ভোরের নীরবতা ভেঙ্গেছে কান্নার রোলে by রমেন দাশগুপ্ত
পূর্ব চরখিজিরপুর, মালিয়ারা আর
বাথুয়া-চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার তিনটি শান্ত, সুনিবিড় গ্রাম।
বুধবার ভোরে তিনটি গ্রামের শত শত মানুষের আর্তচীৎকারে ভেঙ্গেছে
কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির নীরবতা।
ভোরের আলো ফোটার সময়ে
বাহরাইনে অগ্নিকান্ডে নিহত তিনজনের লাশ নিয়ে তিনটি গাড়ি পৌঁছে গ্রামগুলোতে।
সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল উঠে নিহতদের বাড়িতে। কান্নার শব্দ ছাপিয়ে যায়
বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গ্রামে।
শোককে
সঙ্গী করে তিন গ্রামের মানুষ বিদায় দেন মজুরি উপার্জনের দেশে গিয়ে
নির্মমভাবে প্রাণ বিসর্জন দেয়া হত্যভাগ্য তিনজনকে। সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনজনকে দাফন করা হয়।
গত ১১ জানুয়ারি বাহরাইনের রাজধানী মানামার মুখারকা এলাকায় একটি বাসভবনে আগুনে পুড়ে ১৩ জন বাংলাদেশি নিহত হন। এদের মধ্যে তিনজন চট্টগ্রামের।
নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা হলেন, পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামের হাজী রশিদ আহমদের ছেলে মাহবুবুল আলম, একই উপজেলার জিরি ইউনিয়নের মালিয়ারা গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে মো.জামাল উদ্দিন এবং বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব চরখিজিরপুর গ্রামে মৃত সগির আহমদের ছেলে নাজির আহমেদ।
মঙ্গলবার বিকেলে নিহত বাংলাদেশিদের মরদেহগুলো ঢাকায় শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর রাতে তাদের লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতেই তিনজনের লাশ নিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বুধবার ভোর ৪টার দিকে তাদের লাশগুলো নিজ নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছায়।
সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে তিনজনের জানাজা শেষে তাদের দাফন পর্ব শেষ হয়। জানাজায় আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
বাবার ছবিই লিজার স্মৃতি
সাত বছর বয়সী লিজার জন্মের আগেই বাহরাইনে চলে যান তার বাবা জামাল উদ্দিন। ১১ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুরে ফোন করে কথা বলেছিলেন মেয়ে লিজার সঙ্গে। মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন, জানুয়ারির শেষদিকে তিনি ফিরবেন। জামাল উদ্দিন ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে।
বুধবার সকালে পটিয়ার জিরি ইউনিয়নের মালিয়ারা গ্রামে জামাল উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হতভম্ব অবস্থায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন তার ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা আব্দুল আজিজ। পাশে বসেছিলেন ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা। বিলাপ ধরে কাঁদছিলেন মা মহসিনা বেগম।
কাঁদতে কাঁদতে মহসিনা বলেন, `শুক্কুরবার আঁর অঙ্গে পোয়ার কথা অইয়্যে। পোয়া কযে আম্মা তুঁই গম আছনি। আব্বারে কইও ঠান্ডা ন লাগাইবার লাই। আঁই কোইজ্যে, আঁর পেট পুরের যে তোর লাই। তুই আই যাগুই। পোয়া আইস্যে, লাশ হই আইস্যে। (শুক্রবার ছেলে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, আম্মা তুমি ভাল আছ, বাবাকে বলবে ঠান্ডা না লাগাতে। আমি বলেছিলাম, তোর জন্য আমার খারাপ লাগছে। তুই ফিরে আয়। ছেলে ফিরেছে, লাশ হয়ে ফিরেছে।)`
বাবাকে কোনদিন চোখে না দেখলেও লিজার চোখেও ছিল জল। দু`ভাই মামুন, হারুন আর বড় বোন রীণামণির কান্নার শব্দে প্রতিবেশিরাও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। আর ঘরের ভেতর থেকে জামালের স্ত্রী`র কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল, যিনি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বাপরে বাপ, অ বাপ, অ্যাঁই ক্যা ন মরি
বোয়ালখালীর পূর্ব চরখিজিরপুর গ্রামে নজির আহমদের লাশ পৌছানোর পর থেকে তার বাড়িতে শুধু মানুষ আর মানুষ। স্বজনের বিলাপ, প্রতিবেশিদের কান্নায় শোকাবহ পরিবেশ পুরো বাড়িজুড়ে। ছেলের মারা যাবার খবর শোনার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত মা ময়ূর খাতুন (৭০)। শয্যা নিয়েছেন বিছানায়।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার বাড়িতে পৌঁছার পর সাংবাদিক এসেছেন শুনে বিছানা ছেড়ে ধড়মড় করে উঠে আসেন ময়ূর খাতুন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, `বাপরে বাপ, অ বাপ অ্যাই ক্যা ন মরি, তুই ক্যা গেলিগুই ? আঁরারে এহন কনে চাইব ? (বাবারে, বাবা, আমি কেন মরিনাই, তুই কেন মরে গেলি ? আমাদের এখন কে দেখবে ?)`
বাড়ি থেকে একটু দূরে জমিতে ফুফুর কোলে বসে কাঁদছিরেন নজিরের মেয়ে পাঁচ বছর বয়সী জেসি। কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলেন, `আমি বাবার কাছে যাব, আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাও।`
বিলাপ ধরে কাঁদছিলেন নজিরের বড় বোন নূরনাহার বেগমও। সাংবাদিকরা তার ছবি তোলার জন্য গেলে তিনি কান্নার স্বরে বলেন, `ভাই, তুই কি আঁরে ফটো তোলারইবার লাই রাখি গিয়ূজ্জেনা ? আঁই ত সহ্য গরিত ন পারির। (ভাই, তুই কি আমাকে ছবি তোলার জন্য রেখে গেছিস। আমি তো আর সহ্য করতে পারছিনা।`
চরখিজিরপুর গ্রামের বাসিন্দা, সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ মো.করিম বাংলানিউজকে বলেন, `এই গ্রামের অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন দেশে আছে। কেউ কোনদিন বিদেশে এভাবে মারা গেছে বলে শুনিনি।`
গত ১১ জানুয়ারি বাহরাইনের রাজধানী মানামার মুখারকা এলাকায় একটি বাসভবনে আগুনে পুড়ে ১৩ জন বাংলাদেশি নিহত হন। এদের মধ্যে তিনজন চট্টগ্রামের।
নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা হলেন, পটিয়া উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামের হাজী রশিদ আহমদের ছেলে মাহবুবুল আলম, একই উপজেলার জিরি ইউনিয়নের মালিয়ারা গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে মো.জামাল উদ্দিন এবং বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব চরখিজিরপুর গ্রামে মৃত সগির আহমদের ছেলে নাজির আহমেদ।
মঙ্গলবার বিকেলে নিহত বাংলাদেশিদের মরদেহগুলো ঢাকায় শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর রাতে তাদের লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতেই তিনজনের লাশ নিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বুধবার ভোর ৪টার দিকে তাদের লাশগুলো নিজ নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছায়।
সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে তিনজনের জানাজা শেষে তাদের দাফন পর্ব শেষ হয়। জানাজায় আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
বাবার ছবিই লিজার স্মৃতি
সাত বছর বয়সী লিজার জন্মের আগেই বাহরাইনে চলে যান তার বাবা জামাল উদ্দিন। ১১ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুরে ফোন করে কথা বলেছিলেন মেয়ে লিজার সঙ্গে। মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন, জানুয়ারির শেষদিকে তিনি ফিরবেন। জামাল উদ্দিন ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে।
বুধবার সকালে পটিয়ার জিরি ইউনিয়নের মালিয়ারা গ্রামে জামাল উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হতভম্ব অবস্থায় বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন তার ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা আব্দুল আজিজ। পাশে বসেছিলেন ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা। বিলাপ ধরে কাঁদছিলেন মা মহসিনা বেগম।
কাঁদতে কাঁদতে মহসিনা বলেন, `শুক্কুরবার আঁর অঙ্গে পোয়ার কথা অইয়্যে। পোয়া কযে আম্মা তুঁই গম আছনি। আব্বারে কইও ঠান্ডা ন লাগাইবার লাই। আঁই কোইজ্যে, আঁর পেট পুরের যে তোর লাই। তুই আই যাগুই। পোয়া আইস্যে, লাশ হই আইস্যে। (শুক্রবার ছেলে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, আম্মা তুমি ভাল আছ, বাবাকে বলবে ঠান্ডা না লাগাতে। আমি বলেছিলাম, তোর জন্য আমার খারাপ লাগছে। তুই ফিরে আয়। ছেলে ফিরেছে, লাশ হয়ে ফিরেছে।)`
বাবাকে কোনদিন চোখে না দেখলেও লিজার চোখেও ছিল জল। দু`ভাই মামুন, হারুন আর বড় বোন রীণামণির কান্নার শব্দে প্রতিবেশিরাও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। আর ঘরের ভেতর থেকে জামালের স্ত্রী`র কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল, যিনি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বাপরে বাপ, অ বাপ, অ্যাঁই ক্যা ন মরি
বোয়ালখালীর পূর্ব চরখিজিরপুর গ্রামে নজির আহমদের লাশ পৌছানোর পর থেকে তার বাড়িতে শুধু মানুষ আর মানুষ। স্বজনের বিলাপ, প্রতিবেশিদের কান্নায় শোকাবহ পরিবেশ পুরো বাড়িজুড়ে। ছেলের মারা যাবার খবর শোনার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত মা ময়ূর খাতুন (৭০)। শয্যা নিয়েছেন বিছানায়।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার বাড়িতে পৌঁছার পর সাংবাদিক এসেছেন শুনে বিছানা ছেড়ে ধড়মড় করে উঠে আসেন ময়ূর খাতুন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, `বাপরে বাপ, অ বাপ অ্যাই ক্যা ন মরি, তুই ক্যা গেলিগুই ? আঁরারে এহন কনে চাইব ? (বাবারে, বাবা, আমি কেন মরিনাই, তুই কেন মরে গেলি ? আমাদের এখন কে দেখবে ?)`
বাড়ি থেকে একটু দূরে জমিতে ফুফুর কোলে বসে কাঁদছিরেন নজিরের মেয়ে পাঁচ বছর বয়সী জেসি। কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলেন, `আমি বাবার কাছে যাব, আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাও।`
বিলাপ ধরে কাঁদছিলেন নজিরের বড় বোন নূরনাহার বেগমও। সাংবাদিকরা তার ছবি তোলার জন্য গেলে তিনি কান্নার স্বরে বলেন, `ভাই, তুই কি আঁরে ফটো তোলারইবার লাই রাখি গিয়ূজ্জেনা ? আঁই ত সহ্য গরিত ন পারির। (ভাই, তুই কি আমাকে ছবি তোলার জন্য রেখে গেছিস। আমি তো আর সহ্য করতে পারছিনা।`
চরখিজিরপুর গ্রামের বাসিন্দা, সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ মো.করিম বাংলানিউজকে বলেন, `এই গ্রামের অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন দেশে আছে। কেউ কোনদিন বিদেশে এভাবে মারা গেছে বলে শুনিনি।`
No comments