বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-কর্মক্ষম জনশক্তি কর্মহীন by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে কত, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি, তা অসমর্থিত সূত্রে প্রকাশ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। নিকট-অতীতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর 'কর্মসংস্থান তদারকি জরিপ'-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মোট শ্রমশক্তির ৫ শতাংশ বেকার অর্থাৎ কর্মহীন।
ধারণা করা হচ্ছে, যদি এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-নিরক্ষর কর্মক্ষম মানুষের বর্ধিত সংখ্যা বেকারের তালিকা আরো অনেক স্ফীত করবে। একটি দেশের মানবসম্পদের এমন অপচয়, তা উন্নয়ন-অগ্রগতির বড় অন্তরায়। যেকোনো দেশে মানুষই বড় সম্পদ। মানুষের শ্রমে-ঘামে, বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণীর মেধা-মননে, পরিকল্পনা-উদ্যোগে একটি দেশ ও জাতি দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের জনশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষিত, অথচ কর্মহীন! বেকারত্বের ঢেউ কোন পর্যায়ে ঠেকেছে, তা অনুসন্ধান করলে কূলকিনারা পাওয়া মুশকিল। এই যে কর্মক্ষম জনশক্তি কর্মহীন, তা নিঃসন্দেহে জাতির মহার্ঘ অপচয়_এ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক পরিসংখ্যান চিত্র থেকে জানা গেছে, গোটা বিশ্বে বেকারের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। এই বেকারের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের বাসিন্দা। উন্নত বিশ্বেও বেকার আছে। কোথাও বেকার ভাতা প্রথা চালু আছে। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা যে অনেক স্ফীত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বেকারদের একটা অংশ অপরাধজগতে নাম লিখিয়েছে এবং বড় অংশটা বেকারত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। যে দেশের শিক্ষিতদের অবস্থা এই এবং যারা দেশের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না, সে দেশের উন্নতি-অগ্রগতির আশা করা দুরাশারই নামান্তর। এই পরিস্থিতিকে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতার ফল এবং তা নতুন কিছু নয় কিংবা সাম্প্রতিক সৃষ্ট চিত্রও নয়। মহাজোট সরকার কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ ইতিমধ্যে নিয়েছে বটে, কিন্তু তাও সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে পরিবারপিছু একজনকে কর্মে যুক্ত করার সরকারের নতুন উদ্যোগ ক্ষীণ হলেও শুভ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ বলা যায়। তবে ইতিমধ্যে এ নিয়েও কিছু অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে এবং এর পেছনে মুখ্যত স্থানীয় ক্ষমতাবানদের (যারা ক্ষমতাসীনদের কাছঘেঁষা বলে পরিচিত) নেতিবাচক ভূমিকা দায়ী। ক্ষমতার এই কুমিররা যা পায় তা-ই খায়, এও বাংলাদেশের পুরনো চিত্র। সরকার কি এই জটাজাল ছিন্ন করতে পারবে?
২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই বাজেটে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্য খাতে। সন্দেহ নেই, প্রস্তাবটি ছিল উত্তম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের ওই সদিচ্ছার কি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে? চাটার কিংবা লুটেপুটে খাওয়ার দল কিন্তু সব সময়ই ওত পেতে থাকে সম্ভাবনার গলা টিপে ধরতে। সব গিলে ফেলতে তারা থাকে অধিক তৎপর। দেশের শ্রমবাজারে যে হারে কর্মী প্রবেশ করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কম হারে কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে_এ চিত্রও নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি চিত্র, যা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দাগটি সংগতই আরো মোটা করেছে। ভিন্ন এক পরিসংখ্যানে জানা গেল, গত পাঁচ বছরে দেশে বেকার ও অর্ধবেকারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি আছে। দেশে নারীর কর্মসংস্থানের বড় একটি ক্ষেত্র তৈরি পোশাক শিল্প খাত। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও খাতটি রয়েছে বিশেষ অবস্থানে। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে এই খাতের অগ্রগতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর পেছনে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিও বেশ খানিকটা দায়ী। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে সম্প্রতি পুরুষকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকেনি। এর আগে দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো একটি বিশেষ ভূমিকা রাখলেও একপর্যায়ে তা অনেকটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। মৌলবাদীদের অপতৎপরতার কারণে তারাও হাত গোটাতে বসেছিল। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োগ দেওয়া হলেও এর বেশির ভাগই দলীয় বিবেচনায় হয়েছে_এমন অভিযোগ রয়েছে। স্থগিত করে পুনর্নিয়োগদানের নাটকও ওই সরকারের আমলে হয়েছে। অব্যাহত দলীয়করণের কারণে জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে ওঠেনি এবং এর বিরূপ প্রভাব অন্যদিকেও ধাক্কা দিয়েছিল। বেসরকারি খাত অসহযোগিতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন বিস্ময়করভাবে 'চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ' বৃদ্ধি পায় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। একপর্যায়ে সরকারি কর্মক্ষেত্রে তারা নিয়োগ স্থগিত রেখেছিল, কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। আমাদের মনে হচ্ছে, ওই সরকার রাজস্ব ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও বিদায়ের আগ পর্যন্ত তারা এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। ওই সময় এ খাতে বরাদ্দের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং এর ঠিক বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে উন্নয়ন খাতে।
আংশিক বেকার, প্রচ্ছন্ন বেকার, নিরক্ষর বেকার আর শিক্ষিত বেকারের এই সমাবেশে চাকরি বা কাজের সংস্থান যে কতটা জরুরি, তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে সব সরকারই কৃষি ও শিল্প খাতে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করত। কিন্তু তা হয়নি। অন্যদিকে রুগ্ণ শিল্পের তালিকাও কম স্ফীত নয়। যুবকদের কর্মতৎপরতায় যুক্ত করার উদ্দেশ্যে স্থাপিত কর্মসংস্থান ব্যাংকের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ। সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অবকাশ থাকলেও নানা কারণে তা আশানুরূপ হয়নি। তবে এ খাতে তুলনামূলকভাবে উন্নতি কম হলেও হয়েছে। গ্যাস, কয়লাভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পথ যেখানে অনেকটাই সুগম করা যেত, তাও সম্ভব হয়নি। কোটি কোটি শিক্ষিত ও নিরক্ষর বেকারের দেশে প্রতিবছর ৫০-৬০ হাজার কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি মুষ্টিভিক্ষার মতোই। নগর নয়, শিক্ষিত ও নিরক্ষর বেকারের বেশির ভাগের বেকারত্ব ঘোচানোর উপযুক্ত জায়গা যে গ্রাম, সেই গ্রাম তো বরাবরই চরম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। দক্ষ, অদক্ষ, আধাদক্ষ বিপুলসংখ্যক মানবসম্পদকে কর্মযুক্ত করার পরিকল্পনা এ কারণেই আশানুরূপ ফল দিচ্ছে না। পূর্ববর্তী দুটি সরকারের আমলে বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল এবং নতুন শ্রমবাজার সন্ধানেও তাদের কোনো সাফল্য ছিল না। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, বিদেশে শ্রমিকদের বিক্ষোভ-আন্দোলন, অবৈধ বসবাস, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে বিদায়ী চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে জনশক্তি রপ্তানির আয় হ্রাস পায়। তা ছাড়া দেশে তখন উগ্র জঙ্গিবাদীদের অব্যাহত সন্ত্রাসও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় সম্ভাবনাময় জীবনগুলো সমুদ্র, মরু ও তুষারাবৃত পথে ভাগ্যোন্নয়নে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনো অনেকেই বিদেশের কারাগারে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। দলে দলে দেশে ফেরত আসার ঘটনাও ঘটছে। মহাজোট সরকার এই চিত্র পাল্টানোর চেষ্টা চালালেও এখন পর্যন্ত সুফল তেমন মেলেনি। এ অবস্থায় দরকার দেশে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কৃষিশিল্প ও সেবা খাতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কারণ কর্মসংস্থানে এই খাতগুলোর সুযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে এই রূপান্তর যে অত্যন্ত জরুরি, এর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
ইতিমধ্যে বহুবার মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর উচ্চারণসর্বস্ব গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের অমিত শক্তি কাজে লাগানোর পথ ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করা হয়নি। দুনিয়ার ইতিহাসে, এমনকি সমকালীন বিশ্বেও এমন কোনো কোনো দেশ রয়েছে, যারা কেবল শ্রম ও দক্ষতার দ্বারা অগ্রগতির পথ সুপ্রশস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সেসব দেশের সরকার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে বলেই কাজটা সম্ভব হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, স্বল্পোন্নত তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে একটি বড় বাধা বেকারত্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ থেকে উত্তরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য দরকার কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা করা। কিন্তু এর নামেও আমরা অতীতে দেখেছি নিজেদের উদরপূর্তির মহড়া। প্রচলিত তাত্তি্বক শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা খাতে গুরুত্ব প্রদানের ওপর নানা মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরে জোর দেওয়া হলেও তা থেকে গেছে উপেক্ষিত। বিশ্বায়নের এই যুগে যখন বিশ্বব্যাপী চলছে 'গ্লোবাল ভিলেজ কনসেপ্ট', তখন দক্ষ মানবসম্পদের জন্য নিজেদের দেশের বাইরেও কাজের সুযোগ বিদ্যমান_এ কথাটি আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা যে বোঝেন না, তা কিন্তু নয়। সমস্যা হলো সদিচ্ছার বড় অভাব।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক সীমারেখা অনুপাতে বিশ্বের অন্যতম অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭৫০ জন মানুষ বাস করে। কিন্তু কাজ নেই! সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থানের বাইরেও আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষকে কর্মযুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং এর ক্ষেত্র বিস্তৃত। আগেই বলেছি, কৃষিক্ষেত্র ও শ্রমঘন সেবা খাতগুলো এর বড় ক্ষেত্র। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বড় সমস্যার সমাধান করতে হলে যে পথে হাঁটতে হয়, এ থেকে অতীতে দেশের নীতিনির্ধারকদের অবস্থানের যোজন যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এখনো এর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমনটি যেখানে বিদ্যমান, সেখানে মানবসম্পদের উন্নয়ন কিংবা কর্মসংস্থানের মতো দেশ-জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোর স্পর্শ পাবে কী করে? আগামী অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৯.৫ শতাংশকে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার সরকারের তরফে মিলেছে। গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গত বছরের তুলনায় আগামী বছরে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বেশি করা হবে। দেখা যাক, অঙ্গীকারের কতটা মূল্য দেওয়া হয়।
সনাতনি সংজ্ঞায় যাদের 'অর্ধবেকার' বলা হচ্ছে, তাদেরও একটি বড় অংশ প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ বেকার। এই চিত্র দূর করতে হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ধারণা কার্যকর করে তুলতে হবে। ফলে একদিকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে এবং অন্যদিকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, রেমিট্যান্সের প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীও সময় নিয়ে কাজ খুঁজতে পারবে। একই সঙ্গে জন্মহার হ্রাসকরণের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অবশ্যই জোর দিতে হবে সেই সব সেবা খাতে, যেগুলো শ্রমঘন। গ্রামের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং কর্মপরিকল্পনার বড় অংশে গ্রামকেই রাখতে হবে। বিশাল এই বেকার ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই উজ্জীবিত রাখতে হবে_এটি সরকারের দায়িত্বশীলরা যত দ্রুত গভীরভাবে অনুধাবন করবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক পরিসংখ্যান চিত্র থেকে জানা গেছে, গোটা বিশ্বে বেকারের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। এই বেকারের বেশির ভাগই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের বাসিন্দা। উন্নত বিশ্বেও বেকার আছে। কোথাও বেকার ভাতা প্রথা চালু আছে। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা যে অনেক স্ফীত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বেকারদের একটা অংশ অপরাধজগতে নাম লিখিয়েছে এবং বড় অংশটা বেকারত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। যে দেশের শিক্ষিতদের অবস্থা এই এবং যারা দেশের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না, সে দেশের উন্নতি-অগ্রগতির আশা করা দুরাশারই নামান্তর। এই পরিস্থিতিকে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতার ফল এবং তা নতুন কিছু নয় কিংবা সাম্প্রতিক সৃষ্ট চিত্রও নয়। মহাজোট সরকার কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ ইতিমধ্যে নিয়েছে বটে, কিন্তু তাও সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে পরিবারপিছু একজনকে কর্মে যুক্ত করার সরকারের নতুন উদ্যোগ ক্ষীণ হলেও শুভ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ বলা যায়। তবে ইতিমধ্যে এ নিয়েও কিছু অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে এবং এর পেছনে মুখ্যত স্থানীয় ক্ষমতাবানদের (যারা ক্ষমতাসীনদের কাছঘেঁষা বলে পরিচিত) নেতিবাচক ভূমিকা দায়ী। ক্ষমতার এই কুমিররা যা পায় তা-ই খায়, এও বাংলাদেশের পুরনো চিত্র। সরকার কি এই জটাজাল ছিন্ন করতে পারবে?
২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই বাজেটে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্য খাতে। সন্দেহ নেই, প্রস্তাবটি ছিল উত্তম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের ওই সদিচ্ছার কি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে? চাটার কিংবা লুটেপুটে খাওয়ার দল কিন্তু সব সময়ই ওত পেতে থাকে সম্ভাবনার গলা টিপে ধরতে। সব গিলে ফেলতে তারা থাকে অধিক তৎপর। দেশের শ্রমবাজারে যে হারে কর্মী প্রবেশ করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কম হারে কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে_এ চিত্রও নতুন কিছু নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি চিত্র, যা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দাগটি সংগতই আরো মোটা করেছে। ভিন্ন এক পরিসংখ্যানে জানা গেল, গত পাঁচ বছরে দেশে বেকার ও অর্ধবেকারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি আছে। দেশে নারীর কর্মসংস্থানের বড় একটি ক্ষেত্র তৈরি পোশাক শিল্প খাত। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও খাতটি রয়েছে বিশেষ অবস্থানে। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে এই খাতের অগ্রগতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর পেছনে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিও বেশ খানিকটা দায়ী। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে সম্প্রতি পুরুষকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকেনি। এর আগে দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো একটি বিশেষ ভূমিকা রাখলেও একপর্যায়ে তা অনেকটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। মৌলবাদীদের অপতৎপরতার কারণে তারাও হাত গোটাতে বসেছিল। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োগ দেওয়া হলেও এর বেশির ভাগই দলীয় বিবেচনায় হয়েছে_এমন অভিযোগ রয়েছে। স্থগিত করে পুনর্নিয়োগদানের নাটকও ওই সরকারের আমলে হয়েছে। অব্যাহত দলীয়করণের কারণে জনকল্যাণমুখী প্রশাসন গড়ে ওঠেনি এবং এর বিরূপ প্রভাব অন্যদিকেও ধাক্কা দিয়েছিল। বেসরকারি খাত অসহযোগিতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন বিস্ময়করভাবে 'চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ' বৃদ্ধি পায় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। একপর্যায়ে সরকারি কর্মক্ষেত্রে তারা নিয়োগ স্থগিত রেখেছিল, কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। আমাদের মনে হচ্ছে, ওই সরকার রাজস্ব ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও বিদায়ের আগ পর্যন্ত তারা এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। ওই সময় এ খাতে বরাদ্দের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং এর ঠিক বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে উন্নয়ন খাতে।
আংশিক বেকার, প্রচ্ছন্ন বেকার, নিরক্ষর বেকার আর শিক্ষিত বেকারের এই সমাবেশে চাকরি বা কাজের সংস্থান যে কতটা জরুরি, তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে সব সরকারই কৃষি ও শিল্প খাতে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করত। কিন্তু তা হয়নি। অন্যদিকে রুগ্ণ শিল্পের তালিকাও কম স্ফীত নয়। যুবকদের কর্মতৎপরতায় যুক্ত করার উদ্দেশ্যে স্থাপিত কর্মসংস্থান ব্যাংকের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ। সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অবকাশ থাকলেও নানা কারণে তা আশানুরূপ হয়নি। তবে এ খাতে তুলনামূলকভাবে উন্নতি কম হলেও হয়েছে। গ্যাস, কয়লাভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পথ যেখানে অনেকটাই সুগম করা যেত, তাও সম্ভব হয়নি। কোটি কোটি শিক্ষিত ও নিরক্ষর বেকারের দেশে প্রতিবছর ৫০-৬০ হাজার কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়টি মুষ্টিভিক্ষার মতোই। নগর নয়, শিক্ষিত ও নিরক্ষর বেকারের বেশির ভাগের বেকারত্ব ঘোচানোর উপযুক্ত জায়গা যে গ্রাম, সেই গ্রাম তো বরাবরই চরম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। দক্ষ, অদক্ষ, আধাদক্ষ বিপুলসংখ্যক মানবসম্পদকে কর্মযুক্ত করার পরিকল্পনা এ কারণেই আশানুরূপ ফল দিচ্ছে না। পূর্ববর্তী দুটি সরকারের আমলে বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল এবং নতুন শ্রমবাজার সন্ধানেও তাদের কোনো সাফল্য ছিল না। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, বিদেশে শ্রমিকদের বিক্ষোভ-আন্দোলন, অবৈধ বসবাস, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে বিদায়ী চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে জনশক্তি রপ্তানির আয় হ্রাস পায়। তা ছাড়া দেশে তখন উগ্র জঙ্গিবাদীদের অব্যাহত সন্ত্রাসও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় সম্ভাবনাময় জীবনগুলো সমুদ্র, মরু ও তুষারাবৃত পথে ভাগ্যোন্নয়নে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনো অনেকেই বিদেশের কারাগারে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। দলে দলে দেশে ফেরত আসার ঘটনাও ঘটছে। মহাজোট সরকার এই চিত্র পাল্টানোর চেষ্টা চালালেও এখন পর্যন্ত সুফল তেমন মেলেনি। এ অবস্থায় দরকার দেশে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কৃষিশিল্প ও সেবা খাতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কারণ কর্মসংস্থানে এই খাতগুলোর সুযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে এই রূপান্তর যে অত্যন্ত জরুরি, এর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
ইতিমধ্যে বহুবার মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর উচ্চারণসর্বস্ব গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের অমিত শক্তি কাজে লাগানোর পথ ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করা হয়নি। দুনিয়ার ইতিহাসে, এমনকি সমকালীন বিশ্বেও এমন কোনো কোনো দেশ রয়েছে, যারা কেবল শ্রম ও দক্ষতার দ্বারা অগ্রগতির পথ সুপ্রশস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সেসব দেশের সরকার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে বলেই কাজটা সম্ভব হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, স্বল্পোন্নত তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে একটি বড় বাধা বেকারত্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ থেকে উত্তরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য দরকার কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা করা। কিন্তু এর নামেও আমরা অতীতে দেখেছি নিজেদের উদরপূর্তির মহড়া। প্রচলিত তাত্তি্বক শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা খাতে গুরুত্ব প্রদানের ওপর নানা মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরে জোর দেওয়া হলেও তা থেকে গেছে উপেক্ষিত। বিশ্বায়নের এই যুগে যখন বিশ্বব্যাপী চলছে 'গ্লোবাল ভিলেজ কনসেপ্ট', তখন দক্ষ মানবসম্পদের জন্য নিজেদের দেশের বাইরেও কাজের সুযোগ বিদ্যমান_এ কথাটি আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা যে বোঝেন না, তা কিন্তু নয়। সমস্যা হলো সদিচ্ছার বড় অভাব।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক সীমারেখা অনুপাতে বিশ্বের অন্যতম অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭৫০ জন মানুষ বাস করে। কিন্তু কাজ নেই! সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থানের বাইরেও আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষকে কর্মযুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং এর ক্ষেত্র বিস্তৃত। আগেই বলেছি, কৃষিক্ষেত্র ও শ্রমঘন সেবা খাতগুলো এর বড় ক্ষেত্র। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বড় সমস্যার সমাধান করতে হলে যে পথে হাঁটতে হয়, এ থেকে অতীতে দেশের নীতিনির্ধারকদের অবস্থানের যোজন যোজন দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এখনো এর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমনটি যেখানে বিদ্যমান, সেখানে মানবসম্পদের উন্নয়ন কিংবা কর্মসংস্থানের মতো দেশ-জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোর স্পর্শ পাবে কী করে? আগামী অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৯.৫ শতাংশকে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার সরকারের তরফে মিলেছে। গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গত বছরের তুলনায় আগামী বছরে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বেশি করা হবে। দেখা যাক, অঙ্গীকারের কতটা মূল্য দেওয়া হয়।
সনাতনি সংজ্ঞায় যাদের 'অর্ধবেকার' বলা হচ্ছে, তাদেরও একটি বড় অংশ প্রকৃতপক্ষে পূর্ণ বেকার। এই চিত্র দূর করতে হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ধারণা কার্যকর করে তুলতে হবে। ফলে একদিকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে এবং অন্যদিকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, রেমিট্যান্সের প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীও সময় নিয়ে কাজ খুঁজতে পারবে। একই সঙ্গে জন্মহার হ্রাসকরণের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অবশ্যই জোর দিতে হবে সেই সব সেবা খাতে, যেগুলো শ্রমঘন। গ্রামের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং কর্মপরিকল্পনার বড় অংশে গ্রামকেই রাখতে হবে। বিশাল এই বেকার ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমেই উজ্জীবিত রাখতে হবে_এটি সরকারের দায়িত্বশীলরা যত দ্রুত গভীরভাবে অনুধাবন করবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments