ভিন্নমত-শেয়ারবাজার- ঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পরে যেন বিরানভূমি by আবু আহমেদ
এমনটিই হবে আমিও ভেবেছিলাম। কারণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে যে ঝড় বইয়ে দেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে, তারই ফল হলো আজকের বিনিয়োগকারীশূন্য শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজারে প্রথমে ঘটে কেলেঙ্কারি। তারপর ধস। তারপর অনেক দিন ধরে ভল্লুকজ্বরে-আক্রান্ত বাজার।
সে বাজার হবে হতাশার। সে বাজার হবে নিষ্ক্রিয়। শেয়ারবাজার শুধু নিজে ধসিত হয় না, অন্য বাজারগুলোকেও টেনে নিচে নামায়। এ বিষয়টি আমাদের অর্থনীতিতে এতটা পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় না, কারণ অর্থনীতির আকারের তুলনায় আমাদের শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণটা এখনো সীমিত। যদি অন্য অনেক শেয়ারবাজারের মতো আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ের ৮০ শতাংশ লোক বা তাদের অর্থ কোনো না কোনোভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থাকত, আর শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি এবং ধস নামত, তাহলে কেমন হতো! তবু বাজারের তুলনায় ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বরং বেশিই বলা চলে। অতি আশার এবং সেই সঙ্গে অতি তেজি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিকে শুধু দাওয়াত দিতে থাকে। কেলেঙ্কারি করার ক্ষমতা আর ইচ্ছা যাদের আছে, তখন তারা ছক কষতে থাকে ঠিক যেমনটি করেছে তারা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে নিয়ে ২০১০ সালে। হাজার হাজার কোটি টাকার শেয়ার বেচল ওই কুশীলবরা, তা-ও অতি উঁচু প্রিমিয়ামে। শেয়ার বেচাকেনার শাখা গিয়ে উপস্থিত হলো একেবারে উপজেলা পর্যন্তই। ১৫ লাখ বিনিয়োগকারী নতুন করে মাত্র এক বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করল। বাহ! সেই সুযোগ আর হারায় কে! শুরু হলো উঁচু প্রিমিয়ামে IPO ছাড়া, উঁচু প্রিমিয়ামে Right Issue করা, অতি উচ্চ মূল্যে পরিচালকদের শেয়ার বেচা। হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার জন্য একটা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা দরকার ছিল। সেটা অনুষ্ঠিত হলো তখনকার রেগুলেটর SEC-এর সহায়তায়। বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত বিরল, যে রেগুলেটরকে সৃষ্টি করা হয়েছে বিনিয়োগকারীদের সাধারণ স্বার্থ দেখার জন্য, সেই রেগুলেটর যা শেষ পর্যন্ত সভাপতিত্ব করল লুণ্ঠনযজ্ঞের!
আজকে শেয়ারবাজারকে ঘিরে হৈচৈ নেই। কোনো প্রতিবাদ সভা হয় না। কেউ আর অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ চায় না। আজকে যেন সবই ঠিকঠাক চলছে। তবে সেই ঠিকঠাক হলো শ্মশানের নীরবতার মতো চুপচাপের আবহ; কিন্তু ভেতরে ভয় আর যাতনা আঘাত করে যাচ্ছে। যারা পুঁজি হারিয়ে ঘরে ফিরে গেছে, তাদের যাতনা তারা বহু দিন বয়ে বেড়াবে, সবর যদি পারে সেই যাতনাকে ভুলিয়ে দেবে। আর যারা আজও বাজারে আছে, তারা নিত্যনতুন শঙ্কার মধ্যে আছে। এই বুঝি তাদের পুঁজির বাকি অংশের একটা অংশ গেল। কোথায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, কোথায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শত শত কোটি টাকা। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নেই, তাই তারাও নেই। পুরো অর্থনীতিই এখন তারল্যের খরার মধ্যে চলছে। বাড়তি অর্থ কারো কাছে নেই। আছে অতি ছোট একটা গোষ্ঠীর কাছে, যারা রাষ্ট্রীয় সুযোগের অপব্যবহার করতে অতি দক্ষ। বাদবাকি মানুষের অবস্থা কী হয়েছে, তা ছোট কর্মচারী, ছোট দোকানি, স্কুলের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করুন। অনেকেই তাদের অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকেই ভোগই কমিয়ে দিয়েছে, যদিও অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভোগ বেড়েছে। কোন উৎস থেকে এসব লোক বর্ধিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল দেবে? কেউ কি তিন-চারজনের পারিবারিক বাজেটটা মিলিয়ে দেবে? সরকারের এজেন্সিগুলো সব কিছুই বর্ধিত হারে নিচ্ছে তাদের থেকে- যাদের বর্ধিত আয় নেই। যাক, শেয়ারবাজারের কথায় আসি। ঝড় যখন বয়ে গেল, তখন শুরু হলো মিছিল-মিটিং। সে কী জোর প্রতিবাদ। প্রতিবাদে কাজ হয়। শুরু হলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেক সিটিং। আশ্বাসও দেওয়া হলো- সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে, আসল কাজে হাত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখ, ঝড় আসার লক্ষণ দেখেও যারা খুদে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন না, তাঁরা কি পারবেন ঝড়ের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে।
বর্তমানেও যে রেগুলেটর SEC ভালো করছে, সেটা বলব না। কিছু পদক্ষেপ অবশ্য ভালো নিয়েছে। কিছু পদক্ষেপ শুধু ভুল বার্তা দিয়েছে। এর মধ্যে আজ এই মার্কেটেও উঁচু প্রিমিয়ামে IPO-এর অনুমোদন। কেন ১০ টাকার শেয়ারকে ৫০ টাকায় বেচার অনুমোদন দিতে হবে। ৫০ টাকায় শেয়ার কিনে আগামী পাঁচ-ছয় বছর বিনিয়োগকারী কী হিসাবে লভ্যাংশ পাবে? আজও মনে হবে SEC সেই ধুরন্ধর খেলোয়াড়দের পক্ষেই কাজ করছে। অনেক কম্পানি অবস্থার সুযোগ নিয়ে শত শত কোটি টাকার প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করেছে। যারা অতি লাভের আশায় সেদিন প্লেসমেন্টের শেয়ার কিনেছিল, তারা আজকে কথিত 'ধরা খাওয়া' পার্টি। কম্পানি আর তারাই জানে, তাদের মধ্যে বেচাকেনার অর্থ নিয়ে বিরোধ কোন দিন শেষ হবে। ১৯৯৬ সালেও অনেক কম্পানি আগেভাগে শেয়ার বেচে উধাও হয়ে গেছে। ২০১০ সালের ব্যাপ্তিটা আরো ব্যাপক। দুঃখ হলো, আমরা ঘটনা ঘটে গেলে চেঁচামেচি করি। কে করল, কেন করল, কেন এমন হলো- এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও দেখা যায় অন্তহীন ভাবনা প্রকাশ করতে। কিন্তু তেমন যে একটা কিছু হবে, সে ব্যাপারে অনেকেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কে অনুমতি দিয়েছিল ব্রোকারদের ব্যবসাকে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে? আজকেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রেগুলেটর তেমন কিছুই শিখেনি। কিছুদিন আগে কাগজে দেখলাম, রেগুলেটর SEC মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে নাকি Bonus/Right Offer-এর অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবছে। তাদের এ ভাবনাকে শুধু অজ্ঞতারই আরেক উদাহরণ বলব। কেউ চাইছে বা কেউ বলছে বলে তো সে অনুযায়ী SEC সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু দেখা যায় ক্ষেত্রবিশেষে তা-ই হচ্ছে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও কলামিস্ট
আজকে শেয়ারবাজারকে ঘিরে হৈচৈ নেই। কোনো প্রতিবাদ সভা হয় না। কেউ আর অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ চায় না। আজকে যেন সবই ঠিকঠাক চলছে। তবে সেই ঠিকঠাক হলো শ্মশানের নীরবতার মতো চুপচাপের আবহ; কিন্তু ভেতরে ভয় আর যাতনা আঘাত করে যাচ্ছে। যারা পুঁজি হারিয়ে ঘরে ফিরে গেছে, তাদের যাতনা তারা বহু দিন বয়ে বেড়াবে, সবর যদি পারে সেই যাতনাকে ভুলিয়ে দেবে। আর যারা আজও বাজারে আছে, তারা নিত্যনতুন শঙ্কার মধ্যে আছে। এই বুঝি তাদের পুঁজির বাকি অংশের একটা অংশ গেল। কোথায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, কোথায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শত শত কোটি টাকা। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নেই, তাই তারাও নেই। পুরো অর্থনীতিই এখন তারল্যের খরার মধ্যে চলছে। বাড়তি অর্থ কারো কাছে নেই। আছে অতি ছোট একটা গোষ্ঠীর কাছে, যারা রাষ্ট্রীয় সুযোগের অপব্যবহার করতে অতি দক্ষ। বাদবাকি মানুষের অবস্থা কী হয়েছে, তা ছোট কর্মচারী, ছোট দোকানি, স্কুলের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করুন। অনেকেই তাদের অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকেই ভোগই কমিয়ে দিয়েছে, যদিও অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভোগ বেড়েছে। কোন উৎস থেকে এসব লোক বর্ধিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল দেবে? কেউ কি তিন-চারজনের পারিবারিক বাজেটটা মিলিয়ে দেবে? সরকারের এজেন্সিগুলো সব কিছুই বর্ধিত হারে নিচ্ছে তাদের থেকে- যাদের বর্ধিত আয় নেই। যাক, শেয়ারবাজারের কথায় আসি। ঝড় যখন বয়ে গেল, তখন শুরু হলো মিছিল-মিটিং। সে কী জোর প্রতিবাদ। প্রতিবাদে কাজ হয়। শুরু হলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেক সিটিং। আশ্বাসও দেওয়া হলো- সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে, আসল কাজে হাত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখ, ঝড় আসার লক্ষণ দেখেও যারা খুদে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন না, তাঁরা কি পারবেন ঝড়ের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে।
বর্তমানেও যে রেগুলেটর SEC ভালো করছে, সেটা বলব না। কিছু পদক্ষেপ অবশ্য ভালো নিয়েছে। কিছু পদক্ষেপ শুধু ভুল বার্তা দিয়েছে। এর মধ্যে আজ এই মার্কেটেও উঁচু প্রিমিয়ামে IPO-এর অনুমোদন। কেন ১০ টাকার শেয়ারকে ৫০ টাকায় বেচার অনুমোদন দিতে হবে। ৫০ টাকায় শেয়ার কিনে আগামী পাঁচ-ছয় বছর বিনিয়োগকারী কী হিসাবে লভ্যাংশ পাবে? আজও মনে হবে SEC সেই ধুরন্ধর খেলোয়াড়দের পক্ষেই কাজ করছে। অনেক কম্পানি অবস্থার সুযোগ নিয়ে শত শত কোটি টাকার প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করেছে। যারা অতি লাভের আশায় সেদিন প্লেসমেন্টের শেয়ার কিনেছিল, তারা আজকে কথিত 'ধরা খাওয়া' পার্টি। কম্পানি আর তারাই জানে, তাদের মধ্যে বেচাকেনার অর্থ নিয়ে বিরোধ কোন দিন শেষ হবে। ১৯৯৬ সালেও অনেক কম্পানি আগেভাগে শেয়ার বেচে উধাও হয়ে গেছে। ২০১০ সালের ব্যাপ্তিটা আরো ব্যাপক। দুঃখ হলো, আমরা ঘটনা ঘটে গেলে চেঁচামেচি করি। কে করল, কেন করল, কেন এমন হলো- এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও দেখা যায় অন্তহীন ভাবনা প্রকাশ করতে। কিন্তু তেমন যে একটা কিছু হবে, সে ব্যাপারে অনেকেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কে অনুমতি দিয়েছিল ব্রোকারদের ব্যবসাকে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে? আজকেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রেগুলেটর তেমন কিছুই শিখেনি। কিছুদিন আগে কাগজে দেখলাম, রেগুলেটর SEC মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে নাকি Bonus/Right Offer-এর অনুমোদন দেওয়ার কথা ভাবছে। তাদের এ ভাবনাকে শুধু অজ্ঞতারই আরেক উদাহরণ বলব। কেউ চাইছে বা কেউ বলছে বলে তো সে অনুযায়ী SEC সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু দেখা যায় ক্ষেত্রবিশেষে তা-ই হচ্ছে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও কলামিস্ট
No comments