বেশিরভাগ এসিড সন্ত্রাসের বিচার হয় নাঃ আইন আছে প্রয়োগ নেই!

মৃত্যুদণ্ডের বিধানসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়ায় এসিড-সন্ত্রাসের ভয়াবহতা কমলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তদের ছোড়া এসিডে ঝলসে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের শরীর। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে শুরু করে অবুঝ শিশু, বিশেষত কিশোরী-তরুণীরা এসিড সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
এসিড সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছে তাদের অভিযোগ, আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না বলেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইনের ফাঁক-ফোকর থাকায় যথাযথ বিচার হচ্ছে না বা বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সরকার এসব বিষয়ের দিকে নজর না দিলে এই নৃশংসতম প্রতিশোধের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, দেশে এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে প্রায় দু’শটি। এসিড সারভাইভর্স ফাউন্ডেশন (এএসএফ) কর্তৃপক্ষের মতে, ১৯৯৯ সালের মে মাস থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় দুই হাজার ১৭৩টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক ঘটনায় ১৮০ জনেরও বেশি লোক এসিড দগ্ধ হয়েছে। এ পর্যন্ত যারা এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছে বা হচ্ছে তাদের প্রায় ৯৫ ভাগই নারী এবং শিশু। এসিডে ঝলসে যাওয়া নারীদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অন্যদিকে এসিড সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের ৯৯ ভাগই মধ্যবয়সী পুরুষ অথবা তরুণ। এএসএফের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসিড আক্রমণের শিকার হয়েছে ২২ জন। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কম হলেও যে কোনো বিবেচনায় ভয়াবহ। শুধু সংখ্যার বিচারে এসিড সহিংসতার পরিমাপ করা যায় না। মনুষ্যত্বের প্রতি এই ঘোরতর নৃশংসতা মানুষের প্রতিশোধস্পৃহার চূড়ান্ত পতনকেই প্রমাণ করে। এই পতন রোধ করতে কঠোর আইনের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, এসিড নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০০২ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে এসিড নিক্ষেপকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, দেশে এত এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত প্রণীত আইন অনুসারে অপরাধীরা সাজা ভোগ করছে না, স্থাপিত হচ্ছে না কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত। এএসএফ-এর দেয়া সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত তিন বছরে মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। দেখা গেছে, দায়সারাগোছের তদন্তের কারণে মামলা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা করা হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিরা ছাড়া পেয়ে গেছে। এমনকি বাদীকেই আসামিপক্ষ হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এসিডদগ্ধ মানুষটিই তো ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী। সারা জীবন তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে এই নৃশংসতার চিহ্ন বহন করতে হবে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে আইনের হাত এতটা খাটো হয়ে যায় কেন? এই জিজ্ঞাসার জবাব না খুঁজে শুধু কেতাবি আইন কতটা কার্যকর হবে তা ভাবনার বিষয়ই বটে। কারণ, এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, স্রেফ প্রমাণ না পাওয়ার অজুহাতে মামলা পড়ে থাকে, অনেক সময় মামলা ঝুলে যায় চিকিত্সা সনদের অভাবে। ক্ষেত্রবিশেষে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সাক্ষী বা বাদী আদালতে হাজির হন না। এ অবস্থায় অসম শর্তের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি হয়। ফলে মানবতা ধূলিলুণ্ঠিত হয়। বিচারের বাণী সত্যিকার অর্থেই নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
না, এভাবে একটি সভ্য সমাজে আইনের ফাঁক-ফোকর এতটা উন্মুক্ত থাকতে পারে না। এসিড-সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধীকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শনাক্তকরণের দায়িত্ব নিতে হবে। দণ্ড দিয়ে প্রমাণ করতে হবে—এই সেই দুর্বৃত্ত। এজন্য ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মামলা নেয়া, এসিডদগ্ধ ব্যক্তি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ দ্রুত অভিযুক্তকে আটক করতে পুলিশ প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। একই সঙ্গে এসিডের সহজলভ্যতা কমানোর উপায় বের করে এর বিক্রয়-বিধি নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে যারা এসিডদগ্ধ হয়ে বিপর্যস্ত জীবনের ভার বহন করছে তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও সরকারসহ এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে। মোদ্দাকথা শুধু কাগুজে আইন নয়, জরুরি হচ্ছে তা কার্যকর করা। এ ব্যাপারে সরকারকে দায় নিতে হবে। এসিডদগ্ধ মানুষ বাড়বে অথচ কঠোর দণ্ডের বিধান অকেজো হয়ে থাকবে—তা হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.