কাবিখা কাবিটা টিআর প্রকল্প-সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসনই যেন উদ্দেশ্য

অনেক প্রকল্প আছে কেবল কাগজ-কলমে। অনেকগুলোর কাজ হয়েছে যৎসামান্য। আবার অনেক জায়গায় স্থানীয় সাংসদের অনুসারীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ করিয়ে নিয়ে তা তুলে হজমও করেছেন। উন্নয়নের নামে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসনই যেন প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য।


এই হচ্ছে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের বেশির ভাগ চিত্র। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের অনুসন্ধানে টিআর-কাবিখার এই চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে। অথচ গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য এসব প্রকল্প বা কর্মসূচি নেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে গ্রামের অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এ জন্য খরচও হয় কোটি কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিজে কাজ করছেন। প্রথম আলোকে তিনি গতকাল শুক্রবার বলেন, বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার অনেক বড়, ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাঠপর্যায়ে গবেষণা থেকেও দেখা গেছে, যেখানে তদারক-ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানেই দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অস্তিত্বহীন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ তুলে নেওয়া হয়। আবার যেখানে কার্ড-ব্যবস্থা আছে, সে ক্ষেত্রে কার্ড পেতে রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীদের বাড়তি অর্থও দিতে হয়।
হোসেন জিল্লুর আরও বলেন, আবার এখানে অপচয়ও হচ্ছে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক কারণে অপচয় ও দুর্নীতির সুযোগ বেশি তৈরি হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, দারিদ্র্য বিমোচনে এই কর্মসূচির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ফলে অনেক মানুষ উপকৃতও হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের ভানুডাঙ্গা গুচ্ছগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪২ হাজার টাকা। প্রকল্প কমিটির সভাপতি, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নুরনবী। বিদ্যালয়ের কোনো কাজ করা হয়নি উল্লেখ করে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আয়েজ উদ্দীন জানান, অন্য প্রকল্পের শ্রমিকেরা মাটি ফেলেছে। সেটাকেই দেখিয়ে কাবিখার বরাদ্দ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে নুরনবী মুঠোফোনে বলেন, ‘এসব কাজ কেমন হয় আপনাদের জানা আছে।’
সোনামুখী ইউনিয়নের সোনামুখী শ্মশানঘাট সংস্কারের জন্য তিন টন গম দেওয়া হলেও কোনো কাজ করা হয়নি। প্রকল্প সভাপতি, ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি উজ্জ্বল ভৌমিক বলেন, ‘প্রকল্পের মধ্যে ১০ হাজার টাকা উপজেলা পরিষদে দিতে হয়েছে। মাত্র ১০ হা্জার টাকা আমি পেয়েছিলাম। এ টাকা আমার কাছে রয়েছে। বুঝতেই তো পারছেন, এগুলো সব দলীয়ভাবে বণ্টন করা হয়েছে।’
টিআর কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হলেও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখনো বরাদ্দের টাকাই পায়নি। যশোর-৪ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ রণজিৎ কুমার রায়ের অনুসারীরা ভুয়া নাম ব্যবহার করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইউনিয়নের ক্ষেত্রপালা মহিলা মাদ্রাসার শ্রেণীকক্ষ নির্মাণের জন্য ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাদেক আলী বলেন, ‘বরাদ্দের ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নেতা বাবলু সাহার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর বাবলু সাহার পেছনে কয়েক দিন ঘুরে ব্যর্থ হয়েছি। পরে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের নেতা ঈমান আলী বিশ্বাসকে বিষয়টি জানাই।’ ঈমান আলী বিশ্বাস এ বিষয়ে বলেন, ‘এমপি সাহেবকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি আশ্বাসও দেন। কিন্তু আজও টাকা পাওয়া যায়নি।’
ক্ষেত্রপালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাটের জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সমর সেন বিষয়টি জানেন না। তিনি পরিচালনা কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের নেতা এস এম আজমের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন। এস এম আজম বলেন, ‘বরাদ্দের টাকা তুলতে গিয়ে দেখি আমার স্বাক্ষর জাল করে কে যেন আগেই টাকা তুলে নিয়েছে। বিষয়টি পিআইওকে জানিয়ে কোনো ফল হয়নি।’
বগুড়ার ধুনট উপজেলার মাঠপাড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নামে টিআর প্রকল্পের পাঁচ টন গম বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এই গম বিক্রির টাকা তুলে নেন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম জানান, গম বিক্রির টাকা থেকে তিনি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু সভাপতি কোনো টাকা দেয়নি।
একই উপজেলার মাদারভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে টিআরের পাঁচ টন গম তুলে নিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের একটি স্টিলের আলমারি ও বিদ্যালয়ে সামান্য চুনকামের কাজ করেছেন উপজেলা যুবলীগের সদস্য সাইদুল ইসলাম। তবে বানিয়াগাতি গ্রামে ইসকেন্দার আলী (ই-আলী) জামে মসজিদের নামে টিআরের পাঁচ টন গম তুলে নিয়ে কোনো কাজই করেননি উপজেলা যুবলীগের সদস্য আরিফুল রহমান।
ধুনটের চালার ভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়ে একটি বই রাখার তাক কিনে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের সভাপতি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মনোয়ার হোসেন। একই গ্রামের স্বতন্ত্র দাখিল মাদ্রাসার নামে ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ছানোয়ার হোসেন। বোমগাড়া হাটের উন্নয়নের নামে কাবিখার পাঁচ টন গম ও কাবিটার ৫০ হাজার টাকা তুলে নিলেও কোনো কাজ করেননি নিমগাছি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তারা মিয়া।
উপজেলা পিআইও আবদুল্লাহেল কাফি জানান, এসব প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনেককে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চিঠিও পাঠানো হয়েছে।
নাটোরের গুরুদাসপুরের নাজিরপুর ইউনিয়নের চন্দ্রপুর তুলাধনা ঈদগাহ মাঠ সংস্কারের নামে আড়াই টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প সভাপতি ও স্থানীয় আ.লীগের নেতা মো. আবু জাফর কোনো কাজ না করে তা আত্মসাৎ করেন। আবু জাফর বলেন, ‘৩২ হাজার টাকায় ডিও বিক্রি করেছি। এর মধ্যে অফিস খরচ ১৩ হাজার টাকা দেওয়ার পর ১৯ হাজার টাকা জমা রেখেছি।’
মশিন্দা ইউনিয়নের রানীগ্রাম আহলে হাদিস মসজিদ থেকে কাফির বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে কাবিখার ১১ টন খাদ্যশস্য উত্তোলন হলেও অর্ধেক কাজও হয়নি। প্রকল্প কমিটির সভাপতি ইউপি সদস্য রবিউল করিম বলেন, তিনি কিছু জানেন না, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সবকিছু করেছেন। মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, প্রকল্পের বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্ধেক কাজ করা হয়েছে।
চাপিলা ইউনিয়নের আলীপুর দাখিল মাদ্রাসার দেয়াল নির্মাণের জন্য দুই দফায় এক লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করার হলেও কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্প কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের নেতা আ. করিম মিয়া দাবি করেন, খরচ বাদ দিয়ে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়ে কাজ করা হয়েছে।
উপজেলা পিআইও শহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো প্রকল্পই ভুয়া ছিল না। যাচাই-বাছাই করেই অনুদানের টাকা দেওয়া হয়েছে। কমিশন নিয়ে বিল ছাড় করার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী প্রকল্পগুলোতে হরিলুট হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার মাগুরমারী উচ্চবিদ্যালয়ের নামে এক লাখ ১০ হাজার টাকার প্রকল্প দেখানো হয়েছে। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন জানান, তাঁর স্কুলে একটিমাত্র কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সহসপুর দাখিল মাদ্রাসা, চকরামপুর উচ্চবিদ্যালয়, মাদার দরগা সেন্টু শাহ উচ্চবিদ্যালয়, কুমড়িয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু হাতেমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রিন্টারসহ একটি করে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের পাঠক শিকড় ইহছান দরবার শরিফের ঘর নির্মাণকাজে টিআরের এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনো কাজ করা হয়নি বলে জানান দরবার শরিফের সভাপতি জামিল বিন আবদুর রহমান। প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম খান। তাঁর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম খানের দাবি, শতভাগ কাজ করা হয়েছে।
একই ইউনিয়নের পাঠক শিকড় সর্বজনীন দুর্গামন্দির সংস্কারে দুই টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। মন্দির কমিটির সভাপতি নিরোদ চন্দ্র পাল অভিযোগ করেন, ‘আমার মন্দিরে এক টাকারও কাজ করা হয়নি।’ প্রকল্পের সভাপতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কল্যাণ চন্দ্র বর্মণ কাজ না করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘টাকা জমা রয়েছে, এখন কাজ করা হবে।’

No comments

Powered by Blogger.