গোলাম আযমের গ্রেপ্তার এবং প্রকৃত বিচার by ডা. এম এ হাসান

নানা প্রতিকূলতা, ব্যর্থতা এবং বহুমুখী দুর্বলতা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমকে কারারুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছেন। এতে পুরো জাতি আনন্দিত। তবে ঠিক এ মুহূর্তে উল্লসিত হওয়ার মতো এমনকিছুঘটেনি।অপরাধীর বিচার এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা একটি সভ্য সমাজের স্বাভাবিক গতিধারার অংশ।


বিচার অপরাধীকেও সুযোগ করে দেয় আত্মপক্ষ সমর্থনের এবং অপরাধ স্বীকার করে নিজেকে মুক্ত মানুষে পরিণত করার। সভ্য সমাজে বিচার মানে কাউকে পুড়িয়ে হত্যা বা চরম প্রতিহিংসায় ক্রুশবিদ্ধ করা নয়। এ জাতীয় মাইন্ডসেট বা বিচারের নামে নির্যাতন বা নৃশংস হত্যা বা এমন বাসনা বর্বরতার নামান্তর। এটাও বিচারযোগ্য অপরাধ। যেমন হয়েছে লিবিয়ার গাদ্দাফির ক্ষেত্রে। বিচার হতে হবে অপরাধের। বিচার চালিত হবে আইন অনুসরণ করে। অপরাধী তার যোগ্য শাস্তি পাবে এবং তাকে সে শাস্তি মেনে নিতে হবে মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই। এখানে মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ড মুখ্য বিষয় নয়। সমাজে ন্যায় ও অন্যায়বোধের জাগরণ এবং মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই মুখ্য বিষয়। স্থিরচিত্তে শাস্তি মানার মধ্যেও যেমন মর্যাদা রয়েছে, তেমনি অপরাধের সংশোধন বা অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধের মধ্যে সভ্যতার আকাঙ্ক্ষা নিহিত রয়েছে। প্রতিহিংসা, অপরাধীর প্রতি ক্রোধ বা দুর্বলতা_কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত নয়। অনুকম্পা বা পড়সঢ়ধংংরড়হ সভ্যতার অনুষঙ্গ। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল মুখ্য অপরাধী। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অপরাধকর্ম আদালতে নথিবদ্ধ না হলে কিংবা তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন না করা গেলে ন্যায় ও সত্য অধরা থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে অনুকম্পা বা উদ্যোগের অভাব বিচারহীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করবে। এতে পাকিস্তান ও তাদের অনুসারীরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে যে তারা তেমন কোনো অপরাধ করেনি। যা কিছু অপরাধ করছে তা কেবল বাঙালি দোসররা। বিদ্রোহ করেছিল ওই বাঙালিরা, তারাই সহিংসতায় মেতেছিল। গত ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালে শর্মিলা বোস বিবিসির সংবাদে এমন কিছু বলেছিলেন। যেন এ বিচারে পাকিস্তান ধোয়া তুলসী পাতা। এই ভয়াবহ মিথ্যাচার এবং বিচারহীনতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বর্তমান ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে বিচারকে তৃণমূল পর্যায়ে নিতে হবে। এর মানে এই নয় যে জামায়াত বা অন্যান্য দলের সদস্যসহ নানা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যাসহ নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞে উন্মাদ হয়েছিল তারা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে। তবে বিচারের মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। সংঘাত ও আত্মপরিচয়ের সংকটে নিমজ্জিত জাতিকে পথ দেখানো। কেবল আবেগ ও শক্তিতে সব কিছু সম্পাদন করা যায় না, গালভরা কথা বলে মেঠো বক্তৃতা দেওয়া যায়, টেবিল উত্তপ্ত করা যায়; আসল কাজটি করা যায় না। কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয়। বিচারের লক্ষ্য অনুধাবনের জন্য এক স্তরের বুদ্ধি ও বোধ প্রয়োজন। এ কথা সত্য যে গোলাম আযম পাকিস্তানি সেনাপ্রধান টিক্কা ও নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন এবং জনবল দিয়ে সাহায্য করেছেন। তথাকথিত দুষ্কৃতকারী নামধারী বাঙালি নিধনে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধকর্ম সাধনে তিনি একজন প্রধান সংগঠক তথা উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া, টিক্কা গংয়ের কাছে অস্ত্র চেয়েছেন তাঁর দলীয় লোকদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করতে। তিনি নানা প্রক্রিয়ায় তাঁর দলীয় শত্রুসহ বাঙালি নিধনে সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। এর সাক্ষী ও প্রমাণ রয়েছে নানা স্তরে। কেবল গোলাম আযম নয়, তার যোগ্য সাথি মাওলানা আবদুস সোবহান, এ বি এম খালেক মজুমদার, এ এস এম সোলায়মান, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, আলবদর মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মাঈনউদ্দিন, মহিউদ্দিন, ইমরান, কামরান, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ফিদাউল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম, আবু নসর ফারুকি, ইকরামুল হক, হুসাইন খান, মাইনুর রহমান, আবদুল জব্বার, ইসলাম উদ্দীন, নাজমুস সাকিব, জয়নাল, শাহজাহান চৌধুরী, মোজ্জামেল চৌধুরী, প্রফেসর আবদুস সাত্তার, মতিউর রহমান (মতি চেয়ারম্যান), অ্যাডভোকেট হাবীবুর রহমান, জয়নাল আবেদীন মুক্তার, কামাল টাইপিস্ট, অ্যাডভোকেট শামসুল হুদা, আলী আজম মাস্টার, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আবদুল আলীম, মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, মোহাম্মদ আয়েন-উদ-দীন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কাউন্সিলর মুসলিম লীগের মাওলানা ফরিদ উদ্দিন, রাজাকার ফজলুর রহমান সুলতান, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, রজব আলী, রিয়াসত আলী, কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী (সিলেটি), মাওলানা আতাউর রহমান খানসহ ৭৯ জন ভয়ংকর ঘাতক বিহারি, ৩৬৯ জন পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে অবর্ণনীয় নৃশংসতা এবং অসংখ্য অপরাধের প্রমাণ রয়েছে। এদের বিচার ছাড়া সামগ্রিক বিচার প্রহসন হিসেবে রয়ে যাবে।
যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি অফিসার জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল নজর হোসেন শাহ, জেনারেল এ ও মিঠ্ঠা খান, জেনারেল গুল হাসান, মেজর জেনারেল ওমর, জেনারেল এসজিএম পীরজাদা, লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান, মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা, ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হোসেন আনসারী, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ, মেজর জেনারেল এম রহিম খান, ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির খান, ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদ, লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজ, ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা, ব্রিগেডিয়ার মনজুর হোসেন আতিফ, ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ আসলাম নিয়াজি, ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ শফি, ব্রিগেডিয়ার সাদ উল্লাহ খান এস কে, ব্রিগেডিয়ার আতাউল্লাহ খান, ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, ব্রিগেডিয়ার আই আর শরীফ, কর্নেল আতিক মালিক, কর্নেল হেজাজী, লে. কর্নেল ফাতেমী, লে. কর্নেল মোহাম্মদ আকবর, লে. কর্নেল রিয়াজ হোসেন জাভেদ, লে. কর্নেল এস এফ এইচ রিজভী, লে. কর্নেল এস এফ এইচ বোখারী, মেজর আতা মোহাম্মদ, মেজর এ এস পি কোয়ায়েশী, মেজর আশফাক আহমেদ চীমা, মেজর আবদুল হামিদ খটক, মেজর গোলাম মোহাম্মদ, মেজর খিজার হায়াৎ, মেজর মাদাদ হোসেন শাহ, মেজর মোহাম্মদ ইফতিখার খান, মেজর মোহাম্মদ জুলফিকার রাঠোর, মেজর এস এম এইচ এস বোখারী, মেজর জেড খান, মেজর আসলাম, মেজর উইলিয়াম, মেজর শের খান, মেজর তহসীন মির্জা, মেজর নিসার আহমেদ খান শেরওয়ানী, মেজর নাদের পারভেজ খান, ক্যাপ্টেন ইফতেখার আহমেদ গোন্দাল, ক্যাপ্টেন ইকবাল শাহ, ক্যাপ্টেন মোজাফফর হোসেন নাকভী, ক্যাপ্টেন এজাজ, ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ খান, ক্যাপ্টেন কার্নি, ক্যাপ্টেন তাহের, লেফটেন্যান্ট তারিক, লেফটেন্যান্ট নেওয়াজ রিজভী, সুবেদার হানিফ, সুবেদার ফয়েজ সুলতান, সুবেদার আকরাম খান, সুবেদার মোস্তফা খান, সুবেদার শের শাহ খান, সুবেদার সিদ্দিক, হাবিলদার এনায়েত খান, হাবিলদার আলাউদ্দিন, সেপাই আবদুর রহিম, স্কোয়াড্রন লিডার ওয়াহিদ, রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরীফ, লে. কমোডর এ এ খান, কমোডর ইকরামুল হক মালিক, কমান্ডার খতিব মাসুদ হোসেন, নেভাল কমান্ডার গুলজারিন প্রমুখ পাকিস্তানি নরপশুর বিচার ছাড়া বিচারহীনতার নেতিবাচক প্রক্রিয়া কেবল উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বকে কলুষিত করবে। এ থেকে পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকদের কেউই পরিত্রাণ পাবে না।
লেখক : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.