কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে মেতে আছে দেশের মানুষ। খুবই স্বাভাবিক। বিশ্বকাপের আয়োজক হতে পারা কম কথা তো নয়। তারপর আবার বিশ্বকাপের খেলায় রয়েছে নিজেদের দল এবং দলটি দুর্বল নয়। বাঘা বাঘা দলকে হারানোর ক্ষমতা ও সাহস আছে তাদের।
তাই আবেগের আতিশয্যে যদি সবাই ভাসেই, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! বাংলাদেশ দলকে মোটামুটি সম্মানজনক অবস্থানে দেখার স্বপ্ন অযৌক্তিকও নয়। তাই ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় চলছে বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ-তর্ক। বাংলাদেশ দলের জার্সি-টুপি-স্কার্ফ বিক্রি হচ্ছে দেদার। সেই সঙ্গে লাল-সবুজ রঙের জাতীয় পতাকাও। গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন বিশ্বকাপ নিয়ে থাকছে বিশেষ আয়োজন। বাংলাদেশের বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখতে যে যার মতো যথাসাধ্য করে যাচ্ছে। অফিশিয়াল আয়োজকদের মুখাপেক্ষী হচ্ছে না কেউ। আমাদের মতো দেশে এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বকাপ কিংবা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনকারী বেশ কিছু দেশে গিয়ে দেখেছি এবং শুনেছি, এ রকমটাই হয়। কেবল রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও চীনে গিয়ে জেনেছি অফিশিয়াল আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণের কথা। ভালো যে আমাদের সেই রকম নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়নি।
গাঁটের পয়সা খরচ করে বিশ্বকাপ নিয়ে বইমেলায় এসেছে একাধিক গ্রন্থ। বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে কণ্ঠশিল্পীদের নতুন গান। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছোট-বড় কনসার্ট। এ রকমই একটা হৈচৈ ফেলে দেওয়া কনসার্ট হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। অনেক টাকা ব্যয়ের কনসার্ট। নাচ-গান-লেজার শো-আতশবাজিতে ভরপুর। দেশের সুপারস্টাররা ছাড়া কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের হার্টথ্রব তারকারাও। কে না জানে, মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে বেঁধে ফেলেছে। কিছুদিন আগে মুম্বাইয়ের শাহরুখ খানকে নিয়ে ঢাকায় কী হৈচৈ না হয়ে গেল। এবার এসেছিলেন সালমান-অক্ষয়-ক্যাটরিনা-অনুষ্কা-প্রীতমরা। স্বাভাবিকভাবে এবারও খুব হৈচৈ হয়েছে। টিকিটের দাম ছিল আকাশছোঁয়া! তবুও মাঠভর্তি মানুষ। আয়োজকরা খুশি। তবে অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত দুর্বল ব্যবস্থাপনার। দুর্বল ব্যবস্থাপনার অনুষ্ঠানে কে কি করেছে, সেই আলোচনায় না-ই বা গেলাম। আমি অনুষ্ঠান থেকে ঘরে ফিরেছি মুম্বাইয়ের হার্টথ্রব তারকা অক্ষয় কুমারের একটি কথা মনে নিয়ে। অক্ষয় বলেছেন, এটাই তার বাংলাদেশে প্রথম আসা নয়। ২৭ বছর আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, থেকেছেন এবং মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলে চাকরিও করেছেন। তিনি বলেছেন, ২৭ বছরে ঢাকা অকল্পনীয়ভাবে পাল্টে গেছে, যাকে তিনি উন্নতি হিসেবে দেখছেন। অক্ষয়ের এ কথা ভাবতে গিয়ে ২৭ বছর আগের ঢাকার চেহারাটা বারবার মনে পড়ছিল। এখন থেকে ২৭ বছর পেছানো মানে তিরাশি-চুরাশি সাল। রাস্তায় এত গাড়ি ছিল না। অক্ষয় যে উঁচু উঁচু আধুনিক বাড়িঘর দেখে অবকাঠামোর উন্নতির কথা বলেছেন (আদৌ তা উন্নতি কি না সে ব্যাপারে কথা আছে), সেসব কংক্রিটের জঞ্জাল ছিল না। রাস্তায় যানজট ছিল না। মতিঝিল থেকে ধানমণ্ডি রিকশা চড়েই যাওয়া যেত। মোবাইল ফোন ছিল না। বেসরকারি চ্যানেলের টক শোতে যে কারো জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ ছিল না। চ্যানেল মালিকদের টেলিভিশন সম্পর্কে খুব একটা ধারণাও ছিল না। পকেটে ৫০০ টাকা থাকা মানেই তখন অনেক টাকা। মধ্যবিত্তের হাতে অত টাকা-পয়সা ছিল না এবং তাদের ভাবনায়ও ছিল না যে তাঁরা গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারেন। আজকের অনেক ধনকুবের তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে, বাড়ি থেকে পাঠানো সীমিত টাকায় মাস কাটান। গার্মেন্ট, ঠিকাদারি, তদবির-বাণিজ্য করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পথ সাধারণের জন্য তখনো খুব একটা খোলেনি। প্রগতিশীলদের কাছে এনজিও ছিল সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের জাল এবং সমাজ বিনষ্টের মারাত্মক ষড়যন্ত্র। এ রকম অনেক কিছুই ২৭ বছর আগে অন্য রকম ছিল। সেই সময়ের রাজনীতির অবস্থাও নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার কথা নয়। জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। দেশবাসী, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ এরশাদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে। তিরাশির মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ বিশাল মিছিলে এরশাদের পুলিশ বাহিনী যে সহিংস আক্রমণ চালায় তার স্মৃতি আজও অমলিন। দোয়েল চত্বর এবং শিশু একাডেমীর সামনে পুলিশ বাহিনীর নির্মমতায় হতাহত হলো বিদ্রোহী ছাত্ররা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে তখন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল এক সঙ্গেই আন্দোলন করেছে, যা আর কখনোই এ শহরে দেখা যাবে না। তা ছাড়া ছাত্র আন্দোলনের সেই চরিত্র কি আজ আর দেখা যায়! দেখা যাবে কখনো! মনে হয় না। ছাত্র রাজনীতির চরিত্র এবং চেহারা এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। সেদিনের গৌরবগাথা আজ শুধু স্মৃতির অ্যালবামে। তাই অক্ষয় কুমারের কথার সূত্র ধরে যখন ২৭ বছরের দূরত্বে অতীতে তাকাই তখন পার্থক্যটা অনেক বেশি মনে হয়। তবে যা হারিয়ে যায় তা আগলে রেখে জাবর কাটার অর্থ নেই জানি। কিন্তু তখনকার ছাত্র রাজনীতির আদর্শিক চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে, এ কথা মনে হলেই কষ্ট বাড়ে।
পুনঃ শেষ হয়েও শেষ হলো না। কালের যাত্রার এ লেখা শেষ করার আগেই আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জিতল। জয়ের আনন্দে রাতভর জেগে থাকল ঢাকাসহ দেশের সব অঞ্চলের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ। শুক্রবার খেলা শেষ হওয়ার পর রাজপথ এবং মেঠোপথে জনস্রোতের যে ঢল নেমেছিল, সারা রাত তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে দেশের ১৫ কোটি মানুষের স্বপ্ন এখন আকাশ স্পর্শ করেছে। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ দলকে আরো ভালো খেলতে হবে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা থেকে এ শিক্ষাটাই নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামনের ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী। কেউ কিন্তু সহজে ছাড় দেবে না।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
গাঁটের পয়সা খরচ করে বিশ্বকাপ নিয়ে বইমেলায় এসেছে একাধিক গ্রন্থ। বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে কণ্ঠশিল্পীদের নতুন গান। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছোট-বড় কনসার্ট। এ রকমই একটা হৈচৈ ফেলে দেওয়া কনসার্ট হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। অনেক টাকা ব্যয়ের কনসার্ট। নাচ-গান-লেজার শো-আতশবাজিতে ভরপুর। দেশের সুপারস্টাররা ছাড়া কনসার্টে যোগ দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের হার্টথ্রব তারকারাও। কে না জানে, মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে বেঁধে ফেলেছে। কিছুদিন আগে মুম্বাইয়ের শাহরুখ খানকে নিয়ে ঢাকায় কী হৈচৈ না হয়ে গেল। এবার এসেছিলেন সালমান-অক্ষয়-ক্যাটরিনা-অনুষ্কা-প্রীতমরা। স্বাভাবিকভাবে এবারও খুব হৈচৈ হয়েছে। টিকিটের দাম ছিল আকাশছোঁয়া! তবুও মাঠভর্তি মানুষ। আয়োজকরা খুশি। তবে অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত দুর্বল ব্যবস্থাপনার। দুর্বল ব্যবস্থাপনার অনুষ্ঠানে কে কি করেছে, সেই আলোচনায় না-ই বা গেলাম। আমি অনুষ্ঠান থেকে ঘরে ফিরেছি মুম্বাইয়ের হার্টথ্রব তারকা অক্ষয় কুমারের একটি কথা মনে নিয়ে। অক্ষয় বলেছেন, এটাই তার বাংলাদেশে প্রথম আসা নয়। ২৭ বছর আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, থেকেছেন এবং মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলে চাকরিও করেছেন। তিনি বলেছেন, ২৭ বছরে ঢাকা অকল্পনীয়ভাবে পাল্টে গেছে, যাকে তিনি উন্নতি হিসেবে দেখছেন। অক্ষয়ের এ কথা ভাবতে গিয়ে ২৭ বছর আগের ঢাকার চেহারাটা বারবার মনে পড়ছিল। এখন থেকে ২৭ বছর পেছানো মানে তিরাশি-চুরাশি সাল। রাস্তায় এত গাড়ি ছিল না। অক্ষয় যে উঁচু উঁচু আধুনিক বাড়িঘর দেখে অবকাঠামোর উন্নতির কথা বলেছেন (আদৌ তা উন্নতি কি না সে ব্যাপারে কথা আছে), সেসব কংক্রিটের জঞ্জাল ছিল না। রাস্তায় যানজট ছিল না। মতিঝিল থেকে ধানমণ্ডি রিকশা চড়েই যাওয়া যেত। মোবাইল ফোন ছিল না। বেসরকারি চ্যানেলের টক শোতে যে কারো জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ ছিল না। চ্যানেল মালিকদের টেলিভিশন সম্পর্কে খুব একটা ধারণাও ছিল না। পকেটে ৫০০ টাকা থাকা মানেই তখন অনেক টাকা। মধ্যবিত্তের হাতে অত টাকা-পয়সা ছিল না এবং তাদের ভাবনায়ও ছিল না যে তাঁরা গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারেন। আজকের অনেক ধনকুবের তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে, বাড়ি থেকে পাঠানো সীমিত টাকায় মাস কাটান। গার্মেন্ট, ঠিকাদারি, তদবির-বাণিজ্য করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পথ সাধারণের জন্য তখনো খুব একটা খোলেনি। প্রগতিশীলদের কাছে এনজিও ছিল সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের জাল এবং সমাজ বিনষ্টের মারাত্মক ষড়যন্ত্র। এ রকম অনেক কিছুই ২৭ বছর আগে অন্য রকম ছিল। সেই সময়ের রাজনীতির অবস্থাও নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার কথা নয়। জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। দেশবাসী, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ এরশাদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে। তিরাশির মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ বিশাল মিছিলে এরশাদের পুলিশ বাহিনী যে সহিংস আক্রমণ চালায় তার স্মৃতি আজও অমলিন। দোয়েল চত্বর এবং শিশু একাডেমীর সামনে পুলিশ বাহিনীর নির্মমতায় হতাহত হলো বিদ্রোহী ছাত্ররা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে তখন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল এক সঙ্গেই আন্দোলন করেছে, যা আর কখনোই এ শহরে দেখা যাবে না। তা ছাড়া ছাত্র আন্দোলনের সেই চরিত্র কি আজ আর দেখা যায়! দেখা যাবে কখনো! মনে হয় না। ছাত্র রাজনীতির চরিত্র এবং চেহারা এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। সেদিনের গৌরবগাথা আজ শুধু স্মৃতির অ্যালবামে। তাই অক্ষয় কুমারের কথার সূত্র ধরে যখন ২৭ বছরের দূরত্বে অতীতে তাকাই তখন পার্থক্যটা অনেক বেশি মনে হয়। তবে যা হারিয়ে যায় তা আগলে রেখে জাবর কাটার অর্থ নেই জানি। কিন্তু তখনকার ছাত্র রাজনীতির আদর্শিক চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে, এ কথা মনে হলেই কষ্ট বাড়ে।
পুনঃ শেষ হয়েও শেষ হলো না। কালের যাত্রার এ লেখা শেষ করার আগেই আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জিতল। জয়ের আনন্দে রাতভর জেগে থাকল ঢাকাসহ দেশের সব অঞ্চলের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ। শুক্রবার খেলা শেষ হওয়ার পর রাজপথ এবং মেঠোপথে জনস্রোতের যে ঢল নেমেছিল, সারা রাত তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে দেশের ১৫ কোটি মানুষের স্বপ্ন এখন আকাশ স্পর্শ করেছে। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ দলকে আরো ভালো খেলতে হবে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা থেকে এ শিক্ষাটাই নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামনের ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী। কেউ কিন্তু সহজে ছাড় দেবে না।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments