সেই আগুনের আকাঙ্ক্ষা
খেলার মাঠে আবাহনী-মোহামেডান প্রতিদ্বন্দ্বিতা উঠে গিয়েছিল ধ্রুপদি উচ্চতায়। কোথায়, কীভাবে হারিয়ে গেল সেই আগুন? লিখেছেন পবিত্র কুন্ডু আতাউর রহমানের চোখগুলো আগে জ্বলজ্বল করত। এখন ধূসর। আগে তারস্বরে চিৎকার করতেন। পুলিশ থাকত তটস্থ। এই বুঝি কোনো গালির গোলা এসে পড়ল।
প্রতিপক্ষের সমর্থক আর খেলোয়াড়দের দিকেও ছুটত তাঁর অগ্নিবাণ। এখন গলায় জোর নেই। কিন্তু আতাউর ওরফে আতা ভাই মোহামেডান নামটাকে বুকের খাঁচায় পুরে এখনো স্টেডিয়ামে আসেন। সাদা-কালোদের খেলা দেখার অভ্যাসটা ঢুকে গেছে রক্ত কণিকায়। অর্ধ শতাব্দী ধরে এটি তাঁর জীবনের অনুষঙ্গ। মোহামেডান জিতলে তিনি অদৃশ্য টিনের তলোয়ারধারী বাদশা, হারলে সর্বস্বান্ত।
মজিবর রহমান ওরফে পাগলা মজিবর মিটফোর্ড থেকে স্টেডিয়ামে আসার রাস্তাটি এখনো ভোলেননি। যেখানেই আবাহনীর খেলা, সেখানেই মজিবর। আকাশি-নীলের পথচলার শুরুর দিকের সেই কিশোর সমর্থক মেঘে মেঘে অনেক বেলা পার করে ৫০ পেরিয়ে গেছেন। তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দের সঙ্গে এখনো একাকার আবাহনী নামটি। তফাত শুধু হাফপ্যান্টের ওপর পরা লুঙ্গিটিকে পতাকার মতো করে ওড়াতে পারেন না। গর্বিত দুটো হাতে এখন লজ্জার ভার।
এতটা হয়তো নয়, তবে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবাহনী-মোহামেডান নাম দুটি এরকমই চুম্বক আকর্ষণ ছিল মানুষের কাছে। এই দুদলের ফুটবল থাকলে সারা দেশ হতো দ্বিখণ্ডিত। আড্ডার চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে যেত অবচেতনে। সংসারে ঢুকে পড়ত অশান্তি। ছাত্রদের লেখাপড়া উঠত শিকেয়। ভাইয়ে ভাইয়ে হতো মারামারি। আবাহনী-মোহামেডান খেলা মানে বন্ধুতে বন্ধুতে বিশ্বাসভঙ্গ। বিদ্বানে মূর্খে এককাট্টা। বিকেল চারটায় শুরু খেলা দেখতে বেলা ১১টা থেকে লম্বা লাইন। কালোবাজারির পকেট ভারী। ফেডারেশনের পাতি কর্তাদের ‘বাড়তি’ দু পয়সা রোজগার। মাঠে ৬০ হাজার দর্শক তো, বাইরেও ২০। একটা শব্দের সংক্রমণ থেকে সমুদ্রের গর্জন। ম্যাচ চালাতে আসার আগে রেফারির সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ। মাঠের শৃঙ্খলা সামলাতে ওষ্ঠাগত পুলিশের প্রাণ। ইটপাটকেলের ঝড়। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ। পল্টন-গুলিস্তানে স্বয়ংক্রিয় যানজট। একদিকে আনন্দ-বন্যা তো অন্যদিকে শোকের শ্মশান। ইংল্যান্ডে যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল, স্পেনে যেমন রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ইতালিতে এসি মিলান-ইন্টার মিলান, আর্জেন্টিনায় রিভারপ্লেট-বোকা জুনিয়র্স, নিদেনপক্ষে বাড়ির পাশে আরশিনগর কলকাতায় মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল প্রতিদ্বন্দ্বিতার উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ। এই দুদলের আবেগ ঢুকে গিয়েছিল দেশজ সংস্কৃতিতে।
সংস্কৃতির সেই ইটখানা এখন নোনাধরা। কোথায় হারাল সেই দিন? অপরিণামদর্শিতার চোরাবালিতে, পাতানো খেলার অন্ধকূপে। আজ আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল হলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মোহামেডান গ্যালারি নামে চিহ্নিত উত্তর-পূর্ব কোণে বসে হাজার দুয়েক দর্শক। পশ্চিম গ্যালারি অর্থাৎ আবাহনী গ্যালারিতে আর দুই হাজার। দুদলের প্র্যাকটিস দেখতে যে দর্শক হতো, শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচেও সব কুড়িয়ে তা হবে না। মাঠে উত্তেজনা নেই। খেলার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। খেলার আগে কথার লড়াই নেই। কোনো খেলোয়াড় নিয়ে টানাটানি নেই। দলবদল যেন গরিব ঘরের দুই বর-কনের অনাড়ম্বর বিবাহ বাসর। খেলা শেষে কোনো ভক্ত মৃদুস্বরে পত্রিকা অফিসে জানতে চাইলেন, ভাই, কে জিতল, আবাহনী না মোহামেডান? উত্তর শুনে মনে হতে পারে, তিনি হাত ধুয়ে ফেললেন।
শুধু আবাহনী-মোহামেডান খেলা কেন, বাংলাদেশের ফুটবল দেখতেই কেউ এখন স্টেডিয়ামে যাবে না। গাঁটের পয়সা খরচ করে পাতানো খেলা দেখতে কেন যেতে হবে? শাহেদের গলার স্বরে ‘তপ্ত সিসা’। তাঁর নেশা ছিল ফুটবল আর গান। মাঠে গিয়ে ফুটবল দেখাটা এখন ভুলে যাওয়া গন্ধের স্মৃতি, বুঁদ তিনি সংগীতে। তবে দেশের ফুটবলের কথা উঠলে তাঁর বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় হয়। আবাহনী-মোহামেডান নাম কোনো এক এল-ডোরাডো নগরে নিয়ে যায় তাঁকে।
অতলে হারিয়ে যেতে বসা ফুটবলকে আবার আলোর পথে ফেরাতে আবাহনী-মোহামেডান নামের উন্মাদনাকে ভীষণ দরকার। আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের যেমন এটি মনে হয়, তেমনি প্রত্যয় জাগে মোহামেডানের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ারও। বড় দুটি দলের দীর্ঘদিনের কান্ডারি হয়ে এই নাম-সম্পদটিকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি। এটি আজ বড় পীড়াদায়ক তাঁদের কাছে। নিজের দলের খেলা মাঠে গিয়ে দেখতেই খারাপ লাগে লোকমান ভূঁইয়ার। মন টানে না। কবির-মারী-আশরাফদের পর যে বিখ্যাত সাদা-কালো ছিল মঞ্জু-বাদল-সাব্বির-কায়সার হামিদদের গায়ে, সেই জার্সি কারা এখন পরছে ভেবে অবাক হন ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা ভদ্রলোক। কোথায় এঁদের সেই তারকাদ্যুতি, যা পতঙ্গের মতো টেনে আনবে দর্শককে? কোথায় সেই স্কিল! সালাউদ্দিন-অমলেশ-নান্নু-চুন্নু, আসলাম-মুন্নাদের উত্তরাধিকার বয়ে কারা আজ আবাহনীর জার্সি গায়ে দিচ্ছে, এটা ভাবতেও বিস্ময়বোধ করেন হারুনুর রশিদ।
এটা সত্য, নব্বইয়ের দশকে ড্রয়িং রুমে ইউরোপিয়ান ফুটবলের আগমনও আরেকটা সত্য। স্যাটেলাইট টিভিতে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-চেলসি, এসি মিলান-ইন্টার মিলানের খেলা দেখার পর ঢাকার মাঠে আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল দেখেও চোখ কচলাতে হয়। ফুটবলই তো? অমৃতের জায়গায় এ যে অখাদ্য। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের জনপ্রিয়তম ডিফেন্ডারদের একজন কায়সার হামিদের চোখে এটাই দর্শকপ্রিয়তার শিকড় কেটেছে সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে পড়বে, এটা তো ছিল সময়ের দাবি। কায়সার বলছেন, সেই সময়কে বুঝতে পারেনি জনপ্রিয়তম ক্লাব দুটো, সমর্থকদের অব্যাহত সমর্থনের স্রোতকে বহমান রাখতে পারেনি। শেখ মোহাম্মদ আসলাম আবাহনী-মোহামেডান নামের অমর্যাদা দেখে কষ্ট পান। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো খেলোয়াড় তুলে আনতে না পারা এবং সমর্থন ধরে রাখতে না পারার দায়টা তাঁর বিচারে ক্লাব কর্তৃপক্ষের। যাঁরা আজ পেশাদার যুগে ক্লাব পরিচালনার দায়িত্বে, সত্যিকারের যোগ্যতা তাঁদের আছে কি না, সেই প্রশ্নটা দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকার রেখেছেন জাতির কাছে।
আবাহনী-মোহামেডানের দুটি সমর্থক গোষ্ঠীই বা কী করছে? ১৯৭৯ সালে গঠিত আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত। ৬টি বিভাগীয় ও ৬৪টি জেলা কমিটি আছে তাদের। ঢাকায় আছে থানা ও ওয়ার্ড কমিটিও। প্রতিটি কমিটি ১০০ জন সমর্থককে মাঠে আসতে উদ্বুদ্ধ করলেও তো স্টেডিয়াম ভরে যায়। আবাহনী কেন্দ্রীয় সমর্থক গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক এনাম-ই-খোদা জুলু এই দুর্দিনে সমর্থকদের এমন উদ্বুদ্ধকরণের দিকেই জোর দিতে চান। তাঁর কথা, সারা দেশে আবাহনীর সমর্থন আছে, কিন্তু সমর্থকেরা ঢুকে গেছে চার দেয়ালের মধ্যে। আবার তাদের মাঠে টানতে তাই সারা দেশে প্রচারণা চালাবেন। প্রমাণ করে দেবেন ১৯৮৭ সালে লিমিটেড কোম্পানি হওয়া ক্লাবের চেয়েও সমর্থক গোষ্ঠী বেশি সংগঠিত। যে প্রমাণ তাঁরা আগেও দিয়েছেন ক্লাবের রজত জয়ন্তী পালন করে, প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ কামালের নামে নিয়মিতভাবে শেখ কামাল স্বর্ণপদক বিতরণ করে। একই রকম তাড়না বোধ করছেন মোহামেডান সমর্থক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এফ এম রফিকউদ্দিনও। তাঁরাও অচিরেই নামবেন সাংগঠনিক কাজে। এরই অংশ হিসেবে গত বছর লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত মোহামেডানের পরিচালনা পর্ষদের কাছে পেশ করেছেন পাঁচ দফা দাবি।
সবখানেই একই সুর। প্রধান দুই ক্লাবের হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তাকে ফেরাতে হবে। তাহলেই আবার যদি খেলার বাগিচায় ফোটে ফুল। ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ যদি এখনো ৯০ হাজার দর্শক টানে মাঠে, আবাহনী-মোহামেডান পারবে না কেন?
যাওয়ার চেয়ে ফিরে আসার পথটাই বেশি চেনা-জানা। এখনই হোক ফেরার মৌসুম।
মজিবর রহমান ওরফে পাগলা মজিবর মিটফোর্ড থেকে স্টেডিয়ামে আসার রাস্তাটি এখনো ভোলেননি। যেখানেই আবাহনীর খেলা, সেখানেই মজিবর। আকাশি-নীলের পথচলার শুরুর দিকের সেই কিশোর সমর্থক মেঘে মেঘে অনেক বেলা পার করে ৫০ পেরিয়ে গেছেন। তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দের সঙ্গে এখনো একাকার আবাহনী নামটি। তফাত শুধু হাফপ্যান্টের ওপর পরা লুঙ্গিটিকে পতাকার মতো করে ওড়াতে পারেন না। গর্বিত দুটো হাতে এখন লজ্জার ভার।
এতটা হয়তো নয়, তবে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবাহনী-মোহামেডান নাম দুটি এরকমই চুম্বক আকর্ষণ ছিল মানুষের কাছে। এই দুদলের ফুটবল থাকলে সারা দেশ হতো দ্বিখণ্ডিত। আড্ডার চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে যেত অবচেতনে। সংসারে ঢুকে পড়ত অশান্তি। ছাত্রদের লেখাপড়া উঠত শিকেয়। ভাইয়ে ভাইয়ে হতো মারামারি। আবাহনী-মোহামেডান খেলা মানে বন্ধুতে বন্ধুতে বিশ্বাসভঙ্গ। বিদ্বানে মূর্খে এককাট্টা। বিকেল চারটায় শুরু খেলা দেখতে বেলা ১১টা থেকে লম্বা লাইন। কালোবাজারির পকেট ভারী। ফেডারেশনের পাতি কর্তাদের ‘বাড়তি’ দু পয়সা রোজগার। মাঠে ৬০ হাজার দর্শক তো, বাইরেও ২০। একটা শব্দের সংক্রমণ থেকে সমুদ্রের গর্জন। ম্যাচ চালাতে আসার আগে রেফারির সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ। মাঠের শৃঙ্খলা সামলাতে ওষ্ঠাগত পুলিশের প্রাণ। ইটপাটকেলের ঝড়। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ। পল্টন-গুলিস্তানে স্বয়ংক্রিয় যানজট। একদিকে আনন্দ-বন্যা তো অন্যদিকে শোকের শ্মশান। ইংল্যান্ডে যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল, স্পেনে যেমন রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ইতালিতে এসি মিলান-ইন্টার মিলান, আর্জেন্টিনায় রিভারপ্লেট-বোকা জুনিয়র্স, নিদেনপক্ষে বাড়ির পাশে আরশিনগর কলকাতায় মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল প্রতিদ্বন্দ্বিতার উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ। এই দুদলের আবেগ ঢুকে গিয়েছিল দেশজ সংস্কৃতিতে।
সংস্কৃতির সেই ইটখানা এখন নোনাধরা। কোথায় হারাল সেই দিন? অপরিণামদর্শিতার চোরাবালিতে, পাতানো খেলার অন্ধকূপে। আজ আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল হলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মোহামেডান গ্যালারি নামে চিহ্নিত উত্তর-পূর্ব কোণে বসে হাজার দুয়েক দর্শক। পশ্চিম গ্যালারি অর্থাৎ আবাহনী গ্যালারিতে আর দুই হাজার। দুদলের প্র্যাকটিস দেখতে যে দর্শক হতো, শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচেও সব কুড়িয়ে তা হবে না। মাঠে উত্তেজনা নেই। খেলার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। খেলার আগে কথার লড়াই নেই। কোনো খেলোয়াড় নিয়ে টানাটানি নেই। দলবদল যেন গরিব ঘরের দুই বর-কনের অনাড়ম্বর বিবাহ বাসর। খেলা শেষে কোনো ভক্ত মৃদুস্বরে পত্রিকা অফিসে জানতে চাইলেন, ভাই, কে জিতল, আবাহনী না মোহামেডান? উত্তর শুনে মনে হতে পারে, তিনি হাত ধুয়ে ফেললেন।
শুধু আবাহনী-মোহামেডান খেলা কেন, বাংলাদেশের ফুটবল দেখতেই কেউ এখন স্টেডিয়ামে যাবে না। গাঁটের পয়সা খরচ করে পাতানো খেলা দেখতে কেন যেতে হবে? শাহেদের গলার স্বরে ‘তপ্ত সিসা’। তাঁর নেশা ছিল ফুটবল আর গান। মাঠে গিয়ে ফুটবল দেখাটা এখন ভুলে যাওয়া গন্ধের স্মৃতি, বুঁদ তিনি সংগীতে। তবে দেশের ফুটবলের কথা উঠলে তাঁর বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় হয়। আবাহনী-মোহামেডান নাম কোনো এক এল-ডোরাডো নগরে নিয়ে যায় তাঁকে।
অতলে হারিয়ে যেতে বসা ফুটবলকে আবার আলোর পথে ফেরাতে আবাহনী-মোহামেডান নামের উন্মাদনাকে ভীষণ দরকার। আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের যেমন এটি মনে হয়, তেমনি প্রত্যয় জাগে মোহামেডানের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ারও। বড় দুটি দলের দীর্ঘদিনের কান্ডারি হয়ে এই নাম-সম্পদটিকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি। এটি আজ বড় পীড়াদায়ক তাঁদের কাছে। নিজের দলের খেলা মাঠে গিয়ে দেখতেই খারাপ লাগে লোকমান ভূঁইয়ার। মন টানে না। কবির-মারী-আশরাফদের পর যে বিখ্যাত সাদা-কালো ছিল মঞ্জু-বাদল-সাব্বির-কায়সার হামিদদের গায়ে, সেই জার্সি কারা এখন পরছে ভেবে অবাক হন ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা ভদ্রলোক। কোথায় এঁদের সেই তারকাদ্যুতি, যা পতঙ্গের মতো টেনে আনবে দর্শককে? কোথায় সেই স্কিল! সালাউদ্দিন-অমলেশ-নান্নু-চুন্নু, আসলাম-মুন্নাদের উত্তরাধিকার বয়ে কারা আজ আবাহনীর জার্সি গায়ে দিচ্ছে, এটা ভাবতেও বিস্ময়বোধ করেন হারুনুর রশিদ।
এটা সত্য, নব্বইয়ের দশকে ড্রয়িং রুমে ইউরোপিয়ান ফুটবলের আগমনও আরেকটা সত্য। স্যাটেলাইট টিভিতে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-চেলসি, এসি মিলান-ইন্টার মিলানের খেলা দেখার পর ঢাকার মাঠে আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল দেখেও চোখ কচলাতে হয়। ফুটবলই তো? অমৃতের জায়গায় এ যে অখাদ্য। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের জনপ্রিয়তম ডিফেন্ডারদের একজন কায়সার হামিদের চোখে এটাই দর্শকপ্রিয়তার শিকড় কেটেছে সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে পড়বে, এটা তো ছিল সময়ের দাবি। কায়সার বলছেন, সেই সময়কে বুঝতে পারেনি জনপ্রিয়তম ক্লাব দুটো, সমর্থকদের অব্যাহত সমর্থনের স্রোতকে বহমান রাখতে পারেনি। শেখ মোহাম্মদ আসলাম আবাহনী-মোহামেডান নামের অমর্যাদা দেখে কষ্ট পান। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো খেলোয়াড় তুলে আনতে না পারা এবং সমর্থন ধরে রাখতে না পারার দায়টা তাঁর বিচারে ক্লাব কর্তৃপক্ষের। যাঁরা আজ পেশাদার যুগে ক্লাব পরিচালনার দায়িত্বে, সত্যিকারের যোগ্যতা তাঁদের আছে কি না, সেই প্রশ্নটা দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকার রেখেছেন জাতির কাছে।
আবাহনী-মোহামেডানের দুটি সমর্থক গোষ্ঠীই বা কী করছে? ১৯৭৯ সালে গঠিত আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত। ৬টি বিভাগীয় ও ৬৪টি জেলা কমিটি আছে তাদের। ঢাকায় আছে থানা ও ওয়ার্ড কমিটিও। প্রতিটি কমিটি ১০০ জন সমর্থককে মাঠে আসতে উদ্বুদ্ধ করলেও তো স্টেডিয়াম ভরে যায়। আবাহনী কেন্দ্রীয় সমর্থক গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক এনাম-ই-খোদা জুলু এই দুর্দিনে সমর্থকদের এমন উদ্বুদ্ধকরণের দিকেই জোর দিতে চান। তাঁর কথা, সারা দেশে আবাহনীর সমর্থন আছে, কিন্তু সমর্থকেরা ঢুকে গেছে চার দেয়ালের মধ্যে। আবার তাদের মাঠে টানতে তাই সারা দেশে প্রচারণা চালাবেন। প্রমাণ করে দেবেন ১৯৮৭ সালে লিমিটেড কোম্পানি হওয়া ক্লাবের চেয়েও সমর্থক গোষ্ঠী বেশি সংগঠিত। যে প্রমাণ তাঁরা আগেও দিয়েছেন ক্লাবের রজত জয়ন্তী পালন করে, প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ কামালের নামে নিয়মিতভাবে শেখ কামাল স্বর্ণপদক বিতরণ করে। একই রকম তাড়না বোধ করছেন মোহামেডান সমর্থক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এফ এম রফিকউদ্দিনও। তাঁরাও অচিরেই নামবেন সাংগঠনিক কাজে। এরই অংশ হিসেবে গত বছর লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত মোহামেডানের পরিচালনা পর্ষদের কাছে পেশ করেছেন পাঁচ দফা দাবি।
সবখানেই একই সুর। প্রধান দুই ক্লাবের হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তাকে ফেরাতে হবে। তাহলেই আবার যদি খেলার বাগিচায় ফোটে ফুল। ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ যদি এখনো ৯০ হাজার দর্শক টানে মাঠে, আবাহনী-মোহামেডান পারবে না কেন?
যাওয়ার চেয়ে ফিরে আসার পথটাই বেশি চেনা-জানা। এখনই হোক ফেরার মৌসুম।
No comments