শিক্ষকরাই ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির নিয়ামক by ড. মিল্টন বিশ্বাস
১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনাকে অধিকাংশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য অশুভ বার্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয় ছিল- 'ছাত্ররাজনীতির ক্ষত : এ অসুস্থ প্রবণতা রোধ করতে হবে'।
অর্থাৎ, গণমাধ্যমের বক্তব্য ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের বিপক্ষে। একসময় নানা রকম সাংগঠনিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের আদর্শগত কর্মকাণ্ড তুলে ধরত। শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হতো নীতি-আদর্শের প্রতি; সংগঠনের কাজে শ্রম দিত। সেই দিন আর নেই। এখন ছাত্ররাজনীতিতে অর্থ প্রাপ্তিই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ও দায়িত্বশীল ভূমিকার দিনের কথা ভেবে আমরা অশ্রু বিসর্জন করি। উপরন্তু ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছাত্রদের সেই ভূমিকা বর্তমান প্রজন্মের তরুণরাও ভুলতে বসেছে বলে আক্ষেপ করা হয়। এই সবকিছুর পেছনেই শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। কেবল রাজনীতি নয়, ছাত্রদের আচরণের গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে শিক্ষকদের কারণেই। শ্রদ্ধার চোখে দেখা শিক্ষকসমাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিবিড় সম্পর্ক আর নেই। এ ক্ষেত্রে লেখাপড়ার পরিবেশ নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে এবং সেই আদর্শগত ও নিঃস্বার্থ ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসকদের আন্তরিকতা। ক্যাম্পাস দখল করে রাখার প্রবণতা সব সরকারের সময় একই ধরনের হলেও জামায়াত-শিবির কর্তৃক প্রগতিশীল ছাত্রদের রগকাটাসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো অবশ্যই পৈশাচিক ছিল। তবু বলতে হয়, দখলদারিত্বের অবসান এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির নীতিনির্ধারক, অর্থাৎ ছাত্রদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ করার দায়িত্ব প্রথমত শিক্ষকদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিকশিত হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার ক্রমপ্রসার ঘটলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে পাবলিক ভার্সিটিগুলো অস্থির করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। একদিকে মৌলবাদীদের উত্থান, অন্যদিকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়েছেন সরকারসহ অভিভাবক ও শিক্ষকমণ্ডলী। বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগরের পরে আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম কৌশলে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে তিনি উপাচার্যদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে, দায়বদ্ধতার বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, জনগণের টাকায় ছাত্ররা লেখাপড়া করে। যারা এই টাকার জোগান দিচ্ছেন, সেই গরিব সাধারণ মানুষ অনেকেই নিজের সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। অন্যদিকে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবির, হিযবুত তাহরীরসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী সংগঠন, এমনকি সরকারবিরোধী শিক্ষকরাও। যুদ্ধাপরাধী বিচার ঠেকাতে শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষ ছড়ানো হচ্ছে বলেও মনে করা হয়। অস্থিরতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের মধ্যে বহিরাগতদের সাহায্যে রক্তক্ষয়ী সহিংস সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। এভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে সুযোগসন্ধানী মহল। আমাদের মতে, সরকারবিরোধী মহল মদদ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্থিরতার ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সতর্ক থাকাটা জরুরি। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন কোনো বাধা না থাকে, উপাচার্যরা দ্রুত তা নিশ্চিত করবেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা তদারকি করবে। তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের ঘটনা অতীতের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'চাইলেই তা রাতারাতি সমাধান করা যাবে না, তবে সরকার এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।' এটা খুব আশাবাদী মন্তব্য। বর্তমান সরকারের শিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখতে হলে অবশ্যই ছাত্রলীগকে আদর্শগত রাজনীতি করতে হবে। এজন্য তাদের সব অপকর্মকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা, দোষীকে শাস্তি দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান বর্তমান সরকারের নেতাদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। ছাত্রলীগকে বারবার কেবল টেন্ডারবাজ, অপকর্মের হোতা- এসব বলার চেয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দলের সিনিয়র নেতারা পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং প্রশাসনের দায়িত্ব তাদের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ছাত্ররাজনীতির সংগ্রামী ও ত্যাগী ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের ভাবতে হবে। কোনো ঘটনা যেন বিচারবিহীন থেকে না যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা দূর করার জন্য শিক্ষকরা কী করতে পারেন? অনেকের ধারণা, ছাত্ররা শিক্ষকদের কথা শোনে না। কিন্তু কেন শোনে না, সেটা চিন্তা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তারা হতাশ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। সেশনজটে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত; দেখতে পাচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির নির্লজ্জ নজির। উল্লেখ্য, উপাচার্যরাও শিক্ষক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালানোর ঘাটতি থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দিতে পারেন না কেউ কেউ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার ঘটনা ঘটলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্রদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো চাকু-ছোরা-চাপাতি কেন থাকবে? থাকবে বই। তাদের আদর্শ হবে- শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি। একই সঙ্গে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার সুযোগ সন্ধানীদেরও রুখতে হবে। সমস্যা কিন্তু গোটা কয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকই চলছে। এ জন্য ঢালাওভাবে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে শিক্ষা কার্যক্রমকে নিরাশাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন করাও ঠিক নয়।
ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেন শিক্ষকরাই। ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ঢাকায় যখন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকটি বর্ষের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর ঘুরে দেখছিলাম। প্রথম বর্ষের ক্লাস ছিল; সেটা শেষ করে বের হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম আমি নিজেই। আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছেলেমেয়েদের এবং শিক্ষক ফখরুল ইসলাম ও শেখ সাদীকে। সবাই মিলে এক কিলোমিটার হেঁটে লেকের ধারে উপস্থিত হই এবং বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে দুই কিলোমিটার হেঁটে ফিরে আসি কলাভবনে। এই যে বেড়ানো, প্রকৃতি দেখা, সবাই মিলে হৈচৈ করা, এর কোনো অর্থ আছে কি? অবশ্যই আছে। চারদিকে যেখানে শূন্যতা, শিক্ষার্থীদের কেউ-ই স্বপ্ন দেখাতে পারছে না, তাদের সামনে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি নেই, যেখানে কেবল ব্যর্থতা ও নৈরাজ্যের সংবাদে পৃথিবী ভারী হয়ে গেছে, সেখানে এ ধরনের ঘুরে বেড়ানোর তাৎপর্য আছে বৈকি। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক জোরালো করতে চাই। শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট সমস্যা সহানুভূতির সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা দরকার। তারা যেন খোলামেলাভাবে তাদের আনন্দ-বেদনা ও সমস্যার কথা বলতে পারে এবং আমরা আপনজনের মতো তাদের পরামর্শ দিতে পারি, এ জন্যই তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মাঠে-ঘাটে হেঁটে বেড়ানো চলে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নৈরাজ্য ও অস্থিরতা চলছে, তার অবসানও সম্ভব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেই কেবল তারা আমাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে উৎসাহী হবে, নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতা থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলে অনেক সমস্যার সমাধান বাতলে দিতে পারে। তবে ছাত্ররাজনীতির পেশিশক্তির কবল থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতাও প্রয়োজন। কারণ, কিছু দুর্বৃত্ত এবং ছাত্র নামধারীকে অপরাধের জন্য শাস্তি দিতেও সক্ষম হতে হবে। অন্যায় সহ্য করাটা অন্যায় করারই নামান্তর- এটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email-writermiltonbiswas@gmail.com
১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে পাবলিক ভার্সিটিগুলো অস্থির করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। একদিকে মৌলবাদীদের উত্থান, অন্যদিকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়েছেন সরকারসহ অভিভাবক ও শিক্ষকমণ্ডলী। বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগরের পরে আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকম কৌশলে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে তিনি উপাচার্যদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে, দায়বদ্ধতার বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, জনগণের টাকায় ছাত্ররা লেখাপড়া করে। যারা এই টাকার জোগান দিচ্ছেন, সেই গরিব সাধারণ মানুষ অনেকেই নিজের সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। অন্যদিকে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবির, হিযবুত তাহরীরসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী সংগঠন, এমনকি সরকারবিরোধী শিক্ষকরাও। যুদ্ধাপরাধী বিচার ঠেকাতে শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষ ছড়ানো হচ্ছে বলেও মনে করা হয়। অস্থিরতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের মধ্যে বহিরাগতদের সাহায্যে রক্তক্ষয়ী সহিংস সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। এভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে সুযোগসন্ধানী মহল। আমাদের মতে, সরকারবিরোধী মহল মদদ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্থিরতার ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সতর্ক থাকাটা জরুরি। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন কোনো বাধা না থাকে, উপাচার্যরা দ্রুত তা নিশ্চিত করবেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা তদারকি করবে। তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের ঘটনা অতীতের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'চাইলেই তা রাতারাতি সমাধান করা যাবে না, তবে সরকার এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।' এটা খুব আশাবাদী মন্তব্য। বর্তমান সরকারের শিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখতে হলে অবশ্যই ছাত্রলীগকে আদর্শগত রাজনীতি করতে হবে। এজন্য তাদের সব অপকর্মকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা, দোষীকে শাস্তি দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান বর্তমান সরকারের নেতাদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। ছাত্রলীগকে বারবার কেবল টেন্ডারবাজ, অপকর্মের হোতা- এসব বলার চেয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দলের সিনিয়র নেতারা পালন করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং প্রশাসনের দায়িত্ব তাদের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ছাত্ররাজনীতির সংগ্রামী ও ত্যাগী ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের ভাবতে হবে। কোনো ঘটনা যেন বিচারবিহীন থেকে না যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা দূর করার জন্য শিক্ষকরা কী করতে পারেন? অনেকের ধারণা, ছাত্ররা শিক্ষকদের কথা শোনে না। কিন্তু কেন শোনে না, সেটা চিন্তা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তারা হতাশ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। সেশনজটে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত; দেখতে পাচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির নির্লজ্জ নজির। উল্লেখ্য, উপাচার্যরাও শিক্ষক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালানোর ঘাটতি থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দিতে পারেন না কেউ কেউ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার ঘটনা ঘটলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছাত্রদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো চাকু-ছোরা-চাপাতি কেন থাকবে? থাকবে বই। তাদের আদর্শ হবে- শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি। একই সঙ্গে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার সুযোগ সন্ধানীদেরও রুখতে হবে। সমস্যা কিন্তু গোটা কয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিকই চলছে। এ জন্য ঢালাওভাবে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে শিক্ষা কার্যক্রমকে নিরাশাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন করাও ঠিক নয়।
ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেন শিক্ষকরাই। ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ঢাকায় যখন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকটি বর্ষের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর ঘুরে দেখছিলাম। প্রথম বর্ষের ক্লাস ছিল; সেটা শেষ করে বের হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম আমি নিজেই। আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছেলেমেয়েদের এবং শিক্ষক ফখরুল ইসলাম ও শেখ সাদীকে। সবাই মিলে এক কিলোমিটার হেঁটে লেকের ধারে উপস্থিত হই এবং বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে দুই কিলোমিটার হেঁটে ফিরে আসি কলাভবনে। এই যে বেড়ানো, প্রকৃতি দেখা, সবাই মিলে হৈচৈ করা, এর কোনো অর্থ আছে কি? অবশ্যই আছে। চারদিকে যেখানে শূন্যতা, শিক্ষার্থীদের কেউ-ই স্বপ্ন দেখাতে পারছে না, তাদের সামনে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি নেই, যেখানে কেবল ব্যর্থতা ও নৈরাজ্যের সংবাদে পৃথিবী ভারী হয়ে গেছে, সেখানে এ ধরনের ঘুরে বেড়ানোর তাৎপর্য আছে বৈকি। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক জোরালো করতে চাই। শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট সমস্যা সহানুভূতির সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করা দরকার। তারা যেন খোলামেলাভাবে তাদের আনন্দ-বেদনা ও সমস্যার কথা বলতে পারে এবং আমরা আপনজনের মতো তাদের পরামর্শ দিতে পারি, এ জন্যই তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মাঠে-ঘাটে হেঁটে বেড়ানো চলে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নৈরাজ্য ও অস্থিরতা চলছে, তার অবসানও সম্ভব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেই কেবল তারা আমাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে উৎসাহী হবে, নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতা থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলে অনেক সমস্যার সমাধান বাতলে দিতে পারে। তবে ছাত্ররাজনীতির পেশিশক্তির কবল থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতাও প্রয়োজন। কারণ, কিছু দুর্বৃত্ত এবং ছাত্র নামধারীকে অপরাধের জন্য শাস্তি দিতেও সক্ষম হতে হবে। অন্যায় সহ্য করাটা অন্যায় করারই নামান্তর- এটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email-writermiltonbiswas@gmail.com
No comments