প্রস্তাবিত উড়ালসড়ক-সরকার জমি দিতে পারেনি, বিনিয়োগকারীর টাকা নেই by আনোয়ার হোসেন
প্রস্তাবিত ঢাকা উড়ালসড়ক নির্মাণে জট খুলছে না। প্রকল্পের জন্য সরকার এখনো সব জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পারেনি। ফলে এই সড়ক নির্মাণের কাজ আরও ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চলতি ১৯ জানুয়ারির মধ্যে উড়ালসড়কের (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। অর্থের সংস্থান ও জমি অধিগ্রহণ হয়নি বলে ১২ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত হয়, কাজ ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়া হবে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উড়ালসড়কের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত দীর্ঘ এই উড়ালসড়কটি বিদ্যমান রেললাইন ঘেঁষে হবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পরও সরকার ও বিনিয়োগকারী—দুই পক্ষ প্রস্তুতি শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) উড়ালসড়ক প্রকল্প নেওয়া হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের প্রায় আট হাজার ৭০৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। এ লক্ষ্যে থাইল্যান্ডভিত্তিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি চুক্তি হয়। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকার যানজট নিরসনে এই উড়ালসড়ক বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গত বছর ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উড়ালসড়ক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালসড়কের প্রথম পর্যায়ে কাজ হবে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে আট কিলোমিটার। কাজ শুরুর আগে এই অংশের প্রকল্প এলাকার জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা সেতু বিভাগের। কিন্তু কুড়িল ও নাখালপাড়ায় জমির মালিকেরা প্রতিবাদ করায় সেতু বিভাগ সেটি করতে পারেনি।
সড়কের দ্বিতীয় পর্বের কাজ হবে তেজগাঁও থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এই পর্বের জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে সেতু বিভাগ।
তৃতীয় পর্যায়ে কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ-ডেমরা সড়ক হয়ে কুতুবখালী গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিশবে উড়ালসড়ক। এই পর্বের পথ ঠিক করে কোথা থেকে, কী পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হবে, তার তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সায়েদাবাদ ও মানিকনগর এলাকায় প্রকল্পের জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে মালিকেরা কমিটি করে প্রতিবাদ শুরু করেছেন।
প্রকল্প সূত্র জানায়, উড়ালসড়কের এই তিন পর্যায়ের জন্য আলাদা করে সময় ও ব্যয় ধরা হয়নি। জমি অধিগ্রহণে জটিলতা এড়ানোর জন্য তিন পর্বে ভাগ করা হয়েছে প্রকল্পটি।
উড়ালসড়ক প্রকল্পের বেশির ভাগ ভূমিই সরকারি। প্রথম পর্বে সর্বোচ্চ ১৫ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর চূড়ান্ত তালিকা করা হচ্ছে। তবে জমি অধিগ্রহণের জন্য এখনো ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অর্থ বরাদ্দ করতে পারেনি সেতু বিভাগ।
এই পর্বে কুড়িলে সেনাবাহিনীর একটি পেট্রল পাম্প, বনানীতে সিনেমা হল, খেলার মাঠ ও শাহীনবাগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। এখনো এসব স্থাপনার জন্য সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি পড়বে তৃতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ কমলাপুর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত।
অর্থের সংস্থান: চুক্তি অনুযায়ী, উড়ালসেতু প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, এর ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগকারী এবং ২৭ শতাংশ সরকারের বহন করার কথা। বিনিয়োগকারীর ৭৩ শতাংশের মধ্যে ৩১ শতাংশ ইতাল-থাই কোম্পানির তাদের নিজস্ব উৎস থেকে জোগান দেওয়ার কথা আছে। বাকি ৪২ শতাংশ তাদের সুবিধামতো উৎস থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়ার কথা। চুক্তিতে বলা আছে, কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ৪২ শতাংশ অর্থ জোগাড় করা হয়েছে, তা প্রমাণপত্রসহ সেতু বিভাগে জমা দিতে হবে। কিন্তু কাজ শুরুর সময় পেরিয়ে গেলেও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ঋণ জোগাড় করতে পারেনি।
চুক্তিমতে, বাংলাদেশ সরকার ২৭ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে ছয় কিস্তিতে। অর্ধেক নির্মাণকালে এবং বাকি অর্ধেক নির্মাণ শেষে চালু হওয়ার পর। নির্মাণকালের প্রথম কিস্তি দেওয়ার কথা ৩০ শতাংশ কাজ হওয়ার পর।
জানতে চাইলে প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরুর জন্য যেসব পূর্বশর্ত পূরণ করার কথা, তা কেউ করতে পারেনি। তাই প্রকল্পটি সময়মতো শুরু ও শেষ করা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী সানোয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, সেতু বিভাগ ও বিনিয়োগকারী—দুই পক্ষেরই প্রস্তুতিতে কিছু ঘাটতি আছে। তাই ছয় মাস বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তিন মাসের মধ্যেই ভূমিসংক্রান্ত সমস্যা মিটে যাবে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও ছয় মাসের মধ্যে অর্থ জোগাড় করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে কাজ শুরু করতে কোনো সমস্যা হবে না।
রুট: উড়ালসড়কটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মগবাজার ও কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে কুতুবখালী গিয়ে শেষ হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে দুটি উড়াল সংযোগ সড়ক। এর একটি পলাশী থেকে কাঁটাবন ও সোনারগাঁও হোটেল হয়ে মগবাজার রেলক্রসিংয়ে গিয়ে উড়ালসড়কের সঙ্গে মিশবে। অন্যটি মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে ফার্মগেট হয়ে তেজগাঁও গিয়ে মূল উড়ালসড়কে যুক্ত হবে।
No comments