মত ও মন্তব্য-স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনরুজ্জীবন ও জাতীয় সংকট by হারুন হাবীব
বহু দলমত বা তাদের বিপরীতমুখী কর্মতৎপরতা একটি দেশের স্বাভাবিক ও সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন। যেকোনো সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষ বহু মত ও পথের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আমাদের বাংলাদেশে আমরা একটি মুক্ত সমাজ সংস্কৃতি চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তাঁর মত ও বিশ্বাসের কথা বলতে পারবেন, আদর্শের চর্চা করতে পারবেন। সেই মত বা পথ, নীতি-আদর্শ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে- তার বিচার হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সুষ্ঠু নির্বাচনে।
সে কারণে বিশেষ দলমতের শক্ত সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও আমি তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবির প্রতি সমর্থন দেওয়ার পক্ষপাতী নই। তবে সংকট হয়, যখন গণতান্ত্রিক অধিকার ও ধর্মের নামে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা সীমা অতিক্রম করে। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে এই গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির যেভাবে পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছে, যেভাবে প্রায় সারা দেশে প্রকাশ্য নৈরাজ্য চালিয়েছে, অগি্নসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে- তাতে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে ভাবার সময় এনে দিয়েছে সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের। আমার বিশ্বাস, 'মুক্তিযুদ্ধপন্থী' উদার গণতন্ত্রীদের জন্য এ পরিস্থিতির মূল্যায়ন জরুরি।
এই নৈরাজ্য এমন এক সময়ে ঘটতে শুরু করেছে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ তার ৪২তম বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের এ নৈরাজ্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করা বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই ভাবিয়ে তুলেছে। এ যেন ৪১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের নতুন সদর্প রণহুংকার। এ যেন বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর একটি চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান সরকার তার শেষ বছরে পা দিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। সব দেশেই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনকে অবমূল্যায়ন করার দৃষ্টান্ত আছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কিত করা হয়েছে রাজনীতির স্বার্থে, আবার সংগত কারণেও।
যা হোক, ক্ষমতার শেষ বছরে পা দিয়েছে বলে সরকারের সমালোচনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। নানামুখী ষড়যন্ত্রেরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে সরকারকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও সরকারবিরোধীরা সময়কে কাজে লাগিয়ে তাকে নির্বাচনের আগেই পরাজিত করার কৌশল অবলম্বন করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে! বলতেই হবে, এ সুযোগকে পরিপূর্ণ ব্যবহার করছে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি, যারা বাংলাদেশের জন্মের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী। এরা পরিপূর্ণ শক্তিতে মাঠে নেমেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে জোটবদ্ধ হয়ে এরা আবার বড় একটি রাজনৈতিক দলেরও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে।
প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম বন্ধুদেশ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতের মাটিতে এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছিল ১৯৭১ সালে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের মাটিতে এক কোটি ছিন্নমূল মানুষ ৯টি মাস কাটিয়েছে। অকৃপণভাবে ভারত তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ইতিহাসের সত্য এই যে ভারতের সরকার, সর্বস্তরের মানুষ, রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে সমর্থন জুগিয়েছে। তারা একদিকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা জুগিয়েছে। এমনকি পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য আরো এই যে সেই যৌথ বাহিনীর কাছেই ঢাকার মাটিতে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেছে জে. নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা।
এ সব কিছুই অমোঘ ইতিহাস, এর ব্যতিক্রম ইতিহাসের নিষ্ঠুর বিকৃতি। বাংলাদেশের জন্মের এই ইতিহাস গ্রহণ করার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক দল বা মতের অনুসারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তী সম্ভবত সেই ইতিহাসের প্রতি তাঁর দেশের দায়বদ্ধতার কথা নতুন করে উচ্চারণ করেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের 'শিখা চিরন্তন' বেদির 'বিজয় মঞ্চে' স্বাধীনতার ৪২তম বিজয় দিবস উদ্যাপনে ক্ষমতাসীন দলের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি, প্রতিবেশী ভারত কখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন দেবে না। এই কূটনীতিক স্পষ্ট করেই বলেছেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, ভারত কোনো দিন তাদের সমর্থন দিতে পারে না। এটা ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই রাষ্ট্রদূত। আমরা ভারতের এই নীতিগত অবস্থানকে অভিনন্দন জানাই।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য, রাজনীতিক ও সমাজের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলেও আখ্যায়িত করেছেন সন্দীপ চক্রবর্তী। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ভারত তার সর্বমুখী সহায়তা অব্যাহত রাখবে, যাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। আমরা ভারতের এই প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাশীল হতে চাই।
৪১ বছর আগে হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের বঙ্গীয় দোসরদের প্রতিহত করতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল বিদেশি অনেক নাগরিক, রাষ্ট্র ও সংগঠন। এদের সবার কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। চার দশক পর হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঋণ স্বীকার করে ওই সব বিদেশি ব্যক্তি-সংগঠনকে সম্মাননা জানানো বর্তমান সরকারের একটি বড় কাজ বলে আমি বিবেচনা করি।
২০১১ সালে পাঁচ শরও বেশি এমন বিদেশি বন্ধু ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পর্যায়ক্রমে তাদের সম্মানিত করা হচ্ছে। গত বছরের ২৫ জুলাই সেদিনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। ইন্দিরার পুত্রবধূ ও ভারতের কংগ্রেস দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেওয়া হয় মরণোত্তর এ সম্মাননা। দ্বিতীয় পর্বে গত বছরের ২৭ মার্চ বিভিন্ন দেশের ৮২ ব্যক্তি ও সংগঠনকে 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' ও 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্বে গত ২০ অক্টোবর ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ দফায় ৯টি দেশের ৬০ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা'।
জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী একটি দল। মুক্তিযুদ্ধের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পাকিস্তানি বাহিনীর সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রত্যক্ষ সহযোগীও। আরো সত্য যে দলটি দেশের স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও তাদের পরাজয়ের ক্ষোভ বহন করে চলেছে। অন্যদিকে তারা আবার বিএনপির মতো একটি বড় দলের মুখ্য রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু সহযোগীই বা বলি কেন, নানা দৃষ্টান্তে এটিও মনে করার কারণ থাকে যে বিএনপি ক্রমান্বয়েই জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে দলটি যে তাণ্ডব চালিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে, সে তাণ্ডবের কোনো নিন্দা জানায়নি বিএনপি।
অতি সম্প্রতি বিএনপি যখন 'মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা'র নামে একটি অনুষ্ঠান করেছে, শোনা গেল, তাতে জামায়াত নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো জামায়াত নেতা বা রাজাকারকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি, হবেও না। দলের সমন্বয়কারী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াতকে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনায় দাওয়াত দেওয়া হয়নি।
ঘটনাটি একদিক থেকে ইতিবাচক। কিন্তু এতেই সন্দেহ দূর হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে জামায়াত বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র। শুধু জামায়াত কেন, প্রায় প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠন তার নিকটতম রাজনৈতিক বন্ধু। বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়তো নানা কৌশলী বিবেচনায় তাই জামায়াতকে নাও রাখা হতে পারে, তাই বলে আঁতাত ভেঙে গেছে বা যাবে- এমনটা ভাবার কারণ নেই।
বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের আদর্শগত দূরত্ব অনেক। যেকোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আদর্শগত বিভেদের পরও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় থাকে, যা আমাদের বেলায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনুপস্থিত। রাজনীতির এই বিশেষ মন্দ দিকটা সারা বিশ্বেই সমালোচিত। বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ায় খুব সহজেই বাংলাদেশের এই সংকটকে 'দুই বেগমের লড়াই' বলে উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, লড়াইটা কি শুধুই 'দুই বেগমের', নাকি অন্য কিছু?
আমার বিশ্বাস, এ ধরনের উক্তি বাংলাদেশের মূল সমস্যার একটি সরলীকৃত পর্যবেক্ষণ মাত্র। বাংলাদেশে নানা সংকট আছে; সরকার বা বিরোধী দল পরিচালনায় সংকটও আছে; আছে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, অপশাসন ও সর্বগ্রাসী অস্থিরতা। এসব সংকট, সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু মৌলিক যে সংকট, তার সমাধান অনেক বেশি সময় ও শ্রমসাধ্য বলেই আমার ধারণা। মৌলিক এ সংকটটি হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুজ্জীবন এবং তাদের পরিকল্পিত আগ্রাসন।
স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি চার দশক পর বিশ্বের অন্য কোনো দেশে পাওয়া না গেলেও আমাদের বেলায় যে তা সত্য, সেটি মানলে বাংলাদেশের সংকট অনুধাবনে সুবিচার করা হবে বলে আমার ধারণা। এ সত্যকে উপেক্ষা করা সুুবিবেচনার কাজ হবে না। বরং এই দুর্ভাগ্যজনক সত্যকে মেনে নিয়েই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
বিগত চার দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের ভিত্তি শক্তিশালী করা হয়েছে। তাদের অবস্থান বিস্তৃত করা হয়েছে, বিকশিত করা হয়েছে। এ সংকট দেশকে উত্তরোত্তর সংকটের দিকে ধাবিত করছে। এর প্রভাব রাজনীতিকে কলুষিত করছে, সমাজকে খণ্ডিত করছে, উগ্র ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে, অফিস-আদালত, গ্রামগঞ্জ, পথঘাট বিভাজিত হচ্ছে। বলতেই হবে যে, এ সংকট অবশ্যই মৌলিক, সাধারণ কোনো রাজনৈতিক সংকট নয়। এটি পরিকল্পিত ও আরোপিত। কাজেই এর সমাধান সেভাবেই নিরূপণ করতে হবে।
অনেকেই হয়তো এই সংকটকে গুরুত্ব দিতে চাইবেন না। স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা অন্যান্য দেশের মতো সমাজের সুস্থিরতা চান, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসন চান; সংকট-সংঘাত কামনা করেন না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এতটা সরলীকৃত চিন্তায় বাংলাদেশের মৌল সংকটটির সুরাহা সম্ভব হবে না। সব গণতান্ত্রিক দেশের মতোই এ দেশে বহু দলমত থাকবে, মতের ও পথের বিতর্ক হবে। এটিই প্রত্যাশিত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভোটে নতুন সরকার হবে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির এই পুনরুজ্জীবনকে ঠেকাতে না পারলে মূল জাতীয় সংকট কখনো দূর হবে না।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সব ব্যক্তি, দল-গোষ্ঠী ও প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষের সে কারণেই মৌল সংকটটির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। পুনর্গঠিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যাতে বাঙালির রক্তার্জিত স্বাধীনতার ফসলকে ব্যর্থ করে দিতে না পারে, সে লক্ষ্যে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিককে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও কলামিস্ট
সে কারণে বিশেষ দলমতের শক্ত সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও আমি তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবির প্রতি সমর্থন দেওয়ার পক্ষপাতী নই। তবে সংকট হয়, যখন গণতান্ত্রিক অধিকার ও ধর্মের নামে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা সীমা অতিক্রম করে। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে এই গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির যেভাবে পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছে, যেভাবে প্রায় সারা দেশে প্রকাশ্য নৈরাজ্য চালিয়েছে, অগি্নসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে- তাতে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে ভাবার সময় এনে দিয়েছে সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের। আমার বিশ্বাস, 'মুক্তিযুদ্ধপন্থী' উদার গণতন্ত্রীদের জন্য এ পরিস্থিতির মূল্যায়ন জরুরি।
এই নৈরাজ্য এমন এক সময়ে ঘটতে শুরু করেছে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ তার ৪২তম বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের এ নৈরাজ্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করা বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই ভাবিয়ে তুলেছে। এ যেন ৪১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের নতুন সদর্প রণহুংকার। এ যেন বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর একটি চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান সরকার তার শেষ বছরে পা দিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। সব দেশেই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনকে অবমূল্যায়ন করার দৃষ্টান্ত আছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কিত করা হয়েছে রাজনীতির স্বার্থে, আবার সংগত কারণেও।
যা হোক, ক্ষমতার শেষ বছরে পা দিয়েছে বলে সরকারের সমালোচনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। নানামুখী ষড়যন্ত্রেরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে সরকারকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও সরকারবিরোধীরা সময়কে কাজে লাগিয়ে তাকে নির্বাচনের আগেই পরাজিত করার কৌশল অবলম্বন করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে! বলতেই হবে, এ সুযোগকে পরিপূর্ণ ব্যবহার করছে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি, যারা বাংলাদেশের জন্মের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী। এরা পরিপূর্ণ শক্তিতে মাঠে নেমেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে জোটবদ্ধ হয়ে এরা আবার বড় একটি রাজনৈতিক দলেরও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে।
প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম বন্ধুদেশ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতের মাটিতে এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছিল ১৯৭১ সালে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের মাটিতে এক কোটি ছিন্নমূল মানুষ ৯টি মাস কাটিয়েছে। অকৃপণভাবে ভারত তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ইতিহাসের সত্য এই যে ভারতের সরকার, সর্বস্তরের মানুষ, রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে সমর্থন জুগিয়েছে। তারা একদিকে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা জুগিয়েছে। এমনকি পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়ে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য আরো এই যে সেই যৌথ বাহিনীর কাছেই ঢাকার মাটিতে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেছে জে. নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা।
এ সব কিছুই অমোঘ ইতিহাস, এর ব্যতিক্রম ইতিহাসের নিষ্ঠুর বিকৃতি। বাংলাদেশের জন্মের এই ইতিহাস গ্রহণ করার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক দল বা মতের অনুসারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তী সম্ভবত সেই ইতিহাসের প্রতি তাঁর দেশের দায়বদ্ধতার কথা নতুন করে উচ্চারণ করেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের 'শিখা চিরন্তন' বেদির 'বিজয় মঞ্চে' স্বাধীনতার ৪২তম বিজয় দিবস উদ্যাপনে ক্ষমতাসীন দলের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি, প্রতিবেশী ভারত কখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন দেবে না। এই কূটনীতিক স্পষ্ট করেই বলেছেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, ভারত কোনো দিন তাদের সমর্থন দিতে পারে না। এটা ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই রাষ্ট্রদূত। আমরা ভারতের এই নীতিগত অবস্থানকে অভিনন্দন জানাই।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য, রাজনীতিক ও সমাজের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলেও আখ্যায়িত করেছেন সন্দীপ চক্রবর্তী। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ভারত তার সর্বমুখী সহায়তা অব্যাহত রাখবে, যাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। আমরা ভারতের এই প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাশীল হতে চাই।
৪১ বছর আগে হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের বঙ্গীয় দোসরদের প্রতিহত করতে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল বিদেশি অনেক নাগরিক, রাষ্ট্র ও সংগঠন। এদের সবার কাছে আমাদের ঋণ অপরিসীম। চার দশক পর হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঋণ স্বীকার করে ওই সব বিদেশি ব্যক্তি-সংগঠনকে সম্মাননা জানানো বর্তমান সরকারের একটি বড় কাজ বলে আমি বিবেচনা করি।
২০১১ সালে পাঁচ শরও বেশি এমন বিদেশি বন্ধু ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পর্যায়ক্রমে তাদের সম্মানিত করা হচ্ছে। গত বছরের ২৫ জুলাই সেদিনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। ইন্দিরার পুত্রবধূ ও ভারতের কংগ্রেস দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুলে দেওয়া হয় মরণোত্তর এ সম্মাননা। দ্বিতীয় পর্বে গত বছরের ২৭ মার্চ বিভিন্ন দেশের ৮২ ব্যক্তি ও সংগঠনকে 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' ও 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' দেওয়া হয়। তৃতীয় পর্বে গত ২০ অক্টোবর ৬১ ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ দফায় ৯টি দেশের ৬০ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা'।
জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী একটি দল। মুক্তিযুদ্ধের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পাকিস্তানি বাহিনীর সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রত্যক্ষ সহযোগীও। আরো সত্য যে দলটি দেশের স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও তাদের পরাজয়ের ক্ষোভ বহন করে চলেছে। অন্যদিকে তারা আবার বিএনপির মতো একটি বড় দলের মুখ্য রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু সহযোগীই বা বলি কেন, নানা দৃষ্টান্তে এটিও মনে করার কারণ থাকে যে বিএনপি ক্রমান্বয়েই জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে দলটি যে তাণ্ডব চালিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে, সে তাণ্ডবের কোনো নিন্দা জানায়নি বিএনপি।
অতি সম্প্রতি বিএনপি যখন 'মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা'র নামে একটি অনুষ্ঠান করেছে, শোনা গেল, তাতে জামায়াত নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো জামায়াত নেতা বা রাজাকারকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি, হবেও না। দলের সমন্বয়কারী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াতকে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনায় দাওয়াত দেওয়া হয়নি।
ঘটনাটি একদিক থেকে ইতিবাচক। কিন্তু এতেই সন্দেহ দূর হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে জামায়াত বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র। শুধু জামায়াত কেন, প্রায় প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠন তার নিকটতম রাজনৈতিক বন্ধু। বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়তো নানা কৌশলী বিবেচনায় তাই জামায়াতকে নাও রাখা হতে পারে, তাই বলে আঁতাত ভেঙে গেছে বা যাবে- এমনটা ভাবার কারণ নেই।
বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের আদর্শগত দূরত্ব অনেক। যেকোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আদর্শগত বিভেদের পরও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় থাকে, যা আমাদের বেলায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনুপস্থিত। রাজনীতির এই বিশেষ মন্দ দিকটা সারা বিশ্বেই সমালোচিত। বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ায় খুব সহজেই বাংলাদেশের এই সংকটকে 'দুই বেগমের লড়াই' বলে উল্লেখ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, লড়াইটা কি শুধুই 'দুই বেগমের', নাকি অন্য কিছু?
আমার বিশ্বাস, এ ধরনের উক্তি বাংলাদেশের মূল সমস্যার একটি সরলীকৃত পর্যবেক্ষণ মাত্র। বাংলাদেশে নানা সংকট আছে; সরকার বা বিরোধী দল পরিচালনায় সংকটও আছে; আছে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, অপশাসন ও সর্বগ্রাসী অস্থিরতা। এসব সংকট, সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু মৌলিক যে সংকট, তার সমাধান অনেক বেশি সময় ও শ্রমসাধ্য বলেই আমার ধারণা। মৌলিক এ সংকটটি হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুজ্জীবন এবং তাদের পরিকল্পিত আগ্রাসন।
স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি চার দশক পর বিশ্বের অন্য কোনো দেশে পাওয়া না গেলেও আমাদের বেলায় যে তা সত্য, সেটি মানলে বাংলাদেশের সংকট অনুধাবনে সুবিচার করা হবে বলে আমার ধারণা। এ সত্যকে উপেক্ষা করা সুুবিবেচনার কাজ হবে না। বরং এই দুর্ভাগ্যজনক সত্যকে মেনে নিয়েই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
বিগত চার দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের ভিত্তি শক্তিশালী করা হয়েছে। তাদের অবস্থান বিস্তৃত করা হয়েছে, বিকশিত করা হয়েছে। এ সংকট দেশকে উত্তরোত্তর সংকটের দিকে ধাবিত করছে। এর প্রভাব রাজনীতিকে কলুষিত করছে, সমাজকে খণ্ডিত করছে, উগ্র ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে, অফিস-আদালত, গ্রামগঞ্জ, পথঘাট বিভাজিত হচ্ছে। বলতেই হবে যে, এ সংকট অবশ্যই মৌলিক, সাধারণ কোনো রাজনৈতিক সংকট নয়। এটি পরিকল্পিত ও আরোপিত। কাজেই এর সমাধান সেভাবেই নিরূপণ করতে হবে।
অনেকেই হয়তো এই সংকটকে গুরুত্ব দিতে চাইবেন না। স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা অন্যান্য দেশের মতো সমাজের সুস্থিরতা চান, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসন চান; সংকট-সংঘাত কামনা করেন না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এতটা সরলীকৃত চিন্তায় বাংলাদেশের মৌল সংকটটির সুরাহা সম্ভব হবে না। সব গণতান্ত্রিক দেশের মতোই এ দেশে বহু দলমত থাকবে, মতের ও পথের বিতর্ক হবে। এটিই প্রত্যাশিত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভোটে নতুন সরকার হবে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির এই পুনরুজ্জীবনকে ঠেকাতে না পারলে মূল জাতীয় সংকট কখনো দূর হবে না।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সব ব্যক্তি, দল-গোষ্ঠী ও প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষের সে কারণেই মৌল সংকটটির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। পুনর্গঠিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যাতে বাঙালির রক্তার্জিত স্বাধীনতার ফসলকে ব্যর্থ করে দিতে না পারে, সে লক্ষ্যে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিককে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও কলামিস্ট
No comments