মহাজোট সরকারের ৩ বছর-বিদ্যুৎ খাত : পরিকল্পনা ও নীতি ভ্রান্ত by ড. এম শামসুল আলম
জনজীবন রক্ষা ও উন্নয়নের প্রয়োজনে দারিদ্র্য বিমোচন জরুরি। সে জন্য জাতীয় আয় তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগের বেশি হিসেবে অব্যাহত থাকতে হবে। টেকসই বাণিজ্যিক জ্বালানি প্রবাহ নিশ্চিত হলে শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে বিদ্যুৎ প্রবাহ/ব্যবহার প্রবৃদ্ধি অনায়াসে অব্যাহত থাকতে পারে। তাতে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারে। অর্থাৎ ২০২১ সালে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৫০০ কিলোওয়াট আওয়ার
(একক) এবং ২০৩১ সালে তা ১০০০ একক ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ তখন উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবে।
ক. বিদ্যুৎ উৎপাদন/প্রবাহ : গত অর্থবছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২০০ একক।
মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যক্তি খাত-উৎপাদন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সরকারি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি তেমন হয়নি। বরং ২০০৯-১০ তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৯ ভাগ। অন্যদিকে ২০০৭-০৮-এর তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বৃদ্ধি পায় শতকরা ৩০.০৯ ভাগ। তা ছাড়া ২০০৪-০৫ অর্থবছরে মোট উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের পরিমাণ ছিল যেখানে শতকরা ৩৮.২৩ ভাগ, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়ায় ৫২.৯৩ ভাগ। এ সময়ে ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ ব্যবহার আরইবিতে বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২২৪.৬০ ভাগ এবং পিডিবিতে ৬১.০০ ভাগ। ১৯৯৬ সালে আইপিপির আওতায় ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। তখন সরকারের নীতিগত অভিমত ছিল, মোট উৎপাদনে ব্যক্তি খাত-উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগের বেশি হবে না। অথচ এখন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০০৯-১০ অর্থবছর ব্যতীত কোনো সময়ই শতকরা ১০ ভাগ হয়নি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সে প্রবৃদ্ধি ছিল আশঙ্কাজনক। শতকরা ০.১৪ ভাগ। গত অর্থবছরে তা ছিল ৬.৫৩ ভাগ। জানা যায়, বিদ্যুৎ ঘাটতি ২০০৯ সালে ছিল ১৬০০ মেগাওয়াট। ২০১১ সালে ১৭০০ মেগাওয়াট। জ্বালানি নিরাপত্তা যে বিপণ্ন, এ তথ্যচিত্রে সেই প্রমাণই পাওয়া যায়।
খ. গ্যাস উৎপাদন/প্রবাহ : বাণিজ্যিক জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগ পূরণ হয় গ্যাসে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির শতকরা ৮০ ভাগই গ্যাস। নিচের ছকে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর অবধি গড়ে বার্ষিক শতকরা ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে সে প্রবৃদ্ধি ০.৭৭। মোট সরবরাহকৃত গ্যাসে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের অংশ শতকরা ৩৬ ভাগ। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫২ ভাগ। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি সামঞ্জস্য না থাকায় একদিকে গ্যাস সংকট দেখা দেয়, অন্যদিকে সরবরাহকৃত গ্যাসে ব্যক্তি খাত-গ্যাসের অংশ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় বাড়তে থাকে। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। তাই গ্যাস সরবরাহ ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পায় এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠিত হয়। কিন্তু এ তহবিলের অর্থ এখনো কাজে আসেনি। জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০০৯ সালের শুরুতে দৈনিক ঘাটতি ছিল ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস। ২০১১ সালে সে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫০ কোটি ঘনফুট। এ সময় সরবরাহ বাড়ে ৬৫ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, তাই ঘাটতি বেড়েছে।
গ. বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি : পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দফায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে বিদ্যুতের মূল্য হলো ৪.২০৫০ টাকা এবং ৩৩ কেভিতে ৪.২৪৫০ টাকা। অবশ্য আরইবির জন্য এ মূল্যহার যথাক্রমে ৩৩ কেভিতে ৩.১৭৫০ টাকা। ঘাটতি পূরণের জন্য পিডিবি বিদ্যুতের মূল্যহার ২.৮০ থেকে ৪.৮৬ টাকা, অর্থাৎ শতকরা ৭৩ ভাগ বৃদ্ধির আবেদন করে। অথচ বৃদ্ধি হলো ৩৩ ভাগ (গত ১ ডিসেম্বর থেকে শতকরা ১৬.৭৯ ভাগ এবং আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪.৩৭ ভাগ)। ফলে বাদবাকি ঘাটতি পূরণের জন্য বিইআরসি সরকারের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সেই ব্যয় এখন ৫.৫০ টাকা। ফলে ঘাটতি আরো বেড়েছে। তা ছাড়া ভোক্তা পর্যায়ে শতকরা ২১ ভাগ বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের মূল্যহার হবে ৫.০৯ টাকা। ফলে বিতরণেও ঘাটতি থাকবে। তাতে বোঝা যায়, ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি একমাত্র কৌশল নয়। গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, সমন্বিতভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো এবং ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হতো না।
ঘ. কেন এই মূল্যবৃদ্ধি : ১. সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০ ভাগ। পিডিবির কমেছে ২ ভাগ। অথচ ভাড়া বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১৫০ ভাগ। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। ২. সরকারি খাতে প্লান্ট-ফ্যাক্টর খুবই কম (৪০%-৫০%)। অথচ ব্যক্তি খাতে তা অনেক বেশি (৮০%-৯০%)। ইকোনমিক লোড-ডিসপ্যাস হলে ঘাটতি কম হতো। ৩. উৎপাদনরত বেশ কিছু সরকারি প্লান্ট অনেক পুরনো ও অদক্ষ। আউটেজ বেশি। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। ৪. ভাড়া প্লান্ট অধিকাংশই পুরনো। দক্ষতাও কম। নন-ফুয়েল ব্যয় বেশি। বিদ্যুৎ প্রবাহ টেকসই নয়। দাম বেশি। ৫. ঘাটতি পূরণে সরকার যে অর্থ দেয়, তা ভর্তুকি বলা হলেও পিডিবি পায় দেনা হিসেবে। তাই ওই অর্থের সুদ যোগ হওয়ায় ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। ৬. সরকারি সংস্থায় প্রয়োজনের তুলনায় জনবল বেশি থাকায় ওভারহেড ব্যয় বাড়ে। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ায় ঘাটতি বাড়ে। ৭. সরকারি গ্যাস-বিদ্যুতের ক্রয় মূল্যহার ১.৫০ টাকার বেশি নয়। অথচ ভাড়া বিদ্যুৎ কিনতে হয় অধিক দামে। ৮. বিতরণে কম্পানিভেদে সিস্টেম লস শতকরা ৮.৭৭ থেকে ১৩.০০ ভাগ। বিতরণ ব্যয় ৭০ পয়সা থেকে ১.৩০ টাকা। সঞ্চালনে সিস্টেম লস শতকরা ৩.৪৫ ভাগ। বিতরণ ব্যয় ২২.৯১ পয়সা। সিস্টেম লস এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। ৯. অভিযোগ রয়েছে, গ্যাসের বিতরণে সিস্টেম লস শতকরা ৩০ ভাগ। এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়নি। ১০. বিতরণ কম্পানির ভোক্তা পর্যায়ের গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণের প্রস্তাব পৃথকভাবে কখনো বিবেচনা করা হয়নি। তার ওপর গণশুনানিও হয়নি। ফলে কম্পানিভেদে বিতরণ ব্যয় ও সিস্টেম লসে কী ধরনের তারতম্য রয়েছে এবং তা যৌক্তিক কি না তা যাচাই-বাছাই হয়নি। সঞ্চালনের ব্যাপারেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ১১. অতীতে লাখ লাখ কি.মি. বিতরণ লাইন বাড়লেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়েনি। পরবর্তী সময়ে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও বিদুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়ায় সরবরাহ বাড়েনি। এখনো সে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে স্থিরব্যয় বৃদ্ধি ক্রমাগত অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ সে অনুপাতে বৃদ্ধি না হওয়ায় প্রতি একক বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ছে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ১২. গ্যাসের অভাব না হলে পিডিবির ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন হতো। ঘাটতি কম হতো। ১৩. সব ক্ষেত্রে রেশনিং হলেও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া গ্যাসে রেশনিং হয় না। অথচ এই গ্যাসের সবটাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় না। ১৪. আইওসির কাছ থেকে কেনা গ্যাসের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তরল জ্বালানিও যদি কর, শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত হতো, তাতে ঘাটতি কম হতো। গ্যাস খাত লাভজনক বিধায় ঘাটতির কারণে সিএনজির মূল্য দফায় দফায় বাড়েনি। কৌশলগত কারণে বেড়েছে। বৃদ্ধিজনিত উদ্বৃত্ত অর্থ জ্বালানি খাতের ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যবহার হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হতো। ১৫. তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি আগামীতেও বাড়তে থাকবে। ফলে ঘাটতিও বৃদ্ধি পাবে। তা মোকাবিলার জন্য কেবল মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক সমাধান নয়। সে ক্ষেত্রে এই ঘাটতি পূরণে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার কৌশল অবলম্বন করা জরুরি ছিল। ১৬. প্রান্তিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং কৃষিসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের এই মূল্যবৃদ্ধির কবল থেকে রক্ষার জন্য সামাজিক সুরক্ষার কৌশল গ্রহণ করা জরুরি ছিল। ১৭. স্বল্পতার কারণে কেবল প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া গ্যাসে লস হয়, সেহেতু সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দেওয়ার ব্যাপারে বিতরণ কম্পানির আগ্রহ কম। তিতাস ইতিমধ্যে ৬৯৩টি সংযোগ দিলেও গ্যাসের অভাবে পিডিবির বন্ধ থাকা প্লান্টে গ্যাস দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায়নি। ১৮. বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতকে পিডিবির মূল্যে গ্যাস দেওয়া হয়। অথচ সে বিদ্যুৎ কেনা হয় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দামে। অর্থাৎ পিডিবি, এমনকি কোনো কোনো আইপিপির বিদ্যুতের দাম অপেক্ষা অনেক বেশি দামে। ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম ১৩২ কেভি লেভেলে পাইকারি বিদ্যুতের দামের সমতুল্য। ১৯. আরইবি ৩৩ কেভিতে ব্যক্তি খাত থেকে ক্ষুদ্র-প্লান্টের বিদ্যুৎ কেনে। এ বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয় পিডিবির কাছ থেকে এই ৩৩ কেভিতে, যে দামে বিদ্যুৎ কেনা হয় সেই দামের সঙ্গে সংগতি রেখে। তাতে ব্যক্তি খাত অনেক বেশি মুনাফা লাভের সুযোগ পায়। আরইবিতে এমন বিদ্যুৎ ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ এখানেই নিহিত। শুধু উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে এ দাম নির্ধারণ হওয়া ছিল যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। ২০. ভারতীয় মানদণ্ডে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে সিম্পল সাইকেল প্লান্টে সিস্টেম লস শতকরা ১ ভাগ। কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্টে শতকরা ৩ ভাগ। কয়লা-বিদ্যুৎ প্লান্টের ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াটের অধিক হলে সিস্টেম লস হয় শতকরা ৬ ভাগ। নিম্ন ক্ষমতাসম্পন্ন প্লান্টে ১২ ভাগ। বাংলাদেশের জন্য এ লসের সুস্পষ্ট গ্রহণযোগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। প্লান্টগুলো উন্নত প্রযুক্তিতে সংস্কার করা হলে বিদ্যমান লস অনেক বেশি কমিয়ে আনা সম্ভব। ২১. কোরিয়ান ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্লান্টের দক্ষতা শতকরা ৫০ ভাগ এবং প্লান্ট-ফ্যাক্টর ৯০ ভাগ হলে টনপ্রতি ১২৩ ডলার দামের কয়লায় প্রতি একক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৩.৩০ টাকায়। তাতে নন-ফুয়েল ব্যয় ৭০ পয়সার বেশি নয়। আমাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে নন-ফুয়েল ব্যয় ৭০-৮০ পয়সা বেশি নয়। অথচ ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে যে বেঞ্চমার্ক প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে নন-ফুয়েল ব্যয় ধরা হয়েছে দুই টাকারও বেশি। ২২. ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতেও ভর্তুকি দিতে হবে। সে ভর্তুকির পরিমাণ কত হবে তা নির্ভর করছে কী মূল্যহারে এ বিদ্যুৎ আমদানি হবে তার ওপর। সে মূল্য যদি বাণিজ্যিক বিবেচনায় নির্ধারণ হয়, তাহলে তা কোনোভাবেই ৮.০০ টাকার কম হবে না। এ পরিস্থিতিতে তেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে কম ভর্তুকি দিতে হবে। আমাদের বিতরণ সংস্থার হিসাবে আমাদের বিদ্যুতের বাণিজ্যিক মূল্যহার ১২.০০ টাকার অধিক। ২৩. ইতিমধ্যে লাভজনক হওয়ায় ডেসকো, তিতাস, জিটিসিএল ও পিজিসিবির শেয়ার বিক্রি করে এসব সরকারি কম্পানির আংশিক মালিকানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ডিপিডিসিসহ লাভজনক অথবা লাভজনক হতে পারে এমন সব কম্পানির শেয়ার বিক্রি বিবেচনাধীন রয়েছে। শেয়ার বিক্রির এসব অর্থ ভর্তুকির নামে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া লোন পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে। ২৪. ভর্তুকি/ধার দেওয়া হয় জনগণের অর্থ। আবার জনগণের সম্পদ বিক্রি করে সে ধার পরিশোধ হয়। জনগণ নিজের অর্থ ধার হিসেবে নিজে পায়। আবার সে অর্থ তার সম্পদ বিক্রি করে পরিশোধ করা হয়। মাঝখানে নিজের মালিকানাধীন সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। এর থেকে বড় জনস্বার্থবিরোধী এবং অপরাধমূলক কাজ আর কী হতে পারে? ২৫. গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ অলস পড়ে আছে। জনগণ গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ দিয়ে এ তহবিলে অর্থ জোগায়। আশা ছিল এই অর্থে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন হবে। গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় কমবে। কম দামে জনগণ গ্যাস পাবে। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ অর্থ লোন হিসেবে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। তাতে এ অর্থের সুদ এবং অর্থ যোগ হয়ে গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় কমার পরিবর্তে বাড়বে। এ অবস্থা কি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা নয়? ২৬. ব্যক্তি খাত রেগুলেটরি নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিধায় তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাদের কাছ থেকে কেনা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যহার আদৌ যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত কি না, তা যাচাই-বাছাই করার আইনগত সুযোগ নেই। ২৭. আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য যখন ৯০-৯৫ ডলার, তখন বিপিসি সে তেল কেনে ১২৩ ডলারে। দামসহ ভোক্তা পর্যায়ে এ তেলের সরবরাহ ব্যয় যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত কি না যাচাই-বাছাই হয় না। বিইআরসি আইন অনুযায়ী গণশুনানির ভিত্তিতে জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ হলে স্বচ্ছ ও যৌক্তিক হতো। ২৮. ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারকে দেশি-বিদেশি আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এ জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ২৯. এ অবস্থায় ঘাটতি ও ঋণ উভয়ই ধারাবাহিকভাবে বাড়বে, যদি উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা না হয়। ৩০. পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কয়লা থেকে। তার আগেই গ্যাস ও জ্বালানি তেল থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি গ্যাস পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি তেল ছাড়া আর কোনো বিকল্প জ্বালানির উৎস পরিকল্পনায় বিবেচনা করা হয়নি। আবার সে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করাও কঠিন। ফলে জ্বালানি সংকট ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
ঙ. জ্বালানি পরিস্থিতি : আলোচ্য প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে জ্বালানি সরবরাহ অনিশ্চিত এবং টেকসই আর্থিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত। ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে সরকারি খাতের তুলনায় ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বেশি দামে কেনা হয়, অন্যদিকে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যক্তি খাতের উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। তাতে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু বিদ্যুৎ ঘাটতি কমেনি। আবার গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় যেন বৃদ্ধি না হয়, সে জন্য দেশীয় কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভোক্তারা গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ জোগান দিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিলে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা জমা হচ্ছে। কিন্তু তাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। ২০০৩ সালে সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের অংশ ছিল শতকরা ২০ ভাগ, এখন ৫২ ভাগ। এর পরও স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি কম্পানির সঙ্গে পিএসসি ২০১১ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা কমপক্ষে ২৫০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ ২০০ কোটি ঘনফুট। আর্থসামাজিক শ্রেণীভেদে জ্বালানি চাহিদা পূরণে অঞ্চলভিত্তিক জ্বালানি সরবরাহে সমতা, সমসুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। সব এলাকায় গ্যাস যায়নি। সিলিন্ডারে এলপিজিও সব এলাকায় পেঁৗছায়নি। দামের দিক থেকে উভয় ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। অঞ্চলভেদে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাপারেও ভোক্তারা বৈষম্যের শিকার। মূল্যহার নির্ধারণে সমতা আনা যায়নি। বড় শিল্পের তুলনায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যহার অধিক। গ্রামের নূ্যনতম বিলদাতা ১৭ লাখ গ্রাহক মাসে ৫-১০ এককের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পায় না। অথচ মাসিক বিল দেয় ৯৮ টাকা। কয়লানীতি না হওয়ার অজুহাতে কয়লা খাত উন্নয়ন অনিশ্চিত। জ্বালানি সংরক্ষণ আইন না হওয়ায় জ্বালানি সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়ন কার্যক্রমও নিশ্চিত করা যায়নি।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সামর্থ্য বা সক্ষমতা (Capability) থাকা চাই। সেসব সক্ষমতা মূলত নির্ভর করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ওপর জনগণের কতখানি স্বত্বাধিকার (Entitlement) আছে তার ওপর। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলে তাতেই জনগণের স্বত্বাধিকার থাকবে, এমন কথা বলা যায় না। যদি তা ক্রয় করার সামর্থ্য বা সক্ষমতা জনগণের না থাকে। সে স্বত্বাধিকার যদি প্রকৃতই থেকে থাকে, তাহলেই টেকসই জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ফলে জ্বালানি প্রবাহ প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে এবং মাথাপিছু কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ ব্যবহার/খরচের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিদেশি ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়োজনে উভয় খাতকে মুনাফামুখী করার প্রয়োজনে চলমান সংস্কার। অথচ সংকট নিরসন না হওয়ায় এবং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সে সংস্কার এখন বড়ই বিভ্রান্তির শিকার। তাতে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ছ. সুপারিশ : নিজস্ব মালিকানায় ও কর্তৃত্বে নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে কম দামি ও টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল। সরকার সে কৌশল অবলম্বন করেনি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সরবরাহ ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এই কৌশল অবলম্বন করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদে জনগণ যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে জনজীবন রক্ষা ও উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন কঠিন হবে।
জ. শেষ কথা : ১. উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে সরকারি মালিকানাধীন কম্পানির দ্বারা ১০টি কূপ জরুরি ভিত্তিতে খনন করে দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা কি সম্ভব ছিল না? ২. ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রের এক টিসিএফ মজুদ গ্যাস উৎপাদন কি জরুরি ছিল না? ৩. ফুলবাড়ী খনি-বিতর্ক এড়িয়ে দিঘিপাড়া ও খালাশপীর খনির কয়লা তোলা কি জরুরি ছিল না? ৪. সরকারের মালিকানায় ও কর্তৃত্বে সার্বিক বিবেচনায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার আওতায় জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করা হলে জ্বালানি নিরাপত্তা কি নিশ্চিত করা সম্ভব হতো না? এসব করা হলে বিদ্যুতের মূল্য স্বাভাবিক রাখা কি সম্ভব হতো না? এসব প্রশ্নের জবাব একটাই, তা হলো যেসব ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এযাবৎকাল পরিচালিত হয়েছে, তাঁরা কেউই জনবান্ধব ছিলেন না। তাঁদের কাছে জনস্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। তাঁরা জনগণের কল্যাণ করার দায়িত্ব নেননি। তাই তা হয়নি। সরকার দিনবদলের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। তাঁদের বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে তাঁরা সে দাবিও করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সে বদল কি হয়েছে? জ্বালানি নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা যায়নি, এর জবাব সচেতন মানুষের অজানা নয়।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
ক. বিদ্যুৎ উৎপাদন/প্রবাহ : গত অর্থবছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২০০ একক।
মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যক্তি খাত-উৎপাদন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সরকারি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি তেমন হয়নি। বরং ২০০৯-১০ তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৯ ভাগ। অন্যদিকে ২০০৭-০৮-এর তুলনায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বৃদ্ধি পায় শতকরা ৩০.০৯ ভাগ। তা ছাড়া ২০০৪-০৫ অর্থবছরে মোট উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের পরিমাণ ছিল যেখানে শতকরা ৩৮.২৩ ভাগ, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়ায় ৫২.৯৩ ভাগ। এ সময়ে ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ ব্যবহার আরইবিতে বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২২৪.৬০ ভাগ এবং পিডিবিতে ৬১.০০ ভাগ। ১৯৯৬ সালে আইপিপির আওতায় ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। তখন সরকারের নীতিগত অভিমত ছিল, মোট উৎপাদনে ব্যক্তি খাত-উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগের বেশি হবে না। অথচ এখন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০০৯-১০ অর্থবছর ব্যতীত কোনো সময়ই শতকরা ১০ ভাগ হয়নি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সে প্রবৃদ্ধি ছিল আশঙ্কাজনক। শতকরা ০.১৪ ভাগ। গত অর্থবছরে তা ছিল ৬.৫৩ ভাগ। জানা যায়, বিদ্যুৎ ঘাটতি ২০০৯ সালে ছিল ১৬০০ মেগাওয়াট। ২০১১ সালে ১৭০০ মেগাওয়াট। জ্বালানি নিরাপত্তা যে বিপণ্ন, এ তথ্যচিত্রে সেই প্রমাণই পাওয়া যায়।
খ. গ্যাস উৎপাদন/প্রবাহ : বাণিজ্যিক জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগ পূরণ হয় গ্যাসে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির শতকরা ৮০ ভাগই গ্যাস। নিচের ছকে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর অবধি গড়ে বার্ষিক শতকরা ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে সে প্রবৃদ্ধি ০.৭৭। মোট সরবরাহকৃত গ্যাসে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের অংশ শতকরা ৩৬ ভাগ। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫২ ভাগ। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি সামঞ্জস্য না থাকায় একদিকে গ্যাস সংকট দেখা দেয়, অন্যদিকে সরবরাহকৃত গ্যাসে ব্যক্তি খাত-গ্যাসের অংশ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় বাড়তে থাকে। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। তাই গ্যাস সরবরাহ ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পায় এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠিত হয়। কিন্তু এ তহবিলের অর্থ এখনো কাজে আসেনি। জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০০৯ সালের শুরুতে দৈনিক ঘাটতি ছিল ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস। ২০১১ সালে সে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫০ কোটি ঘনফুট। এ সময় সরবরাহ বাড়ে ৬৫ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, তাই ঘাটতি বেড়েছে।
গ. বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি : পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দফায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ১৩২ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে বিদ্যুতের মূল্য হলো ৪.২০৫০ টাকা এবং ৩৩ কেভিতে ৪.২৪৫০ টাকা। অবশ্য আরইবির জন্য এ মূল্যহার যথাক্রমে ৩৩ কেভিতে ৩.১৭৫০ টাকা। ঘাটতি পূরণের জন্য পিডিবি বিদ্যুতের মূল্যহার ২.৮০ থেকে ৪.৮৬ টাকা, অর্থাৎ শতকরা ৭৩ ভাগ বৃদ্ধির আবেদন করে। অথচ বৃদ্ধি হলো ৩৩ ভাগ (গত ১ ডিসেম্বর থেকে শতকরা ১৬.৭৯ ভাগ এবং আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪.৩৭ ভাগ)। ফলে বাদবাকি ঘাটতি পূরণের জন্য বিইআরসি সরকারের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সেই ব্যয় এখন ৫.৫০ টাকা। ফলে ঘাটতি আরো বেড়েছে। তা ছাড়া ভোক্তা পর্যায়ে শতকরা ২১ ভাগ বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের মূল্যহার হবে ৫.০৯ টাকা। ফলে বিতরণেও ঘাটতি থাকবে। তাতে বোঝা যায়, ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি একমাত্র কৌশল নয়। গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, সমন্বিতভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো এবং ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হতো না।
ঘ. কেন এই মূল্যবৃদ্ধি : ১. সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০ ভাগ। পিডিবির কমেছে ২ ভাগ। অথচ ভাড়া বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১৫০ ভাগ। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। ২. সরকারি খাতে প্লান্ট-ফ্যাক্টর খুবই কম (৪০%-৫০%)। অথচ ব্যক্তি খাতে তা অনেক বেশি (৮০%-৯০%)। ইকোনমিক লোড-ডিসপ্যাস হলে ঘাটতি কম হতো। ৩. উৎপাদনরত বেশ কিছু সরকারি প্লান্ট অনেক পুরনো ও অদক্ষ। আউটেজ বেশি। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। ৪. ভাড়া প্লান্ট অধিকাংশই পুরনো। দক্ষতাও কম। নন-ফুয়েল ব্যয় বেশি। বিদ্যুৎ প্রবাহ টেকসই নয়। দাম বেশি। ৫. ঘাটতি পূরণে সরকার যে অর্থ দেয়, তা ভর্তুকি বলা হলেও পিডিবি পায় দেনা হিসেবে। তাই ওই অর্থের সুদ যোগ হওয়ায় ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। ৬. সরকারি সংস্থায় প্রয়োজনের তুলনায় জনবল বেশি থাকায় ওভারহেড ব্যয় বাড়ে। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ায় ঘাটতি বাড়ে। ৭. সরকারি গ্যাস-বিদ্যুতের ক্রয় মূল্যহার ১.৫০ টাকার বেশি নয়। অথচ ভাড়া বিদ্যুৎ কিনতে হয় অধিক দামে। ৮. বিতরণে কম্পানিভেদে সিস্টেম লস শতকরা ৮.৭৭ থেকে ১৩.০০ ভাগ। বিতরণ ব্যয় ৭০ পয়সা থেকে ১.৩০ টাকা। সঞ্চালনে সিস্টেম লস শতকরা ৩.৪৫ ভাগ। বিতরণ ব্যয় ২২.৯১ পয়সা। সিস্টেম লস এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। ৯. অভিযোগ রয়েছে, গ্যাসের বিতরণে সিস্টেম লস শতকরা ৩০ ভাগ। এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়নি। ১০. বিতরণ কম্পানির ভোক্তা পর্যায়ের গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণের প্রস্তাব পৃথকভাবে কখনো বিবেচনা করা হয়নি। তার ওপর গণশুনানিও হয়নি। ফলে কম্পানিভেদে বিতরণ ব্যয় ও সিস্টেম লসে কী ধরনের তারতম্য রয়েছে এবং তা যৌক্তিক কি না তা যাচাই-বাছাই হয়নি। সঞ্চালনের ব্যাপারেও এই একই কথা প্রযোজ্য। ১১. অতীতে লাখ লাখ কি.মি. বিতরণ লাইন বাড়লেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়েনি। পরবর্তী সময়ে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও বিদুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়ায় সরবরাহ বাড়েনি। এখনো সে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে স্থিরব্যয় বৃদ্ধি ক্রমাগত অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ সে অনুপাতে বৃদ্ধি না হওয়ায় প্রতি একক বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ছে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ১২. গ্যাসের অভাব না হলে পিডিবির ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন হতো। ঘাটতি কম হতো। ১৩. সব ক্ষেত্রে রেশনিং হলেও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া গ্যাসে রেশনিং হয় না। অথচ এই গ্যাসের সবটাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় না। ১৪. আইওসির কাছ থেকে কেনা গ্যাসের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তরল জ্বালানিও যদি কর, শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত হতো, তাতে ঘাটতি কম হতো। গ্যাস খাত লাভজনক বিধায় ঘাটতির কারণে সিএনজির মূল্য দফায় দফায় বাড়েনি। কৌশলগত কারণে বেড়েছে। বৃদ্ধিজনিত উদ্বৃত্ত অর্থ জ্বালানি খাতের ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যবহার হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হতো। ১৫. তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি আগামীতেও বাড়তে থাকবে। ফলে ঘাটতিও বৃদ্ধি পাবে। তা মোকাবিলার জন্য কেবল মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক সমাধান নয়। সে ক্ষেত্রে এই ঘাটতি পূরণে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার কৌশল অবলম্বন করা জরুরি ছিল। ১৬. প্রান্তিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং কৃষিসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের এই মূল্যবৃদ্ধির কবল থেকে রক্ষার জন্য সামাজিক সুরক্ষার কৌশল গ্রহণ করা জরুরি ছিল। ১৭. স্বল্পতার কারণে কেবল প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া গ্যাসে লস হয়, সেহেতু সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দেওয়ার ব্যাপারে বিতরণ কম্পানির আগ্রহ কম। তিতাস ইতিমধ্যে ৬৯৩টি সংযোগ দিলেও গ্যাসের অভাবে পিডিবির বন্ধ থাকা প্লান্টে গ্যাস দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায়নি। ১৮. বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতকে পিডিবির মূল্যে গ্যাস দেওয়া হয়। অথচ সে বিদ্যুৎ কেনা হয় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দামে। অর্থাৎ পিডিবি, এমনকি কোনো কোনো আইপিপির বিদ্যুতের দাম অপেক্ষা অনেক বেশি দামে। ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম ১৩২ কেভি লেভেলে পাইকারি বিদ্যুতের দামের সমতুল্য। ১৯. আরইবি ৩৩ কেভিতে ব্যক্তি খাত থেকে ক্ষুদ্র-প্লান্টের বিদ্যুৎ কেনে। এ বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয় পিডিবির কাছ থেকে এই ৩৩ কেভিতে, যে দামে বিদ্যুৎ কেনা হয় সেই দামের সঙ্গে সংগতি রেখে। তাতে ব্যক্তি খাত অনেক বেশি মুনাফা লাভের সুযোগ পায়। আরইবিতে এমন বিদ্যুৎ ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ এখানেই নিহিত। শুধু উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে এ দাম নির্ধারণ হওয়া ছিল যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। ২০. ভারতীয় মানদণ্ডে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে সিম্পল সাইকেল প্লান্টে সিস্টেম লস শতকরা ১ ভাগ। কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্টে শতকরা ৩ ভাগ। কয়লা-বিদ্যুৎ প্লান্টের ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াটের অধিক হলে সিস্টেম লস হয় শতকরা ৬ ভাগ। নিম্ন ক্ষমতাসম্পন্ন প্লান্টে ১২ ভাগ। বাংলাদেশের জন্য এ লসের সুস্পষ্ট গ্রহণযোগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। প্লান্টগুলো উন্নত প্রযুক্তিতে সংস্কার করা হলে বিদ্যমান লস অনেক বেশি কমিয়ে আনা সম্ভব। ২১. কোরিয়ান ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্লান্টের দক্ষতা শতকরা ৫০ ভাগ এবং প্লান্ট-ফ্যাক্টর ৯০ ভাগ হলে টনপ্রতি ১২৩ ডলার দামের কয়লায় প্রতি একক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৩.৩০ টাকায়। তাতে নন-ফুয়েল ব্যয় ৭০ পয়সার বেশি নয়। আমাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনে নন-ফুয়েল ব্যয় ৭০-৮০ পয়সা বেশি নয়। অথচ ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে যে বেঞ্চমার্ক প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে নন-ফুয়েল ব্যয় ধরা হয়েছে দুই টাকারও বেশি। ২২. ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতেও ভর্তুকি দিতে হবে। সে ভর্তুকির পরিমাণ কত হবে তা নির্ভর করছে কী মূল্যহারে এ বিদ্যুৎ আমদানি হবে তার ওপর। সে মূল্য যদি বাণিজ্যিক বিবেচনায় নির্ধারণ হয়, তাহলে তা কোনোভাবেই ৮.০০ টাকার কম হবে না। এ পরিস্থিতিতে তেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে কম ভর্তুকি দিতে হবে। আমাদের বিতরণ সংস্থার হিসাবে আমাদের বিদ্যুতের বাণিজ্যিক মূল্যহার ১২.০০ টাকার অধিক। ২৩. ইতিমধ্যে লাভজনক হওয়ায় ডেসকো, তিতাস, জিটিসিএল ও পিজিসিবির শেয়ার বিক্রি করে এসব সরকারি কম্পানির আংশিক মালিকানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ডিপিডিসিসহ লাভজনক অথবা লাভজনক হতে পারে এমন সব কম্পানির শেয়ার বিক্রি বিবেচনাধীন রয়েছে। শেয়ার বিক্রির এসব অর্থ ভর্তুকির নামে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া লোন পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে। ২৪. ভর্তুকি/ধার দেওয়া হয় জনগণের অর্থ। আবার জনগণের সম্পদ বিক্রি করে সে ধার পরিশোধ হয়। জনগণ নিজের অর্থ ধার হিসেবে নিজে পায়। আবার সে অর্থ তার সম্পদ বিক্রি করে পরিশোধ করা হয়। মাঝখানে নিজের মালিকানাধীন সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। এর থেকে বড় জনস্বার্থবিরোধী এবং অপরাধমূলক কাজ আর কী হতে পারে? ২৫. গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ অলস পড়ে আছে। জনগণ গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ দিয়ে এ তহবিলে অর্থ জোগায়। আশা ছিল এই অর্থে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন হবে। গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় কমবে। কম দামে জনগণ গ্যাস পাবে। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ অর্থ লোন হিসেবে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। তাতে এ অর্থের সুদ এবং অর্থ যোগ হয়ে গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় কমার পরিবর্তে বাড়বে। এ অবস্থা কি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা নয়? ২৬. ব্যক্তি খাত রেগুলেটরি নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিধায় তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাদের কাছ থেকে কেনা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যহার আদৌ যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত কি না, তা যাচাই-বাছাই করার আইনগত সুযোগ নেই। ২৭. আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য যখন ৯০-৯৫ ডলার, তখন বিপিসি সে তেল কেনে ১২৩ ডলারে। দামসহ ভোক্তা পর্যায়ে এ তেলের সরবরাহ ব্যয় যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত কি না যাচাই-বাছাই হয় না। বিইআরসি আইন অনুযায়ী গণশুনানির ভিত্তিতে জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ হলে স্বচ্ছ ও যৌক্তিক হতো। ২৮. ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য সরকারকে দেশি-বিদেশি আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এ জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ২৯. এ অবস্থায় ঘাটতি ও ঋণ উভয়ই ধারাবাহিকভাবে বাড়বে, যদি উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা না হয়। ৩০. পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কয়লা থেকে। তার আগেই গ্যাস ও জ্বালানি তেল থেকে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি গ্যাস পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি তেল ছাড়া আর কোনো বিকল্প জ্বালানির উৎস পরিকল্পনায় বিবেচনা করা হয়নি। আবার সে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করাও কঠিন। ফলে জ্বালানি সংকট ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
ঙ. জ্বালানি পরিস্থিতি : আলোচ্য প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে জ্বালানি সরবরাহ অনিশ্চিত এবং টেকসই আর্থিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত। ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে সরকারি খাতের তুলনায় ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বেশি দামে কেনা হয়, অন্যদিকে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যক্তি খাতের উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। তাতে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু বিদ্যুৎ ঘাটতি কমেনি। আবার গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় যেন বৃদ্ধি না হয়, সে জন্য দেশীয় কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভোক্তারা গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ জোগান দিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিলে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা জমা হচ্ছে। কিন্তু তাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। ২০০৩ সালে সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের অংশ ছিল শতকরা ২০ ভাগ, এখন ৫২ ভাগ। এর পরও স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি কম্পানির সঙ্গে পিএসসি ২০১১ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা কমপক্ষে ২৫০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ ২০০ কোটি ঘনফুট। আর্থসামাজিক শ্রেণীভেদে জ্বালানি চাহিদা পূরণে অঞ্চলভিত্তিক জ্বালানি সরবরাহে সমতা, সমসুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। সব এলাকায় গ্যাস যায়নি। সিলিন্ডারে এলপিজিও সব এলাকায় পেঁৗছায়নি। দামের দিক থেকে উভয় ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। অঞ্চলভেদে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাপারেও ভোক্তারা বৈষম্যের শিকার। মূল্যহার নির্ধারণে সমতা আনা যায়নি। বড় শিল্পের তুলনায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যহার অধিক। গ্রামের নূ্যনতম বিলদাতা ১৭ লাখ গ্রাহক মাসে ৫-১০ এককের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পায় না। অথচ মাসিক বিল দেয় ৯৮ টাকা। কয়লানীতি না হওয়ার অজুহাতে কয়লা খাত উন্নয়ন অনিশ্চিত। জ্বালানি সংরক্ষণ আইন না হওয়ায় জ্বালানি সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়ন কার্যক্রমও নিশ্চিত করা যায়নি।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সামর্থ্য বা সক্ষমতা (Capability) থাকা চাই। সেসব সক্ষমতা মূলত নির্ভর করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ওপর জনগণের কতখানি স্বত্বাধিকার (Entitlement) আছে তার ওপর। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলে তাতেই জনগণের স্বত্বাধিকার থাকবে, এমন কথা বলা যায় না। যদি তা ক্রয় করার সামর্থ্য বা সক্ষমতা জনগণের না থাকে। সে স্বত্বাধিকার যদি প্রকৃতই থেকে থাকে, তাহলেই টেকসই জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ফলে জ্বালানি প্রবাহ প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে এবং মাথাপিছু কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ ব্যবহার/খরচের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিদেশি ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়োজনে উভয় খাতকে মুনাফামুখী করার প্রয়োজনে চলমান সংস্কার। অথচ সংকট নিরসন না হওয়ায় এবং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সে সংস্কার এখন বড়ই বিভ্রান্তির শিকার। তাতে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ছ. সুপারিশ : নিজস্ব মালিকানায় ও কর্তৃত্বে নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে কম দামি ও টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন কৌশল। সরকার সে কৌশল অবলম্বন করেনি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সরবরাহ ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এই কৌশল অবলম্বন করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদে জনগণ যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে জনজীবন রক্ষা ও উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন কঠিন হবে।
জ. শেষ কথা : ১. উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে সরকারি মালিকানাধীন কম্পানির দ্বারা ১০টি কূপ জরুরি ভিত্তিতে খনন করে দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা কি সম্ভব ছিল না? ২. ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রের এক টিসিএফ মজুদ গ্যাস উৎপাদন কি জরুরি ছিল না? ৩. ফুলবাড়ী খনি-বিতর্ক এড়িয়ে দিঘিপাড়া ও খালাশপীর খনির কয়লা তোলা কি জরুরি ছিল না? ৪. সরকারের মালিকানায় ও কর্তৃত্বে সার্বিক বিবেচনায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার আওতায় জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করা হলে জ্বালানি নিরাপত্তা কি নিশ্চিত করা সম্ভব হতো না? এসব করা হলে বিদ্যুতের মূল্য স্বাভাবিক রাখা কি সম্ভব হতো না? এসব প্রশ্নের জবাব একটাই, তা হলো যেসব ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এযাবৎকাল পরিচালিত হয়েছে, তাঁরা কেউই জনবান্ধব ছিলেন না। তাঁদের কাছে জনস্বার্থ প্রাধান্য পায়নি। তাঁরা জনগণের কল্যাণ করার দায়িত্ব নেননি। তাই তা হয়নি। সরকার দিনবদলের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছে। তাঁদের বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে তাঁরা সে দাবিও করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সে বদল কি হয়েছে? জ্বালানি নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা যায়নি, এর জবাব সচেতন মানুষের অজানা নয়।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments