আফগানিস্তানে শান্তির সম্ভাবনা by মহীউদ্দীন আহমদ
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পরিস্থিতি
২০১২ সালের পুরো সময়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল ছিল। নতুন বছরের শুরুতে
কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা
কিছুটা হলেও বেড়েছে কিন্তু বাস্তবে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন
সম্ভব হবে কি না তা বলার সময় এখনো আসেনি।
আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা থাকলেও অতীত ইতিহাসের আলোকে দেশটির ভবিষ্যৎ
সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা দুষ্কর একটি বিষয়। আশাবাদ ব্যক্ত করার পেছনে যে
দুটো বিষয় রয়েছে তার একটি হলো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই)
আফগান বিষয়ে পলিসির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও দ্বিতীয়টি হলোÑ ২০১৪ সালের
মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে
যাওয়ার ঘোষণা। পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে তালেবানদের শান্তি
আলোচনা তথা বিদেশীয় সংলাপে বসার পথ উন্মুক্ত করা। তালেবানদের
শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরসহ শতাধিক আফগান তালেবান পাকিস্তানের কাছে বন্দী
রয়েছেন। তাদের মুক্তির প্রক্রিয়ায় ১৯ জনকে ইতোমধ্যে মুক্তি দেয়া হয়েছে
ও বাকিদেরও ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাকিস্তান। তালেবানদের
দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারদারও মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।
আফগান সরকার, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় নতুন বছরের শুরুতেই
একটি অস্ত্র বিরতি চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ
নেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে শান্তি প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
তালেবান প্রতিনিধি ও আফগান সরকারের সাথে জাপান ও প্যারিসে আলোচনা হয়েছে।
গত ডিসেম্বর মাসে ফ্রান্সে তালেবান প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক হয়েছে আফগান
হাই পিস কাউন্সিলের সদস্যদের তবে আলোচনাগুলো খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে বলে
মনে হচ্ছে না।
আফগান প্রেসিডেন্ট কাতারের তালেবান দফতরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে না শুরু থেকেই, এ ছাড়া আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পাকিস্তানের প্রচুর মতভেদ ও বিরোধ রয়েছে। তা ছাড়া সংলাপ ও শান্তিপ্রক্রিয়া এবং কারজাই সরকারের উপস্থিতির প্রশ্নেও তালেবানদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে প্রচুর মতভেদও রয়েছে। মতভেদ রয়েছে খোদ মার্কিন বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যেও, তারাও তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী তালেবানদের সাথে সংলাপে রাজি নয়। তাই বর্তমান বাস্তবতায় শান্তিপ্রক্রিয়ায় সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি, তালেবানদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া ওবামা প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তালেবানদের সাথে সংলাপের আয়োজন ও একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে কাবুল সরকার এই মুহূর্তে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আগ্রহী হলেও তা বাস্তবে রূপান্তরিত করা কঠিন ও দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার সন্দেহ নেই। নতুন বছরের শুরুতে ইসলামাবাদকে নিয়ে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান ত্যাগের আগে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদন ও আফগানিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম আফগান বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেতে একটি কার্যকর ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে সংলাপ করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। ওয়াশিংটন আলোচনায় ২০১৪ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর তিন হাজার থেকে ৯ হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মোতায়েন রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এসব সেনার ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে তবে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। বলা হচ্ছেÑ নবগঠিত আফগান বাহিনীকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা দেয়াই হবে এসব সেনাদের মূল উদ্দেশ্য। আপাত দৃষ্টিতে ওবামা কারজাইর মধ্যকার ওয়াশিংটন বৈঠক নতুন বছরের শুরুতে আফগানিস্তানে শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে বড় ধরনের অগ্রগতি বলে মনে করা হলেও এর সাফল্য নির্ভর করছে তালেবানদের সাথে কার্যকর অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদনের ওপর। সার্বিক বিবেচনায় আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সব আলোচনা এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে ঐকমত্যে পৌঁছা ও নতুন কৌশল গ্রহণের ওপর নির্ভর করছে ন্যাটো জোটের ২০১৪ সালের মধ্যে আফগান ত্যাগের পর স্থিতিশীলতা অর্জন ও সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়ানোর মতো বিষয়টি।
আফগানিস্তান সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন তাদের কাছে বিষয়টি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ কেননা সশস্ত্র ও ুদ্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর কারণে আফগানিস্তানে শান্তি অর্জনের বিষয়টি দুঃস্বপ্ন বলে অনেকেই মনে করছেন। এ দিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে ২০১৪ সালে ন্যাটো বাহিনী সরে যাওয়ার পরপরই আফগানিস্তানে সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং এমনকি গৃহযুদ্ধও লেগে যেতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এমনিতেই ক্রমে নাজুক হচ্ছে। ২০১৪ সালের পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে তা নিশ্চিত। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের আফগান নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে এটা নিশ্চিত, পরিস্থিতি যদি এ রকম থাকে তাহলে নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি ও বড় ধরনের বিপর্যয় হবে। আফগান সরকার যদি আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তবে তা হয়তো জরুরি অবস্থা জারি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে ও এই জরুরি অবস্থা হয়তো পরে দেশটির পতন ডেকে আনবে। অন্য দিকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, আফগান যুদ্ধ শিগগির শেষ হয়ে যাবে এমনটি আশা করা যায় না। তিনি বলেন, আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটবে বলে যে ধারণা করা হচ্ছে তা মোটেও ঠিক নয়। অদূর ভবিষ্যতেও আফগানিস্তানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটি আশা করা যায় না।
পাশাপাশি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সিলেক্ট কমিটি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে আফগানিস্তান হয়তো কখনো একটি টেকসই রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। কমিটির সদস্যরা বলেছেনÑ যুক্তরাজ্য সরকার আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
পাশ্চাত্যের সংবাদ ও রাজনৈতিক মহল দাবি করে আসছে ২০১৪ সালে ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান ত্যাগের পর বিরাজমান হুমকি মোকাবেলা করার ক্ষমতা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর নেই যদিও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে পর্যায়ক্রমে ন্যাটো জোটের সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি হবে ও দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি সক্ষম। ন্যাটো জোটের কমান্ডার রিচার্ড ক্রিপ ওয়ালও একই মতামত পোষণ করে বলেছেন আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী বিদেশী বাহিনীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক বিদেশী সৈন্যের উপস্থিতিতে ২০১৪ সালের পর আফগান পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন প্রতিবেশী পাকিস্তান ভারতসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, খোদ এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মহল। তিন হাজার থেকে ৯ হাজার মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে রেখে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম কি না এ প্রশ্নও এখন উঠে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ ‘স্বল্পসংখ্যক সৈন্য মোতায়েন’ রেখে অর্জন সম্ভবপর নয় তাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তার সৈন্যদের নিরাপদে আফগানিস্তান ত্যাগ নিশ্চিত করা। সেই বিবেচনায় যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তান তথা ২০১৪ সালের পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর বিকল্পও কোনো চিন্তা তার আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গতি নেই ওবামা প্রশাসনের। কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই ন্যাটো বাহিনীর অক্ষত অবস্থায় ও নিরাপদে আফগান ত্যাগের যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। অতীতের বাস্তবতায় এমনটা কখনো হয়নি, ভবিষ্যতে কী হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কেননা বিপুল জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কোনো বিদেশী শক্তি নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তারা হয়তো আফগানিস্তানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়টি এলাকার সরকারগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমান অবস্থান থেকে সরে যেতে চায় সেই লক্ষ্যেই তাদের প্রস্তুতি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জন ক্যারির দায়িত্ব গ্রহণের পর আফগান সঙ্কট সমাধানে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার ওপর শান্তিপ্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে অনেকটা। আফগান সঙ্কট সমাধানে এ অঞ্চলের সরকারগুলোর পাশাপাশি তালেবানদেরও প্রত্যাশা হবে নতুন কিছু প্রাপ্তি। জন ক্যারির নির্বাচন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে সব মহলই আশাবাদী। বিশ্লেষকদের অনেকের মতেই আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ইতি টানতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ আবারো তালেবানদের হাতে চলে গেলেও তাদের আপত্তি নেই।
আফগান প্রেসিডেন্ট কাতারের তালেবান দফতরকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে না শুরু থেকেই, এ ছাড়া আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পাকিস্তানের প্রচুর মতভেদ ও বিরোধ রয়েছে। তা ছাড়া সংলাপ ও শান্তিপ্রক্রিয়া এবং কারজাই সরকারের উপস্থিতির প্রশ্নেও তালেবানদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে প্রচুর মতভেদও রয়েছে। মতভেদ রয়েছে খোদ মার্কিন বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যেও, তারাও তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী তালেবানদের সাথে সংলাপে রাজি নয়। তাই বর্তমান বাস্তবতায় শান্তিপ্রক্রিয়ায় সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি, তালেবানদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া ওবামা প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তালেবানদের সাথে সংলাপের আয়োজন ও একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে কাবুল সরকার এই মুহূর্তে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আগ্রহী হলেও তা বাস্তবে রূপান্তরিত করা কঠিন ও দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার সন্দেহ নেই। নতুন বছরের শুরুতে ইসলামাবাদকে নিয়ে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান ত্যাগের আগে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদন ও আফগানিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম আফগান বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেতে একটি কার্যকর ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে সংলাপ করেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। ওয়াশিংটন আলোচনায় ২০১৪ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর তিন হাজার থেকে ৯ হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মোতায়েন রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এসব সেনার ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে তবে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। বলা হচ্ছেÑ নবগঠিত আফগান বাহিনীকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা দেয়াই হবে এসব সেনাদের মূল উদ্দেশ্য। আপাত দৃষ্টিতে ওবামা কারজাইর মধ্যকার ওয়াশিংটন বৈঠক নতুন বছরের শুরুতে আফগানিস্তানে শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে বড় ধরনের অগ্রগতি বলে মনে করা হলেও এর সাফল্য নির্ভর করছে তালেবানদের সাথে কার্যকর অস্ত্রবিরতি চুক্তি সম্পাদনের ওপর। সার্বিক বিবেচনায় আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সব আলোচনা এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে ঐকমত্যে পৌঁছা ও নতুন কৌশল গ্রহণের ওপর নির্ভর করছে ন্যাটো জোটের ২০১৪ সালের মধ্যে আফগান ত্যাগের পর স্থিতিশীলতা অর্জন ও সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়ানোর মতো বিষয়টি।
আফগানিস্তান সম্পর্কে যারা অবহিত আছেন তাদের কাছে বিষয়টি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ কেননা সশস্ত্র ও ুদ্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর কারণে আফগানিস্তানে শান্তি অর্জনের বিষয়টি দুঃস্বপ্ন বলে অনেকেই মনে করছেন। এ দিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে ২০১৪ সালে ন্যাটো বাহিনী সরে যাওয়ার পরপরই আফগানিস্তানে সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং এমনকি গৃহযুদ্ধও লেগে যেতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এমনিতেই ক্রমে নাজুক হচ্ছে। ২০১৪ সালের পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে তা নিশ্চিত। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের আফগান নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে এটা নিশ্চিত, পরিস্থিতি যদি এ রকম থাকে তাহলে নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি ও বড় ধরনের বিপর্যয় হবে। আফগান সরকার যদি আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তবে তা হয়তো জরুরি অবস্থা জারি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে ও এই জরুরি অবস্থা হয়তো পরে দেশটির পতন ডেকে আনবে। অন্য দিকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, আফগান যুদ্ধ শিগগির শেষ হয়ে যাবে এমনটি আশা করা যায় না। তিনি বলেন, আফগান যুদ্ধের অবসান ঘটবে বলে যে ধারণা করা হচ্ছে তা মোটেও ঠিক নয়। অদূর ভবিষ্যতেও আফগানিস্তানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটি আশা করা যায় না।
পাশাপাশি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সিলেক্ট কমিটি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে আফগানিস্তান হয়তো কখনো একটি টেকসই রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। কমিটির সদস্যরা বলেছেনÑ যুক্তরাজ্য সরকার আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
পাশ্চাত্যের সংবাদ ও রাজনৈতিক মহল দাবি করে আসছে ২০১৪ সালে ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান ত্যাগের পর বিরাজমান হুমকি মোকাবেলা করার ক্ষমতা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর নেই যদিও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে পর্যায়ক্রমে ন্যাটো জোটের সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি হবে ও দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি সক্ষম। ন্যাটো জোটের কমান্ডার রিচার্ড ক্রিপ ওয়ালও একই মতামত পোষণ করে বলেছেন আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী বিদেশী বাহিনীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক বিদেশী সৈন্যের উপস্থিতিতে ২০১৪ সালের পর আফগান পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন প্রতিবেশী পাকিস্তান ভারতসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, খোদ এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো মহল। তিন হাজার থেকে ৯ হাজার মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে রেখে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম কি না এ প্রশ্নও এখন উঠে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ ‘স্বল্পসংখ্যক সৈন্য মোতায়েন’ রেখে অর্জন সম্ভবপর নয় তাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তার সৈন্যদের নিরাপদে আফগানিস্তান ত্যাগ নিশ্চিত করা। সেই বিবেচনায় যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তান তথা ২০১৪ সালের পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর বিকল্পও কোনো চিন্তা তার আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গতি নেই ওবামা প্রশাসনের। কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই ন্যাটো বাহিনীর অক্ষত অবস্থায় ও নিরাপদে আফগান ত্যাগের যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। অতীতের বাস্তবতায় এমনটা কখনো হয়নি, ভবিষ্যতে কী হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কেননা বিপুল জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কোনো বিদেশী শক্তি নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তারা হয়তো আফগানিস্তানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়টি এলাকার সরকারগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমান অবস্থান থেকে সরে যেতে চায় সেই লক্ষ্যেই তাদের প্রস্তুতি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জন ক্যারির দায়িত্ব গ্রহণের পর আফগান সঙ্কট সমাধানে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার ওপর শান্তিপ্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে অনেকটা। আফগান সঙ্কট সমাধানে এ অঞ্চলের সরকারগুলোর পাশাপাশি তালেবানদেরও প্রত্যাশা হবে নতুন কিছু প্রাপ্তি। জন ক্যারির নির্বাচন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে সব মহলই আশাবাদী। বিশ্লেষকদের অনেকের মতেই আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ইতি টানতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ আবারো তালেবানদের হাতে চলে গেলেও তাদের আপত্তি নেই।
No comments