সম্পাদকের কলামঃ পদ্মা সেতু ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস by ইমদাদুল হক মিলন
আড়াই-তিন বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে গিয়েছি একটা সেমিনারে। সেখানকার ওয়েস্টিন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা। আমার স্বভাব হচ্ছে পৃথিবীর যে দেশেই যাই, যে শহরেই যাই, সেখানকার বইয়ের দোকান ঘুরে দেখবই। বালি দ্বীপে গিয়েও তা-ই করেছি। প্রথম দিন সন্ধ্যাবেলাই বেরিয়েছি বইয়ের দোকানের খোঁজে। হোটেলের খুব কাছেই অভিনব ধরনের একটা শপিং এরিয়া।
বিশাল এলাকা নিয়ে প্রচুর চোখধাঁধানো দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। ট্যুরিস্টরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একপাশে একটা বইয়ের দোকান। সঙ্গে আমার দুই বন্ধু আফজাল হোসেন ও সানাউল আরেফিন। আমরা তিনজন গিয়ে বইয়ের দোকানটায় ঢুকলাম। চারদিকে পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের বই। শেলফের পর শেলফ বই আর বই। একটা কাচের বুকশেলফে অতিযত্নে দাঁড় করানো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের `বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস` বইটি। নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা `পাবলিক অ্যাফেয়ার্স` থেকে বেরিয়েছে। প্রকাশের পর থেকেই বইটি `নিউ ইয়র্ক টাইমস` পত্রিকার বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে। বালি দ্বীপে এই বই দেখে আমার যে কী উত্তেজনা! বইটি বের করে গভীর মমতায় হাত বুলাতে লাগলাম। দোকানের মধ্যবয়সী মহিলাকে গিয়ে বললাম, এই লেখক আমার দেশের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ। শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। মহিলা বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ঠিক এ রকম অনুভূতি হয়েছিল আমেরিকার `কীওয়েস্ট` শহরে গিয়ে। ওই শহরে পৃথিবী-কাঁপানো লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। আমার অতিপ্রিয় লেখক হেমিংওয়ে। তাঁর লেখার ঘরের পুরনো আলমিরাতে দেখেছিলাম, `ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সী`র বাংলা অনুবাদের একটি বই। হেমিংওয়ের বাড়িতে তাঁর প্রিয় আলমিরায় আমার ভাষার বই, আমার সেই উত্তেজনা আর বালি দ্বীপের বইয়ের দোকানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বই দেখার উত্তেজনা একরকম।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এক গৌরব বয়ে এনেছেন। নোবেল প্রাইজ। তাঁর কারণে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনেছে পৃথিবী। তাঁর উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণের ধারণা গ্রহণ করেছে বিশ্বের অনেক দেশ। পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনারারি ডক্টরেট পেয়েছেন ১৩/১৪টি। চ্যান্সেলর হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এই বাঙালিকে। তাঁর সম্মান পৃথিবীজোড়া। কত কত আন্তর্জাতিক পুরস্কার যে পেয়েছেন! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আর এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁর বন্ধু। পৃথিবীর যে দেশেই যান সে দেশেই এই কৃতী বাঙালির কদর আকাশছোঁয়া।
আমার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে দেখলাম, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কী-রকম ভক্ত তাঁর, কী-রকম শ্রদ্ধা-সম্মান তাঁর জন্য। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। শুধু তরুণ প্রজন্মের কাছে নয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছেই ড. ইউনূস এ রকম জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
মনে আছে ড. ইউনূসের নোবেল পাওয়ার খবর ফোনে আমাকে জানিয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদক এবং কলামিস্ট আতাউস সামাদ। শোনার পর আমার কী উত্তেজনা, চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেললাম। ভাইবোনদের ফোন করি, বন্ধুবান্ধবকে ফোন করি। পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মেতে উঠেছে তাঁকে নিয়ে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠেছে। বাংলাদেশের একজন মানুষ নোবেল পেয়েছে, এ আমাদের বিশাল অর্জন।
তখন বিএনপি ক্ষমতায়।
ঢাকার মেয়র সিদ্ধান্ত নিলেন ড. ইউনূসকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় নাগরিক সংবর্ধনা দেবেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আমাকে পরামর্শের জন্য ডাকলেন। আমরা দুজন প্রথমেই বললাম, একটা শর্ত আছে, দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে, বুদ্ধিজীবী এবং শ্রদ্ধেয়জনদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। অনুষ্ঠানটিকে শুধু বিএনপির অনুষ্ঠান করা যাবে না। তাহলে আমরা নেই।
মেয়র সাহেব আমাদের কথা মেনে নিলেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আর আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল মানপত্র লেখার। খুবই খেটেখুটে কাজটা আমরা করলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানে গিয়ে দুজনই হতভম্ব। বিএনপির নেতা-কর্মী এবং তাঁদের দলের বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কেউ নেই। শুনলাম, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সবাইকেই। অন্যান্য দলের কেউ আসেননি। কথাটা আমরা বিশ্বাস করলাম না। খুবই মন খারাপ করে বসে রইলাম।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা হচ্ছে এই জায়গায়, বড় মানুষদের তারা নিজেদের দলের সম্পদ মনে করে। বিএনপি সেদিন এ কাজটিই করেছিল। যেহেতু তারা ক্ষমতায়, তাদের সময় নোবেল পেয়েছেন ড. ইউনূস, যেমন করে হোক এই মানুষটিকে নিজেদের করতে হবে, এই চিন্তা।
এই মনোভাব আওয়ামী লীগেরও আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উঠেপড়ে লাগল। কেন লাগল সেই বিষয়ে নানা কথা ভাসতে লাগল হাওয়ায়। আমি সেসব কথা নিয়ে কথা বলতে চাই না। নোবেলজয়ী একজন মানুষের কথা বলি। তিনি কলম্বিয়ার লোক। নাম গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। কলম্বিয়ায় তিনি একটা দৈনিক পত্রিকা বের করতেন। একদিকে পত্রিকার সম্পাদক, অন্যদিকে অসাধারণ লেখক। `ম্যাজিক রিয়ালিজম` বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় `জাদুবাস্তবতা`, সাহিত্যের এই নবতর তত্ত্বের উদ্ভাবক। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় কলম্বিয়ান সরকারের অনাচারের কথা এতটাই নির্ভীকভাবে তুলে ধরতেন তিনি, কলম্বিয়া সরকার উঠেপড়ে লাগল তাঁর পেছনে। দেশে টিকতে না পেরে তিনি সপরিবারে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলেন। সেখানে বসে লিখলেন তাঁর এ পর্যন্ত লেখা পৃথিবীর যাবতীয় ভালো উপন্যাসের ধারণা বদলে দেওয়া উপন্যাস `ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড` বা `শতবর্ষের নির্জনতা`। পৃথিবী কেঁপে উঠল এই উপন্যাসের ধাক্কায়। নোবেল প্রাইজ পেলেন মার্কেজ। দেশের মানুষের মতো কলম্বিয়ার স্বৈরাচারী সরকারও আনন্দে উদ্বেলিত হলো। আমার দেশের লেখক নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, এ তো বিশাল অর্জন, দেশের জন্য বিশাল গৌরব! লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো মার্কেজকে। তাঁর কলম মুক্ত করে দেওয়া হলো। লিখুন, আপনি আপনার মতো করে লিখুন। কলম্বিয়া আপনার আলোয় আলোকিত হতে চায়।
ড. ইউনূসের আলোয়ও বাংলাদেশ আলোকিত হয়েছে। কিন্তু এই মানুষটিকে আমরা স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অবিরাম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হচ্ছে তাঁকে। তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মর্যাদা লুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধুলোয়। কেন এমন একজন মানুষকে দেশের কল্যাণকর কাজে না লাগিয়ে তাঁকে আমরা বিব্রত করছি, নানাভাবে অপমান-অপদস্থ করছি! এই করে পৃথিবীর বড় দেশগুলোর কাছে যে আমাদের ভাবমূর্তি বলে কিছু থাকছে না, একবারও সে কথা আমরা ভাবছি না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে আমেরিকা, হিলারি ক্লিনটন নিজে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিছুতেই যেন নষ্ট করা না হয় এই প্রতিষ্ঠান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, দেশের বিজ্ঞজনেরা বলছেন, কারো কথাই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
কেন?
এই মুহূর্তে দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে একটি বিষয়ে। পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু যদি হয়ে যেত, বাংলাদেশের চেহারা ঘুরে যেত। দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থায় যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন হতো। সরকারের নানামুখী কার্যক্রমে ঝুলে গেছে পদ্মা সেতু। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে- এ অভিযোগে সরে গেছে বিশ্বব্যাংক। এডিবি, জাইকা, আইডিবি সর্বত্র এক ধরনের অনিশ্চয়তা। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটা চুক্তিতে যাওয়ার কথা হলো। সেই প্রস্তাবও হতাশাজনক। আর নিজস্ব অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নানা রকম সমস্যা। এই যে দেশের এত বড় এক কর্মকাণ্ড, দেশটিকে বড় একটি উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া, এই ক্ষেত্রে কি ড. ইউনূসকে ব্যবহার করা যেত না? তাঁর মাধ্যমে কি চেষ্টা করে দেখা যেত না, বিশ্বব্যাংক সব ভুলে এগিয়ে আসে কি না! স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে কি না!
এ তো গেল একটা দিক, এবার অন্য একটা দিক নিয়ে দু-একটি কথা বলি। ড. ইউনূস নোবেল এনে বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ তাঁর দেশ, এ দেশের জল-হাওয়ায় তিনি বড় হয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে, ক্ষুদ্রঋণতত্ত্ব উদ্ভাবন করে তিনি নিজে সম্মানিত হয়েছেন, দেশের মানুষকেও গৌরবান্বিত করেছেন। এ দেশের মানুষও তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। তিনি কি সব ভুলে পারতেন না ব্যক্তিগতভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কোনো উদ্যোগ নিতে? তিনি কি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না? দেশের কল্যাণের কথা ভেবে এগিয়ে আসতে পারতেন না এই ক্ষেত্রটি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেই জটিলতা নিরসনের জন্য! সরকার না হয় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তাঁকে বিব্রত করছে কিন্তু তিনি সব ভুলে, কেন দেশের কথা ভেবে, দেশের উন্নতির কথা ভেবে এদিকটায় একবারও নজর দিলেন না? দেশের সাধারণ মানুষ এ রকম কথাও বলে, পদ্মা সেতু নাকি আটকে আছে ড. ইউনূসের জন্য! তিনি চাইলেই নাকি হতে পারে স্বপ্নের এই সেতু! তিনি রাগ-অভিমান করে চেষ্টা করছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক এ রকম অনুভূতি হয়েছিল আমেরিকার `কীওয়েস্ট` শহরে গিয়ে। ওই শহরে পৃথিবী-কাঁপানো লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। আমার অতিপ্রিয় লেখক হেমিংওয়ে। তাঁর লেখার ঘরের পুরনো আলমিরাতে দেখেছিলাম, `ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সী`র বাংলা অনুবাদের একটি বই। হেমিংওয়ের বাড়িতে তাঁর প্রিয় আলমিরায় আমার ভাষার বই, আমার সেই উত্তেজনা আর বালি দ্বীপের বইয়ের দোকানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বই দেখার উত্তেজনা একরকম।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এক গৌরব বয়ে এনেছেন। নোবেল প্রাইজ। তাঁর কারণে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনেছে পৃথিবী। তাঁর উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণের ধারণা গ্রহণ করেছে বিশ্বের অনেক দেশ। পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনারারি ডক্টরেট পেয়েছেন ১৩/১৪টি। চ্যান্সেলর হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এই বাঙালিকে। তাঁর সম্মান পৃথিবীজোড়া। কত কত আন্তর্জাতিক পুরস্কার যে পেয়েছেন! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আর এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁর বন্ধু। পৃথিবীর যে দেশেই যান সে দেশেই এই কৃতী বাঙালির কদর আকাশছোঁয়া।
আমার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে দেখলাম, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কী-রকম ভক্ত তাঁর, কী-রকম শ্রদ্ধা-সম্মান তাঁর জন্য। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। শুধু তরুণ প্রজন্মের কাছে নয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছেই ড. ইউনূস এ রকম জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
মনে আছে ড. ইউনূসের নোবেল পাওয়ার খবর ফোনে আমাকে জানিয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদক এবং কলামিস্ট আতাউস সামাদ। শোনার পর আমার কী উত্তেজনা, চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেললাম। ভাইবোনদের ফোন করি, বন্ধুবান্ধবকে ফোন করি। পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মেতে উঠেছে তাঁকে নিয়ে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠেছে। বাংলাদেশের একজন মানুষ নোবেল পেয়েছে, এ আমাদের বিশাল অর্জন।
তখন বিএনপি ক্ষমতায়।
ঢাকার মেয়র সিদ্ধান্ত নিলেন ড. ইউনূসকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় নাগরিক সংবর্ধনা দেবেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আমাকে পরামর্শের জন্য ডাকলেন। আমরা দুজন প্রথমেই বললাম, একটা শর্ত আছে, দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে, বুদ্ধিজীবী এবং শ্রদ্ধেয়জনদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। অনুষ্ঠানটিকে শুধু বিএনপির অনুষ্ঠান করা যাবে না। তাহলে আমরা নেই।
মেয়র সাহেব আমাদের কথা মেনে নিলেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আর আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল মানপত্র লেখার। খুবই খেটেখুটে কাজটা আমরা করলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানে গিয়ে দুজনই হতভম্ব। বিএনপির নেতা-কর্মী এবং তাঁদের দলের বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কেউ নেই। শুনলাম, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সবাইকেই। অন্যান্য দলের কেউ আসেননি। কথাটা আমরা বিশ্বাস করলাম না। খুবই মন খারাপ করে বসে রইলাম।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা হচ্ছে এই জায়গায়, বড় মানুষদের তারা নিজেদের দলের সম্পদ মনে করে। বিএনপি সেদিন এ কাজটিই করেছিল। যেহেতু তারা ক্ষমতায়, তাদের সময় নোবেল পেয়েছেন ড. ইউনূস, যেমন করে হোক এই মানুষটিকে নিজেদের করতে হবে, এই চিন্তা।
এই মনোভাব আওয়ামী লীগেরও আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উঠেপড়ে লাগল। কেন লাগল সেই বিষয়ে নানা কথা ভাসতে লাগল হাওয়ায়। আমি সেসব কথা নিয়ে কথা বলতে চাই না। নোবেলজয়ী একজন মানুষের কথা বলি। তিনি কলম্বিয়ার লোক। নাম গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। কলম্বিয়ায় তিনি একটা দৈনিক পত্রিকা বের করতেন। একদিকে পত্রিকার সম্পাদক, অন্যদিকে অসাধারণ লেখক। `ম্যাজিক রিয়ালিজম` বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় `জাদুবাস্তবতা`, সাহিত্যের এই নবতর তত্ত্বের উদ্ভাবক। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় কলম্বিয়ান সরকারের অনাচারের কথা এতটাই নির্ভীকভাবে তুলে ধরতেন তিনি, কলম্বিয়া সরকার উঠেপড়ে লাগল তাঁর পেছনে। দেশে টিকতে না পেরে তিনি সপরিবারে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলেন। সেখানে বসে লিখলেন তাঁর এ পর্যন্ত লেখা পৃথিবীর যাবতীয় ভালো উপন্যাসের ধারণা বদলে দেওয়া উপন্যাস `ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড` বা `শতবর্ষের নির্জনতা`। পৃথিবী কেঁপে উঠল এই উপন্যাসের ধাক্কায়। নোবেল প্রাইজ পেলেন মার্কেজ। দেশের মানুষের মতো কলম্বিয়ার স্বৈরাচারী সরকারও আনন্দে উদ্বেলিত হলো। আমার দেশের লেখক নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, এ তো বিশাল অর্জন, দেশের জন্য বিশাল গৌরব! লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো মার্কেজকে। তাঁর কলম মুক্ত করে দেওয়া হলো। লিখুন, আপনি আপনার মতো করে লিখুন। কলম্বিয়া আপনার আলোয় আলোকিত হতে চায়।
ড. ইউনূসের আলোয়ও বাংলাদেশ আলোকিত হয়েছে। কিন্তু এই মানুষটিকে আমরা স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে অবিরাম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হচ্ছে তাঁকে। তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মর্যাদা লুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধুলোয়। কেন এমন একজন মানুষকে দেশের কল্যাণকর কাজে না লাগিয়ে তাঁকে আমরা বিব্রত করছি, নানাভাবে অপমান-অপদস্থ করছি! এই করে পৃথিবীর বড় দেশগুলোর কাছে যে আমাদের ভাবমূর্তি বলে কিছু থাকছে না, একবারও সে কথা আমরা ভাবছি না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে আমেরিকা, হিলারি ক্লিনটন নিজে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিছুতেই যেন নষ্ট করা না হয় এই প্রতিষ্ঠান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, দেশের বিজ্ঞজনেরা বলছেন, কারো কথাই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
কেন?
এই মুহূর্তে দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে একটি বিষয়ে। পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু যদি হয়ে যেত, বাংলাদেশের চেহারা ঘুরে যেত। দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থায় যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন হতো। সরকারের নানামুখী কার্যক্রমে ঝুলে গেছে পদ্মা সেতু। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে- এ অভিযোগে সরে গেছে বিশ্বব্যাংক। এডিবি, জাইকা, আইডিবি সর্বত্র এক ধরনের অনিশ্চয়তা। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটা চুক্তিতে যাওয়ার কথা হলো। সেই প্রস্তাবও হতাশাজনক। আর নিজস্ব অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নানা রকম সমস্যা। এই যে দেশের এত বড় এক কর্মকাণ্ড, দেশটিকে বড় একটি উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া, এই ক্ষেত্রে কি ড. ইউনূসকে ব্যবহার করা যেত না? তাঁর মাধ্যমে কি চেষ্টা করে দেখা যেত না, বিশ্বব্যাংক সব ভুলে এগিয়ে আসে কি না! স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে কি না!
এ তো গেল একটা দিক, এবার অন্য একটা দিক নিয়ে দু-একটি কথা বলি। ড. ইউনূস নোবেল এনে বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ তাঁর দেশ, এ দেশের জল-হাওয়ায় তিনি বড় হয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে, ক্ষুদ্রঋণতত্ত্ব উদ্ভাবন করে তিনি নিজে সম্মানিত হয়েছেন, দেশের মানুষকেও গৌরবান্বিত করেছেন। এ দেশের মানুষও তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। তিনি কি সব ভুলে পারতেন না ব্যক্তিগতভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কোনো উদ্যোগ নিতে? তিনি কি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না? দেশের কল্যাণের কথা ভেবে এগিয়ে আসতে পারতেন না এই ক্ষেত্রটি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেই জটিলতা নিরসনের জন্য! সরকার না হয় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তাঁকে বিব্রত করছে কিন্তু তিনি সব ভুলে, কেন দেশের কথা ভেবে, দেশের উন্নতির কথা ভেবে এদিকটায় একবারও নজর দিলেন না? দেশের সাধারণ মানুষ এ রকম কথাও বলে, পদ্মা সেতু নাকি আটকে আছে ড. ইউনূসের জন্য! তিনি চাইলেই নাকি হতে পারে স্বপ্নের এই সেতু! তিনি রাগ-অভিমান করে চেষ্টা করছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক দৈনিক কালের কণ্ঠ
শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি কি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন? সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ
শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি কি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন? সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ
No comments