চরাচর-সিলেটের সাতকড়া by ইয়াহইয়া ফজল

যে কয়েকটি জিনিসের নাম শোনামাত্র সিলেটের ছবি যে কারো মানসপটে ভেসে ওঠে, তার একটি সাতকড়া। লেবু গোত্রীয় এ ফল সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক সমাদৃত। ভিন্ন স্বাদের এ ফলের জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বময়। সারা বছর ছাড়াও কোরবানির ঈদের সময় সাতকড়ার চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি।


সাতকড়ার বৈজ্ঞানিক নাম Citrus macroptera var. assamensis। দেখতে চ্যাপ্টা গোলাকার, হলদে-সবুজ রঙের পুরু খোসা, শাঁসের পরিমাণ তুলনামূলক কম। দেখতে অনেকটা কমলালেবুর মতো। কিছুটা টক-তিতা স্বাদের। ভেতরে কমলালেবুর মতো সাতটি কড়া রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এটি 'হাতকড়া' নামে পরিচিত। এটি সাইট্রাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে এর চাষ হয়। তবে সাতকড়া ভারতের আসাম রাজ্যের পাহাড়ি এলাকার আদি ফল। প্রাচীনকাল থেকে স্থানীয় আদিবাসীরা এটি রান্না এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। সাতকড়ায় আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'সি', ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস।
সাতকড়া সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মাংস রান্নায়। মাংসের সঙ্গে রান্না করলে ভিন্ন রকম স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়া যায়। সাতকড়া এবং গরুর পায়ের হাড় দিয়ে জনপ্রিয় 'খাট্টা' (টক জাতীয় রান্না) তৈরি করা হয়। তবে মাংস ছাড়াও মাছসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি রান্নায়ও সাতকড়া ব্যবহৃত হয়। সাতকড়ার খোসা দিয়ে নানা স্বাদের মুখরোচক আচার তৈরি হয়। সাতকড়ার খোসা শুকিয়ে, ভাপ দিয়ে ফ্রিজে দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় সাতকড়ার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়। এখন সাতকড়ার মৌসুম হলেও এবার প্রতি হালি সাতকড়া ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।
একটা সময় সাতকড়ার সুবাস সিলেটে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন তা দেশব্যাপী বিস্তৃত। মেহমান আপ্যায়নে সাতকড়ার এমন চাহিদা যে বাইরে থেকে সিলেটে বেড়াতে আসা ভোজনরসিকরা আগেই নিশ্চিত করে নেন খাবারে সাতকড়ার উপস্থিতি। তবে সাতকড়া রান্না করা একটু জটিল। পরিমাণে এদিক-সেদিক হলে রান্না বিস্বাদ হয়ে যায়। অভিজ্ঞতা ছাড়া সাতকড়া রান্না করা নিয়ে অনেক মজাদার ঘটনা রয়েছে।
সিলেটের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সাতকড়া অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী সিলেটিরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে সাতকড়াকে পরিচিত করে তুলেছেন। তাই দিন দিন সাতকড়ার রপ্তানি বাড়ছে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে এর বিশাল চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনকে সিলেটের মানুষ প্রতিনিয়তই সাতকড়া পাঠিয়ে থাকেন। দেশে বেড়াতে এলে যাওয়ার সময় প্রবাসীরা সাতকড়া সঙ্গে নিতে ভোলেন না। এমন কোনো সিলেটি মা পাওয়া যাবে না, যার সন্তান বিদেশে থাকে, অথচ তাকে তিনি হাতকড়া পাঠাননি।
ইয়াহইয়া ফজল

No comments

Powered by Blogger.