দি আর্টিস্ট by অপূর্ব কুমার কুণ্ড
নির্বাক থেকে সবাক হয়ে ওঠা চলচ্চিত্র
মাধ্যমের জন্যে টার্নিং পয়েন্ট হলেও সাউন্ড টেস্টের যাঁতাকলে পড়ে নির্বাক
যুগের কত বাঘা বাঘা অভিনেতা-অভিনেত্রী যে তারকালোক থেকে ছিটকে পড়ে মাটির
ধুলোয় মিশে গেছে সেটি দ্য ফার্স্ট লেডি অব বেঙ্গলি স্ক্রিন কানন দেবীর
আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ পড়া পাঠক-পাঠিকা মাত্রই জানেন।
অনেকটা সেভাবে সাউন্ড টেস্টের মুখে দাঁড়িয়ে নির্বাক যুগের বিখ্যাত এক
হলিউড অভিনেতার থমকে দাঁড়াবার কাহিনী চলচ্চিত্র ‘দি আর্টিস্ট’। কোন খ্যাতিই
যে শেষ পর্যন্ত ধ্রুব তারার মতো ধ্রুব নয় বরং হঠাৎ আলোর রোশানাই ছড়িয়ে
চারদিকে আলোকিত করে পুনঃআঁধারে মিলিয়ে যাবার মতো উল্কাপাত-তা নিয়েও
আর্টিস্ট।
আলো-আঁধারীর রহস্যে ভরা এক অভিনেতার বাস্তব জীবনের সত্য অন্বেষণে ৮৪তম অস্কারে পাঁচ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হওয়া ফ্রান্সের পরিচালক মিশেল হাজানাভিসারের মমত্বভরা বুদ্ধিদীপ্ত নাটকীয় চলচ্চিত্র দি আর্টিস্ট। চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষ হয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনকে শ্রদ্ধা জানাবার অপূর্ব নিদর্শন।
চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় হলভর্তি দর্শক নিমগ্ন হয়ে দেখছে কিনোপ্রাফ স্টুডিও প্রযোজিত আলজিমার পরিচালিত হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন (জাঁ দুজারদাঁ) অভিনীত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘এ রাশিয়ান এ্যাফেয়ার’। চৌকস নিরাপত্তার বেড়াজাল ভেদ করে নায়িকাকে উদ্ধারে নায়কের বীরত্বগাথা। পর্দায় নির্বাক চলচ্চিত্র কিন্তু মঞ্চের সম্মুখে বসে বাদ্যদলের জীবন্ত আবহ নির্মাণ। নায়কের বীরত্ব দেখে হলভর্তি দর্শকের তুমুল করতালি। ব্যক্তি জীবনে মানুষ যা পারে না অথচ কল্পনায় যা পারতে চায় তার মিল পর্দায় দেখে মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস আর ধরে না। সিনেমা শেষে আরাধ্য অভিনেতাকে সীমানার গ-িতে পেয়ে ভক্তেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুঁয়ে দেখতে মরিয়া। নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে শান্ত কিন্তু প্রতিজ্ঞায় ছয় পুলিশ বাহিনী। একমাত্র প্রবেশের অধিকার প্রিন্ট মিডিয়ার আলোকচিত্র শিল্পী এবং সাংবাদিকদের। আলোর ঝলকানি আর প্রশ্ন উত্তরের তোড়ে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন আকাশে ডানা মেলে।
পাখির ডানার ঝাপটায় বিমান যেভাবে উড়ন্ত আকাশে ঝুঁকিতে পড়ে অনেকটা সেরকম ঝুঁকিতে পড়ে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন এক অপরিচিত নারী পিপি মিলারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে। ভক্তদের ধাক্কাধাক্কির কারণে পিপি মিলার ছিটকে নায়কের গ-ির ভেতরে। এসেই যখন পড়া তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পিপি মিলার না বুঝেই জর্জ ভ্যালেনটিনকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। মুহূর্তে মাত্র। ঝলসে ওঠে এক দক্ষ ক্যামেরাম্যানের ফ্ল্যাশ। পরদিন ভ্যারাইটি পত্রিকায় আলিঙ্গনবদ্ধ ছবির পাশে লেখা শিরোনাম, কে এই মেয়ে?
পিপি মিলার বুঝে যায় তার গন্তব্য কোথায়। পত্রিকা স্টল থেকে ভ্যারাইটি পত্রিকা কিনে নিয়ে সোজা দৌড় স্টুডিও কিনোগ্রাফে। মনের বাসনা নিজেকে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রীর আসনে দেখা। অন্যদিকে পরিচালক আলজিমারের মাথায় হাত। কোথায় তার সিনেমা নিয়ে পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রশাংসার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়বে তা না বরং কোটি ডলারের প্রশ্ন, কে এই মেয়ে। ভাগ্যিস মেয়েটা হাতের নাগালে নেই পরিচালক আলজিমারের। আলজিমারের অভিব্যক্তিতে পরিষ্কার, মেয়েটাকে হাতের নাগালে পেলে প্রেসার কুকারের মধ্যে ফেলে টনখানেক গুঁড়া মসলার সাথে সমপরিমাণ লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করত। প্রেসার কুকারের তিন সিটিতে রাগ যাবে না, মিনিমাম দশ সিটি। মেয়েটা পাকামো করার আর সময় পেল না।
সময় মতো ড্যান্স কাস্টিং ডিরেক্টরের সামনে উপস্থিত পিপি মিলার। ড্যান্সে টেস্টে নিজের বুদ্ধিদীপ্ত নৃত্য ভঙ্গিমায় ড্যান্স ডিরেক্টরের সুনজরে পড়ে প্রাক বাছাই পর্ব উত্তীর্ণ হয়ে প্রবেশের সুযোগ পেলো ঢুকতে মূল শুটিং স্পটে। পড়বি তো পড় বাঘের মুখে। পরিচালক আলজিমারের চোখের সামনে হুংকার। ‘এত বড় স্পর্ধা, আমার সামনে, বেরো, আগে বেরো এই ফ্লোর থেকে। সিকিউরিটি, ওকে পিটিয়ে বের কর।’ লজ্জা-অপমানে খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যখন পিপি মিলার বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন পেছন থেকে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের হৃদয় নিংড়ানো ডাক, তুমি যেতে পারবে না। তোমার সঙ্গে আমার পরের দৃশ্যের শট। ইউনিটের সকলে থ! চলচ্চিত্র ইউনিটে ডিরেক্টরের কথাই যেখানে শেষ কথা সেখানে একি অনাকাক্সিক্ষত কথা। ডিরেক্টর যাকে বের করে দিতে চায়, হিরো তাকে ধরে রাখতে চায়। তবু কথায় বলে, যে গাভী দুধ দেয় তার পায়ের লাথিকে আদর ভাবতে ভাল লাগে। পরিত্যক্ত পিপি মিলার অভিনেতা-নায়ক জর্জ ব্যালেনটিনের কল্যাণে তারই সাথে অভিনয় করে চলচ্চিত্র ‘এ জার্মান এ্যাফিয়ার’-এ।
চলচ্চিত্রে এ্যাফেয়ারের দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়েই হয়তো পিপি মিলারের হৃদয়ে অভিসারের দোলা লাগে। নিভৃতে প্রবেশ করে জর্জ ব্যালেটিনের ঘরে। পিপি মিলারের নিষ্পাপ চাওনি, চাওনির মাঝে এত বড় উপকারের কি কারণ সে ব্যাপারে আসমুদ্র কৌতূহল এবং নায়কের নায়কোচিত উপস্থিতিতে বিহ্বল হয়ে পড়ার বিপরীতে আচরণে ও দৃষ্টিতে জর্জ ভ্যালেনটিন সংযত, নির্মোহ কিন্তু সঠিক পথ চিনিয়ে দিতে স্বাভাবিক প্রাজ্ঞ। ইনসার্ট সাবটাইটেলে জর্জ ভ্যালেনটিন পিপি মিলারকে বলে, তুমি এখনই সত্যিকারের অভিনেত্রী হবে যখন তুমি যে কারও থেকে যে কোন অবস্থায় অন্যদের থেকে আলাদা। কথা বলতে বলতে জর্জ ভ্যালেনটিন মেকআপ বক্স থেকে কাঠ পেন্সিল তুলে নিয়ে পিপি মিলারের মুখের ডান দিকে, ঠোঁটের উপরিভাগ কিন্তু নাকের নিচের ভাগে এঁকে দেয় একটি কাল স্পষ্ট। আঁকা কালো স্পটের কারণে পিপি মিলারের মুখাবয়ব তখন শিক্ষা-সংস্কৃতি-সৌন্দর্য এবং ক্ষমতার মিশেলে নান্দনিক। অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন প্রদত্ত কালো স্পষ্ট তখন পিপি মিলারের লাকি স্পট।
লাকি স্পটের কিরন ছটায় পিপি মিলারের চলার পথ যখন ফুলে ফুলে ঢাকা তখন নায়ক অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের পথের সামনে পাথরের স্তূপ। নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে নির্বাক চলচ্চিত্র সবাক হয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সাউন্ড টেস্টের জন্য কণ্ঠ দিতে ডাক পড়েছে একে একে সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীর। ডাক পড়ল নায়ক জর্জ ভ্যালেনটিনের। কিন্তু কোথায় যেন নতুনভাবে পরীক্ষায় বসতে বাধ্য হবার হীনম্মন্যতা। প্রযোজক-পরিচালক আলজিমারের আহ্বানকে উপেক্ষা করা। জর্জ ভ্যালেনটিনের মনের ভাব অনেকটা এরকম, নির্বাক অভিনয় গুনে আমি যখন হলিউড দর্শকের হৃদয়মনি তখন আবার আমাকে সবাক হতে হবে কেন? যে আমি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় জগতের সম্রাট সেই আমাকে টিকে থাকতে হবে পাস ফেলের পরীক্ষায় পাস করে। আর দশ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী যা আমিও তা। উপরন্তু যা দেখবার সেখানে কথার কি দরকার।
দরকার কি অদরকার সেই আবেগের স্রোতে অভিনেতার গা ভাসানো চলে কিন্তু ব্যবসায়ী প্রয়োজকরা সব সময় আগে থেকে বুঝে যায় কোথায় আসল ব্যবসা। বকের দৃষ্টি থেকে মাছ পিছলে যেতে পারে কিন্তু ঝানু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যবসা কখনও পিছলায় না। সেখানে আবেগটাও ব্যবসার পণ্য। প্রয়োজক-পরিচালক আলজিমার ঘোষণা দেয়, কিনোগ্রাফ স্টুডিওর পরবর্তী সব চলচ্চিত্রই হবে সবাক। বিস্মিত অভিনেতা-নায়ক জর্জ ভ্যালেনটিন। অর্থাৎ তাকে বাদ দিয়েই পরিচালক পরবর্তী কাজগুলো চালিয়ে যাবে। তাহলে এতদিন তার একচ্ছত্র আধিপত্য মূলত ফুলানো ফাঁপানো ফানুস যার বাহ্যত চাকচিক্য আছে কিন্তু ভেতরের মূলধন শূন্য। নইলে তাকে ছাড়াই কাজ চলে কি করে?
এতটা বছর প্রয়োজকের ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে কোটি কোটি ডলার পাইয়ে দিলাম সেসব মূল্যহীন। অভিনয় করতে এসে জীবনের থেকে অভিনয়টাকে বড় করে দেখে দেহ-মন-প্রাণ সপে দিলাম যে কিনোগ্রাফ স্টুডিওতে আজ আমি অপ্রযোজনীয়। নির্বাক অভিনেতা আমি, নির্বাক অভিনয চালিয়ে নিতে চাওয়ার আমার দাবির কোন মূল্য নেই প্রযোজক-পরিচালকের কাছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে অভিনেতা কি শুধুই সার্কাসের ক্লাউন যার কাজটা মূলত পরিচালকের নির্দেশে লোক হাসানো। এসবের বাইরেও সাউন্ড টেস্টে আজ আমি যদি বিফল হয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে বাদ পড়ি তবে আমি বাঁচার জন্য দাঁড়াব কোথায়। যে কোটি কোটি দর্শক একবার হাতের নাগালে পাবার জন্য আমায় মরিয়া হয়ে খোঁজে সেই দর্শকই তো আমায় দেখে ঠাট্টা তামাশায় বলবে, ঐ দেখ প্রতিভাধর বোবা অভিনেতা, কথা বলতে পারে না। না না সত্যের মুখোমুখি আজ দাঁড়াতেই হবে। আলজিমারকে উত্তর দিতেই হবে, কেন সে এমন সিদ্ধান্তে গেল। তাকে বলতে হবে, কে বড় লোভ-লালসা নাকি মানবতা। যন্ত্র বড় নাকি মানুষ বড়। নায়ক-অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন প্রযোজক-পরিচালক আলজিমারের মুখোমুখি।
শীতল বরফ চোখ নিয়ে লক্ষ্য নির্ধারণে অবিচল হিসাবী প্রযোজক পরিচালক আলজিমার ইনসার্ট সাবটাইটেল সহযোগে বলে চলে, পৃথিবী এখন কথা বলছে, আমাদের নীরব থাকলে চলবে না। দর্শক সর্বদা চায় দু’হাতে নতুনত্বকে আঁকড়ে ধরতে। আমাদের সবার আগে দর্শক চাহিদা পূরণ করতে হবে। আর সে কারণেই আমাদের পরবর্তী সব নির্মাণে কথা থাকবে। আশা করি আমি কথা দিয়ে আমার কথা বোঝাতে পেরেছি। বুঝতে পারে সবই অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন। তবু স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে যতটুকু অহঙ্কার শিল্পী ধারণ করে তা নিয়েই অভিনেতা জর্জ ভ্যালেটিন বলে, আমি অভিনেতা। আমি জন্মেছি আমাকে দেখতে, শোনাতে না। দেখানো-শোনানোর কাজটা তুমিই চালিয়ে যাও। আমি যতদিন পারব ততদিন দেখিয়েই যাব আর সে পর্যন্ত বন্ধু বিদায়।
বিদায় বেলায় নিজের সাম্রাজ্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলা সম্রাটের বুকের ভেতর উতলে ওঠা স্রোতের তোড় যেভাবে বুক গলা হয়ে চোখের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় অথচ অক্ষমতার ছেলে মানুষী চাওনি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে আসা স্রোতের তোড়ের মুখে বাধা দিতে অনেকটা সে রকম সম্রাটের ভূমিকায় জর্জ ভ্যালেটিন চরিত্রে অভিনেতা জঁ দুজারদা’র অভিনয় দর্শক হৃদয়ের গভীরে গভীরতর ছাপ রেখে যায়।
হৃদয়ের গভীরে আরও সঙ্কোচ কাজ করে যখন অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন তার প্রিয় স্টুডিও ছেড়ে যাচ্ছে আর সেই স্টুডিওতে ঢুকছে তার ভাল লাগার অভিনেত্রী পিপি মিলার। সবদিক দিয়েই নবীনা পিপি মিলারকে তো আর বলা চলে না তার প্রিয় পরিণত অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের সাম্রাজ্য পতনের কাহিনী। তবুও মুখোমুখি দেখা হওয়ায় পিপি মিলারের সর্বাঙ্গে আনন্দের ঝলকানি। আপনি জানেন তো, কিনোগ্রাফ স্টুডিওর পরবর্তী চলচ্চিত্রের জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আর বলবেন না। এই কস্টিউমের মাপ নিচ্ছে তো পরক্ষণেই হেয়ার স্টাইলিস্টের চিরুনির তলে মাথা পেতে দাও। যেই মাত্র ড্যান্স ডিরেক্টরের প্রশিক্ষণ শেষ হচ্ছে অমনি ফ্রুট জুস নিয়ে পাচক হাজির। লাইটের আলোয় ঘামলে টিসু দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে তো পরক্ষণেই মুখে পাউডারের চড়া মেকআপ। স্কিনটা বুঝি এবার যাবে। তা সে যাক, কোটি মানুষের হৃদয়মণি হতে গেলে একটু ঝক্কিতো সামলাতেই হবে। আর কথা বলতে পারব না জর্জ, আমি গেলেই শূটিং শুরু হবে। পিপি মিলারের প্রস্থানে জর্জ ভ্যালেনটিনের দীর্ঘশ্বাস যার অর্থ একটাই, এমন উন্মাদনা একদিন আমারও ছিল।
কি অতীতে ছিল আর ছিল না সেকথা ভেবে বর্তমানে কাজ বন্ধ রেখে ঘরের ভেতর থেকে সিটকেনি লাগিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকলে তো আর বর্তমান চলে না। ফলে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনকে সিদ্ধান্ত নিতেই হয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নতুন কাজ নিয়ে বর্তমানে ঝাঁপিয়ে পড়ার। চলচ্চিত্র বানাতে লাগে লাখ লাখ ডলার। ফলে তাকে হতে হয় প্রযোজক। অন্যের মুখে চেয়ে নিজের বক্তব্য যেহেতু আর বলা চলছে না ফলে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে, নিজে নির্দেশনা দিয়ে এবং অভিনয় করে নির্মিত হলো নির্বাক চলচ্চিত্র ‘টিয়ার্স অব লাভ’। ভালবাসার অশ্রু।
চোখে অশ্রু ঝরে পড়ার আগেই জর্জ ভ্যালেনটিনের চোখে থমকে যায় সিনেমা হলের দিকে তাকিয়ে। তার নির্মিত চলচ্চিত্র টিয়ার্স অব লাভ যে হলে প্রথম প্রদর্শিত হবে তথা রিলিজ হবে সেদিনের তারিখ ২৫ অক্টোবর। ঐ একই দিন একই সময় পামোর হলটিতে প্রদর্শিত হবে কিনোগ্রাফ স্টুডিও প্রযোজিত সবাক চলচ্চিত্র ‘বিউটি স্পট’। জর্জ ভ্যালেনটিনের আবিষ্কৃৃত নায়িকা পিপি মিলার তার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। পুরুষের কল্পনায় উন্মাদনার ঝড় তুলে দেয়ার মতো আবেদনময়ী পোস্টার এবং বিশাল ক্যানভাসের বিলবোর্ডে লাকি স্পটের অধিকারিণী অভিনেত্রী পিপি মিলার। পথচারী যে কোন দিক দিয়ে তাকালে মনে হবে পিপি মিলারের চোখ দুটি তার দিকে তাকিয়ে বলছে, দরজাটা ভালভাবে লাগিয়ে দিয়ে এসো। বিলবোর্ড বিধ্বংসী আবেদনের পাশে বড় বড় দুটি শিরোনাম। একটিতে বিউটি স্পটে এবার পিপি মিলার। অপরটিতে, এবার কথা হবে।
আর কথা! নির্বাক জর্জ ভ্যালেনটিন। একদিকে খোলামেলা দৃশ্য দেখবার দর্শকের সুপ্ত বাসনা। অন্যদিকে অভিনেত্রী কথা বলে দর্শকদের জীবনে প্রথম বারের মতো বিস্ময়ে চমকে দেবে। তৃতীয়ত আজ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়েছে তার চেয়ে হাঁটু বয়সী মেয়ের সাথে আবার যে তারই আবিষ্কার। ভুক্তভোগী মাত্রই জানে, জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারার আনন্দ যতটা না উচ্ছ্বাসের তার থেকে বড় আতঙ্কের বিষয় গন্তব্য থেকে ছিটকে যাবার মুহুর্মুহু হাতছানি। উপরন্তু বানের তোড়ের মতো লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করায় হাত খালি দশা। কে জানে নাম-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি সব কিছু ২৫ অক্টোবর ছবি রিলিজ হবার সাথে সাথে ধুলোয় মিশে যাবে কিনা। চিন্তা যে কত বড় ব্যাধি এবং তা যে কিভাবে মানুষকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে তা অভিনেতা জাঁ দুজারদাঁ’র কয়েকটি অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। অনিশ্চিত আতঙ্কে জজ ভ্যালিনটিন ঘুমের মধ্যেও সজাগ থাকে।
সর্বদাই সজাগ থাকতে হয় সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের। ছবি রিলিজের পূর্ব দিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর রাতে হলিউড স্টারদের ভি.আই.পি রেস্টুরেন্টে যখন এক টেবিলে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন এবং অপর টেবিলে অভিনেত্রী পিপি মিলার। তখন পিপি মিলারের টেবিলে তাকে ঘিরে ধরে বিনোদন সাংবাদিকরা এবং তাদের ক্যামেরা। দু’দিন আগেও যে সাংবাদিকরা জর্জ ভ্যালেটিনকে ফুল বিবেচনা করে নিজেরা মৌমাছি হয়ে আষ্টেপিষ্ঠে ঘিরে ধরত আজ তারাই খবরের উৎস জ্ঞানে অভিনেত্রী পিপি মিলারের মাঝে রানী মৌমাছির সত্তা পেয়ে ক্যামেরার ফ্লাসের আলোক রোশনাই ছাড়িয়ে পিপি মিলারের মুখ দিয়ে দুটি কথা বলিয়ে নিতে মরিয়া। অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের বুকের ভেতর থেকে স্বগতোক্তির মতো দীর্ঘশ্বাস যার অর্থ সেলিব্রেটি জীবন কেন এত দোদুল্যমান, এই আছে এই নাই, জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই।
জোড়া জুড়ির প্রশ্ন না ম্যাডাম পিপি মিলার। আমরা শুধু জানতে চাই, আপনার অভিনীত চলচ্চিত্র বিউটি স্পট এখনও মুক্তি পায়নি। আগামী দিন মুক্তির আগেই আজ আপনি হলিউডের হৃদয়ের রানী, দর্শকের চোখের মণি। আপনি কি বলবেন, এই জায়গায় আপনি কিভাবে পৌঁছালেন। সাংবাদিক খুশি হলে সংবাদটা যে সৌরভ নিয়ে পরদিন কোটি কোটি পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করবে এবং সেই পাঠকই যে হল থেকে টিকেট কেটে ছবিটা দেখতে হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে এটুকু পাকা বুদ্ধি পিপি মিলার বেশ ভালই রাখে। তাই সে সাংবাদিকদের দিকে মোহিনী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে এবং ক্যামেরার সামনে দৈহিক ভঙ্গিমায় উষ্ণতা ছাড়িয়ে সাবটাইটেল সহযোগে বলে চলে, দেখুন আমি আসলে জানি না এমনটা কেন হলো। হতে পারে আমার কথা বলাটা তাদের কাছে ভাল লাগছে এবং তারা তা শুনছে। সত্যি কথা বলতে কি পুরনো অভিনেতা অভিনেত্রীদের এক ঘেয়েমি অভিনয়ের নির্বাক চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে দর্শক ক্লান্ত। এখন সময় এসেছে পুরনোদের বাদ দেবার, নতুনকে স্বাগত জানাবার। তারুণ্যের গভীরে ডুব দিতে হবে এটাই জীবন। পিপি মিলারের কথার উচ্ছ্বাস আর আলোর রোশনাইতে পরিবেশ যখন উৎসবমুখর ঠিক তখন জর্জ ভ্যালেনটিনের মুখে অপমানিত হবার লজ্জা। স্টুডিওতে দু’দিন পা রাখতে না রাখতেই সব বিচারের বিচারক হয়ে গেছে এই হাঁটু বয়সী মেয়ে। পুরনোদের অভিনয় এক ঘেয়েমিতে ভরা, সময় এসেছে পুরনোদের বাদ দেবার। এত বড় অপমানের কথাতো মুখ বুজে মেনে নেয়া আরও বড় অপমান। না একটা কিছু করতেই হয়। খাওয়া শেষ করে মুখ হাত মুছে জর্জ ভ্যালেনটিন এসে দাঁড়ায় মধ্য সেলিব্রেটি পিপি মিলারের সামনে। গনগনে আগুন কয়লার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ পুড়তে পুড়তে আর্তনাদকে চেপে রেখে যদি সাবলীলভাবে কথা চালিয়ে যায় ব্যাপারটা যেমন অনেকটা সেভাবে আক্রোশকে চেপে দৃঢ়তার সাথে জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, আমি পুরনো। কিন্তু তুমি আজ যে নতুন পথে হাঁটছ সে পথ আমিই তৈরি করে দিয়েছি। কথা শেষে জর্জ ভ্যালেনটিন চলে যায় কিন্তু থমকে যায় অভিনেত্রী পিপি মিলার। সেলিব্রেটির মোহ ভেঙ্গে যেন পিপি মিলারের সাময়িক আত্মজিজ্ঞাসা, দিগন্তে চোখ ভাসাতে গিয়ে তবে কি পা জোড়া আমার মাটি ছাড়া।
মাটিতে পা না থাকবারই কথা পিপি মিলারের। ২৫ অক্টোবর তারিখে পত্রিকার পাতায় পাতায় পিপি মিলারের বন্দনা। সপ্তাহজুড়ে ঐ একই প্রবাহ। বড় বড় শিরোনাম, বড় বড় উপাধি। ব্রিলিয়ান্ট। ডোন্ট মিস। দেখুন ভালবাসার নব তরঙ্গ। হৃদয় দুমড়েমুচড়ে নেয়া তরুণী কথা বলছে। অবিশ্বাস্য। টক অব দ্য কান্ট্রি : পিপি মিলার। বিউটি স্পট প্রদর্শিত হলগুলোতে যখন ধারাবাহিক হাউজফুল বোর্ড ঝুলছে তখন জর্জ ভ্যালেনটিনের নির্দেশিত-প্রযোজিত-অভিনীত দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখতে আসে অভিনেত্রী পিপি মিলার।
হলের বড় পর্দায় অভিনেত্রী পিপি মিলার দেখছে, জংগল দস্যুদের হাত থেকে নিজের জীবন বিপন্ন সত্ত্বেও ছবির নায়ক তার নায়িকাকে উদ্ধার করতে মরিয়া। দস্যুদের বল্লমের ফলার মুখে নিজে দাঁড়াচ্ছে তথাপি নায়িকাকে কোনভাবে আক্রান্ত হতে দিচ্ছে না। বল্লম আর নায়িকার মাঝে দাঁড়ানো নায়কের অভিব্যক্তি, জীবন দ্বীপ নিভলে আমার নিভবে রে দস্যুর দল। শক্রতা করবি আমার সাথে কর। নিরীহ অবহেলা নারীর ওপর আঘাত আনতে লজ্জা করে না তোদের জংলী জানোয়ার। আমি বেঁচে থাকতে ওঁর কোন ক্ষতি হতে দেব নারে জানোয়ার। বাঁচতে চাস তো জান নিয়ে পালা নাইলে দেখ আমার বল্লমের ধার কত তীক্ষè, কত নির্মম। বন দস্যুদের হাত থেকে নায়িকাকে মুক্ত করে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিতে গিয়ে নায়ক অনাকাক্সিক্ষতভাবে পড়ে যায় চোরা বালির মাঝে। দস্যু মোকাবেলা করে ক্লান্ত নায়ক শক্তির জোরের অভাবে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে শুরু করে চোরা বালির তলে। পা ডুবতে ডুবতে যখন কোমর অবধি ডুবতে বসেছে তখন নিরাপদে থাকা নায়িকা নিরাপদ স্থান ছেড়ে এগিয়ে আসতে চাইছে চোরাবালির হাত থেকে নায়ককে বাঁচাতে। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ও নায়ক বোঝে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যাওয়া মানুষকে খালি হাতে অপর মানুষ ছাড়াতে এলে যে যেভাবে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় ঠিক একই কথা এই নায়িকারও একই করুণ পরিণতি সুনিশ্চিত। নায়কের বেদনা দেখে নায়িকা যেন একই ভুল না করে সে কথা ভেবেই বুক পরিমাণ বালির তলে ডুবতে থাকা নায়ক চিৎকার করে বলে; বিদায় নরমা। তুমি ফিরে যাও। যেনে রেখ আমি কোনদিনই তোমাকে ভালবাসিনি। বিদায়! ডুবতে ডুবতে নিষ্পলক চাওনি নিয়ে নায়ক চোরা বালির তলে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। ডুবন্ত হাতের শেষ প্রান্তে শেষবারের মতো শেষ বিদায়। দস্যুদের হাত থেকে জীবন ঝুঁকি নিয়ে যে জীবন বাঁচায়, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যে সঙ্গীর ন্যূনতম বিপদের কারণ না হয় সেই নায়কের হঠাৎ বিদায় নায়িকার বুক-গলা ভাসিয়ে যে জলধারা চোখ হয়ে বের হয়, ক্রন্দনের শব্দে আকাশ বাতাসকে ভারি করে তোলে, এমন প্রেমিক নায়ক মানুষটি ছাড়া নায়িকা নরমার যে আজ আর কেউ নেই ঠিক সেখানেই নায়িকার মুখে ওভার ল্যাপে ফুটে ওঠে ছবির টাইটেল, দ্য টেয়ার্স অব লাভ। এখানেই ছবির শেষ কিন্তু অডিয়েন্সে বসা গ্লামার অভিনেত্রী পিপি মিলারের মুখের মেকআপ গলে নামছে তারই চোখ বেয়ে নামা অশ্রু জলের ধারাতে। দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখার বিস্ময় আর এই মাপের অভিনেতাদের পুরনো বলে শ্লাঘা প্রকাশের অনুতাপের অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকা পিপি মিলার বৃষ্টি বাদলার রাতে দৌড় লাগায় জর্জ ভ্যালেনটিনের বাসায় ক্ষমা প্রার্থনার আশায়।
ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যাকুল হৃদয়ে অভিনেত্রী পিপি মিলার অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের দরজায় সম্মুখে। অপরদিকে স্টক মার্কেটের পতনের কারণে দেউলিয়া হয়ে, চলচ্চিত্র নির্মাণে ভরাডুবি খেয়ে, পতনের মুখে স্ত্রী ডরিসের কাছ থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার চূড়ান্ত নোটিস পেয়ে বিধ্বস্ত জর্জ ভ্যালেনটিন নরক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে ঘর ছেড়ে দরজার সম্মুখে। সম্মুখে অভিনেত্রী পিপি মিলারকে দেখে জর্জ ভ্যালেনটিন পুনঃনির্বাক। পিপি মিলার বলে, আমি একটু বসে কথা বলতে চাই, আমি দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখেছি। প্রতি উত্তরে জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, আমাকে কি এখন টিকেটের মূল্য ফেরত দিতে হবে? পিপি মিলার বলে, টিকেটের মূল্যই যদি নিতে আসব তবে নিশ্চয়ই এই বৈরী আবহাওয়াতে আসতাম না। ভালবাসার অশ্রু কি আমি তা বুঝেছি। ভালবাসা মানে এই না যে মুখ দিয়ে বলা, আমি তোমায় ভালবাসি। ভালবাসা সেখানেই প্রাণ পায় যেখানে দুটি হৃদয় যে যার জায়গা থেকে অপরকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়। পরস্পর সেবা এবং শ্রদ্ধা যখন মিলেমিশে ভালবাসাকে অর্থবহ করে তোলে তখন কোন কারণে যদি হৃদয় দুটির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে তবে ভালবাসা সেখানে কেঁদে ওঠে, ভালবাসার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। সেদিনের রাত্রে সাংবাদিকদের কাছে আমার বলা কথার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাকে ব্যথিত করে তুলবার জন্য দুঃখিত। পুরনো, পূর্বসূরীদের সক্ষমতাকে খাটো করে দেখবার জন্য দুঃখিত। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। নির্বাক জর্জ ভ্যালেনটিন কি উত্তর দেবে বুঝে পায় না। শুধু বলে, পিপি মিলার তোমার সবটাই ভুল না। নতুনকে নতুন পথের সুযোগ করে দিয়ে তাকে যে দুহাত বাড়িয়ে সাদরে আহ্বান জানাতে হবে এ ব্যাপারে তোমার মতো সঠিক যা একশতে একশ’, তবে এবার এস।
(এরপর ২০-এর পাতায়)
আলো-আঁধারীর রহস্যে ভরা এক অভিনেতার বাস্তব জীবনের সত্য অন্বেষণে ৮৪তম অস্কারে পাঁচ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হওয়া ফ্রান্সের পরিচালক মিশেল হাজানাভিসারের মমত্বভরা বুদ্ধিদীপ্ত নাটকীয় চলচ্চিত্র দি আর্টিস্ট। চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষ হয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনকে শ্রদ্ধা জানাবার অপূর্ব নিদর্শন।
চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় হলভর্তি দর্শক নিমগ্ন হয়ে দেখছে কিনোপ্রাফ স্টুডিও প্রযোজিত আলজিমার পরিচালিত হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন (জাঁ দুজারদাঁ) অভিনীত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘এ রাশিয়ান এ্যাফেয়ার’। চৌকস নিরাপত্তার বেড়াজাল ভেদ করে নায়িকাকে উদ্ধারে নায়কের বীরত্বগাথা। পর্দায় নির্বাক চলচ্চিত্র কিন্তু মঞ্চের সম্মুখে বসে বাদ্যদলের জীবন্ত আবহ নির্মাণ। নায়কের বীরত্ব দেখে হলভর্তি দর্শকের তুমুল করতালি। ব্যক্তি জীবনে মানুষ যা পারে না অথচ কল্পনায় যা পারতে চায় তার মিল পর্দায় দেখে মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস আর ধরে না। সিনেমা শেষে আরাধ্য অভিনেতাকে সীমানার গ-িতে পেয়ে ভক্তেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুঁয়ে দেখতে মরিয়া। নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে শান্ত কিন্তু প্রতিজ্ঞায় ছয় পুলিশ বাহিনী। একমাত্র প্রবেশের অধিকার প্রিন্ট মিডিয়ার আলোকচিত্র শিল্পী এবং সাংবাদিকদের। আলোর ঝলকানি আর প্রশ্ন উত্তরের তোড়ে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন আকাশে ডানা মেলে।
পাখির ডানার ঝাপটায় বিমান যেভাবে উড়ন্ত আকাশে ঝুঁকিতে পড়ে অনেকটা সেরকম ঝুঁকিতে পড়ে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন এক অপরিচিত নারী পিপি মিলারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে। ভক্তদের ধাক্কাধাক্কির কারণে পিপি মিলার ছিটকে নায়কের গ-ির ভেতরে। এসেই যখন পড়া তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পিপি মিলার না বুঝেই জর্জ ভ্যালেনটিনকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। মুহূর্তে মাত্র। ঝলসে ওঠে এক দক্ষ ক্যামেরাম্যানের ফ্ল্যাশ। পরদিন ভ্যারাইটি পত্রিকায় আলিঙ্গনবদ্ধ ছবির পাশে লেখা শিরোনাম, কে এই মেয়ে?
পিপি মিলার বুঝে যায় তার গন্তব্য কোথায়। পত্রিকা স্টল থেকে ভ্যারাইটি পত্রিকা কিনে নিয়ে সোজা দৌড় স্টুডিও কিনোগ্রাফে। মনের বাসনা নিজেকে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রীর আসনে দেখা। অন্যদিকে পরিচালক আলজিমারের মাথায় হাত। কোথায় তার সিনেমা নিয়ে পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রশাংসার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়বে তা না বরং কোটি ডলারের প্রশ্ন, কে এই মেয়ে। ভাগ্যিস মেয়েটা হাতের নাগালে নেই পরিচালক আলজিমারের। আলজিমারের অভিব্যক্তিতে পরিষ্কার, মেয়েটাকে হাতের নাগালে পেলে প্রেসার কুকারের মধ্যে ফেলে টনখানেক গুঁড়া মসলার সাথে সমপরিমাণ লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করত। প্রেসার কুকারের তিন সিটিতে রাগ যাবে না, মিনিমাম দশ সিটি। মেয়েটা পাকামো করার আর সময় পেল না।
সময় মতো ড্যান্স কাস্টিং ডিরেক্টরের সামনে উপস্থিত পিপি মিলার। ড্যান্সে টেস্টে নিজের বুদ্ধিদীপ্ত নৃত্য ভঙ্গিমায় ড্যান্স ডিরেক্টরের সুনজরে পড়ে প্রাক বাছাই পর্ব উত্তীর্ণ হয়ে প্রবেশের সুযোগ পেলো ঢুকতে মূল শুটিং স্পটে। পড়বি তো পড় বাঘের মুখে। পরিচালক আলজিমারের চোখের সামনে হুংকার। ‘এত বড় স্পর্ধা, আমার সামনে, বেরো, আগে বেরো এই ফ্লোর থেকে। সিকিউরিটি, ওকে পিটিয়ে বের কর।’ লজ্জা-অপমানে খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যখন পিপি মিলার বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন পেছন থেকে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের হৃদয় নিংড়ানো ডাক, তুমি যেতে পারবে না। তোমার সঙ্গে আমার পরের দৃশ্যের শট। ইউনিটের সকলে থ! চলচ্চিত্র ইউনিটে ডিরেক্টরের কথাই যেখানে শেষ কথা সেখানে একি অনাকাক্সিক্ষত কথা। ডিরেক্টর যাকে বের করে দিতে চায়, হিরো তাকে ধরে রাখতে চায়। তবু কথায় বলে, যে গাভী দুধ দেয় তার পায়ের লাথিকে আদর ভাবতে ভাল লাগে। পরিত্যক্ত পিপি মিলার অভিনেতা-নায়ক জর্জ ব্যালেনটিনের কল্যাণে তারই সাথে অভিনয় করে চলচ্চিত্র ‘এ জার্মান এ্যাফিয়ার’-এ।
চলচ্চিত্রে এ্যাফেয়ারের দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়েই হয়তো পিপি মিলারের হৃদয়ে অভিসারের দোলা লাগে। নিভৃতে প্রবেশ করে জর্জ ব্যালেটিনের ঘরে। পিপি মিলারের নিষ্পাপ চাওনি, চাওনির মাঝে এত বড় উপকারের কি কারণ সে ব্যাপারে আসমুদ্র কৌতূহল এবং নায়কের নায়কোচিত উপস্থিতিতে বিহ্বল হয়ে পড়ার বিপরীতে আচরণে ও দৃষ্টিতে জর্জ ভ্যালেনটিন সংযত, নির্মোহ কিন্তু সঠিক পথ চিনিয়ে দিতে স্বাভাবিক প্রাজ্ঞ। ইনসার্ট সাবটাইটেলে জর্জ ভ্যালেনটিন পিপি মিলারকে বলে, তুমি এখনই সত্যিকারের অভিনেত্রী হবে যখন তুমি যে কারও থেকে যে কোন অবস্থায় অন্যদের থেকে আলাদা। কথা বলতে বলতে জর্জ ভ্যালেনটিন মেকআপ বক্স থেকে কাঠ পেন্সিল তুলে নিয়ে পিপি মিলারের মুখের ডান দিকে, ঠোঁটের উপরিভাগ কিন্তু নাকের নিচের ভাগে এঁকে দেয় একটি কাল স্পষ্ট। আঁকা কালো স্পটের কারণে পিপি মিলারের মুখাবয়ব তখন শিক্ষা-সংস্কৃতি-সৌন্দর্য এবং ক্ষমতার মিশেলে নান্দনিক। অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন প্রদত্ত কালো স্পষ্ট তখন পিপি মিলারের লাকি স্পট।
লাকি স্পটের কিরন ছটায় পিপি মিলারের চলার পথ যখন ফুলে ফুলে ঢাকা তখন নায়ক অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের পথের সামনে পাথরের স্তূপ। নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে নির্বাক চলচ্চিত্র সবাক হয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সাউন্ড টেস্টের জন্য কণ্ঠ দিতে ডাক পড়েছে একে একে সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীর। ডাক পড়ল নায়ক জর্জ ভ্যালেনটিনের। কিন্তু কোথায় যেন নতুনভাবে পরীক্ষায় বসতে বাধ্য হবার হীনম্মন্যতা। প্রযোজক-পরিচালক আলজিমারের আহ্বানকে উপেক্ষা করা। জর্জ ভ্যালেনটিনের মনের ভাব অনেকটা এরকম, নির্বাক অভিনয় গুনে আমি যখন হলিউড দর্শকের হৃদয়মনি তখন আবার আমাকে সবাক হতে হবে কেন? যে আমি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয় জগতের সম্রাট সেই আমাকে টিকে থাকতে হবে পাস ফেলের পরীক্ষায় পাস করে। আর দশ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী যা আমিও তা। উপরন্তু যা দেখবার সেখানে কথার কি দরকার।
দরকার কি অদরকার সেই আবেগের স্রোতে অভিনেতার গা ভাসানো চলে কিন্তু ব্যবসায়ী প্রয়োজকরা সব সময় আগে থেকে বুঝে যায় কোথায় আসল ব্যবসা। বকের দৃষ্টি থেকে মাছ পিছলে যেতে পারে কিন্তু ঝানু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যবসা কখনও পিছলায় না। সেখানে আবেগটাও ব্যবসার পণ্য। প্রয়োজক-পরিচালক আলজিমার ঘোষণা দেয়, কিনোগ্রাফ স্টুডিওর পরবর্তী সব চলচ্চিত্রই হবে সবাক। বিস্মিত অভিনেতা-নায়ক জর্জ ভ্যালেনটিন। অর্থাৎ তাকে বাদ দিয়েই পরিচালক পরবর্তী কাজগুলো চালিয়ে যাবে। তাহলে এতদিন তার একচ্ছত্র আধিপত্য মূলত ফুলানো ফাঁপানো ফানুস যার বাহ্যত চাকচিক্য আছে কিন্তু ভেতরের মূলধন শূন্য। নইলে তাকে ছাড়াই কাজ চলে কি করে?
এতটা বছর প্রয়োজকের ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে কোটি কোটি ডলার পাইয়ে দিলাম সেসব মূল্যহীন। অভিনয় করতে এসে জীবনের থেকে অভিনয়টাকে বড় করে দেখে দেহ-মন-প্রাণ সপে দিলাম যে কিনোগ্রাফ স্টুডিওতে আজ আমি অপ্রযোজনীয়। নির্বাক অভিনেতা আমি, নির্বাক অভিনয চালিয়ে নিতে চাওয়ার আমার দাবির কোন মূল্য নেই প্রযোজক-পরিচালকের কাছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে অভিনেতা কি শুধুই সার্কাসের ক্লাউন যার কাজটা মূলত পরিচালকের নির্দেশে লোক হাসানো। এসবের বাইরেও সাউন্ড টেস্টে আজ আমি যদি বিফল হয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে বাদ পড়ি তবে আমি বাঁচার জন্য দাঁড়াব কোথায়। যে কোটি কোটি দর্শক একবার হাতের নাগালে পাবার জন্য আমায় মরিয়া হয়ে খোঁজে সেই দর্শকই তো আমায় দেখে ঠাট্টা তামাশায় বলবে, ঐ দেখ প্রতিভাধর বোবা অভিনেতা, কথা বলতে পারে না। না না সত্যের মুখোমুখি আজ দাঁড়াতেই হবে। আলজিমারকে উত্তর দিতেই হবে, কেন সে এমন সিদ্ধান্তে গেল। তাকে বলতে হবে, কে বড় লোভ-লালসা নাকি মানবতা। যন্ত্র বড় নাকি মানুষ বড়। নায়ক-অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন প্রযোজক-পরিচালক আলজিমারের মুখোমুখি।
শীতল বরফ চোখ নিয়ে লক্ষ্য নির্ধারণে অবিচল হিসাবী প্রযোজক পরিচালক আলজিমার ইনসার্ট সাবটাইটেল সহযোগে বলে চলে, পৃথিবী এখন কথা বলছে, আমাদের নীরব থাকলে চলবে না। দর্শক সর্বদা চায় দু’হাতে নতুনত্বকে আঁকড়ে ধরতে। আমাদের সবার আগে দর্শক চাহিদা পূরণ করতে হবে। আর সে কারণেই আমাদের পরবর্তী সব নির্মাণে কথা থাকবে। আশা করি আমি কথা দিয়ে আমার কথা বোঝাতে পেরেছি। বুঝতে পারে সবই অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন। তবু স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে যতটুকু অহঙ্কার শিল্পী ধারণ করে তা নিয়েই অভিনেতা জর্জ ভ্যালেটিন বলে, আমি অভিনেতা। আমি জন্মেছি আমাকে দেখতে, শোনাতে না। দেখানো-শোনানোর কাজটা তুমিই চালিয়ে যাও। আমি যতদিন পারব ততদিন দেখিয়েই যাব আর সে পর্যন্ত বন্ধু বিদায়।
বিদায় বেলায় নিজের সাম্রাজ্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলা সম্রাটের বুকের ভেতর উতলে ওঠা স্রোতের তোড় যেভাবে বুক গলা হয়ে চোখের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় অথচ অক্ষমতার ছেলে মানুষী চাওনি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে আসা স্রোতের তোড়ের মুখে বাধা দিতে অনেকটা সে রকম সম্রাটের ভূমিকায় জর্জ ভ্যালেটিন চরিত্রে অভিনেতা জঁ দুজারদা’র অভিনয় দর্শক হৃদয়ের গভীরে গভীরতর ছাপ রেখে যায়।
হৃদয়ের গভীরে আরও সঙ্কোচ কাজ করে যখন অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন তার প্রিয় স্টুডিও ছেড়ে যাচ্ছে আর সেই স্টুডিওতে ঢুকছে তার ভাল লাগার অভিনেত্রী পিপি মিলার। সবদিক দিয়েই নবীনা পিপি মিলারকে তো আর বলা চলে না তার প্রিয় পরিণত অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের সাম্রাজ্য পতনের কাহিনী। তবুও মুখোমুখি দেখা হওয়ায় পিপি মিলারের সর্বাঙ্গে আনন্দের ঝলকানি। আপনি জানেন তো, কিনোগ্রাফ স্টুডিওর পরবর্তী চলচ্চিত্রের জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আর বলবেন না। এই কস্টিউমের মাপ নিচ্ছে তো পরক্ষণেই হেয়ার স্টাইলিস্টের চিরুনির তলে মাথা পেতে দাও। যেই মাত্র ড্যান্স ডিরেক্টরের প্রশিক্ষণ শেষ হচ্ছে অমনি ফ্রুট জুস নিয়ে পাচক হাজির। লাইটের আলোয় ঘামলে টিসু দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে তো পরক্ষণেই মুখে পাউডারের চড়া মেকআপ। স্কিনটা বুঝি এবার যাবে। তা সে যাক, কোটি মানুষের হৃদয়মণি হতে গেলে একটু ঝক্কিতো সামলাতেই হবে। আর কথা বলতে পারব না জর্জ, আমি গেলেই শূটিং শুরু হবে। পিপি মিলারের প্রস্থানে জর্জ ভ্যালেনটিনের দীর্ঘশ্বাস যার অর্থ একটাই, এমন উন্মাদনা একদিন আমারও ছিল।
কি অতীতে ছিল আর ছিল না সেকথা ভেবে বর্তমানে কাজ বন্ধ রেখে ঘরের ভেতর থেকে সিটকেনি লাগিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকলে তো আর বর্তমান চলে না। ফলে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনকে সিদ্ধান্ত নিতেই হয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নতুন কাজ নিয়ে বর্তমানে ঝাঁপিয়ে পড়ার। চলচ্চিত্র বানাতে লাগে লাখ লাখ ডলার। ফলে তাকে হতে হয় প্রযোজক। অন্যের মুখে চেয়ে নিজের বক্তব্য যেহেতু আর বলা চলছে না ফলে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে, নিজে নির্দেশনা দিয়ে এবং অভিনয় করে নির্মিত হলো নির্বাক চলচ্চিত্র ‘টিয়ার্স অব লাভ’। ভালবাসার অশ্রু।
চোখে অশ্রু ঝরে পড়ার আগেই জর্জ ভ্যালেনটিনের চোখে থমকে যায় সিনেমা হলের দিকে তাকিয়ে। তার নির্মিত চলচ্চিত্র টিয়ার্স অব লাভ যে হলে প্রথম প্রদর্শিত হবে তথা রিলিজ হবে সেদিনের তারিখ ২৫ অক্টোবর। ঐ একই দিন একই সময় পামোর হলটিতে প্রদর্শিত হবে কিনোগ্রাফ স্টুডিও প্রযোজিত সবাক চলচ্চিত্র ‘বিউটি স্পট’। জর্জ ভ্যালেনটিনের আবিষ্কৃৃত নায়িকা পিপি মিলার তার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। পুরুষের কল্পনায় উন্মাদনার ঝড় তুলে দেয়ার মতো আবেদনময়ী পোস্টার এবং বিশাল ক্যানভাসের বিলবোর্ডে লাকি স্পটের অধিকারিণী অভিনেত্রী পিপি মিলার। পথচারী যে কোন দিক দিয়ে তাকালে মনে হবে পিপি মিলারের চোখ দুটি তার দিকে তাকিয়ে বলছে, দরজাটা ভালভাবে লাগিয়ে দিয়ে এসো। বিলবোর্ড বিধ্বংসী আবেদনের পাশে বড় বড় দুটি শিরোনাম। একটিতে বিউটি স্পটে এবার পিপি মিলার। অপরটিতে, এবার কথা হবে।
আর কথা! নির্বাক জর্জ ভ্যালেনটিন। একদিকে খোলামেলা দৃশ্য দেখবার দর্শকের সুপ্ত বাসনা। অন্যদিকে অভিনেত্রী কথা বলে দর্শকদের জীবনে প্রথম বারের মতো বিস্ময়ে চমকে দেবে। তৃতীয়ত আজ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়েছে তার চেয়ে হাঁটু বয়সী মেয়ের সাথে আবার যে তারই আবিষ্কার। ভুক্তভোগী মাত্রই জানে, জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারার আনন্দ যতটা না উচ্ছ্বাসের তার থেকে বড় আতঙ্কের বিষয় গন্তব্য থেকে ছিটকে যাবার মুহুর্মুহু হাতছানি। উপরন্তু বানের তোড়ের মতো লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করায় হাত খালি দশা। কে জানে নাম-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তি সব কিছু ২৫ অক্টোবর ছবি রিলিজ হবার সাথে সাথে ধুলোয় মিশে যাবে কিনা। চিন্তা যে কত বড় ব্যাধি এবং তা যে কিভাবে মানুষকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে তা অভিনেতা জাঁ দুজারদাঁ’র কয়েকটি অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট। অনিশ্চিত আতঙ্কে জজ ভ্যালিনটিন ঘুমের মধ্যেও সজাগ থাকে।
সর্বদাই সজাগ থাকতে হয় সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের। ছবি রিলিজের পূর্ব দিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর রাতে হলিউড স্টারদের ভি.আই.পি রেস্টুরেন্টে যখন এক টেবিলে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন এবং অপর টেবিলে অভিনেত্রী পিপি মিলার। তখন পিপি মিলারের টেবিলে তাকে ঘিরে ধরে বিনোদন সাংবাদিকরা এবং তাদের ক্যামেরা। দু’দিন আগেও যে সাংবাদিকরা জর্জ ভ্যালেটিনকে ফুল বিবেচনা করে নিজেরা মৌমাছি হয়ে আষ্টেপিষ্ঠে ঘিরে ধরত আজ তারাই খবরের উৎস জ্ঞানে অভিনেত্রী পিপি মিলারের মাঝে রানী মৌমাছির সত্তা পেয়ে ক্যামেরার ফ্লাসের আলোক রোশনাই ছাড়িয়ে পিপি মিলারের মুখ দিয়ে দুটি কথা বলিয়ে নিতে মরিয়া। অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের বুকের ভেতর থেকে স্বগতোক্তির মতো দীর্ঘশ্বাস যার অর্থ সেলিব্রেটি জীবন কেন এত দোদুল্যমান, এই আছে এই নাই, জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই।
জোড়া জুড়ির প্রশ্ন না ম্যাডাম পিপি মিলার। আমরা শুধু জানতে চাই, আপনার অভিনীত চলচ্চিত্র বিউটি স্পট এখনও মুক্তি পায়নি। আগামী দিন মুক্তির আগেই আজ আপনি হলিউডের হৃদয়ের রানী, দর্শকের চোখের মণি। আপনি কি বলবেন, এই জায়গায় আপনি কিভাবে পৌঁছালেন। সাংবাদিক খুশি হলে সংবাদটা যে সৌরভ নিয়ে পরদিন কোটি কোটি পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করবে এবং সেই পাঠকই যে হল থেকে টিকেট কেটে ছবিটা দেখতে হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে এটুকু পাকা বুদ্ধি পিপি মিলার বেশ ভালই রাখে। তাই সে সাংবাদিকদের দিকে মোহিনী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে এবং ক্যামেরার সামনে দৈহিক ভঙ্গিমায় উষ্ণতা ছাড়িয়ে সাবটাইটেল সহযোগে বলে চলে, দেখুন আমি আসলে জানি না এমনটা কেন হলো। হতে পারে আমার কথা বলাটা তাদের কাছে ভাল লাগছে এবং তারা তা শুনছে। সত্যি কথা বলতে কি পুরনো অভিনেতা অভিনেত্রীদের এক ঘেয়েমি অভিনয়ের নির্বাক চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে দর্শক ক্লান্ত। এখন সময় এসেছে পুরনোদের বাদ দেবার, নতুনকে স্বাগত জানাবার। তারুণ্যের গভীরে ডুব দিতে হবে এটাই জীবন। পিপি মিলারের কথার উচ্ছ্বাস আর আলোর রোশনাইতে পরিবেশ যখন উৎসবমুখর ঠিক তখন জর্জ ভ্যালেনটিনের মুখে অপমানিত হবার লজ্জা। স্টুডিওতে দু’দিন পা রাখতে না রাখতেই সব বিচারের বিচারক হয়ে গেছে এই হাঁটু বয়সী মেয়ে। পুরনোদের অভিনয় এক ঘেয়েমিতে ভরা, সময় এসেছে পুরনোদের বাদ দেবার। এত বড় অপমানের কথাতো মুখ বুজে মেনে নেয়া আরও বড় অপমান। না একটা কিছু করতেই হয়। খাওয়া শেষ করে মুখ হাত মুছে জর্জ ভ্যালেনটিন এসে দাঁড়ায় মধ্য সেলিব্রেটি পিপি মিলারের সামনে। গনগনে আগুন কয়লার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ পুড়তে পুড়তে আর্তনাদকে চেপে রেখে যদি সাবলীলভাবে কথা চালিয়ে যায় ব্যাপারটা যেমন অনেকটা সেভাবে আক্রোশকে চেপে দৃঢ়তার সাথে জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, আমি পুরনো। কিন্তু তুমি আজ যে নতুন পথে হাঁটছ সে পথ আমিই তৈরি করে দিয়েছি। কথা শেষে জর্জ ভ্যালেনটিন চলে যায় কিন্তু থমকে যায় অভিনেত্রী পিপি মিলার। সেলিব্রেটির মোহ ভেঙ্গে যেন পিপি মিলারের সাময়িক আত্মজিজ্ঞাসা, দিগন্তে চোখ ভাসাতে গিয়ে তবে কি পা জোড়া আমার মাটি ছাড়া।
মাটিতে পা না থাকবারই কথা পিপি মিলারের। ২৫ অক্টোবর তারিখে পত্রিকার পাতায় পাতায় পিপি মিলারের বন্দনা। সপ্তাহজুড়ে ঐ একই প্রবাহ। বড় বড় শিরোনাম, বড় বড় উপাধি। ব্রিলিয়ান্ট। ডোন্ট মিস। দেখুন ভালবাসার নব তরঙ্গ। হৃদয় দুমড়েমুচড়ে নেয়া তরুণী কথা বলছে। অবিশ্বাস্য। টক অব দ্য কান্ট্রি : পিপি মিলার। বিউটি স্পট প্রদর্শিত হলগুলোতে যখন ধারাবাহিক হাউজফুল বোর্ড ঝুলছে তখন জর্জ ভ্যালেনটিনের নির্দেশিত-প্রযোজিত-অভিনীত দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখতে আসে অভিনেত্রী পিপি মিলার।
হলের বড় পর্দায় অভিনেত্রী পিপি মিলার দেখছে, জংগল দস্যুদের হাত থেকে নিজের জীবন বিপন্ন সত্ত্বেও ছবির নায়ক তার নায়িকাকে উদ্ধার করতে মরিয়া। দস্যুদের বল্লমের ফলার মুখে নিজে দাঁড়াচ্ছে তথাপি নায়িকাকে কোনভাবে আক্রান্ত হতে দিচ্ছে না। বল্লম আর নায়িকার মাঝে দাঁড়ানো নায়কের অভিব্যক্তি, জীবন দ্বীপ নিভলে আমার নিভবে রে দস্যুর দল। শক্রতা করবি আমার সাথে কর। নিরীহ অবহেলা নারীর ওপর আঘাত আনতে লজ্জা করে না তোদের জংলী জানোয়ার। আমি বেঁচে থাকতে ওঁর কোন ক্ষতি হতে দেব নারে জানোয়ার। বাঁচতে চাস তো জান নিয়ে পালা নাইলে দেখ আমার বল্লমের ধার কত তীক্ষè, কত নির্মম। বন দস্যুদের হাত থেকে নায়িকাকে মুক্ত করে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিতে গিয়ে নায়ক অনাকাক্সিক্ষতভাবে পড়ে যায় চোরা বালির মাঝে। দস্যু মোকাবেলা করে ক্লান্ত নায়ক শক্তির জোরের অভাবে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে শুরু করে চোরা বালির তলে। পা ডুবতে ডুবতে যখন কোমর অবধি ডুবতে বসেছে তখন নিরাপদে থাকা নায়িকা নিরাপদ স্থান ছেড়ে এগিয়ে আসতে চাইছে চোরাবালির হাত থেকে নায়ককে বাঁচাতে। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ও নায়ক বোঝে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যাওয়া মানুষকে খালি হাতে অপর মানুষ ছাড়াতে এলে যে যেভাবে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় ঠিক একই কথা এই নায়িকারও একই করুণ পরিণতি সুনিশ্চিত। নায়কের বেদনা দেখে নায়িকা যেন একই ভুল না করে সে কথা ভেবেই বুক পরিমাণ বালির তলে ডুবতে থাকা নায়ক চিৎকার করে বলে; বিদায় নরমা। তুমি ফিরে যাও। যেনে রেখ আমি কোনদিনই তোমাকে ভালবাসিনি। বিদায়! ডুবতে ডুবতে নিষ্পলক চাওনি নিয়ে নায়ক চোরা বালির তলে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। ডুবন্ত হাতের শেষ প্রান্তে শেষবারের মতো শেষ বিদায়। দস্যুদের হাত থেকে জীবন ঝুঁকি নিয়ে যে জীবন বাঁচায়, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যে সঙ্গীর ন্যূনতম বিপদের কারণ না হয় সেই নায়কের হঠাৎ বিদায় নায়িকার বুক-গলা ভাসিয়ে যে জলধারা চোখ হয়ে বের হয়, ক্রন্দনের শব্দে আকাশ বাতাসকে ভারি করে তোলে, এমন প্রেমিক নায়ক মানুষটি ছাড়া নায়িকা নরমার যে আজ আর কেউ নেই ঠিক সেখানেই নায়িকার মুখে ওভার ল্যাপে ফুটে ওঠে ছবির টাইটেল, দ্য টেয়ার্স অব লাভ। এখানেই ছবির শেষ কিন্তু অডিয়েন্সে বসা গ্লামার অভিনেত্রী পিপি মিলারের মুখের মেকআপ গলে নামছে তারই চোখ বেয়ে নামা অশ্রু জলের ধারাতে। দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখার বিস্ময় আর এই মাপের অভিনেতাদের পুরনো বলে শ্লাঘা প্রকাশের অনুতাপের অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকা পিপি মিলার বৃষ্টি বাদলার রাতে দৌড় লাগায় জর্জ ভ্যালেনটিনের বাসায় ক্ষমা প্রার্থনার আশায়।
ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যাকুল হৃদয়ে অভিনেত্রী পিপি মিলার অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনের দরজায় সম্মুখে। অপরদিকে স্টক মার্কেটের পতনের কারণে দেউলিয়া হয়ে, চলচ্চিত্র নির্মাণে ভরাডুবি খেয়ে, পতনের মুখে স্ত্রী ডরিসের কাছ থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার চূড়ান্ত নোটিস পেয়ে বিধ্বস্ত জর্জ ভ্যালেনটিন নরক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে ঘর ছেড়ে দরজার সম্মুখে। সম্মুখে অভিনেত্রী পিপি মিলারকে দেখে জর্জ ভ্যালেনটিন পুনঃনির্বাক। পিপি মিলার বলে, আমি একটু বসে কথা বলতে চাই, আমি দ্য টেয়ার্স অব লাভ দেখেছি। প্রতি উত্তরে জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, আমাকে কি এখন টিকেটের মূল্য ফেরত দিতে হবে? পিপি মিলার বলে, টিকেটের মূল্যই যদি নিতে আসব তবে নিশ্চয়ই এই বৈরী আবহাওয়াতে আসতাম না। ভালবাসার অশ্রু কি আমি তা বুঝেছি। ভালবাসা মানে এই না যে মুখ দিয়ে বলা, আমি তোমায় ভালবাসি। ভালবাসা সেখানেই প্রাণ পায় যেখানে দুটি হৃদয় যে যার জায়গা থেকে অপরকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়। পরস্পর সেবা এবং শ্রদ্ধা যখন মিলেমিশে ভালবাসাকে অর্থবহ করে তোলে তখন কোন কারণে যদি হৃদয় দুটির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে তবে ভালবাসা সেখানে কেঁদে ওঠে, ভালবাসার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। সেদিনের রাত্রে সাংবাদিকদের কাছে আমার বলা কথার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাকে ব্যথিত করে তুলবার জন্য দুঃখিত। পুরনো, পূর্বসূরীদের সক্ষমতাকে খাটো করে দেখবার জন্য দুঃখিত। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। নির্বাক জর্জ ভ্যালেনটিন কি উত্তর দেবে বুঝে পায় না। শুধু বলে, পিপি মিলার তোমার সবটাই ভুল না। নতুনকে নতুন পথের সুযোগ করে দিয়ে তাকে যে দুহাত বাড়িয়ে সাদরে আহ্বান জানাতে হবে এ ব্যাপারে তোমার মতো সঠিক যা একশতে একশ’, তবে এবার এস।
(এরপর ২০-এর পাতায়)
No comments