বহে কাল নিরবধি-বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও পাইপ লাইনের রাজনীতি by এম আবদুল হাফিজ
পূর্ববর্তী ৩০ বছরের বেশির ভাগ সময়ের মতোই এ বছরটিও বিশ্ব অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত প্রমাণাদির যতিচিহ্নে পরিপূর্ণ থাকবে এশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য ও পাশ্চাত্যের আপেক্ষিক পতন। এ তথ্য দিয়েছে 'দ্য ইকোনমিস্ট'। বিশ্বও এখন চলতে শুরু করেছে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার দিকে।
এই বিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থাকে উপলব্ধি করা যায় ইরান থেকে প্যাসিফিক পর্যন্ত বিস্তৃত জ্বালানি ক্ষেত্রগুলোকে কর্তৃত্বে আনার প্রয়াসে। পেপে এসকোওয়ার চলমান কর্তৃত্বের লড়াইকে ইউরেশিয়ার নিয়ন্ত্রণে এক ধরনের 'তরল যুদ্ধ' বলে অভিহিত করেছেন। ইউরেশিয়াকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক না কেন, এই ভূখণ্ডে blue gold and black gold কবজির লড়াইয়ের বাইরে কিছু নেই।
ওপেকের (OPEC) একচেটিয়া জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ ও মধ্যপ্রাচ্যের আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিশ্বশক্তিগুলোকে অন্যত্র অন্য কোথাও থেকে তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেও বাধ্য করেছে। এ ছাড়াও চীন ও ভারতের উত্থান এবং এর পরিণতিতে এদের ক্রমবর্ধমান তেল ও গ্যাসের চাহিদায় বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতি আজ সর্বকালের বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত। এরই মধ্যে মধ্যএশিয়ার 'স্তাল', কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদিই এখন প্রকৃতির ভাণ্ডারে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার। এরাই এখন সর্ববৃহৎ জ্বালানি ভাণ্ডারের ওপর উপবিষ্ট। শুধু তুর্কমেনিস্তানের পরীক্ষিত মজুদই আনুমানিক ৮.১ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই পরিমাণ নিয়ে দেশটি চতুর্থ বৃহত্তম গ্যাস উৎপাদনকারী বিবেচিত। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত যথাক্রমে রাশিয়া, ইরান ও কাতার।
'দ্য গ্রেটগেম' অভিধাটির প্রথম প্রবর্তক ছিলেন ১৮৩৫ সালে আর্থার কোলালি এবং তাতে বোঝাত ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও জার-শাসিত রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যকার মধ্যএশিয়া এবং আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার ও আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘ লড়াই। দুই সাম্রাজ্যের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত অথবা রুশ তুর্কমেনিস্তানে অভিযানের অনুকূল স্ট্র্যাটেজিক অবস্থা তৈরি করা। পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমদ রশিদ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে 'দ্য নিউ গ্রেটগেম' নামে এক নতুন অভিব্যক্তির প্রবর্তন করেন, যার আওতায় পড়ে মধ্যএশিয়ার আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার অন্তর্ভুক্ত যে জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরঘজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং তাজাকিস্তানের উদ্দেশ্য ও কৌশল প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও 'দ্য নিউ গ্রেটগেমে' যুক্ত হয় নতুন খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। উভয় পক্ষে কিছু নতুন আঞ্চলিক শক্তিও গ্রেটগেমের দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে। যাদের মধ্যে আছে চীন, ভারত, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান। এই খেলাটির উপহারসামগ্রী শুধু এই অঞ্চলের জ্বালানি ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারই নয়, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাইপলাইন থেকে প্রাপ্তব্য আর্থিক মুনাফা, ট্যাংকার সার্ভিসের মাশুল, পেট্রোলিয়াম কনসোর্টিয়াম সংগঠনের সুযোগ এবং বহুমুখী আকর্ষণীয় ঠিকাদারি।
পাকিস্তান এই নতুন গ্রেটগেমে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। কেননা জ্বালানি সরবরাহের দুটি প্রধান পাইপলাইন, ইরান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (IPI) এবং তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে TAPI) দুটোকেই অনিবার্যভাবে পাকিস্তান অতিক্রম করতে হবে। নির্মাণাধীন পাইপলাইনই পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির অভ্যন্তরীণ গ্যাস মজুদ দ্রুত শেষ হওয়ার পথে বিধায় পাকিস্তানের জ্বালানি সংকট অচিরেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কিন্তু গ্যাস ট্রানজিটের পথ দেশটির আয়ত্তে থাকায় একসময়ের প্রায় ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তান একটি বিরল সুযোগ পেতে যাচ্ছে। জ্বালানিবঞ্চিত দেশ থেকে পাকিস্তান এশিয়ার জ্বালানি করিডরের মর্যাদা পেতে চলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সুযোগটি দেশটিকে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে পারে। তবে এই সম্ভাবনাটি একেবারে ঝামেলামুক্ত নয়। এই মুহূর্তে আলোচিত গোটা অঞ্চলটি সংঘাতময় পরিস্থিতির আবর্তে থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণে সময় লাগবে।
বর্তমান শতকে গ্রেটগেম অভিধা ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যএশিয়া এবং ট্রান্স ককেশাসে তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার এবং সেখানকার জ্বালানিসম্পদে একটি অংশ নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতার নাম। জানা যায়, শুধু কাস্পিয়ান সাগরের তলদেশেই নাকি রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ফসিল ফুয়েলের অনুদ্ঘাটিত মজুদ। বিভিন্ন অনুমানে তেলের ক্ষেত্রে তার পরিমাণ ৫০ থেকে ১১০ বিলিয়ন ব্যারেল এবং গ্যাসের ক্ষেত্রে এই মজুদ ১৭০ থেকে ৪৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ক্লেভ মানের তথ্যানুযায়ী, শুধু কাজাখস্তান ও আজারবাইজানই ১৩০ বিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেলের মজুদের ওপর অবস্থিত। এই পরিমাণ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মজুদের তিন গুণেরও বেশি।
তবে ঔপনিবেশিকতা-উত্তর গ্রেটগেমের খেলোয়াড়রা ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তরাষ্ট্র এই গ্রেটগেমে একদার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবস্থানে এসেছে। রাশিয়া তার এই পশ্চাৎভূমিতে (Near Abroad) আগেও ছিল। এখনো আছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ভৌগোলিক প্রাসঙ্গিকতা থাকায় এবারের খেলায় ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ চীন ও ভারতের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। আরো আছে রাষ্ট্রসত্তাবিহীন শক্তি, যেমন তেলের কম্পানিগুলো; যাদের আর্থিক সংগতি যেকোনো মধ্যএশীয় দেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি। এবারের গ্রেটগেমের পরিধি যেমন সম্প্রসারিত, কৌশলও তেমনই জটিল ও বহুজাতিক।
গ্রেটগেমের মূল কথা, মধ্য এশিয়া এবং তার সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে রাশিয়া বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাখতে চায়, যাতে সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উত্তরাধিকারী দেশটি কাস্পিয়ান সাগরের তেলের খবরদারি এবং ওই অঞ্চলের তেল রুশ নিয়ন্ত্রিত পাইপলাইনে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দ্বিগুণ মুনাফা হাসিল করতে পারে। এর বিপরীতে মার্কিন তৎপরতার লক্ষ্য এই 'লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায়' তাদেরও একটি অংশ প্রতিষ্ঠা করা। উল্লেখ্য, এককালে এই তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ গোটা অঞ্চলটিই সোভিয়েত কর্তৃত্বাধীন ছিল।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা বিল রিচার্ডসনের উক্তি অনুযায়ী মার্কিনিরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত এই মধ্যএশীয় দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে টানছে এবং পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল করতে চাইছে। সে জন্যই তাঁর মতে, এই অঞ্চলের রাজনীতি ও পাইপলাইন মানচিত্র এই লক্ষ্যে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করতে হবে।
একইভাবে ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক এ অঞ্চলের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত যোগসূত্রের মাধ্যমে মধ্যএশীয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে করে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে- সবারই পছন্দের পাইপলাইন সুবিধাদানকারী দেশে পরিণত হতে পারবে। চীন সত্বরই দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করলে তা বৈশ্বিক পর্যায়ে সর্ববৃহৎ জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশরূপে পরিগণিত হবে। সেখানে আরো দ্রুত আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটলে দেশটি যেকোনো পদ্ধতিতে জ্বালানি সংগ্রহের দিকে ঝুঁকবে।
এরই মধ্যে মধ্যএশীয় অঞ্চলে আন্তরাষ্ট্রীয় বিভেদ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিজ নিজ পছন্দ ও কৌশলের প্রভাবও নগণ্য হবে না। আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রশ্নে সব কিছু ছাপিয়ে ওপরে উঠে আসবে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, রুশ ও এশিয়ার তেল, গ্যাস এবং সেগুলো সরবরাহ যে পাইপলাইনগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি প্রতিযোগী তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সেই নব্বইয়ের দশক থেকে পাইপলাইন নির্মাণে হাত দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনীয় তেল কম্পানি 'ব্রিডাস' তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে TAPI) সংযোগকারী পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব দিলে তার প্রতিকূলে আসে শক্তিশালী মার্কিন তেল কম্পানি ইউনিকলের পাল্টা প্রস্তাব। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইরান ১১৯ মাইল দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করে, যা পূর্ব ইরানকে যুক্ত করবে উত্তর-পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিসাপেক্ষে কাসপিয়ান সাগরের তলদেশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে তুর্কমেনিস্তানের পাইপলাইন, যা ইরানকে এড়িয়ে তুরস্ক পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
পাইপলাইনের রাজনীতিতে মূল প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। রুশরা মার্কিনিদের তাদের মধ্যএশীয় পশ্চাৎভূমি থেকে বহিষ্কারে দৃঢ়সংকল্প। নিজেদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে রুশরা তাদের সম্পদে বাধ্য হয়ে হলেও শুধু ইউরোপীয়দের প্রাধান্য বহাল রাখতে রাজি। কিন্তু আমেরিকানরা এই প্রাধান্যকে বহুপক্ষীয় করার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব নিশ্চিত করতে চায়।
নতুন শতকের গ্রেটগেমে নতুন খেলোয়াড় চীনের উত্থানও উপেক্ষা করা যাবে না। মধ্যএশিয়া অভিমুখে তারাও সন্তর্পণে তাদের নিজস্ব পাইপলাইন নিয়ে এগোচ্ছে। তারাও তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের বিপুল জ্বালানি আহরণে আগ্রহী। জানা যায়, এতদুদ্দেশ্যে তাদেরও পাইপলাইন চীনের সিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে।
তবে গ্যাস পাইপলাইন রাজনীতিতে সম্ভবত ইরানই সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকায়। তা একেবারে অমূলক বা অকারণ নয়। ইরানের কাছে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ও গ্যাস মজুদ। এই মজুদের পরিমাণ ৯৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল। পাইপলাইন রাজনীতিতে ইরানের সক্রিয় ভূমিকা মার্কিনিদের অপছন্দ। তবু ইরান চীনের সঙ্গে ১২০ বিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি সম্পাদন করেছে।
একটি বৃহৎ ক্যানভাসে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, জ্বালানি ও পাইপলাইন রাজনীতির খেলাটি আসলে শক্তি ও ক্ষমতার লড়াই, যা পাশ্চাত্য এবং নবোদ্ভূত এশীয় ব্লকের মধ্যে চলছে। একদিকে এর প্রতিনিধিত্ব করছে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ন্যাটো। অন্যদিকে এর প্রতিনিধিত্ব এশিয়ায় নবগঠিত সাংহাই সহযোগিতা চুক্তি বা ঝঈউ। যার দুটি প্রধান স্তম্ভ রাশিয়া ও চীন। এর মধ্যে কি গন্ধ পাওয়া যায় চিরাচরিত পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্বের, সেই পুরনো ঠাণ্ডা লড়াইয়ের? বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে শেষ পর্যন্ত কী রূপ পরিগ্রহ করে জ্বালানি ও পাইপলাইনের রাজনীতি।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
ওপেকের (OPEC) একচেটিয়া জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ ও মধ্যপ্রাচ্যের আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিশ্বশক্তিগুলোকে অন্যত্র অন্য কোথাও থেকে তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেও বাধ্য করেছে। এ ছাড়াও চীন ও ভারতের উত্থান এবং এর পরিণতিতে এদের ক্রমবর্ধমান তেল ও গ্যাসের চাহিদায় বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতি আজ সর্বকালের বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত। এরই মধ্যে মধ্যএশিয়ার 'স্তাল', কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদিই এখন প্রকৃতির ভাণ্ডারে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার। এরাই এখন সর্ববৃহৎ জ্বালানি ভাণ্ডারের ওপর উপবিষ্ট। শুধু তুর্কমেনিস্তানের পরীক্ষিত মজুদই আনুমানিক ৮.১ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই পরিমাণ নিয়ে দেশটি চতুর্থ বৃহত্তম গ্যাস উৎপাদনকারী বিবেচিত। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত যথাক্রমে রাশিয়া, ইরান ও কাতার।
'দ্য গ্রেটগেম' অভিধাটির প্রথম প্রবর্তক ছিলেন ১৮৩৫ সালে আর্থার কোলালি এবং তাতে বোঝাত ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও জার-শাসিত রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যকার মধ্যএশিয়া এবং আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার ও আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘ লড়াই। দুই সাম্রাজ্যের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত অথবা রুশ তুর্কমেনিস্তানে অভিযানের অনুকূল স্ট্র্যাটেজিক অবস্থা তৈরি করা। পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমদ রশিদ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে 'দ্য নিউ গ্রেটগেম' নামে এক নতুন অভিব্যক্তির প্রবর্তন করেন, যার আওতায় পড়ে মধ্যএশিয়ার আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার অন্তর্ভুক্ত যে জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরঘজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং তাজাকিস্তানের উদ্দেশ্য ও কৌশল প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও 'দ্য নিউ গ্রেটগেমে' যুক্ত হয় নতুন খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। উভয় পক্ষে কিছু নতুন আঞ্চলিক শক্তিও গ্রেটগেমের দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে। যাদের মধ্যে আছে চীন, ভারত, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান। এই খেলাটির উপহারসামগ্রী শুধু এই অঞ্চলের জ্বালানি ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারই নয়, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাইপলাইন থেকে প্রাপ্তব্য আর্থিক মুনাফা, ট্যাংকার সার্ভিসের মাশুল, পেট্রোলিয়াম কনসোর্টিয়াম সংগঠনের সুযোগ এবং বহুমুখী আকর্ষণীয় ঠিকাদারি।
পাকিস্তান এই নতুন গ্রেটগেমে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। কেননা জ্বালানি সরবরাহের দুটি প্রধান পাইপলাইন, ইরান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (IPI) এবং তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে TAPI) দুটোকেই অনিবার্যভাবে পাকিস্তান অতিক্রম করতে হবে। নির্মাণাধীন পাইপলাইনই পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির অভ্যন্তরীণ গ্যাস মজুদ দ্রুত শেষ হওয়ার পথে বিধায় পাকিস্তানের জ্বালানি সংকট অচিরেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কিন্তু গ্যাস ট্রানজিটের পথ দেশটির আয়ত্তে থাকায় একসময়ের প্রায় ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তান একটি বিরল সুযোগ পেতে যাচ্ছে। জ্বালানিবঞ্চিত দেশ থেকে পাকিস্তান এশিয়ার জ্বালানি করিডরের মর্যাদা পেতে চলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সুযোগটি দেশটিকে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে পারে। তবে এই সম্ভাবনাটি একেবারে ঝামেলামুক্ত নয়। এই মুহূর্তে আলোচিত গোটা অঞ্চলটি সংঘাতময় পরিস্থিতির আবর্তে থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রত্যাশা পূরণে সময় লাগবে।
বর্তমান শতকে গ্রেটগেম অভিধা ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যএশিয়া এবং ট্রান্স ককেশাসে তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার এবং সেখানকার জ্বালানিসম্পদে একটি অংশ নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতার নাম। জানা যায়, শুধু কাস্পিয়ান সাগরের তলদেশেই নাকি রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ফসিল ফুয়েলের অনুদ্ঘাটিত মজুদ। বিভিন্ন অনুমানে তেলের ক্ষেত্রে তার পরিমাণ ৫০ থেকে ১১০ বিলিয়ন ব্যারেল এবং গ্যাসের ক্ষেত্রে এই মজুদ ১৭০ থেকে ৪৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ক্লেভ মানের তথ্যানুযায়ী, শুধু কাজাখস্তান ও আজারবাইজানই ১৩০ বিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেলের মজুদের ওপর অবস্থিত। এই পরিমাণ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মজুদের তিন গুণেরও বেশি।
তবে ঔপনিবেশিকতা-উত্তর গ্রেটগেমের খেলোয়াড়রা ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তরাষ্ট্র এই গ্রেটগেমে একদার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবস্থানে এসেছে। রাশিয়া তার এই পশ্চাৎভূমিতে (Near Abroad) আগেও ছিল। এখনো আছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ভৌগোলিক প্রাসঙ্গিকতা থাকায় এবারের খেলায় ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ চীন ও ভারতের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। আরো আছে রাষ্ট্রসত্তাবিহীন শক্তি, যেমন তেলের কম্পানিগুলো; যাদের আর্থিক সংগতি যেকোনো মধ্যএশীয় দেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি। এবারের গ্রেটগেমের পরিধি যেমন সম্প্রসারিত, কৌশলও তেমনই জটিল ও বহুজাতিক।
গ্রেটগেমের মূল কথা, মধ্য এশিয়া এবং তার সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে রাশিয়া বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাখতে চায়, যাতে সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উত্তরাধিকারী দেশটি কাস্পিয়ান সাগরের তেলের খবরদারি এবং ওই অঞ্চলের তেল রুশ নিয়ন্ত্রিত পাইপলাইনে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দ্বিগুণ মুনাফা হাসিল করতে পারে। এর বিপরীতে মার্কিন তৎপরতার লক্ষ্য এই 'লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায়' তাদেরও একটি অংশ প্রতিষ্ঠা করা। উল্লেখ্য, এককালে এই তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ গোটা অঞ্চলটিই সোভিয়েত কর্তৃত্বাধীন ছিল।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা বিল রিচার্ডসনের উক্তি অনুযায়ী মার্কিনিরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত এই মধ্যএশীয় দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে টানছে এবং পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল করতে চাইছে। সে জন্যই তাঁর মতে, এই অঞ্চলের রাজনীতি ও পাইপলাইন মানচিত্র এই লক্ষ্যে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করতে হবে।
একইভাবে ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক এ অঞ্চলের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত যোগসূত্রের মাধ্যমে মধ্যএশীয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে করে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে- সবারই পছন্দের পাইপলাইন সুবিধাদানকারী দেশে পরিণত হতে পারবে। চীন সত্বরই দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করলে তা বৈশ্বিক পর্যায়ে সর্ববৃহৎ জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশরূপে পরিগণিত হবে। সেখানে আরো দ্রুত আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটলে দেশটি যেকোনো পদ্ধতিতে জ্বালানি সংগ্রহের দিকে ঝুঁকবে।
এরই মধ্যে মধ্যএশীয় অঞ্চলে আন্তরাষ্ট্রীয় বিভেদ, বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিজ নিজ পছন্দ ও কৌশলের প্রভাবও নগণ্য হবে না। আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রশ্নে সব কিছু ছাপিয়ে ওপরে উঠে আসবে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, রুশ ও এশিয়ার তেল, গ্যাস এবং সেগুলো সরবরাহ যে পাইপলাইনগুলোর তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি প্রতিযোগী তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সেই নব্বইয়ের দশক থেকে পাইপলাইন নির্মাণে হাত দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টিনীয় তেল কম্পানি 'ব্রিডাস' তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (সংক্ষেপে TAPI) সংযোগকারী পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব দিলে তার প্রতিকূলে আসে শক্তিশালী মার্কিন তেল কম্পানি ইউনিকলের পাল্টা প্রস্তাব। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইরান ১১৯ মাইল দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করে, যা পূর্ব ইরানকে যুক্ত করবে উত্তর-পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিসাপেক্ষে কাসপিয়ান সাগরের তলদেশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে তুর্কমেনিস্তানের পাইপলাইন, যা ইরানকে এড়িয়ে তুরস্ক পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
পাইপলাইনের রাজনীতিতে মূল প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। রুশরা মার্কিনিদের তাদের মধ্যএশীয় পশ্চাৎভূমি থেকে বহিষ্কারে দৃঢ়সংকল্প। নিজেদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে রুশরা তাদের সম্পদে বাধ্য হয়ে হলেও শুধু ইউরোপীয়দের প্রাধান্য বহাল রাখতে রাজি। কিন্তু আমেরিকানরা এই প্রাধান্যকে বহুপক্ষীয় করার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব নিশ্চিত করতে চায়।
নতুন শতকের গ্রেটগেমে নতুন খেলোয়াড় চীনের উত্থানও উপেক্ষা করা যাবে না। মধ্যএশিয়া অভিমুখে তারাও সন্তর্পণে তাদের নিজস্ব পাইপলাইন নিয়ে এগোচ্ছে। তারাও তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের বিপুল জ্বালানি আহরণে আগ্রহী। জানা যায়, এতদুদ্দেশ্যে তাদেরও পাইপলাইন চীনের সিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে।
তবে গ্যাস পাইপলাইন রাজনীতিতে সম্ভবত ইরানই সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকায়। তা একেবারে অমূলক বা অকারণ নয়। ইরানের কাছে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ও গ্যাস মজুদ। এই মজুদের পরিমাণ ৯৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল। পাইপলাইন রাজনীতিতে ইরানের সক্রিয় ভূমিকা মার্কিনিদের অপছন্দ। তবু ইরান চীনের সঙ্গে ১২০ বিলিয়ন ডলারের একটি গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি সম্পাদন করেছে।
একটি বৃহৎ ক্যানভাসে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, জ্বালানি ও পাইপলাইন রাজনীতির খেলাটি আসলে শক্তি ও ক্ষমতার লড়াই, যা পাশ্চাত্য এবং নবোদ্ভূত এশীয় ব্লকের মধ্যে চলছে। একদিকে এর প্রতিনিধিত্ব করছে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ন্যাটো। অন্যদিকে এর প্রতিনিধিত্ব এশিয়ায় নবগঠিত সাংহাই সহযোগিতা চুক্তি বা ঝঈউ। যার দুটি প্রধান স্তম্ভ রাশিয়া ও চীন। এর মধ্যে কি গন্ধ পাওয়া যায় চিরাচরিত পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্বের, সেই পুরনো ঠাণ্ডা লড়াইয়ের? বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে শেষ পর্যন্ত কী রূপ পরিগ্রহ করে জ্বালানি ও পাইপলাইনের রাজনীতি।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলামিস্ট
No comments