চারদিক-বর্ণিল দেয়ালপত্রিকার আয়োজন

হাড়কাঁপানো শীত জানান দিচ্ছে, সময়টা পৌষের শেষাশেষি। সারা দিন একবারের জন্যও সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। তবে এত শীতের মধ্যেও উৎসাহের কোনো কমতি নেই নওগাঁর পিএম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিয়া জান্নাতের। সে নওগাঁ থেকে ঢাকায় এসেছে দেয়ালপত্রিকা উৎসবে যোগ দিতে।


‘দারুণ লাগছে দেয়ালপত্রিকা উৎসবে অংশ নিতে পেরে। আরও বেশি ভালো লাগছে আমাদের এবারের দেয়ালপত্রিকার উপস্থাপন ঢং পুরো বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপরে করায়।’ বলল রাফিয়া জান্নাত। আঁকাবাঁকা মানচিত্রের মাঝে বিভিন্ন অংশে দেয়ালপত্রিকা সাঁটানো হয়েছে। আর এর ওপরে বড় হরফে লেখা ‘চেতনায় ৭১’।
এবার পঞ্চমবারের মতো বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে উদ্যাপিত হচ্ছে দেয়ালপত্রিকা উৎসব। সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই আয়োজন। শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি, চলবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ শেষ হচ্ছে আজ।
পাশেই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডির দিবা শাখার দেয়ালপত্রিকার বোর্ডটি বেশ আকর্ষণীয়। ‘শোলা দিয়ে বড় বোর্ড করে তার ওপর রঙিন কাগজ দিয়ে লাগানো হয়েছে দেয়ালপত্রিকা। এবারের থিম হলো “মাত্রা”। নানা বিষয়ের সংযোজন আছে এবারের মোট ৪০টি লেখার মধ্যে।’ বলছিল দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মির্জা ইফাত নূর। শীতের এই তীব্রতার মধ্যেই নজরে পড়ল ‘হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘকাল তোমার প্রতীক্ষায় আমরা।’ এই আহ্বানের মাঝে যেন উষ্ণতার আবির্ভাব হয়—এমনই প্রত্যাশা তাদের। ভিকারুননিসা নূনের এই শাখার শিক্ষার্থীরা লিখেছে ভ্রমণকাহিনি। নেপালের প্রকৃতির দারুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে তাদের নরম হাতের লেখনীতে। সমসাময়িক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ আছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকার অংশে।
মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের এবারের আয়োজনে পুরোটা লাল আর সবুজ পতাকার আদলে করা। বড় হরফে লেখা ‘খোলা জানালা’। আদেল হাসান বলল, ‘আমরা চাই ইতিহাস জানাতে। খোলা জানালা থিমের মাধ্যমে আসল ইতিহাস বেরিয়ে আসবে।’ ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানের অনুকরণে নাকি এমন নাম।
পাবনার জান্নাথ বিবি জুবিলী গার্লস হাইস্কুলের দেয়ালপত্রিকার থিমের নাম ‘মনন’। উত্তরটা পাওয়া যায় এই স্কুলের শিক্ষার্থী আবিদা আসলামের কাছ থেকে, ‘দেয়ালপত্রিকার উদ্দেশ্যই হলো লেখনীর মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো। আর সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে তার মনন আসলে কী ধারণ করছে, তার ওপর।’ আসছে ফেব্রুয়ারি মাস, তাই অমর একুশকে মাথায় রেখে শহীদ মিনারের আদলে দেয়ালপত্রিকার ফ্রেমের নকশা করেছে সিরাজগঞ্জের রানীগ্রাম আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়।
সেন্ট গ্রেগরিয়ান স্কুলের এবারের আয়োজন কেবল বাংলাদেশের সুন্দরবনকে বাঁচানোর দিক নিয়ে। সুন্দরবনের বিরল প্রজাতির গাছ, পাখির নাম এবং প্রকৃতিকে নিয়ে রয়েছে নানা লেখা। এটা মূলত জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াস থেকে করা—এমনটা জানা যায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সুন্দরবনকে কেমন দেখতে চায়, তেমন লেখাও আছে এই পত্রিকায়। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের দেয়ালপত্রিকার থিমের নাম ‘নিরত্যয়’। ছড়া, ছোটগল্প, উপজাতিদের সংস্কৃতি, নববর্ষ, বাংলার ইতিহাস, এমনকি ফেসবুক নিয়েও আছে নানা লেখা। স্কুলশিক্ষার্থী ও দেয়ালপত্রিকার সম্পাদক শাহরিয়ার জাহান বলল, ‘লেখার বিষয়ে যেমন আছে ভিন্নতা, তেমনি আমরা চেয়েছি আমাদের সৃজনশীলতার প্রকাশে এই লেখাগুলো থাকবে অক্ষয় হয়ে।’
এই সমাজ একটা বৃত্তে আটকে গেছে নানা সংস্কারে। এই বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে—এমনটা মনে করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর তাই তাদের দেয়ালপত্রিকার নাম দিয়েছে ‘বৃত্তাবদ্ধ’।
কুষ্টিয়ার মহিনী মোহন বিদ্যালয়ের লেখার মাঝে আছে লালনের প্রতিকৃতি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ধানমন্ডির প্রভাতি শাখার দেয়ালপত্রিকা উপস্থাপন একেবারেই নান্দনিক। পোড়ামাটির ফলকের কাজ করা চারপাশে। আর এর মাঝেই শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতার প্রকাশ করছে তাদের লেখনীর মাধ্যমে।
বাংলাদেশ দেয়ালপত্রিকা পরিষদের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছিলেন, ‘এবার পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশে দেয়ালপত্রিকা উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে। প্রথমবার উৎসবটি হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এর পর থেকে একটা পরিষদের মাধ্যমে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। কেবল ঢাকাই নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এবার শতাধিক স্কুল ও কলেজ এই আয়োজনে অংশ নিয়েছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম এই সৃজনশীল উদ্যোগটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যমের সক্রিয় অবস্থান এবং পরিবারের ভূমিকা শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করবে।’
এবারের এই উৎসবে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে শতাধিক স্কুল-কলেজ অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা বয়সে অনুজ হলেও নানা বয়সীদের সমাগমে মুখরিত হচ্ছে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ। তবে এবারের দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ আয়োজন হলো, বসার জন্য শণ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি টংঘর বানানো হয়েছে। এ ছাড়া আছে শিকায় ঝুলিয়ে রাখা মুড়ি-মুড়কির ব্যবস্থা।
সারা দিন কষ্ট করেও শিক্ষার্থীদের আনন্দের কমতি নেই। শিশুমনের সৃজনশীলতার যে প্রকাশ ঘটছে এই লেখা আর আঁকা ছবিতে। চাইলে শত ব্যস্ততার মাঝে আপনিও একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.