বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৮২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হামিদুল হক, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধার কথা টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার অন্তর্গত একটি গ্রাম বল্লা। সেখানে কয়েক দিন ধরে অবস্থান করছেন হামিদুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা।
তখন ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি। সকাল আনুমানিক আটটা। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল পাকিস্তানি সেনা কালিহাতী থেকে এগিয়ে আসছে বল্লার দিকে।
পাকিস্তানি সেনারা যে পথে আসছে, সে পথে আছে নদী। পারাপারের জন্য আছে ঘাট। পাকিস্তানি সেনাদের বল্লায় আসতে হলে এই ঘাট দিয়েই আসতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত তৈরি হয়ে রওনা হলেন সেদিক। ওই জায়গাটা আক্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান। পাকিস্তানি সেনারা আসার আগেই গোপনে তাঁরা অবস্থান নিলেন নদীর এপারে।
নদীর ওপার স্বাভাবিক। ঘাটে দুটি নৌকা। হামিদুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিলেন আড়ালে। নদীর ওপার থেকে তাঁদের দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধারা বসে আছেন টানটান উত্তেজনা নিয়ে। সবার চোখ নদীর ওপারে। একটু পর সেখানে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনারা।
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নিশ্চুপ। পাকিস্তানি সেনারা কোথাও কোনো বাধা পায়নি। ঘাটে তারা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে নৌকায় উঠল। তারপর নৌকা চলতে শুরু করল। সেনারা সবাই নৌকায় নিশ্চিত মনে দাঁড়িয়ে। তারা বুঝতেও পারল না নদীর এপারে তাদের জন্য কী ঘটনা অপেক্ষা করছে।
নৌকা নদীর এপারে আসামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজনের অস্ত্র। সবাই গুলি করলেন না। তাঁদের ওপর নির্দেশ, এমনভাবে গুলি করতে হবে যাতে সব নিশানাই সঠিক হয়। এলোপাতাড়ি গুলি করে গুলির অপচয় করা যাবে না। কারণ তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব প্রকট।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই সেনাদের ছোটাছুটিতে ডুবে গেল দুটি নৌকা। ঝাঁপাঝাঁপি করে পানি থেকে উঠে তারা অবস্থান নিল বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছে চারজন পাকিস্তানি সেনা। কয়েকজন নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
একটু পর শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় অনেক শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত। অন্যদিকে হামিদুল হক ও তাঁর বেশির ভাগ সঙ্গী মাত্র কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণ বেশ বেপরোয়া ধরনের। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচলিত হলেন না। স্বল্প প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র গোলাবারুদ সম্বল করেই সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন।
হামিদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা ভরকে গেল। অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা পিছু হটতে শুরু করল। পিছু হটার আগে তারা চেষ্টা করল নিহত সহযোদ্ধাদের লাশ উদ্ধারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ত্বরিত তৎপরতায় তাদের সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো। পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেল।
হামিদুল হক ১৯৭১ সালে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে বল্লাসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন। পাশাপাশি কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক বিভাগেরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হামিদুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীলত্বভূষণ নম্বর ৪২২।
হামিদুল হক বর্তমানে অবসরে জীবনযাপন করছেন। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে তিনি পাঁচ বছর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কচুয়া গ্রামে। বর্তমানে সখীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম হাবিল উদ্দিন, মা কছিরন নেসা, স্ত্রী রোমেচা বেগম। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
পাকিস্তানি সেনারা যে পথে আসছে, সে পথে আছে নদী। পারাপারের জন্য আছে ঘাট। পাকিস্তানি সেনাদের বল্লায় আসতে হলে এই ঘাট দিয়েই আসতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত তৈরি হয়ে রওনা হলেন সেদিক। ওই জায়গাটা আক্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান। পাকিস্তানি সেনারা আসার আগেই গোপনে তাঁরা অবস্থান নিলেন নদীর এপারে।
নদীর ওপার স্বাভাবিক। ঘাটে দুটি নৌকা। হামিদুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিলেন আড়ালে। নদীর ওপার থেকে তাঁদের দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধারা বসে আছেন টানটান উত্তেজনা নিয়ে। সবার চোখ নদীর ওপারে। একটু পর সেখানে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনারা।
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নিশ্চুপ। পাকিস্তানি সেনারা কোথাও কোনো বাধা পায়নি। ঘাটে তারা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে নৌকায় উঠল। তারপর নৌকা চলতে শুরু করল। সেনারা সবাই নৌকায় নিশ্চিত মনে দাঁড়িয়ে। তারা বুঝতেও পারল না নদীর এপারে তাদের জন্য কী ঘটনা অপেক্ষা করছে।
নৌকা নদীর এপারে আসামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজনের অস্ত্র। সবাই গুলি করলেন না। তাঁদের ওপর নির্দেশ, এমনভাবে গুলি করতে হবে যাতে সব নিশানাই সঠিক হয়। এলোপাতাড়ি গুলি করে গুলির অপচয় করা যাবে না। কারণ তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব প্রকট।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই সেনাদের ছোটাছুটিতে ডুবে গেল দুটি নৌকা। ঝাঁপাঝাঁপি করে পানি থেকে উঠে তারা অবস্থান নিল বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছে চারজন পাকিস্তানি সেনা। কয়েকজন নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
একটু পর শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় অনেক শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত। অন্যদিকে হামিদুল হক ও তাঁর বেশির ভাগ সঙ্গী মাত্র কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণ বেশ বেপরোয়া ধরনের। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচলিত হলেন না। স্বল্প প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র গোলাবারুদ সম্বল করেই সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন।
হামিদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা ভরকে গেল। অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা পিছু হটতে শুরু করল। পিছু হটার আগে তারা চেষ্টা করল নিহত সহযোদ্ধাদের লাশ উদ্ধারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ত্বরিত তৎপরতায় তাদের সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো। পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেল।
হামিদুল হক ১৯৭১ সালে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে বল্লাসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন। পাশাপাশি কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক বিভাগেরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হামিদুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীলত্বভূষণ নম্বর ৪২২।
হামিদুল হক বর্তমানে অবসরে জীবনযাপন করছেন। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে তিনি পাঁচ বছর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কচুয়া গ্রামে। বর্তমানে সখীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম হাবিল উদ্দিন, মা কছিরন নেসা, স্ত্রী রোমেচা বেগম। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments