প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু-ভুল চিকিৎসার খেসারত কী?
নচিকেতার গানে আছে_ 'কসাই আর ডাক্তার একই তো নয়/ কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশন/কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে/তোমার আছে ক্লিনিক আর চেম্বার/ও ডাক্তার, ও ডাক্তার।' কসাইয়ের সঙ্গে ডাক্তারের তুলনাই শুধু নয় গানটিতে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আরও নানা কথা আছে। রোগীকে বাগে পেলেই ডাক্তার একগাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফর্দ ধরিয়ে দেন। কোথায় রিপোর্ট তৈরি করাতে হবে তাও বলে দেন। বিনিময়ে ডাক্তার পান কমিশন।
আছে সরকারি হাসপাতালের অচিকিৎস্য পরিবেশের কথা, ডাক্তারদের উৎসাহেই বেসরকারি ক্লিনিকের রমরমা ব্যবসার কথাও। শেষে এ কথাও বলতে ভোলেননি নচিকেতা যে, ডাক্তারদের কাছে মানুষ অসহায়_ 'বাঁচানোর ক্ষমতা তো তোমারই হাতে/তুমি যদি মারো তবে কোথা যাই/অসহায় মানুষের তুমিই তো সবকিছু/করজোড়ে নিবেদন করছি তাই।' নচিকেতা যে ডাক্তারের কথা বলেছেন তারা আমাদের প্রতিবেশী দেশের। কিন্তু গানটিতে ডাক্তার ও ক্লিনিকের যে চিত্র উঠে এসেছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির খুব বেশি অমিল নেই। বরং পরিস্থিতি এখানে ওদেশের চাইতে অনেক খারাপই বলতে হবে। এখানে ডাক্তার, ক্লিনিক, ডায়াগস্টিক সেন্টারের রমরমা। ঢাকা শহরকে বলা হয় মসজিদের শহর। অধুনা জ্যামের শহর তকমাও জুটেছে। কিন্তু ঢাকা শহরকে কেউ যদি ক্লিনিক আর ডায়াগস্টিক সেন্টারের শহর বলেন তবে তাতে ভুল হবে না। রাজধানীর অনেক এলাকাই রীতিমতো ক্লিনিকপাড়া। আর সাধারণ মহল্লাগুলোতেও ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ইয়ত্তা নেই। কেউ হয়তো বলবেন, এত ক্লিনিক তো চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষণ। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এত ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার আসলে দেউলিয়াত্বের লক্ষণ। অধিকাংশ ক্লিনিকের মূল লক্ষ্য রোগীদের গলাকাটা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কয়টি সঠিক রিপোর্ট দেয় তা রীতিমতো অনুসন্ধানের বিষয়। ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারই শুধু নয়, ঢাকায় নামি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ভুল চিকিৎসা, ভুল ওষুধ ও রোগী হয়রানির এন্তার অভিযোগ আছে। কিছুদিন আগে ঢাকার একটি নামি হাসপাতালকে জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট, একটির ডাক্তার ও কর্মকর্তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে, আরেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খোদ রাজধানীর যখন এই অবস্থা তখন রাজধানীর বাইরের চেহারাটা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। পাবনার চাটমোহরে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু, নোয়াখালীতে নবজাতকের মৃত্যু, বরগুনার পাথরঘাটায় নবজাতকসহ প্রসূতির মৃত্যুর খবরগুলো তাই অনেককেই বিস্মিত করে না। বৃহস্পতিবারের সমকালে প্রকাশিত এ বিষয়ক তিনটি খবরকে অনেকে স্রেফ খবর হিসেবেই হয়তো পাঠ করবেন। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, ঘটনাগুলোকে দূর থেকে দেখে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেননা ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে এক বেহাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও ক্লিনিকের অভাব নেই। বিনিয়োগকারীরা মুনাফার লোভে ক্লিনিক তৈরি করছেন বটে, কিন্তু ভালো চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিচ্ছেন না। দক্ষ-বিশেষজ্ঞ দূরের কথা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলছে ক্লিনিক। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অবস্থাও তথৈবচ। এসব ক্লিনিকে রাজত্ব করছে স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ হাতুড়ে ডাক্তাররা। আর এই হাতুড়ে চিকিৎসার সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে প্রসূতি ও নবজাতকদের। দেশে প্রসূতিদের নিয়ে অনেক সচেতনতামূলক কার্যক্রম আছে। প্রসূতিদের যত্ন নেওয়া ও তাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবার নানা উদ্যোগ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রসূতির নিরাপদ চিকিৎসাসেবার উদ্যোগ সামান্য। সরকারি হাসপাতালে স্বস্তিকর পরিবেশ নেই। কিছু দায়িত্বশীল বেসরকারি উদ্যোগ আছে। কিন্তু প্রসূতিদের বড় একটি অংশ এখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন, মুনাফালোভী, অদক্ষ ক্লিনিকের হাতেই জিম্মি। এ অবস্থা উদ্বেগজনক। ক্লিনিকগুলোর এ দুরবস্থায় সাধারণ মানুষ চরম বিপর্যস্ত। শুধু সুচিকিৎসার অভাব নয়, চিকিৎসার্থী মানুষের পকেট কাটার এমন মচ্ছব বোধহয় তুলনাহীন পর্যায়ে পেঁৗছেছে। তাই সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই তৎপর হতে হবে। হাইকোর্ট কিছু ঘটনা আমলে নিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। কিন্তু দেশে প্রচুর ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রত্যেকটি ঘটনা হয়তো হাইকোর্টের পক্ষে আমলে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এখনই ঘটনাগুলো আমলে না নিলে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে অনেকেই মনে করেন।
No comments