গিলগামেশ-৪ by মুহম্মদ নূরুল হুদা
দশম ট্যাবলেটে আছে যাত্রাপথে এক পানশালায় সুন্দরী সিদুরির সঙ্গে গিলগামেশের সাক্ষাতের কথা। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারা দু’জন পথসঙ্গী হয়ে যায়। গিলগামেশ তার গন্তব্যে যাওয়ার দৃঢ়তার কথা বলে। শুনে আঁেক ওঠে সিদুরি। না, মৃত্যুঞ্জয় উত্নাপিশটিমের কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই কোনো মর্ত্যমানবের।
গিলগামেশ দমে যাওয়ার পাত্র নয়। এই এতদূর এসে শেষটা সে দেখে ছাড়বেই। যা হোক, উত্নাপিশটিমের কাছে যেতে হলে পার হতে হবে এক আজব দরিয়া। ঘাট পারাপারের জন্য সেখানে আছে এক মাঝি। মাঝির নাম উরশানবি। তার চারপাশে আছে যত্তসব পাথুরে দৈত্য। দৈত্যরা সব যেমন কদাকার, তেমনি শত্রুভাবাপন্ন। ওরা তেড়ে আসতে চায় তার দিকে। মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না গিলগামেশ। একে একে সব দৈত্য মারা পড়ে তার হাতে। তারপর উরশানবির কাছে গিয়ে তার গন্তব্যের কথা বলে।
উরশানবি কেমন যেন রহস্যের হাসি হাসে। বলে, যাদের তুমি শত্রু ভেবে হত্যা করেছ, তারাই তো হতে পারত তোমার বড় বন্ধু। তারাই তোমাকে পার করে দিতে পারত এই আজব দরিয়া। এই দরিয়ার আরেক নাম মরণদরিয়া। তার জল স্পর্শ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু। এমনকি সেই জলের উপর দিয়ে হাতটা উড়িয়ে নিলেও মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উরশানবি তখন তাকে আরেক বুদ্ধি বাতলে দিল। মরণদরিয়া পার হতে হলে তাকে তার ওপর দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ভেসে যেতে হবে। তার জন্য তাকে কাটতে হবে ১২০টি শক্ত গাছ। প্রতিটি গাছকে নৌকার লগির মতো ব্যবহার করতে হবে। আর তার পরিধেয় বস্ত্রকে খাটাতে হবে পালের মতো। এক লগি ঠেলে পৌঁছতে হবে আরেক লগিতে। একবার এক লগিতে ঠেলা দিয়ে ধরতে হবে আরেক লগি। তখন তারা দু’জন মিলে এই পদ্ধতিতেই পার হলো মরণদরিয়া। তারপর পৌঁছে গেল উত্নাপিশটিমের দ্বীপ দিলমুনে। উত্নাপিশটিম জানতে চাইল তাদের আসার কারণ। গিলগামেশ সবিস্তারে বর্ণনা করল তার অভিযানের গল্প। সব শুনে বিরক্ত হলো সে। কিছুতেই একমত হতে পারল না গিলগামেশের সঙ্গে।
একাদশ ট্যাবলেটে কাহিনী শেষের দিকে মোড় নেয়। গিলগামেশ উত্নাপিশটিমের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। উত্নাপিশটিম তাকে আত্রাহাসিস তথা বানপুরাণের কথা বলে, মানব জাতির ভবিষ্যতের জন্য তার সীমাহীন ত্যাগ স্বীকারের কথা বলে। অমরত্বের সন্ধান দেয়ার আগে উত্নাপিশটিম গিলগামেশকে একটি শর্ত প্রদান করে। ছয়দিন ও সাত রাত তাকে একনাগাড়ে জেগে কাটাতে হবে। গিলগামেশ রাজি হয়। পরমুহূর্তে সে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে। সাতদিন পর জেগে ওঠে গিলগামেশ। উত্নাপিশটিম তাকে তার ব্যর্থতার জন্য চরমভাবে ভর্ত্সনা করে। তাকে উরুকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয়। নির্বাসনে পাঠায় তার পথপ্রদর্শক উরশানবিকে। তখন উত্নাপিশটিমের স্ত্রী তার উপর দয়াপরবশ হয়। উত্নাপিশটিম স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক করে, মানুষের অনন্ত যৌবন লাভের রহস্যের কথা সে জানাবে গিলগামেশকে। তবে সে পথও সুমসৃণ নয়। বেমান দরিয়ার অতলে আছে এক কাঁটাঅলা গুল্ম, যার সারাত্সার পান করলে মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারে। গিলগামেশকে সাগরের অতলে গিয়ে কুড়িয়ে আনতে হবে সেই লতাগুল্ম। রাজি হয়ে যায় রাজা। পায়ের সঙ্গে পাথর বেঁধে সে হেঁটে যেতে থাকে সাগরের তলদেশে। সেই গুল্মের মুখোমুখি হয়। তাকে পরম আদরে উপড়ে আনে শিকড়সুদ্ধ। তারপর উত্নাপিশটিম ও তার স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উরুকে ফিরে আসতে থাকে। পথের মধ্যে হঠাত্ তার সন্দেহ হয়, সে ঠিক গুল্মটি এনেছে কিনা। নিজে খাওয়ার আগে একজন বুড়ো মানুষকে কিঞ্চিত্ খাইয়ে দিলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। পথে এক হৃদে স্নান করার জন্য নেমে পড়ে। গুল্মটা রেখে যায় পাড়ে। পাশ দিয়েই যাচ্ছিল এক বুড়ো সাপ। সে এই অদ্ভুত গুল্মের ঘ্রাণ পেয়ে যায়। মুহূর্তেই পুরোটা গিলে ফেলে সে। তারপর ঘটে অদ্ভুত কাণ্ড। সাপের শরীর থেকে খসে পড়ে পুরনো খোলস। তরতাজা তরুণ শরীর নিয়ে সাপটি দ্রুত হারিয়ে যায় পাশের ঝোপে। অমরত্বকে জয় করার সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলে গিলগামেশ। কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালবেষ্টিত সুরক্ষিত স্বদেশ উরুকে ফিরে আসে রাজা।
দ্বাদশ ট্যাবলেটে আছে অন্য এক ঘটনা, যা মূল ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। হয়তো এটি লিখেছেন আরেক লেখক, তা-ও অনেক পরে। গিলগামেশ ও এনকিদু খেলছিল এক ধরনের পুতুল খেলা। হঠাত্ পুতুলগুলো তাদের হাত থেকে খসে পড়ে পাতালে ঢুকে যায়। এনকিদুও কালবিলম্ব না করে সেই পুতুল ফিরিয়ে আনার জন্য পাতালে নেমে যায়। নামার আগে অবশ্য গিলগামেশ তাকে পরামর্শ দেয়, পাতালে কী কী করা যাবে আর কী কী করা যাবে না। এনকিদু ভুল করে নিষিদ্ধ কাজগুলোই করে। তাই সে ফিরে আসতে পারে না। গিলগামেশ বন্ধুকে ফেরত পাওয়ার জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়। সব দেবতা রাজি না হলেও ইলা ও সামাশ তার প্রার্থনায় দয়াপরবশ হয়। সামাশ ভূপৃষ্ঠে একটা বিশাল ফাঁক তৈরি করে আর সেই ফাঁক দিয়ে এক লাফে উরুকে ফিরে আসে এনকিদু। খুশি হয় গিলগামেশ। তারপর বন্ধুর দিকে তাকায়। খানিকটা যেন অন্যরকম লাগে। এ কি স্বশরীরী এনকিদু, না তার প্রেতাত্মা? চোখ কচলায় গিলগামেশ। বার বার তাকায় বন্ধুর দিকে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে শেষ হয়েও শেষ হয় না গিলগামেশ রহস্য।
লেখক : কবি, প্রফেসর, কলামিস্ট; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব
উরশানবি কেমন যেন রহস্যের হাসি হাসে। বলে, যাদের তুমি শত্রু ভেবে হত্যা করেছ, তারাই তো হতে পারত তোমার বড় বন্ধু। তারাই তোমাকে পার করে দিতে পারত এই আজব দরিয়া। এই দরিয়ার আরেক নাম মরণদরিয়া। তার জল স্পর্শ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু। এমনকি সেই জলের উপর দিয়ে হাতটা উড়িয়ে নিলেও মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। উরশানবি তখন তাকে আরেক বুদ্ধি বাতলে দিল। মরণদরিয়া পার হতে হলে তাকে তার ওপর দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ভেসে যেতে হবে। তার জন্য তাকে কাটতে হবে ১২০টি শক্ত গাছ। প্রতিটি গাছকে নৌকার লগির মতো ব্যবহার করতে হবে। আর তার পরিধেয় বস্ত্রকে খাটাতে হবে পালের মতো। এক লগি ঠেলে পৌঁছতে হবে আরেক লগিতে। একবার এক লগিতে ঠেলা দিয়ে ধরতে হবে আরেক লগি। তখন তারা দু’জন মিলে এই পদ্ধতিতেই পার হলো মরণদরিয়া। তারপর পৌঁছে গেল উত্নাপিশটিমের দ্বীপ দিলমুনে। উত্নাপিশটিম জানতে চাইল তাদের আসার কারণ। গিলগামেশ সবিস্তারে বর্ণনা করল তার অভিযানের গল্প। সব শুনে বিরক্ত হলো সে। কিছুতেই একমত হতে পারল না গিলগামেশের সঙ্গে।
একাদশ ট্যাবলেটে কাহিনী শেষের দিকে মোড় নেয়। গিলগামেশ উত্নাপিশটিমের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। উত্নাপিশটিম তাকে আত্রাহাসিস তথা বানপুরাণের কথা বলে, মানব জাতির ভবিষ্যতের জন্য তার সীমাহীন ত্যাগ স্বীকারের কথা বলে। অমরত্বের সন্ধান দেয়ার আগে উত্নাপিশটিম গিলগামেশকে একটি শর্ত প্রদান করে। ছয়দিন ও সাত রাত তাকে একনাগাড়ে জেগে কাটাতে হবে। গিলগামেশ রাজি হয়। পরমুহূর্তে সে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে। সাতদিন পর জেগে ওঠে গিলগামেশ। উত্নাপিশটিম তাকে তার ব্যর্থতার জন্য চরমভাবে ভর্ত্সনা করে। তাকে উরুকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয়। নির্বাসনে পাঠায় তার পথপ্রদর্শক উরশানবিকে। তখন উত্নাপিশটিমের স্ত্রী তার উপর দয়াপরবশ হয়। উত্নাপিশটিম স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক করে, মানুষের অনন্ত যৌবন লাভের রহস্যের কথা সে জানাবে গিলগামেশকে। তবে সে পথও সুমসৃণ নয়। বেমান দরিয়ার অতলে আছে এক কাঁটাঅলা গুল্ম, যার সারাত্সার পান করলে মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারে। গিলগামেশকে সাগরের অতলে গিয়ে কুড়িয়ে আনতে হবে সেই লতাগুল্ম। রাজি হয়ে যায় রাজা। পায়ের সঙ্গে পাথর বেঁধে সে হেঁটে যেতে থাকে সাগরের তলদেশে। সেই গুল্মের মুখোমুখি হয়। তাকে পরম আদরে উপড়ে আনে শিকড়সুদ্ধ। তারপর উত্নাপিশটিম ও তার স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উরুকে ফিরে আসতে থাকে। পথের মধ্যে হঠাত্ তার সন্দেহ হয়, সে ঠিক গুল্মটি এনেছে কিনা। নিজে খাওয়ার আগে একজন বুড়ো মানুষকে কিঞ্চিত্ খাইয়ে দিলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। পথে এক হৃদে স্নান করার জন্য নেমে পড়ে। গুল্মটা রেখে যায় পাড়ে। পাশ দিয়েই যাচ্ছিল এক বুড়ো সাপ। সে এই অদ্ভুত গুল্মের ঘ্রাণ পেয়ে যায়। মুহূর্তেই পুরোটা গিলে ফেলে সে। তারপর ঘটে অদ্ভুত কাণ্ড। সাপের শরীর থেকে খসে পড়ে পুরনো খোলস। তরতাজা তরুণ শরীর নিয়ে সাপটি দ্রুত হারিয়ে যায় পাশের ঝোপে। অমরত্বকে জয় করার সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলে গিলগামেশ। কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালবেষ্টিত সুরক্ষিত স্বদেশ উরুকে ফিরে আসে রাজা।
দ্বাদশ ট্যাবলেটে আছে অন্য এক ঘটনা, যা মূল ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। হয়তো এটি লিখেছেন আরেক লেখক, তা-ও অনেক পরে। গিলগামেশ ও এনকিদু খেলছিল এক ধরনের পুতুল খেলা। হঠাত্ পুতুলগুলো তাদের হাত থেকে খসে পড়ে পাতালে ঢুকে যায়। এনকিদুও কালবিলম্ব না করে সেই পুতুল ফিরিয়ে আনার জন্য পাতালে নেমে যায়। নামার আগে অবশ্য গিলগামেশ তাকে পরামর্শ দেয়, পাতালে কী কী করা যাবে আর কী কী করা যাবে না। এনকিদু ভুল করে নিষিদ্ধ কাজগুলোই করে। তাই সে ফিরে আসতে পারে না। গিলগামেশ বন্ধুকে ফেরত পাওয়ার জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়। সব দেবতা রাজি না হলেও ইলা ও সামাশ তার প্রার্থনায় দয়াপরবশ হয়। সামাশ ভূপৃষ্ঠে একটা বিশাল ফাঁক তৈরি করে আর সেই ফাঁক দিয়ে এক লাফে উরুকে ফিরে আসে এনকিদু। খুশি হয় গিলগামেশ। তারপর বন্ধুর দিকে তাকায়। খানিকটা যেন অন্যরকম লাগে। এ কি স্বশরীরী এনকিদু, না তার প্রেতাত্মা? চোখ কচলায় গিলগামেশ। বার বার তাকায় বন্ধুর দিকে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে শেষ হয়েও শেষ হয় না গিলগামেশ রহস্য।
লেখক : কবি, প্রফেসর, কলামিস্ট; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব
No comments