পুলিশ সপ্তাহে আত্মজিজ্ঞাসা by এ এম এম শওকত আলী
প্রতিবারের মতো এ বছরও পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। পুলিশের উচ্চতর পর্যায়ের তিনটি পদ এক নম্বর গ্রেডভুক্ত হবে। পরিদর্শক ও উপপরিদর্শক যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত হবে।
বস্তুত একীভূত জাতীয় পে-গ্রেড ঘোষণার পর সরকারি কর্মকর্তাদের চার শ্রেণীতে বিভক্তি প্রথা বিলুপ্ত হলেও এখনো 'শ্রেণী' শব্দটি পদমর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়নি। এক নম্বর গ্রেডভুক্ত হলেই বলা হয় সচিবের সমতুল্য। কারণ বেতনক্রম একই। উচ্চতর বেতনক্রম পদের নির্ণায়ক হওয়ার কথা নয়। তবু তুলনার খাতিরে এ কথা বলা হয়।
পুলিশ সপ্তাহসংক্রান্ত মিডিয়ার কিছু প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পুলিশের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আত্মজিজ্ঞাসামূলক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশবিষয়ক সমন্বয়ক যেসব কথা বলেছেন, তা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। প্রশংসার পরিবর্তে পুলিশের বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। সমন্বয়ক একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, পুলিশের মহাপরিদর্শকের সমতুল্য। মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের পদের কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। এর কারণও রয়েছে। বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যেকোনো অধিদপ্তরের পরিচালনাবিষয়ক কার্যক্রম ওই অধিদপ্তরপ্রধানের দায়িত্ব। নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সমন্বয়সাধনের দায়িত্ব মন্ত্রীর। তবে এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবের। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রণালয়ে একজন একই অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
সংবাদ সূত্রে আরো দেখা যায়, পুলিশের সমন্বয়ক বলেছেন, পুলিশ বাহিনী ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পেয়েছে, যা অতীতের অন্য কোনো সরকার দেয়নি। এ ধরনের বক্তব্যে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর অর্থ কি এই যে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো বিশেষ বিভাগকে সুবিধা দেবে, তার জন্যই কাজ করতে হবে। এ ধরনের মনোভাব সরকারি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমন্বয়কের মূল বক্তব্যের অর্থ হয়তো ছিল সঠিক। কারণ তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সেবার মান বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অন্য একটি বক্তব্য কিছুটা হলেও বিভ্রান্তিকর। তিনি করদাতাদের জন্য পুলিশ কী করছে, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। পুলিশের সেবা কি শুধু করদাতাদের জন্য, না সর্বস্তরের নাগরিকদের জন্য? পুলিশ যে নাগরিক শ্রেণী মোতাবেক বৈষম্যমূলক আচরণ করবে, তা আশা করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও তিনি হয়তো সর্বস্তরের নাগরিকদের কথাই বলতে চেয়েছেন। কারণ তাঁর পরবর্তী বক্তব্যে এ বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। এ বক্তব্যে তিনি বলেছেন, গ্রেড উচ্চমানের করা হলেও সাধারণ মানুষ আশানুরূপ সেবা পাচ্ছে না। পুলিশসংক্রান্ত সুশাসনের এই নেতিবাচক ফলাফলের জন্য তিনি দুটি বিষয় চিহ্নিত করেন_১. প্রশিক্ষণের দুর্বলতা এবং ২. মোটিভেশনের অভাব। দায়বদ্ধতার প্রশ্নও তিনি উত্থাপন করেছেন।
তাঁর এ রকম বক্তব্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার ক্ষোভের কারণ হয়ে পড়ে। একজন ঊর্ধ্বতন পদের কর্মকর্তা সমন্বয়কের বক্তব্যকে বাধাগ্রস্ত করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছু বাদানুবাদও হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিরস্ত না হয়ে কিছু বলার জন্য একপর্যায়ে উপস্থিত মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও আইজিপির অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তিনি চুপ করে বসে পড়েন। এ ধরনের আচরণ লক্ষণমূলক। সৌজন্যমূলক আচরণের পরিপন্থী অথবা সাধারণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী। দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ ধরনের আচরণ কেউ আশা করে না; বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আইজিপির উপস্থিতিতে।
এ ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। সময়টি ছিল ১৯৭৬-৭৭। পুলিশ বিধি অনুযায়ী, একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার পুলিশ সুপার কোয়ার্টারলি পুলিশ সভা আহ্বান করেন। বিধি অনুযায়ী, তিনি জেলার ডেপুটি কমিশনারকেও ওই সভায় উপস্থিত থাকার অনুরোধ করেন। ডেপুটি কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর ও শান্ত পরিবেশে সবাই সবার বক্তব্য শোনেন। কেউ কাউকে বাধাগ্রস্ত করেননি। ওই সভায় পুলিশ সুপার পুলিশের একটি চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেন। আর তা হলো- P=Politeness বা বিনয়ী,O=Obedience বা আজ্ঞানুবর্তিতা, L=Loyalty বা বিশ্বস্ততা, I=Intelligence বা বুদ্ধিমত্তা, C=Courtesy বা ভদ্রতা এবং E=Efficiency বা দক্ষতা। মূলত এই সংজ্ঞায় পুলিশের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলির কথাই বলা হয়েছে। বর্তমান ঘটনায় মনে হয়, দিন বদলে গেছে। তবে নিশ্চয়ই ভালোর জন্য নয়। এ ঘটনায় সংজ্ঞায়িত গুণাবলির কোনো চিহ্ন ছিল না। উল্লেখ্য, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার এসব গুণ সাধারণ নাগরিকরা আশা করে। এসব গুণের অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আইজিপির ভাষণ ছিল ভারসাম্যমূলক। তিনি বলেন, (এক) আত্মজিজ্ঞাসা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং (দুই) তরুণ কর্মকর্তারাই এখন আশার আলো। শেষোক্ত বক্তব্যকে উপস্থিত তরুণ কর্মকর্তারা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান। আশার আলো শুধু পুলিশ বাহিনীতে নয়, প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে দেখা যাবে_এটাই সবাই আশা করে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সার্বিকভাবে এটা দৃশ্যমান এখনো হয়নি। যে ঘটনার কথা বলা হলো, তার মধ্যে একটি সর্বজনীন সত্যতা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা কেন, কোনো মানুষই তার দোষত্রুটি সহজে স্বীকার করতে চায় না। তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এ ধরনের মনোভাব কাম্য নয়।
এ-সংক্রান্ত অন্য একটি সর্বজনীন সত্যতা হলো, সরকারের প্রতি প্রশাসনিক বিভাগ অধিকতর ক্ষমতাসহ স্বাধীনতায় আগ্রহী। তারা মনে করে, তাহলেই তারা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের মনোভাবও জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনার সময় এ বিষয়টি অনেকাংশে দৃশ্যমান ছিল। নতুন খসড়ায় পুলিশ আইনের বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার বিষয় উত্থাপিত হয়। বলা হয়, এটা ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে। আনুষ্ঠানিক সভায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ ধরনের শব্দ সৌজন্যবিবর্জিত। মন্ত্রণালয়ে অনিষ্পন্ন নথির বিষয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। প্রথমোক্ত বিষয়ে বলা যায়, বিষয়টি কয়েক বছর ধরেই বহুল আলোচিত। অনেকের মতে, সরকারি যেকোনো বিভাগকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দেওয়ার নজির কোনো দেশেই নেই; বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সংসদে মন্ত্রীকেই নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হয়। অনেকের মতে, যে খসড়া আইন করা হয়েছে, তার ফলে জবাবদিহির বিষয়টি বিলীন হয়ে যাবে। শেষোক্ত বিষয়ে বলা যায়, কোনো বিভাগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট যুক্তি প্রয়োজন। বক্তব্যে এমন কোনো যুক্তি দেখানো হয়নি; একবাক্যে শুধু অনিষ্পন্ন নথির কথা বলা হয়েছে। এটাই কি যথেষ্ট?
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেছেন। বিষয়টি বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়। সার্বিকভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, দপ্তরপ্রধান বা তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অধীন অন্য কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে ক্ষমতাবান। যে বিষয়ে ক্ষমতাবান, সেই কর্মকর্তাই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ ক্ষমতা ডিআইজিদের অর্পণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। শুধু ডিআইজি কেন, পুলিশ সুপারের ক্ষেত্রেও এটা প্রয়োজন। এক জেলার পুলিশ সুপার তাঁর জেলায় র্যাবের সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করায় সৃষ্ট অসুবিধার কথা বলেছেন, যা উপস্থিত র্যাবের প্রতিনিধি খণ্ডন করেছেন।
এ বিষয়টিই হলো মাঠ প্রশাসনের বৃহত্তর চিত্র। সমন্বয়হীনতা জনস্বার্থের পরিপন্থী। সরকারের সব বিভাগই যদি একে অন্যের সঙ্গে সার্বিক সরকারি কর্মকাণ্ড সমন্বিতভাবে সম্পাদন না করে, তাহলে জনমানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সম্পদেরও অপচয় হবে; বিশেষ করে র্যাব ও পুলিশের মধ্যে যদি সমন্বয়ের অভাব থাকে। অন্য একটি বিষয় হলো, পুলিশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। সম্প্রতি টিআইবির এক জরিপে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই দুর্নীতি অপেক্ষাকৃত বেশি। দোষত্রুটির বিষয়টি সঠিক হলে তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
পুলিশ সপ্তাহসংক্রান্ত মিডিয়ার কিছু প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পুলিশের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আত্মজিজ্ঞাসামূলক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশবিষয়ক সমন্বয়ক যেসব কথা বলেছেন, তা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। প্রশংসার পরিবর্তে পুলিশের বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। সমন্বয়ক একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, পুলিশের মহাপরিদর্শকের সমতুল্য। মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের পদের কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। এর কারণও রয়েছে। বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় যেকোনো অধিদপ্তরের পরিচালনাবিষয়ক কার্যক্রম ওই অধিদপ্তরপ্রধানের দায়িত্ব। নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সমন্বয়সাধনের দায়িত্ব মন্ত্রীর। তবে এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবের। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রণালয়ে একজন একই অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
সংবাদ সূত্রে আরো দেখা যায়, পুলিশের সমন্বয়ক বলেছেন, পুলিশ বাহিনী ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পেয়েছে, যা অতীতের অন্য কোনো সরকার দেয়নি। এ ধরনের বক্তব্যে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর অর্থ কি এই যে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো বিশেষ বিভাগকে সুবিধা দেবে, তার জন্যই কাজ করতে হবে। এ ধরনের মনোভাব সরকারি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমন্বয়কের মূল বক্তব্যের অর্থ হয়তো ছিল সঠিক। কারণ তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সেবার মান বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অন্য একটি বক্তব্য কিছুটা হলেও বিভ্রান্তিকর। তিনি করদাতাদের জন্য পুলিশ কী করছে, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। পুলিশের সেবা কি শুধু করদাতাদের জন্য, না সর্বস্তরের নাগরিকদের জন্য? পুলিশ যে নাগরিক শ্রেণী মোতাবেক বৈষম্যমূলক আচরণ করবে, তা আশা করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও তিনি হয়তো সর্বস্তরের নাগরিকদের কথাই বলতে চেয়েছেন। কারণ তাঁর পরবর্তী বক্তব্যে এ বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। এ বক্তব্যে তিনি বলেছেন, গ্রেড উচ্চমানের করা হলেও সাধারণ মানুষ আশানুরূপ সেবা পাচ্ছে না। পুলিশসংক্রান্ত সুশাসনের এই নেতিবাচক ফলাফলের জন্য তিনি দুটি বিষয় চিহ্নিত করেন_১. প্রশিক্ষণের দুর্বলতা এবং ২. মোটিভেশনের অভাব। দায়বদ্ধতার প্রশ্নও তিনি উত্থাপন করেছেন।
তাঁর এ রকম বক্তব্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার ক্ষোভের কারণ হয়ে পড়ে। একজন ঊর্ধ্বতন পদের কর্মকর্তা সমন্বয়কের বক্তব্যকে বাধাগ্রস্ত করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছু বাদানুবাদও হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিরস্ত না হয়ে কিছু বলার জন্য একপর্যায়ে উপস্থিত মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও আইজিপির অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তিনি চুপ করে বসে পড়েন। এ ধরনের আচরণ লক্ষণমূলক। সৌজন্যমূলক আচরণের পরিপন্থী অথবা সাধারণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী। দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ ধরনের আচরণ কেউ আশা করে না; বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আইজিপির উপস্থিতিতে।
এ ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। সময়টি ছিল ১৯৭৬-৭৭। পুলিশ বিধি অনুযায়ী, একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার পুলিশ সুপার কোয়ার্টারলি পুলিশ সভা আহ্বান করেন। বিধি অনুযায়ী, তিনি জেলার ডেপুটি কমিশনারকেও ওই সভায় উপস্থিত থাকার অনুরোধ করেন। ডেপুটি কমিশনারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর ও শান্ত পরিবেশে সবাই সবার বক্তব্য শোনেন। কেউ কাউকে বাধাগ্রস্ত করেননি। ওই সভায় পুলিশ সুপার পুলিশের একটি চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেন। আর তা হলো- P=Politeness বা বিনয়ী,O=Obedience বা আজ্ঞানুবর্তিতা, L=Loyalty বা বিশ্বস্ততা, I=Intelligence বা বুদ্ধিমত্তা, C=Courtesy বা ভদ্রতা এবং E=Efficiency বা দক্ষতা। মূলত এই সংজ্ঞায় পুলিশের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলির কথাই বলা হয়েছে। বর্তমান ঘটনায় মনে হয়, দিন বদলে গেছে। তবে নিশ্চয়ই ভালোর জন্য নয়। এ ঘটনায় সংজ্ঞায়িত গুণাবলির কোনো চিহ্ন ছিল না। উল্লেখ্য, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার এসব গুণ সাধারণ নাগরিকরা আশা করে। এসব গুণের অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আইজিপির ভাষণ ছিল ভারসাম্যমূলক। তিনি বলেন, (এক) আত্মজিজ্ঞাসা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং (দুই) তরুণ কর্মকর্তারাই এখন আশার আলো। শেষোক্ত বক্তব্যকে উপস্থিত তরুণ কর্মকর্তারা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান। আশার আলো শুধু পুলিশ বাহিনীতে নয়, প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে দেখা যাবে_এটাই সবাই আশা করে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সার্বিকভাবে এটা দৃশ্যমান এখনো হয়নি। যে ঘটনার কথা বলা হলো, তার মধ্যে একটি সর্বজনীন সত্যতা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা কেন, কোনো মানুষই তার দোষত্রুটি সহজে স্বীকার করতে চায় না। তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এ ধরনের মনোভাব কাম্য নয়।
এ-সংক্রান্ত অন্য একটি সর্বজনীন সত্যতা হলো, সরকারের প্রতি প্রশাসনিক বিভাগ অধিকতর ক্ষমতাসহ স্বাধীনতায় আগ্রহী। তারা মনে করে, তাহলেই তারা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের মনোভাবও জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনার সময় এ বিষয়টি অনেকাংশে দৃশ্যমান ছিল। নতুন খসড়ায় পুলিশ আইনের বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার বিষয় উত্থাপিত হয়। বলা হয়, এটা ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে। আনুষ্ঠানিক সভায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ ধরনের শব্দ সৌজন্যবিবর্জিত। মন্ত্রণালয়ে অনিষ্পন্ন নথির বিষয়ে পৃথক পুলিশ বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। প্রথমোক্ত বিষয়ে বলা যায়, বিষয়টি কয়েক বছর ধরেই বহুল আলোচিত। অনেকের মতে, সরকারি যেকোনো বিভাগকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দেওয়ার নজির কোনো দেশেই নেই; বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সংসদে মন্ত্রীকেই নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হয়। অনেকের মতে, যে খসড়া আইন করা হয়েছে, তার ফলে জবাবদিহির বিষয়টি বিলীন হয়ে যাবে। শেষোক্ত বিষয়ে বলা যায়, কোনো বিভাগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট যুক্তি প্রয়োজন। বক্তব্যে এমন কোনো যুক্তি দেখানো হয়নি; একবাক্যে শুধু অনিষ্পন্ন নথির কথা বলা হয়েছে। এটাই কি যথেষ্ট?
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেছেন। বিষয়টি বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়। সার্বিকভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, দপ্তরপ্রধান বা তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অধীন অন্য কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে ক্ষমতাবান। যে বিষয়ে ক্ষমতাবান, সেই কর্মকর্তাই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ ক্ষমতা ডিআইজিদের অর্পণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। শুধু ডিআইজি কেন, পুলিশ সুপারের ক্ষেত্রেও এটা প্রয়োজন। এক জেলার পুলিশ সুপার তাঁর জেলায় র্যাবের সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করায় সৃষ্ট অসুবিধার কথা বলেছেন, যা উপস্থিত র্যাবের প্রতিনিধি খণ্ডন করেছেন।
এ বিষয়টিই হলো মাঠ প্রশাসনের বৃহত্তর চিত্র। সমন্বয়হীনতা জনস্বার্থের পরিপন্থী। সরকারের সব বিভাগই যদি একে অন্যের সঙ্গে সার্বিক সরকারি কর্মকাণ্ড সমন্বিতভাবে সম্পাদন না করে, তাহলে জনমানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সম্পদেরও অপচয় হবে; বিশেষ করে র্যাব ও পুলিশের মধ্যে যদি সমন্বয়ের অভাব থাকে। অন্য একটি বিষয় হলো, পুলিশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। সম্প্রতি টিআইবির এক জরিপে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই দুর্নীতি অপেক্ষাকৃত বেশি। দোষত্রুটির বিষয়টি সঠিক হলে তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments