এবার শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ॥ রমরমা বাণিজ্য প্রাইমারীর ৩০ হাজার শিক্ষক পদে চাকরি পাইয়ে দিতে শুরু হয়েছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ॥ ছড়ানো হচ্ছে নানা প্রপাগাণ্ডা, গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট by বিভাষ বাড়ৈ
স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ বাণিজ্যের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০ হাজার শিৰক নিয়োগ নিয়ে শুরম্ন হয়েছে অর্থ লোপাট। প্রধান শিৰক পদে মৌখিক পরীৰা আর সহকারী শিৰক পদে লিখিত ও মৌখিক পরীৰায় পাস করিয়ে দেয়ার নামে চলছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।
'টাকা দিলেই চাকরি, না দিলে লিখিত পরীৰায়ও ফেল, এমপিরা সুপারিশ না করলে চাকরি হবে না- ইতোমধ্যেই এমন সব প্রচারণা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সর্বত্র। সরকারের প্রভাবশালীরা একেকজন শতাধিক প্রার্থীর নামসহ তালিকাও পাঠিয়ে বসে আছেন। ফলে চাকরির আশায় ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে সিন্ডিকেট চক্রের হাতে ধরা দিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সর্বসাধারণকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছে প্রাথমিক শিৰা অধিদফতর। অন্যদিকে অর্থ লোপাটকারীদের দমনে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিআইডির সহায়তা চেয়েছে প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়।জানা গেছে, এবার পরীৰার শুরম্ন থেকেই শিৰক নিয়োগে অনিয়মের বিরম্নদ্ধে শক্ত অবস্থান প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক অধিদফতরের শীর্ষ ব্যক্তিরা। কিন্তু এই অবস্থানকে থোড়াই কেয়ার করেই সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাদের আত্মীয় পরিচয়দানকারীদের সমন্বয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যনত্ম গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। আবার অধিকাংশ ৰেত্রেই অসাধু এই চক্রের বাণিজ্যে টাকার চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় উপেৰিত হচ্ছেন দলীয় ও মেধাবীরাও। চাকরি দেয়ার নাম করে অর্থ কব্জাকারীরাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয় এবং শিৰা অধিদফতরসহ সরকারের সংশিস্নষ্ট দফতরে। এর আগে ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আর প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের মধ্য দিয়ে গত ৮ জানুয়ারি সারাদেশে অনুষ্ঠিত হয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য সহকারী শিৰক নিয়োগ পরীৰা। পরীৰায় প্রশ্নপত্র জালিয়াতি, ভুয়া পরীৰার্থীদের অংশগ্রহণ, পরীৰার হলে মোবাইল ফোন ব্যবহার, পরীৰার্থীদের পরিদর্শকদের সহযোগিতা করা, আসন বণ্টনে অব্যবস্থাপনাসহ নানা অভিযোগ ওঠে। অপরাধের দায়ে গ্রেফতারও করা হয়েছিল অনেক ভুয়া পরাীৰার্থীকে। ফলে দেশের ইতিহাসে একবারে সবচেয়ে বেশি শিৰক নিয়োগ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে অনুষ্ঠিত এই পরীৰা তখনই রীতিমতো প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২৫ হাজার সহকারী শিৰক নিয়োগের জন্য শূন্য পদের বিপরীতে এ পরীৰায় ৮ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৮ প্রার্থী অংশগ্রহণ করেছে। নেয়া হবে ২৫ হাজার শিৰক, যা একক কোন পরীৰায় দেশের ইতিহাসে সবের্াচ্চ। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে অধিদফতরের সূত্রগুলো। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া সারাদেশের ৬১ জেলায় একযোগে এবার পরীৰা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গত বছর ২০ হাজারের মতো শিৰক নেয়া হয়েছিল। জানা গেছে, গত বছরই প্রায় ৫ হাজার পদে নিয়োগ দেয়ার লৰ্যে অনুষ্ঠিত হয় প্রধান শিৰক নিয়োগের লিখিত পরীৰা। সমপ্রতি ফল প্রকাশের পর প্রার্থীরা এখন মৌখিক পরীৰার অপেৰায় আছেন। ফলে ৩০ হাজার শিৰক নিয়োগের বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে এই মুহূর্তে ব্যসত্ম সরকারের সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু বিশাল এই কর্মযজ্ঞে এমপি, মন্ত্রীসহ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগ পন্থী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের অনাকাঙ্ৰিত হসত্মৰেপ নিয়ে এই মুহূর্তে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। নিয়োগ নিয়ে অসাধু চক্রের বেপরোয়ো বাণিজ্যের ব্যাপারে বিসত্মর অভিযোগ জমেছে মন্ত্রণালয়, অধিদফতরসহ সরকারের সংশিস্নষ্ট দফতরে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ টেলিফোন করে চাকরি দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলে ধরছেন। ৰমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন চক্র প্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ৰমতাসীন দলের কিছু নেতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়, অধিদফতর এবং উপজেলা ও জেলা শিৰা অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িয়ে পড়েছেন নিয়োগ বাণিজ্যে। নিয়োগ নিয়ে এই অর্থ লোপাটের অভিযোগকে সত্য বলেও স্বীকার করছেন প্রাথমিক শিৰা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রধান শিৰক নিয়োগের লিখিত পরীৰার ফল প্রকাশের পর একটি চক্র কৌশলে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মৌখিক পরীৰায় পাস করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন। এছাড়া সহকারী শিৰক নিয়োগ পরীৰায় উত্তীর্ণ হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে সরকারী দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও এলাকায় পরীৰার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এরা মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের যোগসূত্র আছে বলে দাবি করছেন।
এদিকে সরকারের সংশিস্নষ্ট দফতরে আলোচিত এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেল নানা উদ্বেগজনক তথ্য। অভিযোগ পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিৰা অফিসের কর্মকর্তাসহ পরীৰার্থীদের কাছ থেকে। জানা গেছে, সরকারের প্রভাবশালীদের অনেকে লিখিত পরীৰার ফল প্রকাশের আগেই নিজেরা তালিকা তৈরি করে তাদের নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছেন। আবার একেকজনের তালিকায় আছে শতাধিক প্রার্থীর নাম আর রোল নম্বর। এতদিন রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন দাবি করে সরকারী দলের এক সাংসদ তার চাহিদাপত্রে ১৫৮ জনের নাম লিখে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি দেয়ার কথা বলেছেন। লিখিত পরীৰার ফল প্রকাশের পর যেখানে আছে মৌখিক পরীৰা সেখানে আগেই এ ধরনের সুপারিশে রীতিমতো বিব্রত সংশিস্নষ্টরা। মন্ত্রণালয়ের সংশিস্নষ্ট অনেক কর্মকর্তাই বলছেন, যেভাবে বিভিন্ন সুপারিশ সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয় সাংসদরা এমপিও দেয়ার সুপারিশের মতোই এটাকে বৈধ মনে করে এসব তালিকা পাঠাচ্ছ্নে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে এমপি, মন্ত্রী ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ছেলে, ভাগ্নেসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ভাঙ্গিয়ে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি দেয়ার কথা বলে তালিকা তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলার প্রাথীদের সঙ্গে এক মন্ত্রীর ছেলে ও তার লোকজন এই প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করছেন। একই অভিযোগ করেছেন প্রাথমিক শিৰা অধিদফতর এবং প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে কেবল ঐ এলাকায়ই নয়, দেশের আরও অনেক জেলা ও উপজেলা থেকেও সরকারী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নিয়োগ বাণিজ্যের খবর পাওয়া গেছে। দেশের দৰিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী সাংসদের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা। নিয়োগের নামে অর্থ লোপাটের বিষয়টিকে গুরম্নত্ব দিয়ে কাজ শুরম্ন করেছে প্রাথমিক ও গণশিৰ মন্ত্রণালয়। কেবল তাই নয়, অবৈধ এ বাণিজ্য বন্ধে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়তা চেয়েছে মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন। তিনি চাকরি পেতে কাউকে টাকা না দিতে প্রার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহিদ খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা ইতোমধ্যেই অবৈধ এ বাণিজ্য বন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে দুদক এবং সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডির সহায়তা চেয়েছি। আমাদের কথা, নিয়োগ হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং অবৈধ হসত্মৰেপমুক্ত। তিনি বলেন, সংশিস্নষ্টদের প্রতি আমাদের আহব্বান কাউকে আপনারা টাকা দেবেন না। তিনি নিয়োগের এই অপরাধ দমন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের সহায়তা কামনা করেছেন।
অন্যদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যেই লিখিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সর্বসাধারণকে অবৈধ অর্থ দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রাথমিক শিৰা অধিদফতর। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম দুনর্ীতির বিরম্নদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন মহাপরিচালক শ্যামল কানত্মি ঘোষ। একই সঙ্গে শিৰক নিয়োগের জন্য কোন ব্যক্তিকে অর্থ না দিতে সংশিস্নষ্ট সকলকে সতর্ক করেছেন তিনি। শিৰক নিয়োগ কার্যক্রম হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং অবৈধ হসত্মৰেপমুক্ত_এমন দাবি করে তিনি বলেছেন, ৮০ নম্বরের লিখিত পরীৰা ওএআর শীটে গ্রহণ করা হয়েছে এবং পরীৰার উত্তরপত্র অপটিক্যাল মার্ক রিডার পদ্ধতিতে কম্পিউটারে পরীৰা করে ফল প্রকাশ করা হবে। লিখিত পরীৰার ফল প্রকাশে আরও এক মাস সময় লেগে যাবে বলে জানিয়েছেন মহাপরিচালক। তিনি বলেছেন, লিখিত পরীৰায় উত্তীর্ণ প্রাথর্ীদের ২০ নম্বরের মৌখিক পরীৰা নেয়া হবে। মৌখিক পরীৰার প্রাপ্ত নম্বর আর লিখিত পরীৰার প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে মেধা তালিকা প্রণয়ন করা হবে। এ ৰেত্রে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি ও দুনর্ীতির সুযোগ নেই। শিৰক নিয়োগের জন্য কেউ টাকা-পয়সা দাবি করলে মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রম্নমে বিষয়টি অবহিত করতে অনুরম্নধ করেছে অধিদফতর। এৰেত্রে যে কেউ ফ্যাক্সযোগেও যোগাযোগ করতে পারবেন। ফ্যাক্স নম্বর হলো-৮০১৬৪৯৯/ ৭১৬৮৮৭১। টেলিফোন নম্বর হচ্ছে ৮০৫৭৮৭৭/ ৭১৬২৪৮৪।
No comments