আস্থা ফেরাতে গুচ্ছ প্রণোদনা
ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ স্কিমসহ শেয়ারবাজারের জন্য একগুচ্ছ প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। পুঁজিবাজারের তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানানো হয় গতকাল বুধবার।
এসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত এসব পদক্ষেপের ঘোষণা দেন। এ সময় এসইসির সদস্য হেলাল উদ্দিন নিজামী, আমজাদ হোসেন, এম সালাম তালুকদার, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ ও সাইফুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
শেয়ারবাজারের টানা দরপতন ঠেকাতে ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় বৈঠক করে। এসব বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গতকাল জানানো হয়।
এম খায়রুল হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদে আস্থাহীনতা দূর করা। আর আস্থা নির্ভর করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, তথ্যের সঠিক ও প্রাপ্তির মাত্রা, প্রয়োজনীয় তহবিলের সরবরাহ ইত্যাদির ওপর। এ জন্য আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি এতে বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিশেষ স্কিম: যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কারণে প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ স্কিম প্রণয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়েকুজ্জামানকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং এসইসি একজন করে প্রতিনিধি ছাড়াও সিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এ কমিটিতে থাকবেন। প্রয়োজনে কমিটি অতিরিক্ত সদস্য সংযুক্ত করতে পারবে।
কমিটি আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে জমা দেবে। এসইসির একজন কর্মকর্তা জানান, কোন পদ্ধতিতে এবং কাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, কমিটি সেটাই সুপারিশ করবে।
স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ: পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে এসইসি এখনই বাস্তবায়নযোগ্য ১০টি পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। এর আওতায় এখন থেকে শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে (মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস) বিনিয়োগকৃত মূলধন মূল প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের আইনি সীমা বা ‘ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। একই সঙ্গে কোনো কোম্পানির শেয়ারে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মূলধনি বিনিয়োগ ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমার বাইরে রাখা হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত এক গ্রাহক ঋণসীমা সমন্বয়ের মেয়াদ এক বছর, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ লোকসানের মুখে পড়লে তার বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হতো। এখন থেকে মুনাফা ও লোকসান সমন্বয় করে প্রভিশন সংরক্ষণ করা যাবে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৫০ কোটি টাকা মুনাফার পাশাপাশি ৬০ কোটি টাকা লোকসান করলে মাত্র ১০ কোটি টাকা প্রভিশন করতে হবে। আগে লোকসানের পুরোটাই প্রভিশন করতে হতো।
এত দিন ব্যাংক ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের ৯৯ থেকে ১০০ ভাগ মূলধন জোগান দিতে হতো মূল প্রতিষ্ঠানকে। এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠান মূল কোম্পানি থেকে সর্বনিম্ন ৫১ শতাংশ মূলধন সংগ্রহ করে অবশিষ্ট অংশ অন্য যেকোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে পারবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, অর্থমন্ত্রীর পরামর্শে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও অধিক হারে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা—উভয় ধরনের বিমা তহবিলের বিনিয়োগযোগ্য অর্থ অবিলম্বে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর বাইরে ঘোষিত স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক ও অনিবাসী বাংলাদেশিদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লাভের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ কর প্রত্যাহার, বিদেশি বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে বিদেশি ব্রোকারেজ ফার্মকে প্রদেয় কমিশন দ্রুত প্রেরণের ব্যবস্থা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা।
মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ: গুজবনির্ভর ও সংবাদ সংবেদনশীল শেয়ারবাজারের পরিবর্তে একটি পূর্ণ সচেতন মূলধন বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মধ্যমেয়াদি চারটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে এসইসি। সংস্থাটি মনে করছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যাবে। পদক্ষেপগুলো হলো—বিনিয়োগ উপদেশ সেবা চালু, বিনিয়োগকারী, শিক্ষাবিদ ও নীতিপ্রণেতাদের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে মূলধন গবেষণা প্রকাশনা চালু, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নির্দেশনা তৈরি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নিজস্ব মূলধন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
এসইসির মতে, এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক নির্বিশেষে ব্রোকারেজ হাউসগুলো পেশাদার, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে বাধ্য হবে। এতে বাজারে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও নিশ্চিত করা যাবে।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ: এসইসি ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি (চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য) পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে—তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষিত হিসাবের গুণগত মান উন্নত ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রণয়ন, সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং আইন শক্তিশালী করা এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী রক্ষা আইন যুগোপযোগী করা। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও লেনদেনব্যবস্থাকে পৃথক বা ডিমিউচুয়ালাইজ করা; মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে আরও শক্তিশালী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রতিক্রিয়া: এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একধরনের চাপের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় সরকারের সামর্থ্য সীমিত। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও যতটা সম্ভব ভালো কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সরকারের এসব পদক্ষেপ বা ঘোষণা বিনিয়োগকারীরা কীভাবে নেবেন এবং সেগুলোর কার্যকারিতা দেখতে কয়েক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ ঘোষিত প্যাকেজকে বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করে বলেন, স্বল্পমেয়াদি যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-সক্ষমতা বাড়বে। মুনাফার ওপর কর প্রত্যাহার করায় বিদেশি ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগও বাড়বে। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে সব সময় ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণসংক্রান্ত নির্দেশনা বাজারে কিছু বিনিয়োগ নিয়ে আসবে। আবার অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনা প্রশ্নে বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার ফলে সেটিও বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে। এসব পদক্ষেপে বাজার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল রূপ পাবে। সরকারের এসব পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে সহায়তা করবে।
মোহাম্মদ এ হাফিজ বলেন, ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার বা সিআরআর এবং বিধিবদ্ধ জমার হার বা এসএলআর কমানো হলে হয়তো ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতো। তবে এই হার না কমিয়েও ঘোষিত প্যাকেজের ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম শাহদাতউল্লাহ ফিরোজ বলেন, ‘ঘোষিত প্যাকেজকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি হয়তো বিনিয়োগকারীদের পুরোপুরি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তার পরও যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর অর্ধেক বাস্তবায়িত হলেই বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। এখন এর দ্রুত বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও বাড়তে পারে।’
শেয়ারবাজারের টানা দরপতন ঠেকাতে ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় বৈঠক করে। এসব বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গতকাল জানানো হয়।
এম খায়রুল হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদে আস্থাহীনতা দূর করা। আর আস্থা নির্ভর করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, তথ্যের সঠিক ও প্রাপ্তির মাত্রা, প্রয়োজনীয় তহবিলের সরবরাহ ইত্যাদির ওপর। এ জন্য আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি এতে বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিশেষ স্কিম: যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কারণে প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ স্কিম প্রণয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফায়েকুজ্জামানকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং এসইসি একজন করে প্রতিনিধি ছাড়াও সিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এ কমিটিতে থাকবেন। প্রয়োজনে কমিটি অতিরিক্ত সদস্য সংযুক্ত করতে পারবে।
কমিটি আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে জমা দেবে। এসইসির একজন কর্মকর্তা জানান, কোন পদ্ধতিতে এবং কাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, কমিটি সেটাই সুপারিশ করবে।
স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ: পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে এসইসি এখনই বাস্তবায়নযোগ্য ১০টি পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। এর আওতায় এখন থেকে শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে (মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস) বিনিয়োগকৃত মূলধন মূল প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের আইনি সীমা বা ‘ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। একই সঙ্গে কোনো কোম্পানির শেয়ারে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মূলধনি বিনিয়োগ ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমার বাইরে রাখা হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত এক গ্রাহক ঋণসীমা সমন্বয়ের মেয়াদ এক বছর, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ লোকসানের মুখে পড়লে তার বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হতো। এখন থেকে মুনাফা ও লোকসান সমন্বয় করে প্রভিশন সংরক্ষণ করা যাবে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৫০ কোটি টাকা মুনাফার পাশাপাশি ৬০ কোটি টাকা লোকসান করলে মাত্র ১০ কোটি টাকা প্রভিশন করতে হবে। আগে লোকসানের পুরোটাই প্রভিশন করতে হতো।
এত দিন ব্যাংক ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের ৯৯ থেকে ১০০ ভাগ মূলধন জোগান দিতে হতো মূল প্রতিষ্ঠানকে। এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠান মূল কোম্পানি থেকে সর্বনিম্ন ৫১ শতাংশ মূলধন সংগ্রহ করে অবশিষ্ট অংশ অন্য যেকোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে পারবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, অর্থমন্ত্রীর পরামর্শে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও অধিক হারে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা—উভয় ধরনের বিমা তহবিলের বিনিয়োগযোগ্য অর্থ অবিলম্বে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর বাইরে ঘোষিত স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক ও অনিবাসী বাংলাদেশিদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লাভের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ কর প্রত্যাহার, বিদেশি বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে বিদেশি ব্রোকারেজ ফার্মকে প্রদেয় কমিশন দ্রুত প্রেরণের ব্যবস্থা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা।
মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ: গুজবনির্ভর ও সংবাদ সংবেদনশীল শেয়ারবাজারের পরিবর্তে একটি পূর্ণ সচেতন মূলধন বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মধ্যমেয়াদি চারটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে এসইসি। সংস্থাটি মনে করছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যাবে। পদক্ষেপগুলো হলো—বিনিয়োগ উপদেশ সেবা চালু, বিনিয়োগকারী, শিক্ষাবিদ ও নীতিপ্রণেতাদের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে মূলধন গবেষণা প্রকাশনা চালু, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নির্দেশনা তৈরি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নিজস্ব মূলধন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
এসইসির মতে, এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক নির্বিশেষে ব্রোকারেজ হাউসগুলো পেশাদার, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে বাধ্য হবে। এতে বাজারে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও নিশ্চিত করা যাবে।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ: এসইসি ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি (চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য) পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে—তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষিত হিসাবের গুণগত মান উন্নত ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রণয়ন, সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং আইন শক্তিশালী করা এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী রক্ষা আইন যুগোপযোগী করা। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও লেনদেনব্যবস্থাকে পৃথক বা ডিমিউচুয়ালাইজ করা; মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে আরও শক্তিশালী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রতিক্রিয়া: এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একধরনের চাপের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় সরকারের সামর্থ্য সীমিত। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও যতটা সম্ভব ভালো কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সরকারের এসব পদক্ষেপ বা ঘোষণা বিনিয়োগকারীরা কীভাবে নেবেন এবং সেগুলোর কার্যকারিতা দেখতে কয়েক দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ ঘোষিত প্যাকেজকে বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করে বলেন, স্বল্পমেয়াদি যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-সক্ষমতা বাড়বে। মুনাফার ওপর কর প্রত্যাহার করায় বিদেশি ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগও বাড়বে। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে সব সময় ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণসংক্রান্ত নির্দেশনা বাজারে কিছু বিনিয়োগ নিয়ে আসবে। আবার অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনা প্রশ্নে বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার ফলে সেটিও বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে। এসব পদক্ষেপে বাজার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল রূপ পাবে। সরকারের এসব পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে সহায়তা করবে।
মোহাম্মদ এ হাফিজ বলেন, ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার বা সিআরআর এবং বিধিবদ্ধ জমার হার বা এসএলআর কমানো হলে হয়তো ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতো। তবে এই হার না কমিয়েও ঘোষিত প্যাকেজের ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম শাহদাতউল্লাহ ফিরোজ বলেন, ‘ঘোষিত প্যাকেজকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি হয়তো বিনিয়োগকারীদের পুরোপুরি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তার পরও যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর অর্ধেক বাস্তবায়িত হলেই বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। এখন এর দ্রুত বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও বাড়তে পারে।’
No comments