'উন্নয়ন বিস্ময়গুলো' ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে by ড. শামসুল আলম

জাতি হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের চার দশক পূর্ণ হয়েছে এবার। চার দশকে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জনকে অভিহিত করা যায় 'ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ' হিসেবে। কেননা এসব অর্জিত হয়েছে আশপাশের দেশ এবং অনেক স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততম হারে, অথবা স্বল্পতম সময়ে।


আমরা চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ১৫২ কেজি বছরে মাথাপিছু প্রয়োজন বিবেচনায় (১৫০ মিলিয়ন জনসংখ্যা) আমাদের মোট চালের প্রয়োজন ২২ দশমিক ৮০ মিলিয়ন টন এবং বীজ, গো-খাদ্য ও অপচয় মিলে আরো ১০ শতাংশ যোগ করলে মোট চালের প্রয়োজন হয় ২৬ দশমিক ১৫ মিলিয়ন টন। এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত চালের উৎপাদন ৩৩ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন টন। এমনকি জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন হিসাবে নিলেও আমাদের সব মিলিয়ে মোট চালের প্রয়োজন ২৭ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন। এতে মোট চাল উদ্বৃত্তের পরিমাণ এখন ৫ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন টন, নতুন বছরে এটাই সবচেয়ে বড় সুসংবাদ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর এক কোটি টনের (১০ মিলিয়ন টন) কিছু ওপরে ধান উৎপাদন হতো, যা থেকে বিগত চার দশকে বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিনগুণ, যা এখন ৩৫ দশমিক চার মিলিয়ন টন। ভারত খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে ৪০ বছরে, বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে ২৫ বছরে। কৃষিক্ষেত্রের এই অগ্রগতিকে (মৎস্য উৎপাদন ও পোলট্রি শিল্পের বিকাশসহ) বলা যায়, বাংলাদেশের প্রথম 'ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ'।
দ্বিতীয় 'উন্নয়ন বিস্ময়' হচ্ছে গত চার দশকে প্রায় প্রতিটি গ্রামকে সড়ক যোগাযোগের জালের মধ্যে সংযুক্ত করতে পারা। এ ক্ষেত্রে এলজিইডির ভূমিকা প্রশংসনীয়। সড়ক ও জনপথ এত হয়েছে যে বাংলাদেশই হচ্ছে এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সড়ক ঘনত্বের দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এত বেশি সড়ক 'শহররাষ্ট্র' ব্যতীত আর কোথাও নেই। আগামী দিনগুলোতে তেমন বড় নতুন হাইওয়ে করার কিংবা জেলা বা উপজেলা সড়ক সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না। কেবল এখন প্রয়োজন হবে কোনো কোনো হাইওয়ে প্রশস্তকরণ, লিংকব্রিজ গড়ে তোলা, পিচঢালাই এবং রক্ষণাবেক্ষণ। তৃতীয় 'ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ' হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নারী-পুরুষের সংখ্যাসমতা অর্জন। উচ্চ মাধ্যমিকে বরং এখন ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। একটা ধর্মপ্রবণ স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে এ এক আশ্চর্য 'সারপ্রাইজ'ই বটে। তবে চ্যালেঞ্জটা হলো, এ ধারা ধরে রাখা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও তা অর্জন করা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রীদের হার মাত্র ৩৬ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে এ জেন্ডার-সমতার ধারা অব্যাহত রাখতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে কার্যকরভাবে বাধ্যতামূলক করা এবং নতুন সব চাকরির ক্ষেত্রেও নারীদের সমতায়ন নিশ্চিত করা। জেন্ডার-বিষয়ক উন্নয়ন বিস্ময়ের আরো দিক হলো_মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের প্রতি লাখে ৫৭৪ থেকে ২০১০ সালে নেমে এলো ১৯৪-এ। প্রতি হাজারে ১৯৯০ সালের পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ১৪৬ থেকে ২০০৯ সালে ৫০-এ নামিয়ে আনা এবং প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর হার নেমে এসেছে ওই একই সময়ে ৯২ থেকে ৩৯-এ। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশে এবং এর স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিশেষ সম্মাননা পুরস্কারও লাভ করেছে গত বছর। সম্প্রতি দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে প্রদত্ত এক ভাষণে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বলেছেন, 'মানব সম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতসহ সব দেশের চেয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।' অর্থাৎ আমাদের অর্জিত উন্নয়ন বিস্ময়গুলোর বিশ্বস্বীকৃতিও রয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির হারও উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে। স্বাধীনতা-উত্তরকালের মাথাপিছু ৯০ ডলারের আয় এখন ৭৮০ ডলার। এ প্রবৃদ্ধির হার অনেক স্বল্পোন্নত দেশকেই পেছনে ফেলেছে। কি শহর, কি গ্রাম_মানুষের জীবনাচারেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। খাদ্য-খাবার ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে দর্শনীয় পরিবর্তন ঘটেছে।
চতুর্থ 'উন্নয়ন বিস্ময়' হচ্ছে, একেবারে শূন্য থেকে তিন দশকে গার্মেন্টস রপ্তানি ১৮ বিলিয়ন ডলারে উত্তরণ, যা আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের এখন তিন-চতুর্থাংশ। এবং পঞ্চম 'উন্নয়ন বিস্ময়' হচ্ছে, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে উচ্চ প্রযুক্তির সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি করে রপ্তানি করতে পারা। উল্লিখিত 'ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ'গুলো সত্ত্বেও এর সামগ্রিক প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন উৎকর্ষে উল্লম্ফন ঘটিয়ে চার দশকেও মধ্যম আয়ের উন্নত দেশের পর্যায়ে জাতি উন্নীত হতে পারেনি। কারণ এই 'উন্নয়ন বিস্ময়গুলো' আবর্তিত হয়েছে যাত্রাপথে বেশ কিছু 'ব্ল্যাক হোল' বা কালো গহ্বর পরিবেষ্টিত হয়ে। সবচেয়ে বড় ব্ল্যাক হোলটি হলো, দেশের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় এর অত্যধিক জনসংখ্যা। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৪ জন মানুষ দু-একটি 'শহর-রাষ্ট্র' ব্যতীত বিশ্বের আর কোথাও নেই। বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জনসংখ্যা যদি যুক্তরাষ্ট্রে জড়ো করা হয়, তার পরও প্রতি বর্গকিলোমিটারে লোকসংখ্যা হবে বাংলাদেশের চেয়ে কম। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ছিল এক কোটি ৭০ লাখ (সোনার বাংলার দিনগুলি) এবং তা ২৩০ বছরে দ্বিগুণ হয়ে ১৯৩১ সালে পৌঁছে তিন কোটি ৫৬ লাখে। মাত্র ৪৩ বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ১৯৭৪ সালে লোকসংখ্যা হলো, সাত কোটি ১৫ লাখ। ৩৫ বছরেই তা আবার দ্বিগুণ হলো ২০১০ সালে। জনসংখ্যা বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন প্রতিবছর ৮২ হাজার হেক্টর চাষের জমি চলে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে। রাজধানী কিংবা জেলা, উপজেলা শহর_সর্বত্রই মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি। নতুন ঘরবাড়ি উঠানোর স্থান নেই কোথাও। যদিও মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ এখন শহরবাসী। মধ্যম আয়ের উন্নত দেশ হতে হলে জনসংখ্যার অন্তত ৫০ শতাংশ শহরবাসী হতে হবে। সে শহরায়ণের স্থান কোথায়? এখনই ঢাকা শহরের যেকোনো স্থানের প্রতিকাঠা জমি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন বাণিজ্য এলাকার জমির চেয়েও অনেক বেশি দামি। সর্বত্রই সীমাহীন ভিড় বা ক্রাউডিং। এই অত্যধিক জনসংখ্যার কারণেই দরিদ্রের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এখনো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যে চার দশকেও উন্নীত হতে পারিনি তার কারণ, অসংখ্য জনসংখ্যার কালো গহ্বর। এই জনসংখ্যার সর্বাধিক এখন আবার উৎপাদনশীল ও কার্যক্ষম বয়সের (বয়স ১৫-৬৪)। নির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ সবচেয়ে কম। ৬৫ বছর বয়সের ওপর জনসংখ্যা মাত্র ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, আর ৬০ বছর বয়সের ওপর জনসংখ্যা সাড়ে ছয় শতাংশ। ৬৫ বছর বয়সের ওপর জনসংখ্যা ২০৩৫-এ হবে ১৪ শতাংশ এবং ২০৫১ সালে তা হবে ২০ শতাংশ। এই সময়ের ব্যাপক এই কার্যক্ষম জনগোষ্ঠীকে আমরা সম্পদ ও শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের অভাবে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না, যে কারণে রয়েছে উচ্চ বেকারত্ব ও ছদ্মবেকারত্ব (প্রায় ৩৫%)।
দ্বিতীয় বড় ব্ল্যাক হোলটি হলো, ব্যাপক নিরক্ষরতা (কার্যকরভাবে প্রায় জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ)। এত নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে ফর্মাল সেক্টরে কাজ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সব উন্নয়ন চমক ম্লান হয়ে আছে এত বিশাল নিরক্ষরতার অন্ধকারে। পুরো জনগোষ্ঠীকে কার্যকরভাবে সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে আমাদের কত সম্পদ আর কত সময় প্রয়োজন হবে? ২০২১ সালের মধ্যে আমরা তা করে তুলতে পারব কি? এ বিষয়টাকে খুব গভীরভাবে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
একটি বড় ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি হয়েছিল গত শতাব্দীর মধ্যপঁচাত্তরে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয়তা চেতনার মূলে সেই রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লব চরম আঘাত হানে। জাতি পরবর্তী দেড় দশকের জন্য কালো গহ্বরে নিমজ্জিত হয় এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পদ ধ্বংস ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে উন্নয়ন স্তিমিত থাকে। নব্বইয়ের দশকে প্রক্রিয়াগতভাবে গণতন্ত্রের ধারা ফিরে এলেও পেছনের দেড় দশকের সৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের অবশেষ থেকে যায়। যে কারণে সাংঘর্ষিক রাজনীতির ধারা অব্যাহত থেকেই যায়_যদিও এ সময়টায় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুনর্জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। সাংঘর্ষিক রাজনীতির নেতিবাচকতা অব্যাহত থাকায় গণতান্ত্রিক বাতাবরণের মধ্যেও সরকার পরিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হচ্ছে না, যে কারণে শক্তিশালী দৃঢ়চিত্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। আর এ কারণেই সমাজব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতিতে অস্থিরতার কালো গহ্বর থেকেই যাচ্ছে। যার ফল উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে শক্তিশালী সরকার ও সুশাসন প্রয়োজন, তেমনটি পেতে বিলম্ব ঘটছে। সুশাসন মানে হচ্ছে, শাসন-কাঠামোর প্রতিটি স্তরে, যেমনটি আমাদের সংবিধানে উল্লিখিত জবাবদিহিতামূলক জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সুশাসনের বড় চাহিদা হলো, জনপ্রতিনিধিদের সুস্থ বিতর্ক, যে বিতর্কে নাগরিক সমাজের উত্থাপিত নানা প্রশ্নের উত্তর থাকবে। না, তেমন বিতর্কের স্থান জাতীয় সংসদ এখনো হয়ে ওঠেনি বলে অনেকেই মনে করেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক দলগুলোর ডেলিভারিতে তাই এখনো বিরাট ফারাক, যা গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা অর্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হচ্ছে সংসদ ও মিডিয়ায় গভীর বিতর্ক। এবং সেসব বিতর্ক থেকে সংখ্যাধিক্যের মতামতকে সরকারের গ্রহণ ও শাসনে প্রতিফলন ঘটানো। বিরোধী দল না এলেও, সরকারি দলের মধ্যেও খোলামেলা বিতর্কের সুযোগ দেওয়া যায়। উন্নয়নের জন্য সুশাসন এবং সুশাসন পেতে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। প্রায় একই আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ভারত যে আজকে ৯ শতাংশ কিংবা তার কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে, তারও অন্যতম কারণ জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা। আমাদের জাতীয় জীবনের কালো গহ্বরগুলো অবশ্যই বিদূরিত হতে হবে, যদি আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা চাই। দুর্নীতিও একটি কালো গহ্বর, তা বাগে আসছে না বলা হয়ে থাকে কাঙ্ক্ষিত সুশাসনের অভাবেই। জনসংখ্যা কেবল ব্যবস্থাপনা নয়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও ব্যাপক কার্যক্রম গৃহীত হতে হবে। তখনই আমাদের খণ্ড খণ্ড 'ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ'গুলো সার্বিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে একটি সমৃদ্ধ সমাজের জন্ম দেবে এবং এর মধ্য দিয়েই ফিরে পেতে পারি বহু কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্নলোকের সোনার বাংলা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক (বর্তমানে প্রেষণে)

No comments

Powered by Blogger.