স্মরণ-মানিক সাহা : সাধারণ থেকে অসাধারণ

মানিক সাহা জন্মেছিলেন অজপাড়াগাঁয়ে। গ্রামটির নাম চালিতাতলা। বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া থানায় গ্রামটির অবস্থান। গ্রামটির সঙ্গে থানা সদরের যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। খুলনা জেলার তেরখাদা থানার সীমানার কাছাকাছি হওয়ায় ওই গ্রামের মানুষ তেরখাদার সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখত। মানিক সাহা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৬ সালের ১০ জুন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত সেই পরীক্ষায় তিনি এসএসসি পাস করেন।


উচ্চ মাধ্যমিক পড়েন কালিয়ারই শহীদ আবদুস সালাম কলেজে। তারপর চলে আসেন খুলনায়। পড়েন সিটি কলেজে। বিএল কলেজে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদে প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে তিনি বিএল কলেজ থেকে গ্রেপ্তার হন।
মানিক সাহা প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। নিজের চেয়ে অন্যের সমস্যার প্রতি গুরুত্ব দিতেন বেশি। এমনকি কোনো অপরিচিত লোক এসে যদি তাঁর কাছে সমস্যার কথা জানাতেন, তাহলেও তিনি নিজের ঝুঁকির কথা না ভেবে বিপদগ্রস্তের কিছু উপকার করা যায় কি না, সে জন্য সচেষ্ট হতেন। এই মানুষটিকে থামিয়ে দেওয়া হলো। সেই কালো দিনটি ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। খুলনা শহর সেদিন বেশ জমজমাট ছিল। আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর শাখার সম্মেলন। সকাল থেকেই ছোটবড় মিছিল, নানা স্লোগান। সবার লক্ষ্য খুলনার বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী শহীদ হাদিস পার্কসংলগ্ন ময়দান। স্বভাবতই সংবাদকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে আগ্রহ ছিল। বড় মেয়ে পড়ত ভারতে। সে ছুটিতে এসেছিল, তাকেই পৌঁছে দিতে ভারতযাত্রা দুই দিন পিছিয়ে দিয়ে থেকে যান, আওয়ামী লীগের সম্মেলন দেখার জন্য।
ওই দিন সকাল সকাল তিনি বের হন। সম্মেলনস্থলে গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেন। সময় গড়িয়ে যায়। প্রধান অতিথি আসেন না। ওই দিন দুপুরে তাঁর পরিবারের সদস্য এবং কাছের দু-একজন বন্ধুকে নিয়ে হোটেলে খাওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত ওই কর্মসূচির বিষয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে বেশ তাগিদ বোধ করছিলেন। প্রেসক্লাবে আসেন। সামনের কক্ষেই বসেন। সামান্য পরেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে এক আগুন্তুক। মানিক সাহা আগুন্তুককে নিয়ে বেশ শশব্যস্ত হয়ে দোতলার অতিথিকক্ষে নিয়ে যান। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ তাঁদের কথা হয়। আগুন্তুক বিদায় নিলে তিনিও বেরিয়ে পড়েন। প্রেসক্লাবের পিয়নই তাঁকে রিকশা ঠিক করে দেয়। রিকশা চলতে শুরু করে আহসান আহমেদ রোডে তাঁর বাসার দিকে। রিকশায় ওঠার পর সামান্য কটি মুহূর্ত মাত্র। খুলনা প্রেসক্লাবের গেট থেকে বেরিয়ে ডান দিকে সড়কটি ৫০ গজের মতো গিয়ে দুই ভাগ হয়েছে। এক ভাগ সোজা গেছে ছোট মির্জাপুরের দিকে (ওই সড়কটির বর্তমান নাম মানিক সাহা সড়ক); আরেকটি ভাগ গেছে ডান দিকে বেনীবাবু রোডের দিকে। ছোট মির্জাপুরের দিকের রাস্তায় তাঁকে বহনকারী রিকশাটি উঠলে কে যেন তাঁকে ডেকে থামায়।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হয়, তিনি রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। এর পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ! আশপাশসহ দূরের পিকচার প্যালেস মোড়, ডাকবাংলো, শহীদ হাদিস পার্ক প্রভৃতি এলাকায় সেই শব্দ কাঁপুনি তোলে। প্রেসক্লাবের কাছেই হওয়ায় সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরাও ছুটে বেরিয়ে আসেন। কোন দিক দিয়ে শব্দ এলো! এই ভাবনায় সাংবাদিকদের সময় পার করতে হয়নি। ডানের রাস্তায় ধোঁয়ার মতো দেখেই সেদিকে ছুটে গিয়ে সবাই হতবাক হন। একি! নিজের চোখকেই যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কী ভয়ংকর দৃশ্য! উপুড় হয়ে পড়ে আছে মানিক সাহার দেহটি। মাথাটি যেন শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। মনে হচ্ছে, কেউ যেন মাথাটি কিছু একটা দিয়ে থেঁতলে গুঁড়ো করে দিয়েছে। রাস্তাটি রক্তে ভেজা। ভয় জাগানিয়া এই দৃশ্যটি যাতে না দেখতে হয়, সে কারণে কেউ তাড়াতাড়ি একটি সাদা কাপড় জোগাড় করে দেহটি ঢেকে দেয়। চিরতরে হারিয়ে যান সাধারণ থেকে অসাধারণে পরিণত হওয়া এক মানুষ।
গৌরাঙ্গ নন্দী

No comments

Powered by Blogger.