যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কিছু কথা by ড. এম আফজাল হোসেন
বড়দিন উদ্যাপনের পরের দিনটি অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর বুধবারকে আমি একটি বিশেষ মোড়কে বিশেষায়িত করতে চাই। এই দিনের কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়েই আমার এ পর্যালোচনার সূত্রপাত ঘটাতে চাই। একটি সুখবরের মধ্য দিয়েই আলোচিত 'বুধবারে' আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।
সুখবরটি হচ্ছে, বুধবারই পলাতক আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ শেষ হয়েছে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রেখে যেকোনো দিন রায় দেবেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। এখন অপেক্ষা মামলার রায়। প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন, 'আযাদের বিরুদ্ধে মোট আটটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে বিষয়ে আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছি এবং এর অপরাধ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি।' এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের দুটি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এটি একটি বিশাল সুসংবাদ। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের মামলার কার্যক্রমও শেষ হয় ট্রাইব্যুনাল-১-এ। আদালত যেকোনো দিন ওই মামলারও রায় দিতে পারেন।
আলোচিত 'বুধবার' ছিল বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজধানীতে একাধারে পাঁচটি পথসভা। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া একসঙ্গে এতগুলো সভার নজির আমার জানামতে বিরল। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাড্ডার ভাটারায় পথসভার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ১৮ দলের দিনব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি। গাবতলীতে পথসভায় খালেদা জিয়ার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এ কর্মসূচি। পরে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ ও বাড্ডার ভাটারায় পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি। পত্রপত্রিকার খবর হচ্ছে, মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হলেও সব কয়টি পথসভায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে এবং ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দিতে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ছিলেন সক্রিয়। সকাল ১১টা ২০ মিনিট থেকে ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের সুবিচার ও স্বচ্ছ বিচারের দাবি জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের এভাবে রক্ষার ও পুরস্কৃত করার প্রয়াস চালিয়েও কেমন করে আবার তাঁরাই বলেন, 'প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করব আমরাই।'
আলোচিত বুধবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে 'বিভ্রান্তিকর প্রচারের' জবাব দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তথ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়, সেগুলো নিয়ে কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী জানান, তখন বিচারের জন্য ৭৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ওইসব ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন ও ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে যে কথা বিরোধীরা বলেন, তা খণ্ডন করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ৩৭ হাজারের মধ্যে যে ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালগুলোতে তাদের বিচার চলছিল। শুধু রাজনৈতিক কারণে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, শুধু এমন ২৩ হাজার মানুষকে সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তথ্যমন্ত্রীর দেওয়া আরো বিশেষ একটি তথ্য এই যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করা হয়। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস অর্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ ব্যাহত হয়। তিনি আরো বলেন, 'জিয়া বিচারের কাজ সরাসরি বন্ধ করে দেন। আইনটি বাতিল করে দেন। যে ১০ থেকে ১২ হাজার বন্দি যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে ছিল, তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।' ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার বিচারকাজ শুরু করা হয়। ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচারকাজ শুরু করেন।
আলোচিত বুধবারের যে খবরটি আমাকে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হচ্ছে, বিশেষ ভিসার 'অপব্যবহার' করে তুরস্কের বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামিদের পক্ষে দূতিয়ালির সংবাদ। বিষয়টিতে সরকারও উদ্বিগ্ন। আর উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ বিষয়ে সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুধবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মুস্তাফা কামাল তুর্কি রাষ্ট্রদূতের কাছে বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থান তুলে ধরেন। এ সময় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি ওই দিনই আঙ্কারা থেকে তাঁদের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানানোর নির্দেশনা পান। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত এটাও বোঝাতে চেয়েছেন, প্রতিনিধিদলটি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে কোনো রকমের দূতিয়ালি করতে আসেনি। বরং বিষয়টি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে বাংলাদেশ সফর করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে, প্রতিনিধিদলটি যেভাবে বাংলাদেশে এসেছে এবং এ সফরের সময় যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে সরকার উদ্বিগ্ন। কারণ 'অন অ্যারাইভাল ভিসা'র অপব্যবহার করে তুরস্কের প্রতিনিধিদলটি সঠিক কাজ করেনি। তা ছাড়া কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি কিংবা সমস্যা তৈরি করা কোনো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের কাজ নয় বলে বাংলাদেশ মনে করে।
এ ধরনের খবরে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। এমনিতেই রাজাকার ও তাদের দোসরদের উদ্যত ফণা চারদিকে। ইন্টারনেট হ্যাকিংয়ে যারা জড়িত, তাদের কালো থাবার বিস্তার আরো অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত- এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। হরতাল, অবরোধ, আগুন, ভাঙচুর, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন- এসব কোনো ইস্যু নয়। দেশে বিরাজমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির মূল ইস্যু দুটি। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা এবং দ্বিতীয়ত হচ্ছে ক্ষমতা দখল।
বলা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই অবস্থায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার খুব সহজ কাজ নয়। সত্য হচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, বিচারকাজ চলতে থাকে। সে সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি আটঘাট বেঁধে বিচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে, দেশে ও বিদেশে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
বিএনপি দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান না নিলেও নানা প্রশ্ন তুলে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই যেন সচেষ্ট, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভায়ও আটককৃতদের মুক্তির দাবি করা হচ্ছে। বিএনপি তথা ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আন্দোলনে অথচ যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গই প্রধান বক্তব্য হয়ে উঠছে। যখন জামায়াত এই বিচারের বিরুদ্ধে নেমে পুলিশকে হামলা, হরতাল ও অবরোধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, পোড়াপুড়িতে উন্মত্ত তখন তারা বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারাও চাচ্ছে, তবে সেই বিচারটি হতে হবে স্বচ্ছ। তবে একবারও অস্বচ্ছতার কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেনি কিংবা করেনি। বিএনপি এখানে মুখে এক কথা বলছে, বাস্তবে যে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের কর্মকাণ্ড থেকে অনেকটা বোঝা যায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে দেশের মানুষ কতটা সোচ্চার তা এবার বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, বোঝা গেছে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি; বরং তা নতুনভাবে প্রাণশক্তি পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
mafzal07@yahoo.com
আলোচিত 'বুধবার' ছিল বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজধানীতে একাধারে পাঁচটি পথসভা। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া একসঙ্গে এতগুলো সভার নজির আমার জানামতে বিরল। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাড্ডার ভাটারায় পথসভার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ১৮ দলের দিনব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি। গাবতলীতে পথসভায় খালেদা জিয়ার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এ কর্মসূচি। পরে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ ও বাড্ডার ভাটারায় পথসভায় বক্তব্য দেন তিনি। পত্রপত্রিকার খবর হচ্ছে, মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হলেও সব কয়টি পথসভায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে এবং ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দিতে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ছিলেন সক্রিয়। সকাল ১১টা ২০ মিনিট থেকে ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের সুবিচার ও স্বচ্ছ বিচারের দাবি জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের এভাবে রক্ষার ও পুরস্কৃত করার প্রয়াস চালিয়েও কেমন করে আবার তাঁরাই বলেন, 'প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করব আমরাই।'
আলোচিত বুধবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে 'বিভ্রান্তিকর প্রচারের' জবাব দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তথ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়, সেগুলো নিয়ে কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী জানান, তখন বিচারের জন্য ৭৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ওইসব ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন ও ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে যে কথা বিরোধীরা বলেন, তা খণ্ডন করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ৩৭ হাজারের মধ্যে যে ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালগুলোতে তাদের বিচার চলছিল। শুধু রাজনৈতিক কারণে যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, শুধু এমন ২৩ হাজার মানুষকে সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তথ্যমন্ত্রীর দেওয়া আরো বিশেষ একটি তথ্য এই যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করা হয়। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস অর্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ ব্যাহত হয়। তিনি আরো বলেন, 'জিয়া বিচারের কাজ সরাসরি বন্ধ করে দেন। আইনটি বাতিল করে দেন। যে ১০ থেকে ১২ হাজার বন্দি যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে ছিল, তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।' ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার বিচারকাজ শুরু করা হয়। ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচারকাজ শুরু করেন।
আলোচিত বুধবারের যে খবরটি আমাকে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হচ্ছে, বিশেষ ভিসার 'অপব্যবহার' করে তুরস্কের বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামিদের পক্ষে দূতিয়ালির সংবাদ। বিষয়টিতে সরকারও উদ্বিগ্ন। আর উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ বিষয়ে সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুধবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মুস্তাফা কামাল তুর্কি রাষ্ট্রদূতের কাছে বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থান তুলে ধরেন। এ সময় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি ওই দিনই আঙ্কারা থেকে তাঁদের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানানোর নির্দেশনা পান। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত এটাও বোঝাতে চেয়েছেন, প্রতিনিধিদলটি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে কোনো রকমের দূতিয়ালি করতে আসেনি। বরং বিষয়টি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে বাংলাদেশ সফর করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে, প্রতিনিধিদলটি যেভাবে বাংলাদেশে এসেছে এবং এ সফরের সময় যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাতে সরকার উদ্বিগ্ন। কারণ 'অন অ্যারাইভাল ভিসা'র অপব্যবহার করে তুরস্কের প্রতিনিধিদলটি সঠিক কাজ করেনি। তা ছাড়া কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি কিংবা সমস্যা তৈরি করা কোনো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের কাজ নয় বলে বাংলাদেশ মনে করে।
এ ধরনের খবরে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। এমনিতেই রাজাকার ও তাদের দোসরদের উদ্যত ফণা চারদিকে। ইন্টারনেট হ্যাকিংয়ে যারা জড়িত, তাদের কালো থাবার বিস্তার আরো অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত- এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। হরতাল, অবরোধ, আগুন, ভাঙচুর, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন- এসব কোনো ইস্যু নয়। দেশে বিরাজমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির মূল ইস্যু দুটি। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা এবং দ্বিতীয়ত হচ্ছে ক্ষমতা দখল।
বলা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই অবস্থায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার খুব সহজ কাজ নয়। সত্য হচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, বিচারকাজ চলতে থাকে। সে সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি আটঘাট বেঁধে বিচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে, দেশে ও বিদেশে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
বিএনপি দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান না নিলেও নানা প্রশ্ন তুলে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই যেন সচেষ্ট, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভায়ও আটককৃতদের মুক্তির দাবি করা হচ্ছে। বিএনপি তথা ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আন্দোলনে অথচ যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গই প্রধান বক্তব্য হয়ে উঠছে। যখন জামায়াত এই বিচারের বিরুদ্ধে নেমে পুলিশকে হামলা, হরতাল ও অবরোধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, পোড়াপুড়িতে উন্মত্ত তখন তারা বলছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারাও চাচ্ছে, তবে সেই বিচারটি হতে হবে স্বচ্ছ। তবে একবারও অস্বচ্ছতার কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেনি কিংবা করেনি। বিএনপি এখানে মুখে এক কথা বলছে, বাস্তবে যে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের কর্মকাণ্ড থেকে অনেকটা বোঝা যায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে দেশের মানুষ কতটা সোচ্চার তা এবার বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, বোঝা গেছে। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি; বরং তা নতুনভাবে প্রাণশক্তি পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
mafzal07@yahoo.com
No comments