনো উপদলীয় কোন্দল ছাড়াই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাদের কাজ করে যাচ্ছে- তারা হচ্ছে 'মলম পার্টি' ও 'অজ্ঞান পার্টি'।
এমনি আরো আছে। খুনের ব্যাপারগুলো তেমন কিছু নয়। এসব তো অহরহই হচ্ছে। আগে ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হতো। পাচ পাত্তু আর খোকা আর তাদের বন্ধুরা অপকর্ম অনেক করেছে দেশের সেনা ত্রাণকর্তার অর্থানুকূল্যে কিন্তু খুনাখুনি করেনি। অপকর্ম করতে করতে তারা নিজেরাই খুন হয়েছে। কত পরিবর্তন হয়েছে দেশের। আজ একাত্তরের গণহত্যাকারীদের সমর্থকরা রাস্তা মাথায় তুলে এই বলে চিৎকার করে যে অভিযুক্তদের কিছু হলে আগুন জ্বলবে।
সরকার হয়েছে 'নন্দঘোষ'। সব দোষ সরকারের। আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই। ইংরেজ আমলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, 'দেশ গেছে দুঃখ নাই, তোরা আবার মানুষ হ'। আমাদের চার দশকের পরিবর্তিত মানসিকতার বাস্তবতায় এমনি কথা কোনো মহাপুরুষ বলবেন (এবং আমরা তা শুনব) এই আশায় রইলাম।
লেখক : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী চিকিৎসক
কিছু কিছু জিনিস বেড়েছে। সবচেয়ে বেড়েছে 'বিউটি পার্লার'। চার দশক আগে এদের নাম শুনিনি। আর এখন এদের প্রসারের কথা বলতে গেলে ব্যাঙের ছাতার কথাটাই মনে পড়ে যায়। কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আজকাল মহিলারা অবশ্যই পার্লারে যাবেন। হাজারের কমে সেখান থেকে সার্ভিস নেওয়া যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা চলে আসে এই প্রসঙ্গে। বন্ধু আমাকে বলল, আজকাল ছোট ছোট শহরেও এমনকি পুরুষদের জন্যও বিউটি পার্লার হয়েছে।
এখন টেলিভিশন হয়েছে ঘরে ঘরে। বিউটি পার্লারের প্রসারে সাহায্য করেছে টিভি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শস্য ক্ষেতে গ্রামের মানুষগুলো তাদের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চাগুলো খালি গায়ে। তাদের মাঝখানে পার্লারফেরত বেনারসি পরিহিতা টিভিশিল্পীদের দেখে তাঁদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। রেডিওর আমলে গায়িকারা গায়িকা ছিলেন। এখন টিভি তঁাঁদের নায়িকা হতে বাধ্য করেছে। গান গাওয়ার সময় হাসলে ভালো লাগে এমনটা প্রযোজক হয়তো তাঁদের বলে দেন। 'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে' গাইতে গাইতে যখন প্রখ্যাত গায়িকা হাসেন তখন প্রচারমাধ্যমের বিশাল ক্ষমতা সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকে না।
বাংলা ভাষার দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন বাংলার সন্তানরা। সেখান থেকেই স্বাধীনতার চেতনা। কিন্তু ইংরেজি না জানলে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না। এ জন্যই বোধ হয় আজকাল কথা বলতে অনেকে অর্ধেকটা বাংলা আর অর্ধেকটা ইংরেজি বলেন। আর 'কিন্তু' কথাটা আমাদের জবান থেকে একেবারেই উঠে গেছে। অনেকের কথা শুনে মনে হয় তাঁরা 'বাংরেজি' বা 'ইংগালি' বলছেন। এর একটা কারণ হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আরেকটা কারণ হয়তো এই যে টিভির অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণ করার সময় বিদেশি বিদেশি ভাব দেখালে লোকে গুরুত্ব দেবে।
ভাষায় ভেজাল দেখে না হয় আমরা একটু হেসে নিই বা বিরক্ত হই কিন্তু খাবারে ভেজাল নিয়ে কী করব! ফরমালিন দেওয়া মাছের চেয়ে তো পচা মাছ খাওয়াই ভালো ছিল। সবটাতেই ভেজাল। সা'দত হোসেন মান্টোর গল্পের মতো বিষেও ভেজাল। কী সৃজনশীল শক্তি। লিচুগাছেই লিচুতে নাকি লাল রং স্প্রে করে ওরা- লিচুকে পাকা দেখানোর জন্য। এদের ধরবে কে? দেশটা একটা 'পানিশমেন্ট ফ্রি জোনে' পরিণত হয়েছে।
দেশটা আবার ধসের দেশেও পরিণত হয়েছে। শেয়ারবাজারে ধস, ব্যাংকে ধস। আসলে নৈতিকতায় ধস। এই পানিশমেন্ট ফ্রি জোনে যারা ধস ঘটায় তারা নিরাপদ। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, শক্তিশালী। তবে মনে হয়, হাওয়া একটু বদলাচ্ছে। দু-একজন গ্রেপ্তার হচ্ছে। দেখেশুনে মানুষ নেতিবাচক হয়ে গেছে। ওরা বলছে, এদের বিচার ও শাস্তি কি সত্যই হবে?
মানুষের পেশা আর কাজ সব বদলে গেছে। 'ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ' এ-জাতীয় একটি সংস্কৃত বাক্য শুনেছিলাম। এটা এখন আর বলা যাবে না। বলতে হবে 'ছাত্র নং টেন্ডারনং তপঃ'। ছাত্ররা যদি টেন্ডার দেয় তবে ব্যবসায়ীরা কী করছেন? দুষ্টলোকরা বলে তারা সংসদ চালাচ্ছে। শোনা কথা কাজেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে সত্য, তবে শোনা যায় যে ৮০ শতাংশ সংসদ সদস্য নাকি ব্যবসায়ী। চাঁদাবাজি কোথায় হচ্ছে না। টিভিতে দেখলাম পুলিশ গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে। বিবিসির বাংলা বিভাগের একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধে পড়লাম, আমাদের সেনাবাহিনী নাকি ব্যবসায়ে খুব ভালো করছে।
আমাদের দেশে প্রবীণদের পুনর্বাসনের খুব একটা ব্যবস্থা নেই। তাই অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ও সেনাকর্তারা রাজনীতিতে নিজেদের পুনর্বহাল করছেন। চাকরি জীবনে তাঁদের অবদান কেমন ছিল এটা কেউ জানতে আগ্রহী নন। শুনেছি এক কর্মকর্তা তাঁর ক্ষমতা তাঁর চৌহদ্দির বাইরে প্রয়োগ করার জন্য আদালত কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছিলেন। একজন আবার অতি উৎসাহে ১৪৪ ধারার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে আইনে বলা হয়েছে, চারজনের বেশি একসঙ্গে হওয়া যাবে না। সেখানে তিনি একজনের বেশি একসঙ্গে হওয়াকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। এঁরা এখন বড় রাজনৈতিক নেতা। কোনো কোনো অবসরপ্রাপ্ত কর্তা আবার টক শোতে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে উপদেশ বিতরণ করছেন। এই উপদেশদাতাদের সংখ্যা সীমিত। কাজেই একই ধরনের কথা শুনি তাঁদের কাছ থেকে। এঁদের একজনের নাকি একটি 'শপিং মল' আছে । সরকারি চাকরির সীমিত আয়ে কী করে তিনি এটা 'ম্যানেজ' করলেন কে জানে? অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই যে একমাত্র উপদেশদাতা তা নয়। একজন উপদেশদাতা সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিষোদগার করছিলেন ইদানীং। পরে শোনা গেল তিনি নাকি সরকারের কাছ থেকে কিছু বাগাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি এখনো উপদেশ দিয়েই চলেছেন কিন্তু কেউ শুনছে কি না জানি না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস একটা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখনই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তখনই কি আমরা জানতে পারি। তাহলে যখন আমরা জানতে পারিনি তখন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করে কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভালো চাকরি করছে। আমরা তাঁদের সেবা উপভোগ করছি। হে আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করো।
যুগটা হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতির। অ্যাডাম স্মিথ আর জন মেনার্ড কিনসের মতো মহামানবদের কাছে আমরা মুক্ত অর্থনীতির মাহাত্ম্যের কথা শুনেছি। এ কারণেই হয়তো আমাদের সরকার ধসজাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নাক গলায়নি। মুক্ত অর্থনীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই নিশ্চয়ই জাল টাকা তৈরির কাজে মন দিয়েছে কিছু মানুষ। কেউ কেউ নাকি ধরাও পড়েছে। ধরা পড়া মানুষগুলোর সঙ্গে ধরা না পড়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত কী রকম আমরা জানি কি? শুনি আমাদের জিডিপি নাকি সন্তোষজনক। জাল টাকা তৈরি কি গ্রহণ করা হয়েছে জিডিপি নির্ণয়ে? আর টাকা তৈরি যে এত সোজা তা আগে ভাবিনি। একটাই সান্ত্বনা পাই মনে তা হচ্ছে, আমাদের মুদ্রাস্ফীতি যখন নিয়ন্ত্রণ হারায়নি তখন জাল টাকা প্রস্তুতকারকরা হয়তো খুব উপযুক্ত নয়।
অর্থনীতি অন্যান্য নীতিকে প্রভাবিত করবে- এটাই স্বাভাবিক। কাজেই অনেক (সংখ্যা বলা যাবে না) প্রাইভেট শিক্ষায়াতন গড়ে উঠছে। এদের ভর্তি হওয়ার ফি-এর অঙ্ক শুনলে ভিরমি খেতে হয়। আমাদের জন্য গর্বের বিষয় এই যে এত টাকা দেওয়ার যথেষ্ট মানুষ আছে আমাদের দেশে। আমরা অর্থনীতির সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফলের কোনো সম্পর্ক নেই বলে বিশ্বাস করতে চাই।
সবাই অভিযোগ করেন, দুটি রাজনৈতিক দলের হাতে সব ক্ষমতা। তাঁরা তৃতীয় শক্তির উত্থান দেখতে চান। কিছুদিন আগে বিলেতের একটি বাংলা টিভির একটি টক শোতে প্যানেলের সদস্য করা হয়েছিল আমাকে। তৃতীয় শক্তির কথা আমাকে জিজ্ঞেস করা হলে আমি প্রশ্ন জিজ্ঞাসাকারীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, 'পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কোনোটাতে তৃতীয় শক্তি আপনি দেখতে পান কি?' প্যানেলের অপর সদস্য অত্যন্ত চমৎকার প্রশ্ন করলেন, 'এই তৃতীয় শক্তি চাচ্ছে কারা?' এ প্রশ্নটি উঠানোর কারণ হচ্ছে, এই যে দেশে ফলপ্রসূ দল দুটির বেশি না থাকলেও দলাদলির অভাব নেই। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি। আইনজীবীদের মধ্যে দলাদলি। সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলি। অবশ্য সাগর-রুনির খুনি ধরার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকরা। অন্যান্য নিহত সাংবাদিকদের খুনি ধরার দাবি উঠলে (যা উঠা উচিত) কী হবে কে জানে? এসব দলাদলিতে দলাদলিটাই সব। একদল যদি বলে সূর্য পূর্ব দিকে উঠেছে তবে অন্য দলটি বলবে, 'না পশ্চিম দিকে উঠেছে'। আইনজীবীরা দল ধরে এসে উচ্চকণ্ঠে টিভির ক্যামেরার সামনে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, বিচারপতিদের কাছে যুক্তি তুলে ধরে লাভ নেই; কারণ তাঁরাও একটি দলে। অবশ্য হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। দশ বছর আইন ব্যবসায়ে থাকলেই হলো। জজ হওয়ার জন্য বাকিটা 'লবিংই'। পার্লামেন্টকে এই দলাদলির হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিরোধী দল সেখানে যাচ্ছে না। শুধু দলাদলি নয়, উপদলীয় ব্যাপারও রয়েছে। ডাক্তারদের একটি দলের উপদল অপর উপদলের নেতাদের হত্যা করার জন্য পেশাদার খুনি নিয়োগ করেছে এই সংবাদ সংবাদমাধ্যমে দেখলাম যদিও ব্যাপারটি একেবারে চাপা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দুটি দল কোনো উপদলীয় কোন্দল ছাড়াই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাদের কাজ করে যাচ্ছে- তারা হচ্ছে 'মলম পার্টি' ও 'অজ্ঞান পার্টি'।
এমনি আরো আছে। খুনের ব্যাপারগুলো তেমন কিছু নয়। এসব তো অহরহই হচ্ছে। আগে ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হতো। পাচ পাত্তু আর খোকা আর তাদের বন্ধুরা অপকর্ম অনেক করেছে দেশের সেনা ত্রাণকর্তার অর্থানুকূল্যে কিন্তু খুনাখুনি করেনি। অপকর্ম করতে করতে তারা নিজেরাই খুন হয়েছে। কত পরিবর্তন হয়েছে দেশের। আজ একাত্তরের গণহত্যাকারীদের সমর্থকরা রাস্তা মাথায় তুলে এই বলে চিৎকার করে যে অভিযুক্তদের কিছু হলে আগুন জ্বলবে।
সরকার হয়েছে 'নন্দঘোষ'। সব দোষ সরকারের। আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই। ইংরেজ আমলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, 'দেশ গেছে দুঃখ নাই, তোরা আবার মানুষ হ'। আমাদের চার দশকের পরিবর্তিত মানসিকতার বাস্তবতায় এমনি কথা কোনো মহাপুরুষ বলবেন (এবং আমরা তা শুনব) এই আশায় রইলাম।
লেখক : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী চিকিৎসক
No comments