হলমার্ক কেলেঙ্কারি : বিল কেনাবেচায় স্থবিরতা-বৈদেশিক বাণিজ্যে রেড অ্যালার্ট by আশরাফুল ইসলাম
হলমার্ক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন বিল
কেনাবেচায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণবিষয়ক চুক্তি
সম্পাদনের (বিল কেনাবেচা)
ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের স্বার ও উপস্থাপিত তথ্যের
সত্যতা নিয়ে পারস্পারিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ প্রকট আকার ধারণ করায় এখন
কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত বিশেষ করে ব্যাংকিং উপকরণ ‘বিল’ বন্ধক
রেখে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া হয়ে পড়েছে স্থবির।
আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়ায়
এখন এক ব্যাংকের বিল অন্য ব্যাংক কিনছে না। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকসহ
সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিল কেনাবেচা বন্ধ
হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিল বা চেক বন্ধক রেখে ঋণ দেয়া বিলম্বিত হওয়ায়
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হচ্ছে।
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ঋণ
পাওয়া সহজ করতে বিলের মাধ্যমে ঋণ নেয়া একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পদ্ধতি।
ব্যাংকগুলো বৈদেশিক রফতানি ও আমদানি বিল, স্থানীয় রফতানি ও আমদানি বিল,
চেক, ব্যাংক ড্রাফট, ব্যাংক ডকুমেন্টস, রেমিট্যান্স বিল, টেলিগ্রাফিক
ট্রান্সফার, ডিমান্ড ড্রাফটসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং উপকরণ বন্ধক রেখে ঋণ দিয়ে
থাকে। এসব ব্যাংকিং উপকরণ আগাম কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে
ব্যাংকগুলো যেমন মুনাফা করে, তেমনি এসবের বিপরীতে সুদ আদায় করেও তারা
লাভবান হয়। অন্য দিকে ব্যবসায়ীরা লাভবান হয় জটিলতা ছাড়াই দ্রুত টাকা
পেয়ে। সে কারণে এসব ব্যাংকিং উপকরণ বিশেষ করে আমদানি-রফতানিকারক, ট্রেডার,
টেন্ডার কার্যক্রমে বেশ জনপ্রিয়। এসব উপকরণের বিপরীতে ইস্যুকারী ব্যাংকের
গ্যারান্টি পাওয়া যায় বলে এই প্রক্রিয়ায় দেয়া ঋণ অনেকটা নিরাপদ। ফলে
ব্যাংকগুলো এ ধরনের উপকরণ পেলে ঋণ দিতে দেরি করে না। আমদানি-রফতানি ও
ট্রেডিং কার্যক্রমের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ঋণই এই প্রক্রিয়ায় দেয়া হতো। আমদানি
ও রফতানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এসব ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
এই
ঋণে হঠাৎ করে বাধ সেজেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। তারা ওইসব ব্যাংকিং উপকরণ
বন্ধক রেখে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলেও মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে
গেলে দেখা যায় বেশির ভাগ বিলই ভুয়া। এতে এক দিকে গ্যারান্টি দাতা ব্যাংক
যেমন টাকা দিচ্ছে না, তেমনি ঋণ দাতা ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ঋণ
গ্রহীতার কাছ থেকেও গ্যারান্টি দাতা ব্যাংক টাকা আদায় করতে পারছে না। এই
প্রক্রিয়ায় হলমার্ক গ্রুপসহ কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী,
জনতা, অগ্রণী, রূপালী, ইউসিবিএল, শাহজালাল, এনসিসিসহ ২৬টি ব্যাংকের প্রায়
ছয় হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত সাবধানতা : হলমার্ক
কেলেঙ্কারির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারে
ব্যাংকগুলোকে ব্যাংকিং বিল কেনাবেচার সময় সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।
আগে ব্যাংকগুলো শুধু কাগজপত্র লেনদেন করত, এর বিপরীতে কোনো পণ্য লেনদেন
হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ছিল না। এগুলো দেখতো কাস্টমস
বিভাগ। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি
করে কাগজপত্রের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয় কাগজপত্রের সাথে
পণ্য লেনদেন হচ্ছে কি না তাও দেখার জন্য।
এই নিয়ে ব্যাপক সমস্যা
সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অপর একটি সার্কুলার জারি করে এই বিধি
কিছুটা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে পণ্য লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত
করা ছাড়াও শুধু কাগজপত্র লেনদেনের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো বিল কেনাবেচা করতে
পারবে। তবে ব্যাংকারদের এই মর্মে নিশ্চিত হতে হবে যে, কাগজপত্রের পাশাপাশি
পণ্যও লেনদেন হয়েছে।
গত সপ্তাহে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত
চার দিন হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া ব্যাংকগুলোতে গিয়ে দেখা যায়,
বেশির ভাগ ব্যাংকেই বিল কেনাবেচা ১০ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। সরকারি
ব্যাংকগুলোতে প্রভাব পড়েছে আরো বেশি। এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা
জানিয়েছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সময় যেসব কর্মকর্তা তাদের বিলে স্বার
করেছেন বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়ে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেক সৎ কর্মকর্তা শুধু বিলে স্বার করেও অভিযুক্ত
হয়েছেন। এসব কারণে এখন সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিল
কেনায় খুব সতর্কতা অবলম্বন করছেন। একটি বিলের কাগজ ও এর সত্যতা পরীা করে
কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে তাতে প্রতিদিন একজন কর্মকর্তা
আগে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০টি বিল কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারতেন। অথচ
সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়েই গড়ে প্রতিদিন আড়াইশ’ বিল জমা
পড়ে। বর্তমানে যেভাবে বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে তাতে দিনে ২০ থেকে
৩০টি বিল নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বাকি বিলগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি
হচ্ছে। এতে বিলম্বিত হচ্ছে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়াও। একই পরিস্থিতি জনতা,
অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকের। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকেও একই পরিস্থিতি
দেখা গেছে।
সরকারি ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা : হলমার্কের কেলেঙ্কারির
পর বিশেষ করে সরকারি ব্যংকগুলোর প্রতি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এক ধরনের
অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে বিল নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা
ফাঁস হয়ে পড়ায় এখন বেসরকারি ২৬টি ব্যাংক বিপাকে পড়েছে। তারা সোনালী
ব্যাংকের গ্যারান্টিতে কেনা বিলের টাকা ফেরত পাচ্ছে না। ফলে তাদের অনাদায়ী
ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর পরিপ্রেেিত বেসরকারি ব্যাংকগুলোর যেসব
কর্মকর্তা ওইসব বিল কেনার সাথে জড়িত ছিলেন তারাও বেশ চাপে পড়েছেন। এ
কারণে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ বিল কেনা অনেক বেসরকারি ব্যাংক
বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বিপাকে : ব্যাংক কোম্পানি আইন
অনুযায়ী কোনো ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হলে তিনি নতুন করে ঋণ নিতে পারবেন না।
বিল লেনদেন করাও এক ধরনের ঋণ। হলমার্ক কেলেঙ্কারির প্রভাবে অনেক ব্যবসায়ী
এখন বিপাকে পড়েছেন। কেননা অনেক প্রকৃত ব্যবসায়ী হলমার্কের সোনালী
ব্যাংকের দেয়া স্বীকৃতি বিল কিনেছিলেন। কিন্তু মেয়াদ শেষে তা হলমার্ক
পরিশোধ না করায় ওইসব ব্যবসায়ীর নাম এখন ঋণখেলাপির খাতায় উঠেছে। এ কারণে
তারা এখন এলসি খোলাসহ কোনো রকম ব্যবসায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছেন
না।
No comments