অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার by ড. তুহিন ওয়াদুদ
মানুষ যখন আদিম ছিল, তখন তারা দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করত। দলের সদস্যসংখ্যা বেড়ে গেলে দলগুলো আবার বিভিন্ন উপদলে বিভাজিত হতো। কারণ দলে সদস্যসংখ্যা বেশি হলে একই স্থানে পর্যাপ্ত ফল না পেলে খাবার সংকট দেখা দিতে পারে, তাই তাদের বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হওয়া। আমরা অখণ্ড পৃথিবীর মানুষ হলেও বিভিন্ন রকমের আঞ্চলিকতা দ্বারা পরিচিত হই। তাই বলে আমরা মানুষ পরিচয়ের বাইরে কেউ কখনো নই।
অখণ্ড দেশের মধ্যেও আমাদের বিভাগ কিংবা জেলাভিত্তিক আঞ্চলিকতা যেমন আছে, তেমনি অখণ্ড পৃথিবীর ভেতরে আমরা বিভিন্ন দেশের অধিবাসী। ভূমির ওপর আমাদের বিভাজন যত সহজে চলে, আলো-বাতাস-নদী-সমুদ্রের ওপর আমাদের বিভাজন তত সহজে সম্ভব নয়। আমরা খণ্ডকে স্বীকার করে নিয়ে যেমন অখণ্ড মানুষ এবং সভ্যতার নিশানা ওড়াতে বলতে ভালোবাসি_আমরা বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তেমনি আমাদের জল বিভাজনের ক্ষেত্রে উচ্চারণ করা প্রয়োজন, নদীতে রাষ্ট্রিক সীমারেখায় নয়, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের প্রয়োজন। ভারত বাংলাদেশের উজানের দেশ। উজানের সৃষ্ট নদী ভাটির দিকে বয়ে চলে। পৃথিবীব্যাপী নদী প্রসঙ্গে উজান-ভাটির এই প্রবহমানতাই সত্যি। নদীকে সীমানা দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না। ফলে দেশের সীমানার কথা ভেবে নদীর জন্ম কিংবা বেঁচে থাকা নয়। যে নদীর জন্ম বাংলাদেশে হয়নি, জন্ম হয়েছে ভারতে_সে নদী তো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত না হলে তার বেঁচে থাকার কোনো পথ ছিল না। সুতরাং যে নদীর জন্ম ভারতে বলে তার ওপর ভারতের অধিকার বেশি, তা হতে পারে না। দেশ বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত বিভাজনের ইতিহাস ছয় দশকের মাত্র। অভিন্ন নদী অববাহিকাকে কেন্দ্র করে মানুষের বসতি গড়ে ওঠা হাজার বছরের পুরনো। বংশপরম্পরায় যে অভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী নদী অববাহিকায় নদীনির্ভরতার মাধ্যমে বেঁচে ছিল, সেই নদীর ওপর রাষ্ট্রীয় সীমা তুলে দিয়ে নদীর পারের মানুষকে বঞ্চিত করা রীতিমতো অন্যায়। নদী যেহেতু উভয় দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে, সুতরাং নদীতে উভয়ের অধিকার রয়েছে। আমরা যদি মানবিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণ না করে অধিকারভিত্তিক আলোচনা করি, তাতেও দেখা যাবে যে নদী যেসব দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে, ওই নদীতে ওইসব দেশের অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। নদীমার্তৃক বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এই অর্থনীতির সঙ্গে পানির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। উজানের অংশে ভারত থাকার কারণে তাদের পক্ষে নদীর পানি সরিয়ে নেওয়াটা সহজ। ভারত শক্তিতে এবং আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। তারা যদি বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি শুধু নিজেদের মনে করে সেই পানি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে শুধু তাদের কাজে ব্যবহার করে, তার অর্থ দুই অর্থে নেতিবাচক।
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে অলোচনার ঝড় উঠেছিল। উভয় দেশের মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকারের কথাও তুলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো দেশই এখনো নিরাশ হয়নি। উভয় দেশই অব্যাহত চেষ্টার মধ্যে আছে। আমরা যদি নদীকে অভিন্ন অধিকারের ধরে নিয়ে এর পানি বণ্টন করি, নদীর উৎস থেকে যে পানির প্রবাহ থাকে সেই পানির অংশ নির্ধারণ করে আমাদের পানি বণ্টন করতে হবে। সিকিমে যে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশের অধিকার থাকা প্রয়োজন। আগামীতে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। সেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রেও বাংলাদেশের অংশ নিশ্চিত করতে হবে। জলে অধিকার থাকলে জলশক্তি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতেও বাংলাদেশের অধিকার থাকাটা স্বাভাবিক।
ফেনী কিংবা ধরলা নদীর পানিবণ্টন প্রসঙ্গেও আশু সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন। ফেনী নদীর পানি বণ্টন হলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই হয়তো বেশি লাভবান হবে। তার পরও সেই বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। ধরলা নদী কিংবা দুধকুমোর নদীর পানির মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। কুড়িগ্রাম সেচ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। ধরলা এবং দুধকুমোর নদীর পনিবণ্টন চুক্তি ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে হলে কুড়িগ্রাম সেচ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে। এতে করে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের একটি বিশাল জনপদ কৃষিনির্ভর সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারবে। আমরা যদি নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনপদের কথা গুরুত্ব দিয়ে অভিন্ন নদী অধিকারের ভিত্তিতে জল ব্যবহারের সুযোগ পাই, তাহলেই কেবল নদীতে সবার অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যত প্রচেষ্টাই চালানো হোক না কেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে নদীর নাব্য নষ্ট না করা। কারণ নদীর নাব্য নষ্ট করে নদীকে প্রাণহীন করে তুললে প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হতে হবে সবাইকে। এতে করে কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ ভীষণ ক্ষতির মুখে পতিত হবে।
আগামী রবিবার আন্তর্জাতিক নদী দিবস। জাতিসংঘ ২০০৫ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশে রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে দ্বিতীয়বারের মতো দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। দিবস পালনই যথেষ্ট নয়, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সদস্য, পলিসি ফোরাম, রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে অলোচনার ঝড় উঠেছিল। উভয় দেশের মানুষ তাদের প্রাপ্য অধিকারের কথাও তুলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো দেশই এখনো নিরাশ হয়নি। উভয় দেশই অব্যাহত চেষ্টার মধ্যে আছে। আমরা যদি নদীকে অভিন্ন অধিকারের ধরে নিয়ে এর পানি বণ্টন করি, নদীর উৎস থেকে যে পানির প্রবাহ থাকে সেই পানির অংশ নির্ধারণ করে আমাদের পানি বণ্টন করতে হবে। সিকিমে যে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশের অধিকার থাকা প্রয়োজন। আগামীতে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। সেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রেও বাংলাদেশের অংশ নিশ্চিত করতে হবে। জলে অধিকার থাকলে জলশক্তি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতেও বাংলাদেশের অধিকার থাকাটা স্বাভাবিক।
ফেনী কিংবা ধরলা নদীর পানিবণ্টন প্রসঙ্গেও আশু সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন। ফেনী নদীর পানি বণ্টন হলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই হয়তো বেশি লাভবান হবে। তার পরও সেই বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। ধরলা নদী কিংবা দুধকুমোর নদীর পানির মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। কুড়িগ্রাম সেচ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। ধরলা এবং দুধকুমোর নদীর পনিবণ্টন চুক্তি ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে হলে কুড়িগ্রাম সেচ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে। এতে করে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের একটি বিশাল জনপদ কৃষিনির্ভর সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারবে। আমরা যদি নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনপদের কথা গুরুত্ব দিয়ে অভিন্ন নদী অধিকারের ভিত্তিতে জল ব্যবহারের সুযোগ পাই, তাহলেই কেবল নদীতে সবার অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যত প্রচেষ্টাই চালানো হোক না কেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে নদীর নাব্য নষ্ট না করা। কারণ নদীর নাব্য নষ্ট করে নদীকে প্রাণহীন করে তুললে প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হতে হবে সবাইকে। এতে করে কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ ভীষণ ক্ষতির মুখে পতিত হবে।
আগামী রবিবার আন্তর্জাতিক নদী দিবস। জাতিসংঘ ২০০৫ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশে রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে দ্বিতীয়বারের মতো দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। দিবস পালনই যথেষ্ট নয়, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সদস্য, পলিসি ফোরাম, রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ
No comments