সুশাসন-নবম জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা এবং নাগরিক অধিকার by বদিউল আলম মজুমদার
২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ফলে আমরা এখন নবম জাতীয় সংসদের চতুর্থ বর্ষপূর্তি পালন করছি। নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে, নাগরিকদের অর্থে এ সংসদ পরিচালিত হয়ে আসছে।
তাই নাগরিকদের প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে_ গত চার বছর কেমন ছিল এ সংসদের কার্যক্রম?
আমাদের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, '' 'জাতীয় সংসদ' নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন-ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত থাকিবে।"
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকাশিত 'দিনবদলের সনদ' নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে :'জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতি বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।'
দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত ২০২১ সালের জন্য প্রণীত রূপকল্পে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল :'সরকারের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। সংসদকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।'
পক্ষান্তরে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে 'জাতীয় সংসদ' শিরোনামে যেসব অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেগুলো হলো :
হ 'সংসদ হবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদকে একটি কার্যকর এবং অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিএনপি নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
হ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সমাধানকল্পে সংসদে বিরোধী দলের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার নীতি অনুসরণ করা হবে।
হ সংসদের স্থায়ী কমিটিসমূহ সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের মধ্যেই গঠন করা হবে এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যগণকেও স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে।
হ ইস্যুভিত্তিক ওয়াক-আউট ছাড়া কোনো দল বা জোট সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করতে পারবে না। কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমোদন ছাড়া ৩০ দিনের অধিক অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।
হ যিনি স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হবেন, তিনি তার দলীয় পদ থেকে সাথে সাথে ইস্তফা দেবেন এবং সেই দলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। বিরোধী দলের একজন মনোনীত সংসদ সদস্য ডেপুটি স্পিকার হবেন।
হ নির্বাচনের পর সকল সংসদ সদস্য সরকার প্রদেয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা একইভাবে ভোগ করবেন এবং নির্বাচনী এলাকার জন্য সরকারের কোনো ধরনের বরাদ্দে কোনো বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হবে না।
হ সংসদে বিরোধী দল যাতে একটি সম্মানজনক এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, সে জন্য সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।'
এটি সুস্পষ্ট যে, জাতীয় সংসদ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা অতি অপরিহার্য। এটি আমাদের জাতীয় অঙ্গীকারও বটে। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে।
মোটা দাগে চারটি কার্যক্রম আইন প্রণয়নের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমত, সংসদে আইন পাস করা, যার মধ্যে আইনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সংসদে বিতর্ক করা। এ দুটি কার্যক্রমকে সংসদের প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। তৃতীয়ত, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। চতুর্থত, সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদন করা।
সংসদ সদস্যগণ আইনসভার সদস্য। তাই আইন প্রণয়ন তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নতুন আইন পাস করা, আইন সংশোধন করা, এমনকি আইন বাতিল করাও এ দায়িত্বের অংশ। বস্তুত, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদেরই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। সংসদ অধিবেশন না থাকলে কিংবা সংসদ বিলুপ্ত হলে অবশ্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু সেই অধ্যাদেশও পরবর্তী অধিবেশনে সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের আইন প্রণয়নের কাজে মনোযোগ নেই। বস্তুত, সংসদ আজ একটি রাবার স্ট্যাম্পিং বডিতে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে তথাকথিত স্থানীয় উন্নয়ন কাজে নিজেদের লিপ্ত রাখতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন স্কিমের অধীনে বরাদ্দ প্রদান এবং ১৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে সুপারিশ করার এখতিয়ার প্রদানের মাধ্যমে সরকারও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতাকে উৎসাহিত করছে। যার ফলে একদিকে সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। আমাদের মাননীয় স্পিকারের মতে, সংসদ সদস্যদের অনাগ্রহ অব্যাহত থাকলে, আইন প্রণয়নের জন্য ভবিষ্যতে আমাদেরকে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হবে।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বর্তমান সংসদ কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারেনি। বরং এ ব্যাপারে তাদের রেকর্ড হতাশাব্যঞ্জক। সংসদে বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সংসদ সদস্য নেতানেত্রীদের বন্দনা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অশালীনভাবে সমালোচনায় ব্যয় করেন। তাই বিতর্ক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও আমাদের বর্তমান সংসদ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সংসদের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদের অধিকাংশ স্থায়ী কমিটি এক্ষেত্রে কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারছে না। অনেক সংসদীয় কমিটি নিষ্ক্রিয়। আবার কিছু কিছু কমিটি তাদের নিজেদের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজে লিপ্ত। (যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দুদককে নিয়ে টানাটানি) এ ছাড়া নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এখতিয়ার আছে এমন কমিটিতেও অনেক সদস্য গত চার বছরে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপরন্তু, অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত সরকারের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যুর প্রতি সংসদীয় কমিটিগুলোর কোনো মনোযোগ নেই। যেমন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কারসাজি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো সম্পূর্ণ নীরব। পক্ষান্তরে, তারা অত্যন্ত সরব তাদের সুপারিশগুলো মানতে মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করতে। অর্থাৎ, সংসদীয় কমিটিগুলো এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগে অতি আগ্রহী। তাই বর্তমান সংসদ সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করছে না।
সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদনের দায়িত্বও সংসদ অনেকটা রুটিনমাফিক পালন করছে। সরকারের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংসদের পক্ষ থেকে কোনো কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না। বাজেট প্রণয়ন ও বিন্যাসেও সংসদের তেমন ভূমিকা নেই। সাংবিধানিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, বৈদেশিক চুক্তি সংসদে উত্থাপনের ক্ষেত্রে সংসদ সরকারকে বাধ্য করে না। তাই এসব ক্ষেত্রেও সংসদ যথাযথ ভূমিকা রাখছে না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, আমাদের বর্তমান সংসদ তার মূল দায়িত্বগুলো পালন করছে না। ফলে নবম জাতীয় সংসদকে কার্যকর বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। বর্তমান সংসদের অকার্যকারিতার অবশ্য একটি বড় কারণ অতীতের মতো বর্তমান বিরোধী দলেরও লাগাতার সংসদ বর্জন। গত চার বছরে ৩৩৭ কার্যদিবসের ২৮২ কার্যদিবসই অনুপস্থিত থেকে বর্তমান বিরোধী দল সংসদ বর্জনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত সুস্পষ্ট অঙ্গীকার লঙ্ঘন করেই তা করা হয়েছে।
বর্তমান সংসদ শুধু অকার্যকরই নয়, গত চার বছরে এর মর্যাদাও জনগণের দৃষ্টিতে চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদের অনেক সংসদ সদস্যই নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়িত হয়ে পড়েছেন। সংসদীয় বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অকার্যকারিতা তথা সংসদের নিজের কার্যক্রম পুলিশিং-এ ব্যর্থতাই এর অন্যতম কারণ (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর ২০১২)। বিরোধী দলের চিফ হুইপের ওপর শারীরিক নির্যাতনের পরও জনৈক পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করার ফলে সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
আরেকটি কারণেও অনেকের দৃষ্টিতে সংসদ তার মর্যাদার আসন হারিয়েছে। আমাদের সাংবিধানিক স্কিম অনুযায়ী, আইন প্রণেতারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু উপজেলা পরিষদ আইন পাসের মাধ্যমে সংসদ সদস্যগণ উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নিজেদেরকে স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত করে ফেলেছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬ বিটিএল (এইচসিডি) ২০০৮] মামলায় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০০৬ সালে রায় দেন যে, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়া অসাংবিধানিক। তাই আমাদের বর্তমান আইন প্রণেতারা আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হয়েছেন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নবম সংসদের অকার্যকারিতার জন্য সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই দায়ী। কারণ উভয় পক্ষই সংসদ কার্যকর করার অঙ্গীকার করেও তা পালন করেনি। সম্পদের হিসাব প্রদান, আচরণবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি অঙ্গীকারও পালন করা হয়নি। তবে ক্ষমতাসীন থাকার কারণে এসব ব্যর্থতার দায়ভার সরকারি দলের ওপরই বেশি বর্তায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা (যেমন আচরণবিধি সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন) সরকারকেই নিতে হবে।
২৪ জানুয়ারি, ২০১৩
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুজন_ সুশাসনের জন্য নাগরিক
আমাদের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, '' 'জাতীয় সংসদ' নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন-ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত থাকিবে।"
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকাশিত 'দিনবদলের সনদ' নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে :'জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতি বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।'
দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত ২০২১ সালের জন্য প্রণীত রূপকল্পে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল :'সরকারের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। সংসদকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।'
পক্ষান্তরে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে 'জাতীয় সংসদ' শিরোনামে যেসব অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেগুলো হলো :
হ 'সংসদ হবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদকে একটি কার্যকর এবং অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিএনপি নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
হ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সমাধানকল্পে সংসদে বিরোধী দলের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার নীতি অনুসরণ করা হবে।
হ সংসদের স্থায়ী কমিটিসমূহ সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের মধ্যেই গঠন করা হবে এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্যগণকেও স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে।
হ ইস্যুভিত্তিক ওয়াক-আউট ছাড়া কোনো দল বা জোট সংসদের সেশন বা বৈঠক বর্জন করতে পারবে না। কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমোদন ছাড়া ৩০ দিনের অধিক অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।
হ যিনি স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হবেন, তিনি তার দলীয় পদ থেকে সাথে সাথে ইস্তফা দেবেন এবং সেই দলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। বিরোধী দলের একজন মনোনীত সংসদ সদস্য ডেপুটি স্পিকার হবেন।
হ নির্বাচনের পর সকল সংসদ সদস্য সরকার প্রদেয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা একইভাবে ভোগ করবেন এবং নির্বাচনী এলাকার জন্য সরকারের কোনো ধরনের বরাদ্দে কোনো বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হবে না।
হ সংসদে বিরোধী দল যাতে একটি সম্মানজনক এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, সে জন্য সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।'
এটি সুস্পষ্ট যে, জাতীয় সংসদ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা অতি অপরিহার্য। এটি আমাদের জাতীয় অঙ্গীকারও বটে। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে।
মোটা দাগে চারটি কার্যক্রম আইন প্রণয়নের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমত, সংসদে আইন পাস করা, যার মধ্যে আইনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সংসদে বিতর্ক করা। এ দুটি কার্যক্রমকে সংসদের প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। তৃতীয়ত, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। চতুর্থত, সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদন করা।
সংসদ সদস্যগণ আইনসভার সদস্য। তাই আইন প্রণয়ন তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নতুন আইন পাস করা, আইন সংশোধন করা, এমনকি আইন বাতিল করাও এ দায়িত্বের অংশ। বস্তুত, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদেরই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। সংসদ অধিবেশন না থাকলে কিংবা সংসদ বিলুপ্ত হলে অবশ্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু সেই অধ্যাদেশও পরবর্তী অধিবেশনে সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের আইন প্রণয়নের কাজে মনোযোগ নেই। বস্তুত, সংসদ আজ একটি রাবার স্ট্যাম্পিং বডিতে পরিণত হয়েছে। সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে তথাকথিত স্থানীয় উন্নয়ন কাজে নিজেদের লিপ্ত রাখতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন স্কিমের অধীনে বরাদ্দ প্রদান এবং ১৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে সুপারিশ করার এখতিয়ার প্রদানের মাধ্যমে সরকারও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতাকে উৎসাহিত করছে। যার ফলে একদিকে সংসদের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। আমাদের মাননীয় স্পিকারের মতে, সংসদ সদস্যদের অনাগ্রহ অব্যাহত থাকলে, আইন প্রণয়নের জন্য ভবিষ্যতে আমাদেরকে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হবে।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বর্তমান সংসদ কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারেনি। বরং এ ব্যাপারে তাদের রেকর্ড হতাশাব্যঞ্জক। সংসদে বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সংসদ সদস্য নেতানেত্রীদের বন্দনা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অশালীনভাবে সমালোচনায় ব্যয় করেন। তাই বিতর্ক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও আমাদের বর্তমান সংসদ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সংসদের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদের অধিকাংশ স্থায়ী কমিটি এক্ষেত্রে কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারছে না। অনেক সংসদীয় কমিটি নিষ্ক্রিয়। আবার কিছু কিছু কমিটি তাদের নিজেদের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজে লিপ্ত। (যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দুদককে নিয়ে টানাটানি) এ ছাড়া নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এখতিয়ার আছে এমন কমিটিতেও অনেক সদস্য গত চার বছরে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপরন্তু, অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত সরকারের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যুর প্রতি সংসদীয় কমিটিগুলোর কোনো মনোযোগ নেই। যেমন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কারসাজি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো সম্পূর্ণ নীরব। পক্ষান্তরে, তারা অত্যন্ত সরব তাদের সুপারিশগুলো মানতে মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করতে। অর্থাৎ, সংসদীয় কমিটিগুলো এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগে অতি আগ্রহী। তাই বর্তমান সংসদ সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করছে না।
সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদনের দায়িত্বও সংসদ অনেকটা রুটিনমাফিক পালন করছে। সরকারের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংসদের পক্ষ থেকে কোনো কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না। বাজেট প্রণয়ন ও বিন্যাসেও সংসদের তেমন ভূমিকা নেই। সাংবিধানিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, বৈদেশিক চুক্তি সংসদে উত্থাপনের ক্ষেত্রে সংসদ সরকারকে বাধ্য করে না। তাই এসব ক্ষেত্রেও সংসদ যথাযথ ভূমিকা রাখছে না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, আমাদের বর্তমান সংসদ তার মূল দায়িত্বগুলো পালন করছে না। ফলে নবম জাতীয় সংসদকে কার্যকর বলা যুক্তিযুক্ত হবে না। বর্তমান সংসদের অকার্যকারিতার অবশ্য একটি বড় কারণ অতীতের মতো বর্তমান বিরোধী দলেরও লাগাতার সংসদ বর্জন। গত চার বছরে ৩৩৭ কার্যদিবসের ২৮২ কার্যদিবসই অনুপস্থিত থেকে বর্তমান বিরোধী দল সংসদ বর্জনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত সুস্পষ্ট অঙ্গীকার লঙ্ঘন করেই তা করা হয়েছে।
বর্তমান সংসদ শুধু অকার্যকরই নয়, গত চার বছরে এর মর্যাদাও জনগণের দৃষ্টিতে চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদের অনেক সংসদ সদস্যই নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়িত হয়ে পড়েছেন। সংসদীয় বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অকার্যকারিতা তথা সংসদের নিজের কার্যক্রম পুলিশিং-এ ব্যর্থতাই এর অন্যতম কারণ (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর ২০১২)। বিরোধী দলের চিফ হুইপের ওপর শারীরিক নির্যাতনের পরও জনৈক পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করার ফলে সংসদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
আরেকটি কারণেও অনেকের দৃষ্টিতে সংসদ তার মর্যাদার আসন হারিয়েছে। আমাদের সাংবিধানিক স্কিম অনুযায়ী, আইন প্রণেতারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু উপজেলা পরিষদ আইন পাসের মাধ্যমে সংসদ সদস্যগণ উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নিজেদেরকে স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত করে ফেলেছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ [১৬ বিটিএল (এইচসিডি) ২০০৮] মামলায় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০০৬ সালে রায় দেন যে, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়া অসাংবিধানিক। তাই আমাদের বর্তমান আইন প্রণেতারা আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হয়েছেন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নবম সংসদের অকার্যকারিতার জন্য সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই দায়ী। কারণ উভয় পক্ষই সংসদ কার্যকর করার অঙ্গীকার করেও তা পালন করেনি। সম্পদের হিসাব প্রদান, আচরণবিধি প্রণয়ন ইত্যাদি অঙ্গীকারও পালন করা হয়নি। তবে ক্ষমতাসীন থাকার কারণে এসব ব্যর্থতার দায়ভার সরকারি দলের ওপরই বেশি বর্তায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা (যেমন আচরণবিধি সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন) সরকারকেই নিতে হবে।
২৪ জানুয়ারি, ২০১৩
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুজন_ সুশাসনের জন্য নাগরিক
No comments